ফ্যাশন-আধুনিকতার নামে পুরুষ যখন বেপরোয়া

ফ্যাশন-আধুনিকতার নামে পুরুষ যখন বেপরোয়া

মাওলানা মুহাম্মদ ওসমান গনি>

ইসলামে নামাজ, রোজার মতো পর্দার বিধানও ফরজ। ফরজ বিধানগুলো নারী-পুরুষ সবার জন্য সমান। ক্ষেত্র বিশেষে কিছু পার্থক্য রয়েছে। অন্য অনেক বিধান মানার প্রতি গুরুত্ব থাকলেও পর্দার প্রতি অবহেলা থাকে অনেকেরই। নারীদের এ বিধান পালনে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হলেও পুরুষদের জন্যও পর্দা পালন ও এর বিধান মানার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা অনেকটাই ঢাকা পড়ে যায় অন্যান্য আলোচনার ভিড়ে।
পুরুষেরও পর্দার বিধান রয়েছে শুনলে অনেকে হয়ত কিছুটা অবাকও হতে পারে। কারণ তাদের ধারণা পর্দা শুধু নারীর জন্য। অথচ পবিত্র কোরআনে পর্দার বিধান সম্পর্কিত আয়াতটিতে প্রথমে পুরুষের আলোচনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘আপনি মুমিন পুরুষদের নির্দেশ দিন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এটা তাদের জন্য উত্তম পবিত্রতা। নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট তাঁদের কার্যাদির খবর রয়েছে।

পর্দার বিধান নারী-পুরুষ সবার জন্য সমান হলেও দুজনের পর্দার ব্যবহারিক পার্থক্য রয়েছে। নারী বাইরে বের হলে বোরকা-চাদর ইত্যাদির মাধ্যমে তাঁর শরীর ঢেকে পর্দা করবে। আর পুরুষ কাপড়ের মাধ্যমে নিজের সতর তথা নাভীর নিচ থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত আবরণ/ পর্দা করা ফরজ। আর যদি নিজে ফ্যাশন-আধুনিকতা মনে করে হাফ প্যান্ট পরিধান করে বাহিরে ঘোরাফেরা করে সে নিজেও গুনাহগার হবে এবং তাকে যারা দেখবে তারাও গুনাহগার হবে। যেহেতু হাটুর নিচ পর্যন্ত ঢেকে রাখা সকল পুরুষের জন্য ফরজ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে যারা ফ্যাশন বা আধুনিকতার পরশে নিজেকে ও অন্যজনকে প্রতি মুহূর্তে গুনাহের ভাগিদার করছে তা সম্পূর্ণ শরিয়তের আদেশ অমান্য করার কারণে। যা গুনাহে কবীরা হিসাবে সাব্যস্ত।

সদরুশ শরিয়াহ, হযরতুল আল্লামা মুফতী আমজাদ আলী আযমী রহ. বলেন, ‘‘পুরুষের জন্য নাভীর নিচ থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ‘সতরে আওরাত’ অর্থাৎ ততটুকু অংশ ঢেকে রাখা ফরয। নাভী সতরের অন্তর্ভূক্ত নয়, কিন্তু হাঁটু সতরের অন্তর্ভূক্ত। বর্তমান যুগে অধিকাংশ পুরুষ আছে যারা, লুঙ্গি,প্যান্ট অথবা পায়জামা এমনভাবে পরিধান করে যে, নাভীর নিচের কিছু অংশ খোলা থাকে। যদি জামা, শার্ট বা পাঞ্জাবী ইত্যাদি দ্বারা (সেই অংশটি) এভাবে ঢেকে নেয়, যার ফলে শরীরের চামড়ার রং প্রকাশিত হয় না, তবে তা ঠিক আছে। আর যদি প্যান্ট বা পায়জামা নাভীর নিচে এমনভাবে পরিধান করে যার ফলে শরীরের ওই অংশ অন্য কেউ দেখতে পায় তাতে ফরজ তরক হবে এবং এটা হারাম। আর নামাযের মধ্যে এক চতুর্থাংশ পরিমান খোলা থাকলে নামাযই হবে না এবং অনেক অসভ্য এমনও আছে, যে মানুষের সামনে হাঁটু বরং রান পর্যন্তও খোলা রাখে এটাও হারাম । আর যদি তা অভ্যাসে পরিণত হয়, তবে তা ফাসেকী (প্রকাশ্যে গুনাহ করা) বলে গন্য হবে।

এই মাসয়ালাটি আমাদের জানা অতিব জরুরি। তা-না হলে নিজের অজান্তেই অনেকে বেপরোয়াভাবে শরিয়তের ফরয বিধান প্রতিনিয়ত তরক করছে। অনেকেরই এই বদ-অভ্যাস যে, মানুষের সামনে লুঙ্গি বা প্যান্ট হাঁটুর উপরে পরে। অনেকে মাথায় টুপি দিয়ে, লুঙ্গি রাখে হাঁটুর উপর। সুন্নত আদায় করছে, আর অপর দিকে ফরয তরক করছে। আমাদের যুবকেরা অনেকেই তো হাফ প্যান্ট পরিধানকে ফ্যাশন বা আধুনিকতা বলে ধারণা করে এবং নিজেকে স্মার্ট যুবক হিসেবে অন্তরে লালন করে। অথচ একদিকে সে নিজেও গুনাহগার হচ্ছে, পক্ষান্তরে যে তাকে দেখছে এমন ব্যাক্তিকেও গুনাহগার করছে। তাই মাসয়ালাটি হৃদয়ে গেঁথে নেওয়া প্রয়োজন। যারা জানে না তাদেরকে জানানো আবশ্যক। ঘরে হোক কিংবা বাহিরে পর্দার ব্যাপারে বেপরোয়া না হয়ে আমাদের সতর্ক থাকা উচিত। কারণ মানুষের একটা ভুল ধারণা পর্দা শুধু নারীর জন্য; বরং পর্দা করা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য ফরজ।
এক্ষেত্রে খুব টাইট ফিটিং পায়জামা বা টি-শার্ট যেগুলোকে আমরা ফ্যাশন-আধুনিকতা বা স্মার্টনেস বলে মনে করছি, তাও পর্দার আদবের পরিপন্থী। শরীরের আকৃতি মানুষের কাছে এভাবে প্রকাশ পাওয়া দৃষ্টি-কটুও বটে।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষদের উদ্দেশে বলেন, ‘পথের হকগুলোর একটি হলো, দৃষ্টিকে সংযত রাখা।’
সৃষ্টিগত কারণে পোশাকের পর্দার ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি ইসলাম কঠোর নির্দেশ দিয়েছে বটে; কিন্তু দৃষ্টিগত ও হৃদয়গত পর্দায় পুরুষদেরকে কঠোরভাবে সতর্ক করা হয়েছে।

পর্দার বিধান পালনের ক্ষেত্রে পুরুষের কিছু বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখা উচিতঃ
* পুরুষের নাভীর উপর থেকে হাঁটুর নিচে এবং টাকনুর উপর পর্যন্ত ঢাকতে হবে। পুরুষের হাঁটুর উপরে এবং টাখনুর নিচে কাপড় পরা কবিরা গুনাহ ।
* এমন পোশাক পরিধান করবে, যা বিপরীত লিঙ্গের জন্য যৌন আবেদনময় হবে না এবং বিকৃত চিন্তার জন্ম দেবে না।
* পোশাক এমন পাতলা হওয়া চলবে না, যাতে কাপড় পরা সত্বেও উপর দিয়ে ভেতরের চামড়া নজরে আসে। কারণ এমন কাপড় পরিধান করা না করা সমান কথা।
* পোশাক হতে হবে ঢিলেঢালা এবং মার্জিত। এমন আঁট-সাঁট (টাইটফিট) হওয়া যাবে না, যাতে দেহের উঁচু-নিচু গঠন বোঝা যায় ।
* পোশাকটি যেন কোনো বে-দ¦ীন, অবিশ্বাসী/কাফেরদের অনুকরণে না হয়। প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি যে জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন (পোশাকে, চাল-চলনে অনুকরণ) করবে, সে তাদেরই দলভুক্ত হবে।’’
যেমন হাফ প্যান্ট পরিধান করা বে-দ¦ীন, অবিশ্বাসী/কাফেরদের স্বভাব। যা ইসলামি শরিয়তে হারাম, কবিরা গুনাহ ও গর্হিত কাজ।
* পোশাকটি যেন বিপরীত লিঙ্গের পোশাকের অনুরূপ না হয়। এ সম্পর্কে রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ওই সমস্ত নারীদেরকে অভিশাপ দিয়েছেন, যারা পুরুষদের বেশ ধারণ করে এবং ওই সমস্ত পুরুষদেরকেও অভিশাপ দিয়েছেন, যারা নারীদের বেশ ধারণ করে।
* পোশাক যেন জাঁকজমকপূর্ণ প্রসিদ্ধিজনক না হয়। কারণ, এমন ধরনের পোশাক পরিধান করলে সাধারণত পরিধানকারীর মনে অহংকারের সৃষ্টি হয়, যা যুবকরা ফ্যাশন ও আধুনিকতার পরশ মনে করে। তাই রাসুলে পাঁক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ‘‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে প্রসিদ্ধিজনক পোশাক পরিধান করবে, আল্লাহ্ তাকে কিয়ামতের দিন লাঞ্ছনার পোশাক পরিধান করাবেন।
عَنِ ابْنِ عُمَرَ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِيَّاكُمْ وَالتَّعَرِّي فَإِنَّ مَعَكُمْ مَنْ لاَ يُفَارِقُكُمْ إِلاَّ عِنْدَ الْغَائِطِ وَحِينَ يُفْضِي الرَّجُلُ إِلَى أَهْلِهِ فَاسْتَحْيُوهُمْ وَأَكْرِمُوهُمْ-
অর্থ: আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা নগ্নতা হতে বেঁচে থাক। কেননা তোমাদের এমন সঙ্গী আছেন (কিরামান-কাতিবীন) যারা পেশাব-পায়খানা ও স্বামী-স্ত্রীর সহবাসের সময় ছাড়া অন্য কোন সময় তোমাদের হতে আলাদা হন না। সুতরাং তাদের লজ্জা কর এবং সম্মান কর।
[সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-২৮০০]
عَنْ جَابِرٍ، أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلاَ يَدْخُلِ الْحَمَّامَ بِغَيْرِ إِزَارٍ وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلاَ يُدْخِلْ حَلِيلَتَهُ الْحَمَّامَ
অর্থ: হযরত জাবের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা ও পরকালের প্রতি যে ঈমান (দৃঢ় বিশ্বাসস্থাপন করে সে যেন ইযার (লুঙ্গি) পরিহিত অবস্থা ছাড়া গোসলখানায় প্রবেশ না করে। আল্লাহ তা’আলা এবং পরকালের প্রতি যে ঈমান (দৃঢ় বিশ্বাস ) স্থাপন করে সে যেন তার স্ত্রীকে গোসলখানায় প্রবেশ না করায়। [সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-২৮০১]
সুতরাং নারী ও পুরুষের জন্য পর্দা পালন করা সমভাবে প্রযোজ্য। আর মুসলমান যুবকরা হাফ প্যান্ট পরিধানকে ফ্যাশন আধুনিকতা মনে করে যে গুনাহের কাজ নিত্যদিন করছে, আল্লাহ তাআলা সকল মুসলিম যুবককে শরিয়তের এ নিষিদ্ধ ও গর্হিত কাজটিকে ছেড়ে এবং এ বেপরোয়া স্বভাব বাদ দিয়ে কুরআন ও হাদিসের উপর আমল করে ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন জীবনের সফলতা লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন। বিহুরমাতি সায়্যিদিল মুরসালিন।

টিকা:

. সুরা নুর, আয়াত নং- ৩০
. বাহারে শরীয়ত, ১ম খন্ড
. বুখারি, হাদিস নং- ৬২২৯
. আবূ দাউদ, মিশকাত: ৪৩৪৭
. আবূ দাউদ: ৪০৯৭, ইবনে মাজাহ: ১৯০৪
. মুসনাদে আহমাদ, সুনানে আবূ দাউদ, সুনানে ইবনে মাজাহ ও মিশকাত: ৪৩৪৬

লেখক: সহকারী মৌলভী, কাদেরিয়া তৈয়্যেবিয়া কামিল মাদরাসা, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।