নামায আদায়ের সঠিক নিয়ম ও পুরুষ-মহিলার নামাযের মধ্যে পার্থক্য

নামায আদায়ের সঠিক নিয়ম ও পুরুষ-মহিলার নামাযের মধ্যে পার্থক্য

মাওলানা মুহাম্মদ সরওয়ার উদ্দিন ক্বাদেরী>

আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে আমাদের যাবতীয় ইবাদতের মধ্যে ঈমানের পর নামায সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। সকল পুরুষ মুসল্লীর নামাযের পদ্ধতি এক ও অভিন্ন হলেও সংগত কারণে মহিলাদের নামাযে রয়েছে কতিপয় পার্থক্য। এমনকি কুরআন-সুন্নাহ ও নির্ভরযোগ্য ফাতাওয়ার কিতাবে পুরুষ ও মহিলার নামাযের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতির কথা সুষ্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, অলসতা ও অবহেলায় ইচ্ছা মাফিক নামায আদায়ের কারণে বর্তমানে মুসল্লীদের মাঝে সুন্নাত পদ্ধতি অনুসরণপূর্বক সঠিক নিয়মে নামায আদায় করতে দেখা যায় না। অথচ বিশুদ্ধ নামাযই হতে পারে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনের সহজতম মাধ্যম এবং জান্নাতের চাবিকাঠি। বিশ্ববিখ্যাত হানাফী মাজহাব অনুসারে সুন্নাত পদ্ধতিতে (দুই/তিন/চার) রাকা‘আত নামায আদায়ের সঠিক নিয়ম এবং পুরুষ ও মহিলার নামাযের পার্থক্য সম্পর্কে ধারাবাহিক বিবরণ উপস্থাপন করাই আলোচ্য নিবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য।

সুন্নাত পদ্ধতিতে নামায আদায়ের সঠিক নিয়ম
যখন কোন মুসল্লী নামায আদায়ের ইচ্ছা পোষণ করবে তখন তার শরীর অবশ্যই পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র হতে হবে। অযু বা গোসলের প্রয়োজন হলে অবশ্যই তাকে সঠিক নিয়মে অযু বা গোসল করে নিতে হবে। সাথে সাথে মনের পবিত্রতাও অর্জন করতে হবে। মুসল্লীকে পবিত্র পোষাক পরিধান করে দাঁড়ানো ও সাজদার জন্য পবিত্র জায়গা নির্বাচন করে কিবলামুখী হয়ে দাঁড়াতে হবে। শারীরিক বিশেষ কোন অসুবিধা না থাকলে দুই পায়ের মাঝখানে চার আঙ্গুল পরিমাণ ফাঁক রেখে দাঁড়ানো সুন্নাত। মুসল্লী দাঁড়ানো অবস্থায় নিজের সাজদার জায়গাতে দৃষ্টি রাখা মুস্তাহাব। মনের ধ্যানকে নামাযের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবে। মুসল্লী ইবাদতের উদ্দেশ্যে এমনভাবে দাঁড়াবে যেন সে আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছে। এমন ধারণা করতে না পারলে আল্লাহ অবশ্যই তাকে দেখতে পাচ্ছেন বলে ধারণা করবে। মুসল্লী নিজের আমিত্ব ও অস্তিত্ব আল্লাহর সামনে বিলীন করে একনিষ্ঠ মনে পাঠ করবে- إِنِّىْ وَجَّهْتُ وَجْهِىَ لِلَّذِىْ فَطَرَ السَّموَاتِ وَالْاَرْضَ حَنِيْفًا وَّمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ. যে ওয়াক্তের নামায আদায় করছে তা স্থির করে নিয়ত করবে। সাথে সাথে নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা মুস্তাহাব এবং আরবিতে নিয়ত করা উত্তম।

দুই রাকা‘আত বিশিষ্ট নামায হলে نويت ان اصلى لله تعالى ركعتى (নাওয়াইতু আন উসল্লিয়া লিল্লাহি তা‘আলা রাকা‘আতাই), তিন রাকা‘আত বিশিষ্ট নামায হলেثَلَاثَ رَكَعَاتِ (ছালাছা রাকা‘আতে) এবং চার রাকা‘আত বিশিষ্ট নামায হলেأَرْبَعَ رَكَعَاتِ (আরবা‘আ রাকা‘আতে) বলতে হবে। যে ওয়াক্তের নামায সেই ওয়াক্তের নামাযের নাম বলতে হবে। যেমন: সালাতিল ফজর, সালাতিজ জোহর, সালাতিল আছর, সালাতিল মাগরিব, সালাতিল এশা, সালাতিল বিতর, সালাতিত তাহাজ্জুদ, সালাতিল এশরাক্ব, সালাতিল আওয়াবিন, সালাতিত তাসবীহ, সালাতি তাহিয়্যাতিল ওযূ, সালাতি তাহিয়্যাতিল মসজিদ, সালাতিত তাওয়াফ, সালাতিল ইস্তেখারা, সালাতিল জানায়িজ, সালাতি ঈদিল ফিতর, সালাতি ঈদিল আজহা ইত্যাদি। সুন্নাত নামায হলেسُنَّةُ رَسُوْلِ اللهِ تَعَالَي (সুন্নাতু রাসূলিল্লাহি তায়ালা), ফরয নামায হলে فَرْضُ اللهِ تَعَالَي (ফরদ্বুল্লাহি তায়ালা), ওয়াজিব নামায হলেوَاجِبُ اللهِ تَعَالَي (ওয়াজিবুল্লাহি তায়ালা) আর নফল নামায হলে نَفَل (নফল) বলতে হবে। ইমামের পেছনে মুকতাদি নিয়ত করলে চুপে চুপে إِقْتِدَيْتُ بِهذَا الْإِمَامِ (ইকতেদাইতু বি হা-জাল ইমাম) বলবে। তারপর বলবে مُتَوَجِّهًا إِلى جِهَةِ الْكَعْبَةِ الشَّرِيْفَةِ أللهُ أَكْبَر (মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কা‘বাতিশ্ শরীফাতি আল্লাহু আকবর)। তাকবীরের মাধ্যমে নামাযীর জন্য যাবতীয় হালাল কাজ হারাম হয়ে যায়। তাই এটাকে ‘তাকবীরে তাহরীমা’ বলে। তাকবীরে তাহরীমাতে ‘আল্লাহু আকবর’ বলা ওয়াজিব। জামা‘আত আদায়কারী ইমাম সাহেব নিয়তের মধ্যে অতিরিক্ত যোগ করে বলবেনأَنَا إِمَامٌ لِمَنْ حَضَرَ وَلِمَنْ يَّحْضُرُ ‘আনা ইমামুন লিমান হাদ্বারা ওয়া লিমাই ইয়াহদ্বুরু’।

পুরুষ মুসল্লী দুই হাতের তালু, আঙ্গুলির পেট ও মাথা কেবলামুখী রেখে উভয় হাত এতটুকু উপরে উঠাবে যাতে দুই হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির মাথা দু’টি দুই কানের লতি স্পর্শ করে। অন্যান্য আঙ্গুলগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় থাকবে। তাকবীর বলার পূর্বে উভয় হাত উঠানো সুন্নাত। এ সময় মাথা সামনের দিকে ঝুঁকাবে না। বরং সোজা রাখাই সুন্নাত। ‘তাকবীরে তাহরীমা’ বলার সাথে পুরুষ মুসল্লী বাম হাতের কবজির উপর ডান হাতের কবজি রেখে ডান হাতের শাহাদাত আঙ্গুল, মধ্যমা ও অনামিকা আঙ্গুলত্রয় বাম হাতের কবজির উপর লম্বাভাবে রাখবে এবং ডান হাতের কনিষ্ট ও বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা বাম হাতের কবজি জড়িয়ে ধরে নাভীর নিচে বেঁধে নেবে। মহিলা মুসল্লীয়া সীনার উপর হাত বাঁধবে। একাকী নামায আদায়কারী পুরুষ বা মহিলা, জামা’আত সহকারে নামায আদায়কারী ইমাম ও মুক্তাদি সকলে চুপে চুপে ‘দোয়ায়ে সানা’ পাঠ করবে। যদি ইমাম সাহেব বড় আওয়াজে কেরাত পড়ার নামাযে কেরাত আরম্ভ করে দেন তখন মুক্তাদি সুনহানাকা পড়বে না বরং চুপ থেকে ইমামের কেরাত শুনবে। কেননা, ইমামের কেরাত শুনা মুক্তাদির জন্য ফরয। আরسُبْحَانَكَ اَللهم وَبِحَمْدِكَ وَتَبَارَكَ اسْمَكَ وَتَعَالَى جَدُّكَ وَلَا إِلهَ غَيْركَ দোয়ায়ে সানা ‘সুবহানাকা’ পাঠ করা সম্পন্ন হলে হানাফী মাজহাব মতে- নামাযে দাঁড়ানো অবস্থায় শুধুমাত্র ইমাম চুপে চুপে أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ (আউযু বিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম) ও بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ (বিছমিল্লাহির রাহমানির রাহীম) পাঠ করবে, এটা সুন্নাত। ফজর, মাগরিব ও এশার নামাযে বড় আওয়াজে সূরা ফাতিহা পাঠ করবে। অত:পর যে কোন সূরা-কেরাত পাঠ করবে। আর মুক্তাদি দোয়ায়ে সানা ‘সুবহানাকা’ পাঠ করে নীরব থাকবে এবং ইমামের বড় আওয়াজের সূরা-কেরাত শুনতে থাকবে। নিজের সূরা-কেরাত পাঠের প্রয়োজন নেই। কারণ, ইমামের কেরাতই মুক্তাদির কেরাত। একাকী নামায আদায়কারী হলে চুপে চুপে- আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম এবং বিছমিল্লাহির রাহমানির রাহীম পাঠ করবে এবং চুপে চুপে ‘সূরা ফাতিহা’ পাঠ করে যে কোন সূরা-কেরাত পাঠ করবে। ইমামوَلَا الضَّالِّيْنَ (ওয়ালাদ্বদ্বোয়াল্লিন) বলার পর ইমাম ও মুকতাদি সকলেই চুপে চুপেآمِيْنْ (আমিন) বলা সুন্নাত। নামাযের মধ্যে آمِيْنْ (আমিন) উচ্চস্বরে বলা মাকরূহ এবং সুন্নাতের পরিপন্থী।

‘সূরা ফাতিহা’ শেষ হওয়া মাত্রই ইমাম ও একাকী নামায আদায়কারী পবিত্র কুরআনের যে কোন সূরা বা কমপক্ষে একটি বড় আয়াত বা তিনটি ছোট আয়াত পাঠ করবে। সূরা ফাতিহার পর কেরাতের পূর্বে ‘বিসমিল্লাহ’ পড়া মুস্তাহাব। জামা‘আতের নামাযে ইমাম সাহেব সূরা-কেরাত পাঠ করবেন আর মুক্তাদি সূরা-কেরাত ব্যতীত রুকু সাজদার তাসবীহ, তাশাহুদ, দরূদ শরীফ ও দোয়ায়ে মাছুরা পাঠ করবে। সূরা-কেরাত সমাপ্ত হলে ইমাম সাহেব বড় আওয়াজে এবং মুকতাদি ও একাকী নামায আদায়কারী নীরবে কাল বিলম্ব না করে ‘আল্লাহু আকবর’ (তাকবীরে ইন্তেকালিয়া) বলে ইমামের অনুসরণে রুকুতে যাওয়া ওয়াজিব। রুকুতে যাওয়ার সময় ‘আল্লাহু আকবর’ বলা সুন্নাত। রুকু করার সময় ইমাম ও মুক্তাদি সকলেই নিজের পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলির উপর নিজের দৃষ্টি রাখবে। কোমর, পিঠ ও মাথা একই সমান্তরালে কিবলামুখী রাখবে। রুকুতে মাথা ঝুঁকাবে না এবং উঁচুও করবে না বরং পিঠ বরাবর সোজা রাখবে। দুই হাতের তালু দ্বারা দুই হাঁটুকে মজবুতভাবে ধরবে এবং হাতের আঙ্গুলগুলো ফাঁক থাকবে। রুকু অবস্থায় ইমাম মুক্তাদি সকলকেই ছোট আওয়াজেسُبْحَانَ رَبِّيَ الْعَظِيْمِ (সুবহানা রাব্বিয়াল আজীম) ৩বার/৫বার/৭বার পাঠ করবে। তিনবার বলা সুন্নাত, পাঁচবার বলা মুস্তাহাব। রুকুতে কমপক্ষে একবার ‘সুবহানাল্লাহ’ বলার পরিমাণ সময় অবস্থান করা ওয়াজিব। জামা‘আতের নামায আদায়কারী শুধু ইমাম সাহেব উচ্চস্বরেسَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدِه (সামি‘আল্লাহু লিমান হামিদাহ্) বলে রুকু হতে সোজা হয়ে দাঁড়াবে। মুক্তাদিরা চুপে চুপে رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ (রাব্বানা লাকাল হামদ) বলে দাঁড়াবে। মুক্তাদিগণ سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَه (সামি‘আল্লাহু লিমান হামিদাহ্) বলবে না। একাকী নামায আদায়কারী سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَه (সামি‘আল্লাহু লিমান হামিদা) এবং رَبَّنَا َلَكَ الْحَمْدُ (রাব্বানা লাকাল হামদ) বলে সোজা হয়ে দাঁড়াবে। রুকু হতে সোজা হয়ে দাাঁড়িয়ে ১তাসবীহ পরিমাণ সময় স্থির থাকা ওয়াজিব। দাঁড়ানো অবস্থায়-حَمْدًا كَثِيْرًا طَيِّبًا مُبَارَكًا فِيْهِ (হামদান কাছীরান তাইয়্যিবান মুবারাকান ফিহি) পড়তে পারবে। তারপর ইমাম উচ্চস্বরে এবং মুক্তাদি ও একাকী নামায আদায়কারী মুসল্লী চুপে চুপে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে সাজদায় যাবে। সাজদায় যাওয়ার সময় প্রথমে দু’হাটু যমিনে রাখবে তারপর উভয় হাতের তালুকে যমিনে এমনভাবে ফাঁক করে বিছাতে হবে যাতে উভয় হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির মাথা কানের লতি বরাবর হয় এবং দুই হাতের মাঝখানে খালি জায়গায় কপাল ও মাথা রেখে সাজদা করা যায়। সাজদা হবে কপাল ও নাক মাটিতে স্পর্শ করে। সাজদারত অবস্থায় পুরুষ মুসল্লীর পেট ও হাতের উভয় কনুই রান ও পাঁজর থেকে আলাদা থাকবে, যদি মুসল্লীর প্রচন্ড ভীড় না থাকে। আর মহিলা মুসল্লী হাতের উভয় বাহু পেটের সাথে মিলিয়ে পাঁজরের সাথে জড়িয়ে রাখবে। সকল প্রকার মুসল্লী চুপে চুপে سُبْحَانَ رَبِّىَ الأَعْلى (সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা) ৩বার/৫বার/৭বার পাঠ করবে।

তাসবীহ পাঠ সমাপ্ত হলে জামা’আতের নামাযে ইমাম উচ্চ আওয়াজে এবং মুক্তাদি ও একাকী নামায আদায়কারী চুপে চুপে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে সাজদা হতে প্রথমে কপাল, তারপর নাক, অত:পর দুই হাত তুলতে হবে এবং ডান পায়ের পাতা খাড়া রেখে আঙ্গুলসমূহের মাথা কিবলামুখী করে বাম পায়ের পাতা বিছিয়ে তার উপর বসে এক তাসবীহ পরিমাণ সময় স্থির থাকবে এবং এই দোয়াটি পাঠ করবে- اللهم اغْفِرْ لِىْ وَارْحَمْنِىْ وَ اهْدِنِىْ وَعَافِنِىْ وَ ارْزُقْنِىْ. (আল্লাহুম্মাগফির লী ওয়ারহামনী ওয়াহদিনী ওয়া আ-ফিনি ওয়ার জুকনী) ইমাম উচ্চস্বরে এবং মুক্তাদি ও একাকী নামায আদায়কারী চুপে চুপে اَللهُ أَكْبَرُ (আল্লাহু আকবর) বলে পূর্বের নিয়মে দ্বিতীয় সাজদা আদায় করবে। সাজদা অবস্থায় ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আলা’ পূর্বের সংখ্যা অনুযায়ী পাঠ করে পুনরায় পূর্ব নিয়মে সবাই اَللهُ أَكْبَرُ (আল্লাহু আকবর) বলে দ্বিতীয় সাজদা হতে উঠে বসবে না বরং মাটিতে ভর না দিয়ে প্রথমে কপাল, তারপর নাক তারপর দুই হাতের তালু উঠিয়ে দুই হাত দ্বারা উভয় হাঁটুর উপর ভর করে দ্বিতীয় রাকা‘আত আদায়ের উদ্দেশ্যে সোজা হয়ে দাঁড়াবে। দ্বিতীয় রাকা‘আতের উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে উভয় হাত তুলবে না, জামা‘আতের নামাযে শুধু ইমাম এবং একাকী নামায আদায়কারী চুপে চুপে ‘বিছমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ বলে প্রথম রাকা’আতের ন্যায় শুধু ইমাম বড় আওয়াজে আর একাকী নামায আদায়কারী ছোট আওয়াজে সূরা ফাতিহা এবং অন্য কোন সূরা/আয়াত পাঠ করবে। সূরা-কেরাত সমাপ্ত হলে ইমাম বড় আওয়াজে আর মুক্তাদি ও একাকী নামায আদায়কারী ছোট আওয়াজে اَللهُ أَكْبَرُ(আল্লাহু আকবর) বলে পূর্বের নিয়মে রুকু করবে এবং রুকুর তাসবীহ পাঠ করবে। রুকু হতে সোজা দাঁড়িয়ে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে সাজদায় গিয়ে সাজদার তাসবীহ পাঠ করবে। অত:পর সাজদা হতে উঠে ডান পায়ের পাতা খাড়া রেখে আঙ্গুলসমূহ কিবলামুখী করে বাম পায়ের পাতা বিছিয়ে তার উপর স্থির হয়ে বসবে এবং উভয় হাতের আঙ্গুলসমূহ স্বাভাবিকভাবে উভয় রানের উপর বিছিয়ে রাখবে। মহান আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে চুপে চুপে ‘তাশাহুদ’ পাঠ করবে। তাশাহুদ নিম্নরূপঃ
أَلتَّحِيَّاتُ لِلهِ وَالصَّلَوَاتُ وَالطَّيِّبَاتُ اَلسَّلَامُ عَلَيْكَ أَيُّهَا النَّبِىُّ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُه اَلسَّلَامُ عَلَيْنَا وَعَلى عِبَادِ اللهِ الصَّالِحِيْنَ . أَشْهَدُ أَنْ لآ إِلهَ الَّا اللهُ وَ أَشْهَدُ أَنْ مُحَمَّدًا عَبْدُه وَرَسُوْلُه.
‘তাশাহুদ’ পড়ার সময় হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ক্বলবের ধ্যানের মধ্যে হাজের-নাজের জেনে আল্লাহর হাবীবের নূরানী চেহারা মোবারক ও পবিত্র নূরানী সূরতকে নিজের সামনে ধ্যান করে একান্ত বিনয় ও ন¤্রতা সহকারে অতিশয় আদবের সাথেاَلسَّلَامُ عَلَيْكَ أَيُّهَا النَّبِىُّ وَ رَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُه (আসসালামু আলাইকা আইয়ুহান নবীয়্যু ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু) বলে সালাম পেশ করবে। অত:পর أَشْهَدُ أَنْ لآ إِلهَ الَّا اللهُ (আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাহা ইল্লাল্লাহ) পাঠ করে ডান হাতের শাহাদাত আঙ্গুলির মাথা উপরে উঠিয়ে আল্লাহ পাকের একত্ববাদের স্বীকৃতি প্রদান করবে।

শাহাদাত আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করার পদ্ধতি
ডান হাতের কনিষ্ঠা আঙ্গুল ও অনামিকা আঙ্গুলকে এবং মধ্যমা ও বৃদ্ধাঙ্গুলের মাথাযুগলকে মিলিয়ে বৃত্ত বানিয়ে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলার সময় শাহাদাত আঙ্গুলের মাথা কিবলার দিকে ঝুঁকিয়ে উপরে উঠাতে হবে এবং ‘ইল্লাল্লাহ’ বলতেই শাহাদাত আঙ্গুলি নামিয়ে ফেলতে হবে। আঙ্গুলসমূহকে পূর্বের স্বাভাবিক অবস্থায় সোজা করে নিতে হবে। অত:পর সকল প্রকার মুসল্লী চুপে চুপে ‘দরূদে ইবরাহীমি’ পাঠ করবে।
أَللّٰهُمَّ صَلِّ عَلى مُحَمَّدٍ وَ عَلى اٰلِ مُحَمَّدٍ كَماَ صَلَّيْتَ عَلى إِبْرَاهِيْمَ وَ عَلى اٰلِ إِبْرَاهِيْمَ إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدٌ أَللّٰهُمَّ بَارِكْ علَى مُحَمَّدٍ وَ عَلى اٰلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ علَى إِبْرَاهِيْمَ وَ عَلى اٰلِ إِبْرَاهِيْمَ . إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَّجِيْدُ.
দুরূদ শরীফ পাঠ শেষ হলে ‘দোয়া মাছুরা’ পাঠ করবে। দোয়ায়ে মাছুরা নিম্নরূপ:
أَللّٰهُمَّ إِنِّيْ ظَلَمْتُ نَفْسِيْ ظُلْمًا كَثِيْرا وَلَا يَغْفِرُ الذُّنُوْبَ اِلَّا أَنْتَ فَاغْفِرْلِيْ مَغْفِرَةً مِنْ عِنْدِكَ وَ ارْحَمْنِيْ إِنَّكَ أَنْتَ الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ.
‘দোয়া মাছুরা’ পাঠ করা শেষ হলে ইমাম উচ্চস্বরে এবং মুক্তাদি এবং একাকী নামায আদায়কারী প্রথমে ডান দিকে মুখ ফিরিয়ে চুপে চুপেاَلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ ورَحْمَةُ اللهِ (আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ) বলে সালাম দিবে। অত:পর বাম দিকে অনুরূপভাবে মুখ ফিরিয়ে সালাম দিবে। ডান দিকে সালাম দেয়ার সময় নিজের দৃষ্টি ডান কাঁধের উপর এবং বাম দিকে সালাম দেয়ার সময় নিজের দৃষ্টি ডান কাঁধের উপর রাখতে হবে। সালাম দেয়ার সময় যাদেরকে উদ্দেশ্য করবে ঃ জামা‘আতের নামায হলে ইমাম সাহেব ডান দিকে সালাম দেওয়ার সময় ডান দিকের ফেরেস্তা এবং মুক্তাদিগণকে সালাম দেওয়ার নিয়ত করবে। আর বাম দিকে সালাম দেওয়ার সময় বাম দিকের ফেরেস্তা ও মুসল্লীগণকে সালাম দেওয়ার নিয়ত করবে। মুক্তাদি মুসল্লীরা ডানদিকে সালাম দেওয়ার সময় ডানদিকের ফেরেস্তাগণ এবং ইমাম সাহেব যদি ডানদিকে থাকেন তাহলে ইমাম ও ডান দিকের মুসল্লীগণকে সালাম দেওয়ার নিয়ত করবে। আর বাম দিকে সালাম দেওয়ার সময় বাম দিকের ফেরেস্তা এবং ইমাম যদি বাম দিকে থাকেন তাহলে ইমাম ও বাম দিকের মুসল্লীগণকে সালাম দেওয়ার নিয়ত করবে। একাকী নামায আদায়কারী ডানদিকে সালাম দেওয়ার সময় ডান দিকের ফেরেস্তা এবং বামদিকে সালাম দেওয়ার সময় বামদিকের ফেরেস্তাদের সালাম দেওয়ার নিয়ত করবে। এভাবে দুইদিকে সালাম দেওয়ার মাধ্যমে নিয়তকৃত নামায সমাপ্ত হবে। ৩য় ও ৪র্থ রাকা‘আতের রুকু ও সাজদার মাস’আলা ১ম রাকা‘আতের মতই। কিন্তু ফরয নামাযের ৩য় ও ৪র্থ রাকা‘আতে রুকুর আগে ৪টি মাস’আলা: ১.হাত বাঁধা ২. বিসমিল্লাহ পড়া ৩. ইমাম ও একাকী নামায আদায়কারীর সূরা ফাতিহা পড়া, জামা‘আতে নামায আদায়কারী মুক্তাদিগণ ইমামের পেছনে সূরা ফাতিহা পড়বে না ৪. সূরা ফাতিহার পর ‘আমিন’ বলা। ফরয নামাযের শেষ দুই রাকা‘আতে মুক্বতাদী যদি ভুলে সূরা ফাতিহা বা কোন সূরা পড়ে ফেলে নামাযের ক্রটি হবে না এবং এ জন্য সাহু সিজদা আদায় করা ওয়াজিব নয়।

পুরুষ ও মহিলার নামাযের পার্থক্যসমূহ
১. পুরুষ মুসল্লীর জন্য নামাযের আযান দেওয়া সুন্নাত। কিন্তু মহিলাদের নামাযের জন্য আযান নেই এমনকি ইক্বামতও নেই। পুরুষের নামাযের জন্য আযান দিবে পুরুষ ব্যক্তি। আযান দেয়ার জন্য কোন মহিলাকে মুয়াজ্জিন বানানো যাাবে না।
২. পুরুষ মুসল্লী নামাযে দাঁড়ানোর সময় উভয় পায়ের মাঝখানে চার আঙ্গুল পরিমাণ ফাঁক রাখা সুন্নাত। মহিলা মুসল্লীয়া ফাঁক রাখবে না।
৩. মহিলা মুসল্লীয়া পুরুষ ইমামের পেছনে ইকতেদা করলে প্রাপ্তবয়ষ্ক পুরুষদের কাতার হবে সামনে এবং মহিলাদের কাতার হবে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের পেছনে এবং নাবালকদের সামনে।
৪. তাকবীরে তাহরীমার সময় মহিলারা তাদের হাত কাঁধ বরাবর উত্তোলন করবে। পুরুষ মুসল্লী উভয় হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি কানের লতি পর্যন্ত উত্তোলন করবে।
৫. মহিলা মুসল্লী তাকবীরে তাহরীমার সময় দুই হাত উড়নার ভেতরে রাখবে, ওড়নার বাইরে হাত বের করবে না।
৬ তকবীরে তাহরীমার পর পুরুষ মুসল্লী ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি ও কনিষ্ট আঙ্গুল দিয়ে বাম হাতের কবজির গিরা আঁকড়ে ধরবে এবং শাহাদাত আঙ্গুল, মধ্যমা ও অনামিকা আঙ্গুল তিনটি বাম হাতের কবজির উপর রেখে স্বাভাবিকভাবে উভয় হাত নাভীর নিচে বেঁধে নেবে। পক্ষান্তরে মহিলা মুসল্লী ডান হাতের আঙ্গুলগুলো বাম হাতের উপর মিলিয়ে রাখবে এবং উভয় হাত বুকের উপর রাখবে। রুকু ও সাজদা করার সময় পুরুষ মুসল্লী হাত ও পায়ের আঙ্গুলগুলো ফাঁক রাখবে এবং মহিলা মুসল্লী মিলিয়ে রাখবে।
৭. ইমাম এশা, মাগরিব ও ফজর নামাযে উচ্চস্বরে কেরাত পড়বে। একাকী নামায আদায়কারী এবং মহিলা মুসল্লী নামাযের কেরাত সর্বদা নিচু স্বরে পড়বে। তবে মহিলার জামা’আতে নির্জন ও বিশেষ স্থানে মাগরিব, এশা ও ফজর নামাযে কেরাত আওয়াজ করে পড়বে।
৮. মহিলা মুসল্লী রুকুর ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় কম ঝুঁকবে এবং পিঠ টানটান করবে না। পায়ের গোঁড়ালি এবং হাতের কনুই পাঁজরের সাথে মিলিয়ে রাখবে।
৯. পুরুষ মুসল্লী সাজদা অবস্থায় উভয় হাতের কনুই জমিন থেকে পৃথক রাখবে। মহিলা মুসল্লীয়া উভয় হাত কনুইসহ জমিনে বিছিয়ে রাখবে।
১০. নামাযের মধ্যে সাজদা অবস্থায় পুরুষ মুসল্লী পায়ের পাতা খাঁড়া রেখে একটু উঁচু হয়ে সাজদা দেবে। পক্ষান্তরে মহিলা মুসল্লীয়া পায়ের পাতা খাড়া রাখবে না। বরং উভয় পায়ের পাতা ডান দিকে বের করে মাটিতে বিছিয়ে নিচু হয়ে সিজদা আদায় করবে।
১১. নামাযের ইমামত করার জন্য পুরুষই অগ্রগণ্য। উম্মুহাতুল মো’মিনীনদের অনেকেই মুহাদ্দিসা ও ফকিহা ছিলেন। তাঁরা কখনও নামাযে ইমামতির দায়িত্ব পালন করেননি।
১২. পুরুষের জন্য মসজিদে গিয়ে নামায পড়া সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। মহিলার জন্য সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ নয়। মহিলাদের নামায ঘরে পড়াই উত্তম।
১৩. জুমু‘আর নামায কেবলমাত্র পুরুষদের জন্য ফরজ, মহিলাদের জন্য ফরয নয়।
১৪. পুরুষ ও মহিলার নামাযের ভিন্নতার প্রধান বিবেচ্য বিষয় হল সতর। অর্থাৎ মহিলার জন্য শরীয়তের হুকুম হল এমন পদ্ধতি অবলম্বন করা, যা তার পর্দার জন্য অধিক উপযোগী।
১৫. নামাযে কোন কিছু সতর্ক করার প্রয়োজন হলে পুরুষদেরকে ‘তাসবীহ’ পাঠ করে সতর্ক করা হবে। আর মহিলাদের সতর্ক করার নিয়ম হল তাসফীক (করতালি) দেয়া। অর্থাৎ বাম হাতের উপর ডান হাত দ্বারা শব্দ করার মাধ্যমে সতর্ক করা।
উপরোক্ত নিয়মগুলো হাদিস শরীফে বর্ণিত এবং অধমের কাছে সংরক্ষিত আছে। নিবন্ধের কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় আপাতত: আলোচ্য পরিসরে উল্লেখ করা হয়নি। আল্লাহ পাক পুরুষ ও মহিলা সকলকে সুন্নাত পদ্ধতি অনুসরণে একাগ্রচিত্তে নিরলসভাবে নামায আদায়ের তৌফিক দান করুন, আ-মী-ন। বিহুরমাতি সায়্যিদিল মুরসালীন।।

লেখক: মুহাদ্দিস, গহিরা এফ. কে. জামেউল উলূম বহুমুখী কামিল মাদরাসা, রাউজান, চট্টগ্রাম।