গাওসুল আযম হযরত সায়্যিদ আবদুল কাদের জীলানী

গাওসুল আযম হযরত সায়্যিদ আবদুল কাদের জীলানী

আল্লামা হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান >

[মাযহারে জামালে মুস্তফাঈ (নবীজির রূপগুণের প্রকাশস্থল) সৈয়দ নাছির উদ্দীন হাশেমী রহমাতুল্লাহি আলায়হি রচিত হযরত গাওসুল আযম হযরত সাইয়্যিদ আবদুল কাদের জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর একটি প্রামাণ্য জীবনী গ্রন্থ। এটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন আল্লামা হাফেজ আনিসুজ্জমান। ১১ রবিউস্ সানি ১৪৪৫ হিজরী বইটি প্রকাশিত হবে। উক্ত গ্রন্তের কিছু অংশ মাসিক তরজুমানের এ সংখ্যায় প্রকাশ হলো]

শুভ জন্ম ও বংশীয় শাজরা
তাঁর পবিত্র নাম সায়্যিদ আব্দুল কাদের। উপনাম আবু মুহাম্মদ। উপাধি মুহিয়্যুদ্দীন। আসমানী জগতে তাঁর লকব ‘বা-য আশহাব’। আল্লাহ্ তাঁকে ‘গাওসে আ’যম’ খেতাবে ধন্য করেন। তিনি হি. ৪৭০ সনে ইরান দেশের ‘জীলান’ নামক প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। জনৈক বুযুর্গ ব্যক্তি তাঁর শুভ জন্ম সন ও বেসাল (তিরোধান) সম্পর্কে কতই না সুন্দর বলেছেন, جَاءَ فِى عِشْقٍ وَتَوَفّى فِى كَمَالٍ
অর্থাৎ তিনি ‘ইশক’-এ আগমন করেছেন, আর ‘কামাল’-এ ওয়াফাত পেয়েছেন। ৪৭০ হিজরীতে শুভাগমন করে ৯০ বছর ইহজীবনের পর ওয়াফাত হলে ওয়াফাতের সন ৫৬১ হিজরী হয়। তাঁর জন্ম তারিখ ছিল মাহে রমযানের ১ তারিখ (অর্থাৎ ১লা রমযান)।

পবিত্র বেলাদত’র সময়কার কারামতসমূহ
তাঁর সম্মানিত পিতা হযরত আবু সালেহ্ মুসা জঙ্গী-দোস্ত (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) স্বপ্নে হুযুর নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)’র সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হন। নবীজি ফরমান, “হে আমার প্রিয় বেটা আবু সালেহ্, তোমাকে আল্লাহ্ তাআলা এমন এক পুত্র সন্তান দান করেছেন, যে আমার সন্তান এবং মাহ্বুব (প্রিয়তম), আর আল্লাহ্ তাআ-লারও মাহবুব। আল্লাহ্র ওলীগণের মাঝে তাঁর মর্তবা (মর্যাদা) এমনই হবে, আম্বিয়ায়ে কেরামের মাঝে যেমন রয়েছে আমার মর্তবা। তাঁর বেলাদতের সময় শ্রদ্ধেয়া আম্মাজানের বয়স ছিল ৬০ (ষাট) বছর। মায়ের এ বয়সে তাঁর জন্মগ্রহণও এক কারামত বৈকি।
শুভজন্মের পবিত্র মুহুর্তে তাঁর চেহারা মুবারক এতই প্রভাবমন্ডিত আর আলোময় ছিল, কেউ তাঁকে একদৃষ্টিতে তাকাতে পারছিল না। এভাবে আল্লাহ্ তাআলা তাঁকে ‘মাযহারে জামালে মুস্তফাঈ’ (অর্থাৎ নবীজির রূপ-গুণের প্রকাশস্থল) বানিয়েই পাঠিয়েছিলেন।

তাঁর পবিত্র বংশধারা
হুযুর গাওসে আ’যম (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) (পিতা-মাতার) উভয়কুলে সায়্যিদ বংশ (আওলাদে রাসূল)। তিনি উভয়কুলেই শ্রেষ্ঠতম বংশোদ্ভুত। এভাবে যে, তাঁর পবিত্র বংশধারায় শ্রদ্ধেয় পিতার বংশলতিকা হযরত ইমাম হাসান মুজতাবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এবং মাতৃকুল অর্থাৎ তাঁর শ্রদ্ধেয়া আম্মাজানের বংশলতিকা হযরত ইমাম হুসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র সাথে মিলেছে। একথাটিই এক বুযুর্গ ব্যক্তি হুযুর গাওসে আ’যম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র রওযা মুবারকের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন,
ایں بارگاہ حضرت ‏غوث الثقلین است -نقدکمر حیدرونسل حسین است
مادرش حسینی نسب است وپدراو -اولادحسن یعنی کریم الابوین است
অর্থাৎ এটা গাওসে সাকালাইন’র মহান দরবার, যিনি হায়দারে কাররার হযরত আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র পবিত্র বংশজাত এবং ইমাম হোসাইনের উত্তর পুরুষ। তাঁর শ্রদ্ধেয় জননী হলেন হোসাইনী ধারায় এবং তাঁর আব্বাজান হাসানী। মা বাবা উভয়ে অতি সম্ভ্রান্ত বংশজাত। হযরত আব্দুর রহমান জামী (রহ্মাতুল্লাহি আলাইহি) সায়্যিদুনা গাওসে আ’যম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র পবিত্র বংশধারার সেই বৈশিষ্ট্য নিম্মোক্ত শে-এর (পংক্তিমালা) তে ব্যক্ত করেছেন ;
آںشاہ سرفراز کہ غوث الثقلین است –دراصل صحیح النسبین از طرفین است
از سوۓپدر تابحسن سلسلۂ اوست –وزجانب مادردر دریاۓحسین است
অর্থাৎ তিনি সেই উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন শাহেনশাহ্, যিনি জ্বিন-ইনসান’র ‘গাওস’ (রূহানী সহায়ক)। বাস্তবিকই বংশগতভাবে উভয়কুল (পিতৃকুল ও মাতৃকুল) আভিজাত্যের মুকুটধারী। মহিয়ান পিতার দিক থেকে তাঁর বংশধারা হযরত ইমাম হাসান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এবং মহিয়সী মাতার দিক থেকে হযরত ইমাম হোসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র সাথে মিলিত হয়েছে।

তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতা-মাতার পবিত্রতা
হুযুর গাওসে আ’যম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র সম্মানিত পিতা হযরত আবু সালেহ মুসা জঙ্গীদোস্ত (রহ্মাতুল্লাহি আলাইহি)’র আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টা ও সাধনা চলাকালীন এক নদীর কিনারা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। দিন কয়েক তিনি কিছু খেতে পারেন নি। ওই পথে নদীর ধারে একটি আপেল পড়ে থাকতে দেখলেন। তিনদিনেরও অধিক অনাহারে ও ক্ষুধার জ্বালায় তিনি আপেলটি নিয়ে খেয়ে নিলেন। খাওয়ার পরে তিনি ভাবলেন, আপেলটির তো কেউ মালিক থাকবেন। তাঁর অনুমতি ছাড়া আমি যে এই আপেলটি খেয়ে ফেললাম! অনুতপ্ত মনে তিনি ওই আপেলের মালিকের সন্ধানে নদীর পাড় ধরে চলতে শুরু করলেন।
চলতে চলতে কিছুদূর না যেতেই দেখতে পেলেন নদীর ধারে এক বাগান, যেটার একটি আপেল গাছের এক বড় ডাল পাকা পাকা আপেল সমেত নদীর দিকে ঝুঁকে রয়েছে। দেখা মাত্র তিনি বুঝতে পারলেন, ওই আপেলটি এই বাগানেরই হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বাগানটি হযরত আবদুল্লাহ্ সাওমাঈ (রহমাতুল্লাহি আলাইহি)’র। তাই তিনি তাঁর খেদমতে হাজির হয়ে বিনা অনুমতিতে তাঁর বাগানের আপেল খাওয়ার দরুণ ক্ষমা চাইলেন। হযরত আব্দুল্লাহ্ সাওমাঈ নিজেই যেহেতু আল্লাহ্র খাস বান্দাদের একজন ছিলেন, তাই তিনি বুঝে গেলেন যে, ইনি একজন অতি নেককার যুবক। কাজেই তিনি তাঁকে কিছুদিন বাগানের দেখাশোনা করার শর্তে বললেন, ‘তুমি প্রথমত: কিছুদিন এ খেদমত আঞ্জাম দাও, তারপর ক্ষমা করার বিষয়টি ভেবে দেখা যাবে’।
নির্ধারিত মেয়াদ পর্যন্ত যুবক আবু সালেহ অত্যন্ত সততার সাথে এই খেদমত আঞ্জাম দিলেন। এরপর আবারো ক্ষমার আবেদন জানালেন। হযরত আব্দুল্লাহ্ সাওমাঈ (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) এবার বললেন, আরো একটি শর্ত বাকী আছে। তা হলো আমার এক কন্যা আছে, তার দু’চোখ অন্ধ, সে কানে বধির, হাত গুলো নুলো (অবশ), দু’পা খোঁড়া তুমি মেয়েটিকে শাদী করো, তবে তোমাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে। হযরত আবু সালেহ এ শর্তও কবুল করে নিলেন। কথামত শাদী হয়ে গেল। বিয়ের পর যখন বিবিকে বর্ণিত যাবতীয় দৈহিক ক্রটি থেকে মুক্ত ও সুস্থ হওয়ার পাশা পাশি পরিপূর্ণ সৌন্দর্যে পরমা সুন্দরী স্ত্রী রূপে দেখতে পেলেন, তখন অন্য কোন মেয়ে বলে ভাবলেন। ভুল বশতঃ অন্য কারো সাক্ষাৎ হলো ভেবে খুব পেরেশান হয়ে কামরা হতে দ্রুত বেরিয়ে পড়লেন।
এ ঘটনার হযরত আব্দুল্লাহ সাওমাঈ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) নিজ দিব্য দৃষ্টিতে সবকিছু অবগত হলেন। উপস্থিত হয়ে বললেন, “শাহ্যাদা এটাই তো আপনার বিবি! পূর্বাহ্নে আমি তাঁর যে সব বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছিলাম সেগুলোও যথাযথ। বলেছিলাম সে অন্ধ। কারণ, এ পর্যন্ত আমার এ কন্যা কোন গাইর মাহ্রাম (যাদের সাথে বৈবাহিক সম্বন্ধ নিষিদ্ধ নয় এমন) পুরুষের সাক্ষাৎ পায়নি, এ অর্থে সে অন্ধ। বধির বলেছিলাম, কারণ সে শরীয়ত বিরোধী কোন কথা সে কানে শোনে নি। শরীয়তে নিষিদ্ধ কোন কাজ হাতে করতে পারেনি, তাই দু’হাত অবশের মতই। শরীয়ত বহির্ভূত কোন কাজের জন্য কোন দিন ঘরের বাইরে পা রাখেনি বলে তাকে খঞ্জ বলেছিলাম।” এ কথা শুনে আবু সালেহ আনন্দিত হয়ে আল্লাহ্ তাআলার শোক্র করলেন।
হুযুর গাওসে আ’যম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) এই পবিত্র সত্তা দ্বয়ের মাধ্যমে পয়দা হন।

তাঁর নানাজানের বর্ণনা
তাঁর শ্রদ্ধেয় নানাজান হযরত আব্দুল্লাহ সাওমাঈ (আলাইহির রাহমা) জীলান’র শীর্ষস্থানীয় মাশায়েখ ও আওলিয়াদের অন্যতম। তাঁর মা’রেফাত ও কামালাতের অবস্থান ছিল অতি উচ্চ মর্যাদায়। তিনি এমন বুযুর্গদের মধ্যে গণ্য ছিলেন, যাঁদের দুআ তাৎক্ষনিক কবুল হতো। দুনিয়া বিমূখ সাধক, অতি নমনীয় প্রকৃতির ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তার ঘরের দুয়ার গরীব মিসকীনদের জন্য সব সময় উম্মুক্ত ছিল। তাঁর কারামত দৃষ্টে হাজার হাজার লোক তাঁর দীক্ষা গ্রহণে ছুটে আসত এবং বেলায়তের মর্যাদা লাভে ধন্য হতো। হযরত আব্দুল্লাহ সাওমাঈ (রাহমাতুল্লাহ আলাইহি) বার্ধ্যকের ভারে নুয়ে পড়া সত্ত্বেও অত্যধিক নফল ইবাদত ও যিক্র-আযকারে মশগুল থাকতেন ভবিষ্যতের অবস্থাদি অধিকাংশই তাঁর আগাম জানা হয়ে যেত। অর্থাৎ তিনি উচ্চতর কাশফ (দিব্যদৃষ্টি)’র অধিকারী ছিলেন।

সায়্যিদুনা গাওসে আ’যম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র
শৈশব ও যৌবন কাল
সায়্যিদুনা গাওসে আ’যম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র সম্মানিত পিতা-মাতা ইল্ম ও মা’রিফতের সূর্য ও চন্দ্রের মত। যেমন তাঁর সর্বপ্রথম শিক্ষাসদন ছিল তাঁরই পবিত্র গৃহ। তিনি নিজ মা-বাবার কাছেই পবিত্র কুরআন মাজীদ হিফ্য করেন। আর প্রাথমিক শিক্ষা ও অর্জন করেন। এরপর তিনি সেখানেই মাদ্রাসা শিক্ষা শুরু করেন। পরবর্তীতে বাগদাদ গমণ করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন।

ইলম অর্জন ও সমাপন
হুযুর গাওসে আ’যম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ইরশাদ করেছেন, আমি যখন নিজ এলাকায় জীলানে ছিলাম, শিশু অবস্থায় আরাফাতের দিন এক গ্রামের পথে বের হলাম। এক পর্যায়ে আমি ক্ষেতের এক গরুর পেছনে গেলাম। লক্ষ্য করলাম, গরুটি আমার দিকে ফিরে তাকাল এবং বলতে লাগল, ‘হে আব্দুল কাদের, আপনি তো এ কাজের জন্য পয়দা হননি।’ এ ঘটনায় আমি ভয় পেয়ে ঘরে ফিরে আসি এবং ঘরের ছাদে উঠে গেলাম। দেখলাম এক অভাবনীয় দৃশ্য। আরাফাতের ময়দানে লোকদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। এরপর আমি আমার আম্মাজানের খেদমতে হাজির হয়ে আরয করলাম, “আপনি আমাকে আল্লাহ্র রাস্তায় উৎসর্গ করুন। আর আমাকে বাগদাদ যাবার অনুমতি দিন। ওখানে গিয়ে আমি ইলমে দ্বীন হাসিল করবো। শ্রদ্ধেয়া জননী আমার কাছে এর কারণ জানতে চাইলেন। তখন আমি তাঁকে উক্ত ঘটনার কথা খুলে বললাম। আম্মাজানের দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠল। এরপর তিনি তাঁর কাছে গচ্ছিত আমার আব্বাজানের রেখে যাওয়া আশি দীনার আমার কাছে নিয়ে আসলেন। আমি সেখান থেকে চল্লিশ দীনার গ্রহণ করলাম। বাকী চল্লিশ দীনার আমার ভায়ের জন্য রেখে দিলাম। আম্মাজান আমার চল্লিশ দীনার পিরহানের আস্তিনের ভেতর সেলাই করে দিলেন। এরপর আমাকে বাগদাদ যাবার অনুমতি দিয়ে দিলেন। তিনি আমাকে বারবার করে উপদেশ দিলেন, “যে অবস্থাতেই থাকো, সত্য কথা বলো।” আমি রওয়ানা হলাম। মা জননী আমাকে বিদায় জানাতে ঘরের দরজা পর্যন্ত এলেন এবং বললেন, “বেটা, আমি আল্লাহ্রই জন্য তোমাকে আমার কাছ ছাড়া করছি। তোমার এ চেহারা কাল কিয়ামতের দিনই আবার দেখার সৌভাগ্য আমার হবে।”
কেমন আল্লাহ ওয়ালা রমণী ছিলেন। যিনি নিজের প্রিয় সন্তানকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করলেন এবং সন্তানের ওপর তাঁর সব দাবী মাফ করে দিলেন। যাতে সন্তান একাগ্রচিত্তে ইলমে দ্বীন হাসিল করতে পারেন।

পথিমধ্যে তাঁর হাতে ষাটজন ডাকাত
দলের তাওবা করা
হুযুর গাওসে আ’যম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর আম্মাজানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাগদাদ অভিমুখে যাত্রাকারী ছোট এক কাফেলার সাথে রওয়ানা হলেন। গাওসে পাক নিজে বর্ণনা করেন, “আমরা হামদান অতিক্রম করে এমন এক জায়গায় পৌঁছলাম, যা অনেক কর্দমাক্ত ছিল। আমাদের কাফেলার ওপর ষাটজন ডাকাত ঝাঁপিয়ে পড়ল। কাফেলা লুঠ করল। আমার দিকে কেউ এগিয়ে এলোনা। কিছুক্ষণ পর একজন আমার দিকে আসল। জিজ্ঞেস করল, “তোমার কাছে কিছু আছে বুঝি? আমি বললাম, “হ্যাঁ, আমার কাছে চল্লিশটি দীনার আছে।” লোকটি জানতে চাইল, “কোথায় সেগুলো?” বললাম, “আমার পিরহানের ভেতর বগলের নিচ দিকে সেলাই করা।” সে মনে করল, আমি হয়তো রসিকতা করছি। তাই সে আমাকে রেখে চলে গেল। এরপর দ্বিতীয় ব্যক্তি এল। সেও ওই কথাই জিজ্ঞেস করল, যা প্রথমজন করেছিল। আমি প্রথম জনকে যা উত্তর দিয়েছিলাম তাকেও একই উত্তর দিলাম। উভয় গিয়ে তাদের সর্দারকে জানালে সে আমাকে ডেকে পাঠাল। সর্দার আমাকে জিজ্ঞেস করল, “সত্যিই কি তোমার কাছে চল্লিশ দীনার আছে?” আমি বললাম, “হ্যাঁ, আমার পিরহানের সাথে সেলাই করা আছে।” সে আমার পিরহান উল্টিয়ে সেখান থেকে চল্লিশ দীনার বের করে নিল। অবাক হয়ে সে জিজ্ঞেস করল, “এটা প্রকাশ করতে তোমাকে বাধ্য করল কীসে?” অর্থাৎ এটা তুমি বলে দিলে কেন? আমি বললাম, “আমার শ্রদ্ধেয়া আম্মাজান আমাকে সত্য কথা বলতে জোর উপদেশ দিয়েছিলেন। আমি তাঁর ওয়াদা ভঙ্গ করতে পারিনা।” ডাকাত সর্দার আমার এ কথাবার্তা শুনে কাঁদতে লাগল। আর বলতে লাগল, “আপনি আম্মাজানের ওয়াদা লঙ্গন করতে পারছেননা। আর আমার আয়ুষ্কাল প্রায় অতিক্রান্ত হল। আমি অদ্যাবধি নিজ পালন কর্তার সাথে বে-ঈমানী করেই চলেছি।” পরে সে অনুতপ্ত হয়ে আমার নিকট তাওবা করল। তারপরে তার সঙ্গীরা সবাই বলল, “লুটতরাজের কাছে আপনি আমাদের সর্দার ছিলেন, তাওবার ক্ষেত্রেও আপনিই হবেন আমাদের সর্দার। অতঃপর তারা সকলেই আমার হাতে তাওবা করল এবং কাফেলার লুণ্ঠিত মালামাল ফেরৎ দিল।

দ্বীনি ইলম অর্জন সম্পন্ন
হুযুর গাওসে আ’যম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বাগদাদ পৌঁছার পর মাদ্রাসায়ে নিযামিয়ায় ভর্তি হলেন। এ মাদ্রাসা তখনকার সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্র হিসাবে সারা বিশ্বে পরিচিত ও সুবিদিত ছিল। যাতে অত্যন্ত দক্ষ ও পারদর্শী শিক্ষকবৃন্দ পাঠদান করতেন। তিনি সযত্ন অধ্যবসায়ে কয়েক বছরের মধ্যে সকল বিষয়ে অগাধ পা-িত্য অর্জন করেন।

শিক্ষা জীবনের কঠিন সাধনা
অধ্যয়নকালে তাঁকে অনেক কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। অনেক কষ্টও স্বীকার করতে হয়। কিন্তু তাঁর দৃঢ় প্রতিজ্ঞার পথে এসব কষ্ট বাধা হতে পারেনি। শ্রদ্ধেয়া আম্মাজানের দেওয়া চল্লিশ দীনারও এক সময় খরচ হয়ে যায়। এমনকি অনেক দিন না খেয়েও কাটাতে হয়। একবার একাধারে বিশদিন অনাহারে কেটে যায়। অবশেষে একদিন কোন গ্রহণযোগ্য খাদ্যদ্রব্যের সন্ধানে পারস্যের ভগ্নপ্রাসাদের মধ্যে তাশরীফ নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে দেখলেন সত্তরজন আউলিয়ায়ে কেরাম আগে থেকেই কিছু খাবারের সন্ধানে ফিরছিলেন। তিনি তাঁদের সাথে খাবারের খোঁজে অংশ নেয়া উচিৎ নয় ভেবে ফিরে আসলেন।
আরেকদিনের ঘটনা। তিনি প্রচন্ড ক্ষুধায় লাচার হয়ে এস্ত পায়ে এক মসজিদের কোণায় গিয়ে বসে পড়লেন। কিছুক্ষণ না যেতেই অনারব এক যুবক রুটি আর ভুনা গোশত নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করল। আর এক পাশে বসে খেতে শুরু করল। হুযুর গাওসে আ’যম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) নিজে বলেন, “ক্ষুধার তীব্রতায় ওই যুবকের প্রত্যেক লোকমার সাথে সাথে নিজের ও অজান্তে আমার মুখ বারবার খুলে যাচ্ছিল। এ আচরণে এক পর্যায়ে আমি নিজের নফসকে তিরস্কার করি।” ইত্যবসরে যুবকটি আমার দিকে চোখ ফেরায়। সে আমার দিকে খাবার নিয়ে এগিয়ে দিল। আর আমার কাছে জানতে চাইল, “আপনি কোথাকার বাসিন্দা? কী করেন?” আমি বললাম, আমি জীলান থাকি, লেখাপড়ায় আছি,” সে বলল, আপনি কি জীলানের আব্দুল কাদের নামে কাউকে চেনেন? বললাম, ‘জি, হ্যাঁ, সে তো আমিই।” এটা শুনে সে বিচলিত হয়ে ওঠল। আর বলতে লাগল, “খোদার কসম, আমি কতদিন ধরে খুঁজছি। যখন আমি বাগদাদ পৌঁছি, আমার কাছে তখন নিজ খরচের টাকা মওজুদ ছিল। যখন আমি আপনার খোঁজ নিতে শুরু করি, তখন কেউ আপনার সন্ধান দিতে পারেনি। এরই মধ্যে আমার নিজ হাত খরচের টাকা ফুরিয়ে গেল। এরপর আমি তিনদিন না খেয়েই কাটিয়ে দেই। শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে আপনার সম্মানিত আম্মাজান আপনার কাছে পৌঁছাতে যে আমানতের টাকা আমাকে দিয়েছেলেন তা থেকেই এক বেলা খাবারের জন্য এ রুটি গোশত কিনে নিয়েছি। আপনি নিঃসঙ্কোচে এ খাবার গ্রহণ করতে পারবেন। কেননা, এটা আপনারই টাকায় কেনা, বরং এখন আমিই আপনার মেহ্মান।” এটা বলার পর আমি ওই যুবককে সান্তনা দিলাম এবং এতে আমার সম্মতি প্রকাশ করলাম। সে সন্তুষ্টি সহকারে খাবার গ্রহণ করল।

গ্রন্থকারের আরয, এখানে গাওসে আ’যম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র একাধারে অনাহারে থাকা এবং ক্ষুধা তৃষ্ণার কষ্ট সয়ে যাওয়া ছিল তাঁর ইখতিয়ারাধীন, বাধ্য হয়ে নয়। এটা ছিল নফস’র বিরুদ্বে জ্বিহাদ এবং তাকে কাবু করার জন্যই ছিল। কারণ, তিনি তো জন্মেরও আগে বেলায়তের অধিকারী ছিলো। যে কোন কিছুর জন্য দুআ করলেই তা অনায়াসে মিলে যেতো।

লেখক: আরবী প্রভাষক, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম।