রাসূলুল্লাহ’র দেহ মোবারক থেকে নির্গত অতিরিক্ত বস্তু: একটি পর্যালোচনা

রাসূলুল্লাহ’র দেহ মোবারক থেকে নির্গত অতিরিক্ত বস্তু: একটি পর্যালোচনা

মুহাম্মদ রবিউল আলম

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সৃষ্টিজগতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। হুযূর-ই আকরামের মধ্যে অসংখ্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি মানবীয় বৈশিষ্ট্য; তবে তাঁর মানবীয় গুণাবলি সকল মানুষের গুণাবলী থেকে স্বতন্ত্র ও তুলনাহীন। পেশাব-পায়খানা এবং এর পরে ইস্তিঞ্জা ও পবিত্রতা অর্জন ইত্যাদিও অতুলনীয়। তাঁর এসব মানবীয় বৈশিষ্ট্যকে কেন্দ্র করে বর্তমানের সালাফিরা প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে, তাঁর পেশাব, পায়খানা ও রক্ত মোবারক অপবিত্র। অপরদিকে সংখ্যাগরিষ্ট ফকিহ্দের মতে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সমুদয় ফুদ্বলাত (অতিরিক্ত বন্তু) বিশেষ করে পেশাব, পায়খানা ও রক্ত মোবারক পাক। এ দু’টি অভিমতের দালিলিক পর্যালোচনা করাই এ প্রবন্ধের প্রতিপাদ্য।

নবী-রাসূলগণ মানুষের আকারে দুনিয়ায় এসেছেন, বটে তবে সাধারণ মানুষ নন। তাঁদের প্রত্যেক কিছুই সাধারণ মানুষ থেকে ভিন্ন ও অতুলনীয়। তাঁদের ফুদ্বলাত মোবারক বিশেষ করে পেশাব ও পায়খানা মোবারক শুধু পাকই ছিল না; বরং সুগন্ধময় ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম শৌচাগার থেকে আসার পর অনেকে পায়খানা মোবারক দেখতে চেয়েও কখনো কিছু দেখতে পায়নি; কারণ মাটি ওইগুলো পাওয়ার সাথে সাথেই নিজ উদরে ধারণ করে নিতো। কেউ কেউ রাসূলুল্লাহর হাজতস্থলে গিয়েও এসবের সুগন্ধি ছাড়া কোনো বাহ্যিক নিদর্শন পাননি। সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর থুথু ও নাক মুবারকের শ্লেষ্মা পর্যন্ত মাটিতে পড়তে দিতেন না; বরং তাঁরা এসব সংগ্রহ করে নিজেদের শরীরে মেখে নিতেন। অথচ সাধারণ মানুষের এসব বস্তু নিজ শরীরে মাখা তো বহু দূরের কথা; বরং এগুলো দেখতেও অপছন্দ করে। যেখানে মানুষের রক্তের স্বাদ নোনতা, সেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর রক্ত মোবারক সুপেয়। এসব থেকেও সহজে অনুমেয় যে, সাইয়িদুল মুরসালিন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো কিছুই সাধারণ মানুষের সাথে যে তুল্য নয়। এসব বিষয় নিয়ে পূর্ববর্তী আলিমগণ বহু গ্রন্থ রচনা করেও তাঁর সবকিছু সংকলন করে শেষ করতে পারেননি। এ প্রবন্ধে আমি শুধু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পেশাব মোবারক, পায়খানা মোবারক ও রক্ত মোবারক যে পাক ছিল, তার দালিলিক পর্যালোচনা করার প্রয়াস পেয়েছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ফুদ্বলাত মোবারক পাক কিনা, তা নিয়ে দু’টি অভিমত রয়েছে:

প্রথম অভিমত
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পেশাব, পায়খানা ও রক্ত মোবারক পাক। এটি ইমাম আবু হানিফা, মোল্লা আলি ক্বারী সহ অনেক হানাফি আলিম, ইমাম বগভি, ইমাম সুবকি, ইমাম যারকাশি, ইমাম ইবনু হাজর আসকালানি, ইমাম বলকিনি, কাযি হোসাইন, ইমাম ইবনু আরাবি মালিকিসহ পরবর্তী বহু শাফিয়ি আলিমগণ-এর অভিমত। এ ক্ষেত্রে তাঁরা নি¤েœাক্ত দলিলসমূহ পেশ করেন:

প্রথম দলিল
عَنْ أُمِّ أَيْمَنَ، قَالَتْ: قَامَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مِنَ اللَّيْلِ إِلَى فَخَّارَةٍ فِي جَانِبِ الْبَيْتِ فَبَالَ فِيهَا فَقُمْتُ مِنَ اللَّيْلِ، وَأَنَا عَطْشَانَةُ فَشَرِبْتُ مَا فِيهَا، وَأَنَا لَا أَشْعُرُ فَلَمَّا أَصْبَحَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم قَالَ: ্র‌يَا ‌أُمَّ ‌أَيْمَنَ، ‌قَوْمِي ‌فَأَهْرِيقِي مَا فِي تِلْكَ الْفَخَّارَةِগ্ধ قُلْتُ: قَدْ وَاللهِ شَرِبْتُ مَا فِيهَا، قَالَتْ: فَضَحِكَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم حَتّٰى بَدَتْ نَوَاجِذُهُ، ثُمَّ قَالَ: ্রأَمَا إِنَّكِ لَا تَتَّجِعِينَ بَطْنَكِ أَبَدًاগ্ধ
অর্থাৎ হযরত উম্মে আইমন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ এক রাতে ঘুম থেকে উঠে ঘরের পাশে একটি মাটির পাত্রে পেশাব মোবারক করলেন। আমি রাতে ঘুম থেকে উঠে খুব তৃষ্ণার্তবোধ করলাম। অতঃপর মাটির পাত্রে যা ছিল তা পান করে নিলাম। পাত্রে কী ছিল আমি মোটেই অবগত নই। তারপর সকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাকে সম্বোধন করে বলেন, হে উম্মে আইমন, ওঠো এবং মাটির পাত্রে যা আছে তা ফেলে দাও। অতঃপর আমি বললাম, নিশ্চয় আল্লাহর কসম মাটির পাত্রে যা কিছু ছিল, তা আমি পান করে ফেলেছি। তিনি (উম্মে আইমন) বলেন, (এ কথা শুনে) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হেসে ফেললেন। এমনকি তাঁর প্রান্তসীমার দাঁত মোবারক দৃশ্যমান হয়েছিল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহর কসম তোমার পেটে কখনো পীড়া হবে না।’

দ্বিতীয় দলিল
عَنْ ابْنِ جُرَيْجٍ أُخْبِرْتُ ্রأَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَبُولُ فِي قَدَحٍ مِنْ عَيْدَانٍ ثُمَّ يُوضَعُ تَحْتَ سَرِيرِهِ فَجَاءَ فَإِذَا الْقَدَحُ لَيْسَ فِيهِ شَيْءٌ فَقَالَ لِامْرَأَةٍ يُقَالُ لَهَا بَرَكَةُ كَانَتْ تَخْدُمُ أُمَّ حَبِيبَةَ جَاءَتْ مَعَهَا مِنْ أَرْضِ الْحَبَشَةِ: أَيْنَ الْبَوْلُ الَّذِي كَانَ فِي الْقَدَحِ؟ قَالَتْ: شَرِبْتُهُ قَالَ: صِحَّةً يَا أُمَّ يُوسُفَ وَكَانَتْ تُكَنَّى أُمَّ يُوسُفَ فَمَا مَرِضَتْ حَتَّى كَانَ مَرَضُهَا الَّذِي مَاتَتْ فِيهِগ্ধ
অর্থাৎ ইবন জুরাইজ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি অবগত হয়েছি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম (রাতে) একটি কাঠের পাত্রে পেশাব মোবারক করে তা খাট মুবারকের নিচে রেখে দিতেন। একদা ওই পাত্রে কোনো কিছুই নেই দেখে হাবশা থেকে আগত উম্মে হাবিবার সেবিকা বারাকাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করেন, পাত্রের পেশাবটুকু কোথায়? তিনি উত্তরে বলেন, আমি তা পান করে নিয়েছি। তখন হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন, হে উম্মে ইউসুফ, তোমার পেট সুস্থ থাকবে। এরপর মৃত্যুর অসুস্থতা ছাড়া তিনি আর কোনো দিন অসুস্থ হননি।

তৃতীয় দলিল
عَن ابْن عَبَّاس قَالَ ‌حجم النَّبِي صلى الله عليه وسلم غُلَام لبَعض قُرَيْش فَلَمَّا فرغ من حجامته أَخذ الدَّم فَذهب بِهِ فشربه ثمَّ أقبل فَنظر فِي وَجهه فَقَالَ وَيحك مَا صنعت بِالدَّمِ قَالَ يَا رَسُول الله نفست على دمك أَن أهريقه فِي الأَرْض فَهُوَ فِي بَطْني فَقَالَ إذهب فقد أحرزت نَفسك من النَّار.
‘অর্থাৎ হযরত ইবনু আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহুমা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, কুরাইশ বংশের একজন বালক রাসুলুল্লাহকে হিজামত (শিঙ্গা প্রয়োগ) করেন। হিজামত করার পরে রক্ত মোবারকগুলো আড়ালে নিয়ে গিয়ে পান করে নিলেন। তার চেহারার দিকে তাকিয়ে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন, হায়! তুমি রক্তগুলো দিয়ে কী করেছো? তিনি বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনার রক্ত মোবারকগুলো মাটিতে ফেলে দিতে আমার হৃদয় বাধা দিয়েছে। তাই সেটাকে আমার পেটে স্থান দিয়েছি। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন, যাও, তুমি নিজেকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করেছো।

চতুর্থ দলিল
ثنا بُرَيْهُ بْنُ عُمَرَ بْنِ ‌سَفِينَةَ، عَنْ جَدِّهِ قَالَ: احْتَجَمَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم ثُمَّ قَالَ لِي: ” خُذْ هَذَا ‌الدَّمَ فَادْفِنْهُ مِنَ الدَّوَابِّ وَالطَّيْرِ “، أَوْ قَالَ: النَّاسِ وَالدَّوَابِّ شَكَّ ابْنُ أَبِىْ فُدَيْكٍ قَالَ: فَتَغَيَّبْتُ بِه، فَشَرِبْتَه قَالَ: ثُمَّ سَأَلَنِي، فَأَخْبَرْتُه أَنِّىْ شَرِبْتُه فَضَحِكَ ”
‘অর্থাৎ হযরত সফিনা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্কে হিজামত করার পর তিনি আমাকে বলেছিলেন, তুমি এ রক্ত মোবারক নিয়ে পশু পাখি ও মানুষ থেকে গোপন করে রেখো। আমি এগুলো গোপন করে পান করে নিলাম। পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আমি বলেছি যে, এগুলো আমি পান করে নিয়েছি। এ কথা শুনে তিনি হেসে ফেললেন।’
এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত আরো বহু হাদীস শরীফ রয়েছে। এ ব্যাপারে ইবনু হাজর আসকালানি বলেন,
ﻗﺪ ﺗﻜﺎﺛﺮﺕ ﺍﻻﺩﻟﺔ ﻋﻠﻰ ﻃﻬﺎﺭﺓ ﻓﻀﻼﺗﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻭﻋﺪ ﺍﻻﺋﻤﺔ ﺫﻟﻚ ﻓﻰ ﺧﺼﺎﺋﺼﻪ.
‘অর্থাৎ শাইখুল ইসলাম ইবনু হজর আসকালানি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ফুদ্বলাত তথা দেহ মোবারক থেকে নির্গত অতিরিক্ত যাবতীয় বস্তু পবিত্র হওয়ার উপর অসংখ্য দলিল-আদিল্লাহ বিদ্যমান রয়েছে এবং ইমামগণ এসব বিষয়কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বৈশিষ্ট্যের মধ্যে গণ্য করেছেন।’ এসব হাদীস শরীফ উল্লেখ করার পর ইমাম কাস্তালানি বলেন, وفي هذه الأحاديث دلالة على طهارة بوله ودمه صلى الله عليه وسلم ‘ এসব হাদীস শরীফ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পেশাব ও রক্ত মোবারক পাক হওয়াকে প্রমাণ করে।’

পঞ্চম দলিল
عَنْ عَائِشَةَ رضي الله عنها: أَنَّهَا قَالَتْ لِلنَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم: إِنَّكَ تَأْتِي الْخَلَاءَ فَلَا نَرَى مِنْكَ شَيْئًا من الأذى، فقال: يا عائشة، أو ما عَلِمْتِ أَنَّ الْأَرْضَ تَبْتَلِعُ مَا يَخْرُجُ مِنَ الْأَنْبِيَاءِ، فَلَا يُرٰى مِنْهُ شَيْءٌ.
‘অর্থাৎ হযরত আয়িশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা রাসূলুল্লাহ এর খেদমতে আরজ করলেন, আপনি তো শৌচাগারে গিয়ে ফিরে আসেন; কিন্তু আমরা তো সেখানে কিছুই দেখতে পাই না। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন, হে আয়িশা! তুমি কি জান না আম্বিয়ায়ে কিরাম থেকে যা কিছু নির্গত হয়, তা মাটি গিলে ফেলে। ফলে আর কিছুই দেখা যায় না।’ যদিও এ হাদীস শরীফ সরাসরি প্রমাণ করে না যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর পায়খানা মোবারক পাক; তবে এটির ভাবার্থ থেকে তা বুঝা যায়। কেননা, হযরত আয়িশা সিদ্দিকাসহ অনেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পায়খানা মোবারক শৌচাগারে খুঁজতে গিয়েছেন এবং সেখানে সুগন্ধি পেয়েছেন। এসব যদি নাপাক হতো, তাহলে তাঁরা খুঁজতে যেতেন না। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে নিষেধও করতেন। মূলত তাঁরা তা থেকে বরকত হাসিলের জন্য গিয়েছেন; কিন্তু পাননি। কাযি আয়াজ বলেন,
وَهَذَا الْخَبَرُ، وَإِنْ لَمْ يَكُنْ مَشْهُورًا فَقَدْ قَالَ قَوْمٌ من أهل العلم بطهارة هذين الْحَدَثَيْنِ مِنْهُ صلى الله عليه وسلم
‘এ হাদীস শরীফখানা যদিও (মুহাদ্দিসগণের নিকট) মাশহুর পর্যায়ের নয়; তদুপরি একদল আলিমের মতে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পেশাব ও পায়খানা মোবারক পাক।’ ইমাম কাস্তালানি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর যাবতীয় ফুদ্বলাত বিশেষ করে পেশাব, পায়খানা ও রক্ত মোবারক পাক হওয়ার জন্য এসব দলিল যথেষ্ট। ইমাম কাযি হোসাইন বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সবকিছুই পাক। ইমাম আইনি বলেন, এটিই ইমাম আবু হানিফার অভিমত। ইমাম বদরুদ্দিন যারকাশি বলেন, সকল নবী-রাসূলের যাবতীয় অতিরিক্ত বস্তু (ফুদ্বলাত) পাক।

দ্বিতীয় অভিমত
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পেশাব, পায়খানা ও রক্ত মোবারক পাক। এটি ইমাম রাফিয়ি, ইমাম নাভাভিসহ নব্য সালাফিদের অভিমত। ইমাম নাভাভি তাঁর ‘আল্ মাজমু শারহুল মুহায্যাব’ গ্রন্থে দু’টি মত উল্লেখ করে এটিকে সংখ্যাগরিষ্ট আলিমের নিকট বিশুদ্ধ অভিমত বলে মত প্রকাশ করেন।
তাঁদের দলিল হলো, রাসূলুল্লাহ পেশাব মোবারক ও পায়খানা মোবারক শেষে ইস্তিঞ্জা করতেন। তিনি এ ক্ষেত্রে পানি, মাটি কিংবা পাথর ব্যবহার করতেন। তিনি কখনো পানি, কখনো পাথর আবার কখনো উভয় একসাথে ব্যবহার করতেন। এ প্রসঙ্গে বহু হাদীস শরীফ রয়েছে। তন্মধ্যে একটি হাদীস শরীফ উল্লেখ করা হলো। যেমন-
عَنْ أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ يَقُولُ: ্রكَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَدْخُلُ الْخَلَاءَ، فَأَحْمِلُ أَنَا وَغُلَامٌ إِدَاوَةً مِنْ مَاءٍ وَعَنَزَةً، ‌يَسْتَنْجِي ‌بِالْمَاءِ.গ্ধ
‘অর্থাৎ আনাস ইবনু মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম শৌচাগারে প্রবেশ করতেন। আমি ও একজন বালক (আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ মতান্তরে হযরত বিলাল কিংবা আবু হুরাইরা রা.) পানির কলস ও বর্শা বহন করতাম। তিনি পানি দিয়ে ইস্তিঞ্জা করতেন।’ তাঁদের মতে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পেশাব ও পায়খানার অপবিত্র থেকে নিজে বেঁচে থাকতেন এবং উম্মতকে বেঁচে থাকার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁদের আরেকটি যুক্তি হলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর এসব ফুদ্বলাত যদি নাপাক না হতো, তাহলে তিনি ইস্তিঞ্জা করতেন না। কারণ পাক বস্তু থেকে বেঁচে থাকার প্রয়োজন নেই। সুতরাং তিনি যেহেতু ইস্তিঞ্জা করতেন, সেহেতু বুঝা যায় যে, এগুলো অন্যদের মতো নাপাক ছিল।

পর্যালোচনা
সাধারণ মানুষের পেশাব, পায়খানা ও রক্ত নাপাক। এতে কারো দ্বিমত নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ফুদ্বলাত মোবারাক তথা পেশাব, পায়খানা ও রক্ত মোবারকও কি সাধারণ মানুষের হবে, নাকি হবে না, তা নিয়ে দু’টি অভিমত আমরা উপরে দেখেছি। উপরিউক্ত দু’টি মতের মধ্যে প্রথম মতটিই আমাদের কাছে বিশুদ্ধ মনে হয়েছে। দলিলে দেখা গেছে যে, কয়েকজন সাহাবী বিশেষ করে উম্মে আইমন ও বারাকাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পেশাব মোবারাক পান করেছেন। এ কথা জেনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে ধমকও দিলেন না, তিরস্কারও করেননি এবং এ ধরণের কাজ ভবিষ্যতে না করার নির্দেশও দেন নি; বরং তাঁদেরকে সুসংবাদ দিয়েছেন। উম্মে আইমনের কথা শুনে তিনি হেসে দিয়ে বলেছেন, তোমার পেটে আর কখনো পীড়া হবে না এবং দেখা গেছে যে, তিনি মৃত্যু রোগ ছাড়া কখনো অসুস্থ হননি। তিনি বারাকাকে বলেছেন, তোমার পেট সুস্থ থাকবে তথা কোনো রোগ হবে না। এগুলো ‘সহিহ’ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। একইভাবে কয়েকজন সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর রক্ত মোবারক পান করেছেন। তিনি তাঁদের কাউকে ধমকও দিলেন না, নিষেধও করেন নি এমনকি মৃদু তিরস্কারও করেন নি; বরং এসবকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। মুহাদ্দিসগণের পরিভাষা মতে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর উপস্থিতিতে কোনো কাজ করা হলে, তা যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিষেধ না করেন, তাহলে এটিকে ‘হাদীসে মারফু-ই তাকরিরি’ বলা হয়। অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ফুদ্বলাত পান করার বৈধতা হাদীসে মারফু’ দ্বারা প্রমাণিত। মনে রাখতে হবে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কোনো নাপাক বস্তু খাওয়ার অনুমতি দেন নি। কুরআন ও অসংখ্য হাদীস শরীফ দ্বারা নাপাক বস্তু খাওয়া ও পান করা হারাম প্রমাণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ফুদ্বলাত যদি নাপাক হতো, তাহলে তিনি অবশ্যই তিরস্কার করতেন এবং ভবিষ্যতে না করার জন্য আদেশ করতেন। সেখানে এর কোনোটিই ঘটেনি।
একইভাবে কয়েকজন সাহাবী রাসূলুল্লাহর রক্ত মোবারক পান করেছেন। তাঁদের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর, হযরত সফিনা, একজন কুরাইশ বালক প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কুরাইশ বালককে বলেছিলেন, إذهب فقد أحرزت نَفسك من النَّار ‘যাও, তুমি নিজেকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করেছো।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর রক্ত পান করে তাঁকে বলার পর তিনি খুশি হয়ে হেসে দিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর রক্ত যদি নাপাক হতো, তাহলে অবশ্যই তাঁদেরকে তিরস্কার করে নিষেধ করতেন এবং অসন্তুষ্ট হতেন; কিন্তু নিষেধের পরিবর্তে তিনি তাঁদেরকে সুসংবাদ দিয়েছেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর রক্ত মোবারক পাক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পেশাব মোবারক ও রক্ত মোবারক সাধারণ মানুষের রক্তের মতো মনে করলে তো হবে না। এগুলো কোনো ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের রক্তের সাথে মিল ছিল না। যেমন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর রক্ত মোবারকের স্বাদ মধুর মতো মিষ্টি এবং রক্তের সুগন্ধি মিশক-আম্বরের মতো। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর তো রাসূলুল্লাহর রক্ত মোবারক পান করেছিলেন। তাঁকে একদা হযরত শাবি জিজ্ঞাসা করেছিলেন,
كيف وجدت طعم الدم فقال أما الطعم فطعم العسل وأما الرائحة فرائحة المسك
‘আপনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর রক্ত মোবারকের স্বাদ কেমন পেয়েছেন? তিনি বলেন, স্বাদ ছিলো মধুর মতো আর সুঘ্রাণ ছিলো মিশক-আম্বরের মতো।’
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর পায়খানা মোবারক পাক হওয়ার বিষয়টি সরাসরি হাদিস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত নয়; বরং উল্লিখিত দলিলের উপর কিয়াস করে আলিমগণ এ মত প্রকাশ করেছেন। তবে হযরত আয়িশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা সহ কয়েকজন সাহাবী রাসূলুল্লাহর শৌচাগারে গিয়ে এগুলো খুঁজেছেন; কিন্তু পাননি। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, নবি-রাসূলের এসব বস্তু মোবারক মাটি সাথে সাথেই গিলে ফেলে। ফলে অন্য কেউ এগুলো পাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। এখানে লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, সাহাবীগণ কর্তৃক এগুলো খোঁজার ব্যাপারটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম জানার পরও তাঁদেরকে তিরস্কারও করেন নি এবং নিষেধও করেননি। এগুলো যদি নাপাক হতো, তাহলে তিনি বলে দিতেন যে, তোমরা এসব থেকে দূরে থেকো। কারণ তিনি উম্মতকে নাপাকি থেকে দূরে থাকার জন্য বহু হাদীস শরীফে ইরশাদ করেছেন। যাঁরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পায়খানা মোবারক খুঁজতে গিয়েছেন, তাঁরা সেখানে মিশক আম্বরের খুশবু ছাড়া আর কিছুই পাননি। এতে বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর এসব বরকতময় বস্তু সাধারণ মানুষের সাথে কোনো ক্ষেত্রে মিল নেই। তাই সাধারণ মানুষের পেশাব, পায়খানা ও রক্ত নাপাক হওয়ার দলিলের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর এসব ফুদ্বলাতকে মিলানো যুক্তিযুক্ত নয়। এজন্য ইবনু হাজর আসলকালানি, মোল্লা আলি ক্বারী, কাযি আয়াজ প্রমুখ বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহর ফুদ্বলাত পাক হওয়ার বিষয়টি তাঁর বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত।
যাঁরা রাসূলুল্লাহর ফুদ্বলাত মোবারককে নাপাক মনে করেন, তাঁদের দলিল হলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হাজত শেষে ইস্তিঞ্জা করতেন। এসব যদি নাপাক না হতো, তাহলে তো ইস্তিঞ্জাও করতেন না এবং নতুন ওজুও করতেন না। তিনি যেহেতু এসব থেকে পবিত্রতা অর্জন করতেন, সেহেতু প্রমাণিত হয় যে, এগুলো নাপাক ছিল। আমাদের মতে, এ যুক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ফুদ্বলাত মোবারক নাপাক হওয়াকে প্রমাণ করে না। কারণ মানুষ তো বহু পবিত্র বস্তুও ধোয়ে ফেলে যেমন কারো গায়ে থুথু, নাকের শ্লেষ্মা, ময়লা-আবর্জনা বা কোনো ময়লার দাগও মানুষ তাদের শরীরে লাগলে তা ধোয়ে ফেলে। এভাবে রাসূলুল্লাহও স্বীয় সমুন্নত মর্যাদা ও ব্যক্তিত্ব রক্ষার্থে এসব থেকে ইস্তিঞ্জা করতেন। এটি রাসূলুল্লাহর জন্য মুস্তাহাব ছিল। এ প্রসঙ্গে ইমাম আলা হযরত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন,
واما النواقض الحقیقیۃ منا فتنقض منھم ایضا صلوات اللّٰہ تعالٰی علیھم وسلامہ علیھم لالانھا نجسۃ کلا بل ھی فــــــ طاھرۃ بل طیبۃ حلال الاکل والشرب لنا من نبینا صلی اللّٰہ تعالٰی علیہ وسلم کما دل علیہ غیر ماحدیث بل لانھا نجاسۃ فی حقہم صلی اللّٰہ تعالٰی علیہم وسلم لرفعۃ مکانھم ونھایۃ نزاھۃ شانھم کما اشرت الیہ فھذا مانختارہ ونرجوا ن یکون صوابا ان شاء اللّٰہ تعالٰی ۔
‘অর্থাৎ যেসব হাকিকি নাপাক (যেমন পেশাব, পায়খানা) বের হওয়ার কারণে আমাদের ওজু ভেঙ্গে যায়, সেসব বস্তু দ্বারা নবী-রাসূলেরও ওযু ভেঙ্গে যায়; তবে তা তাঁদের ফুদ্বলাত নাপাক হওয়ার কারণে নয়। কেননা, এগুলো শুধু পাক ও পবিত্রই নয়; বরং তাঁদের এগুলো খাওয়া ও পান করা আমাদের জন্য হালাল। এ প্রসঙ্গে বহু হাদীস বর্ণিত রয়েছে। তদুপরি এগুলোর কারণে তাঁদের ওজু ভাঙ্গার কারণ হলো, তাঁরা যেহেতু পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার চূড়ান্ত পর্যায়ে অবস্থান করেন এবং তাঁদের মর্যাদা সর্বোচ্চ হওয়ায় তাঁদের ফুদ্বলাত মোবারক তাঁদের নিকট নাপাক হিসেবে বিবেচিত হয় যেভাবে আমি পূর্বেও ইঙ্গিত করেছি। এটাই আমাদের নির্বাচিত অভিমত এবং আমরা আশা রাখি যে, এটিই সঠিক মত ইনশা আল্লাহ।’
যাঁরা ফুদ্বলাত মোবারককে নাপাক মনে করেন, তাঁদের আরেকটি যুক্তি ছিলো যে, এসব যদি নাপাক না হয়, তাহলে তাঁদের ওজু না ভাঙ্গার কথা। যেহেতু এসবের কারণে তাঁদের ওজু ভেঙ্গে যায়, সেহেতু এগুলো নাপাক বলে প্রমাণিত হয়। আমরা মনে করি, এ যুক্তিও সঠিক নয়। কারণ পাক বস্তু বের হওয়ার কারণেও ওজু ভেঙ্গে যায়। যেমন হানাফি, শাফিয়ি ও হাম্বলি মাযহাব মতে, বমি নাপাক। হানাফিদের মতে, মুখভর্তি বমির কারণে ওজু ভেঙ্গে যায়। যাক, সাধারণ মাসআলা হলো বমি নাপাক হওয়া সত্ত্বেও শাফিয়ি ও হাম্বলিদের মতে, ওজু ভাঙ্গে না। তাঁদের এ অভিমত থেকে প্রমাণিত হয় যে, ওজু ভঙ্গের কারণ হওয়ার জন্য নাপাক হওয়া শর্ত নয়।
সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ফুদ্বলাত মোবারক বের হবার কারণে ওজু ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে এসব ফুদ্বলাত মোবারক নাপাক হওয়া প্রমাণিত হয় না। উল্লেখ্য, কোনো কোনো ফকিহ্ এসব ফুদ্বলাত মোবারক তাঁদের জন্য ওজু ভঙ্গের কারণ হিসেবে বিবেচনা করেন না। কিন্তু আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খাঁ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুসহ অধিকাংশ ফকিহ এগুলোকে ওজু ভঙ্গের কারণ হিসেবে বিবেচনা করেছেন; তবে তা নাপাক হওয়ার কারণে নয়; বরং তাঁরা তাঁদের মর্যাদার কারণে এগুলো থেকে ইস্তিঞ্জা করতেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে যাঁরা তাকওয়ার সর্বোচ্চ স্তরে অবস্থান করেন, তাঁরা কোনো মাকরুহ কাজ তো অনেক দূরের কথা; বরং প্রত্যেক অনুত্তম কাজ থেকেও দূরে থাকতেন। মুত্তাকি ব্যক্তির অবস্থা যদি এমন হয়, সেখানে নবী-রাসূলের ব্যাপার অবস্থা কী হবে সহজেই অনুমেয়। আর নবী-রাসূলের মধ্যে আমাদের নবী সাইয়িদুল কাওনাইন এর কী অবস্থান, তা বলারই অপেক্ষা রাখে না। সাধারণ মানুষের বহু বৈধ কাজও মুত্তাকিদের কাছে মন্দ কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়। এদিকে ইঙ্গিত করে সুফিগণ বলেন, حسنات الابرار سيئات المقربين ‘সৎবান্দাদের সৎকর্ম মুর্কারাবিন তথা উঁচু পর্যায়ের মুত্তাকিদের জন্য মন্দকাজ।’ তাই নবী-রাসূলগণ প্রত্যেক বৈধ অনুত্তম কাজ থেকেও দূরে থাকতেন। অতএব দালিলিক পর্যালোচনা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, নবী-রাসূলের বিশেষকরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর যাবতীয় ফুদ্বলাত পাক ও বরকতময়।

টিকা:
ইমাম তাবারানি, আল্ মু’জামুল কবির, খ. ২৫, পৃ. ৮৯।
শাওকানি, নাইলুল আওতার, খ. ১, পৃ. ১১৫।
ইমাম সুয়ুতি, আল্ খাসায়িসুল কুবরাহ, খ. ২, পৃ. ৪৪০।
ইমাম বুখারি, আত্ তারিখুল কবির, (রিয়াদ: আন্ নাশিরুল মুতামাইয়ায লিত্ তাবাআ ওয়ান নাশার, ১ম সং. ১৪৪০হি.), খ. ৫, পৃ. ৩৩৪; ইমাম বাইহাকি, আস্ সুনান আল্ কুবরা, (বৈরুত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ্, ৩য় সং. ১৪২৪হি.), খ. ৭, পৃ. ১০৭; হা.নং- ১৩৪০৮। এ হাদিস শরিফ এর সনদ যদিও দুর্বল; কিন্তু একাধিক সূত্রে বর্ণিত হওয়ায় তা আর দুর্বলের পর্যায়ভুক্ত নয়।
ইবনু হাজর আসকালানি, ফাতহুল বারি, (মিশর: আল্ মাকতাবাতুস্ সালাফিয়্যাহ, ১৩৮০হি.), খ. ১, পৃ. ২৭২।
ইমাম কাস্তালানি, আল্ মাওয়াহিবুল লাদুনিয়্যাহ্, খ. ৫, পৃ. ৫৫১।
তাবারানি, আল্ মু’জামুল আউসাত্ব, (কায়রো: দারুল হারামাইন, তা.বি.), খ. ৮, পৃ. ২১, হা. নং-৭৮৩৫।
মূলত তাঁর নামের শুদ্ধ উচ্চারণ হলো ‘কাদি ইয়াদ’; বুঝার সুবিধার্থে প্রচলিত বানানটি ব্যবহার করা হয়েছে।
কাযি ইয়াজ, আবুল ফদল ইবনু মুসা, আশ্ শিফা, (আম্মান: দারুল ফাইহা, ২য় সং, ১৪০৭হি.), খ. ১, পৃ. ১৫৫।
ইমাম কাস্তালানি, প্রাগুক্ত, খ. ৫, পৃ. ৫৫২।
প্রাগুক্ত; ইবনু আবিদিন আশ্ শামি, মুহাম্মদ আমিন, রাদ্দুল মুহতার, (মিশর: মুস্তাফা আল্ বাবি, ২য় সং. ১৩৮৬হি.), খ. ১, পৃ. ৩১৮।
ইমাম যুরকানি, মুহাম্মদ ইবনু আবদিল বাকি, শারহুয্ যুরকানি আলাল মাওআহিবিল লাদুনিয়্যাহ্, (বৈরুত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ্, ১ম সং. ১৪১৭হি.), খ. ৫, পৃ. ৫৫৩।
ইমাম নাভাভি, আবু যাকারিয়া মুহিউদ্দিন ইবন শারাফ, আল্ মাজমু শারহুল মুহাযযাব,(কায়রো: দারু ইদারাতুত্ তাবাআ আল্ মুনিরিয়্যাহ্, ১৩৪৪হি.), খ. ১, পৃ. ৬৩৪।
ইমাম বুখারি, মুহাম্মদ ইবনু ইসমাইল, আল্ জামিউ আস্ সহিহ্,(মিশর: আল্ মাতবাআতুল কুবরা আল্ আমিরিয়্যাহ্, ১৩১১হি.), খ. ১, পৃ. ৪২; হা. নং- ১৫২।
মুল্লা আলি কারি, শারহুশ শিফা, (বৈরুত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ্, ১ম সং. ১৪২১হি.), খ. ১, পৃ. ১৭০।
নাভাভি, আল মাজমু, প্রাগুক্ত, খ. ১, পৃ. ২৩৪।
আলা হযরতত ইমাম আহমদ রেযা, আল্ ফাতাওয়া র্আ রিযভিয়্যাহ্, খ. ১, পৃ. ১২২।
হানাফিদের মতে, মুখভর্তি বমি নাপাক আর কম বমি পাক।
আল্ মাওসুআতুল ফিকহিয়্যাহ্ আল্ কুয়াইতিয়্যাহ, (মিশর: মাতাবিয়ু দারিস্ সাফওয়া, ১ম সং.), খ. ৩৪, পৃ. ৭৮। সকল সাধারণ গ্রন্থাদি।

লেখক: প্রভাষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।