আজাদী আন্দোলনের কিংবদন্তী আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদী

আজাদী আন্দোলনের কিংবদন্তী আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদী

ইমরান হুসাইন তুষার>

ইংরেজরা যখন এ দেশে আগমন করে তখন দিল্লির মসনদে সম্রাট আকবর। তিনি পর্তুগিজ,আরব বণিকদের পাশাপাশি ইংরেজদেরও এ দেশে বাণিজ্য করার সুযোগ দেন। ১৬১৭ সালে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গির ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভারতে বাণিজ্যের অনুমতি দান করেন। নবম মুঘল সম্রাট ফারুক শিয়র ১৭১৭ সালে একটি ফরমানের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে শুল্ক ছাড়া বাংলায় বাণিজ্য করার অনুমতি দেন। কিন্তু মুঘল বাংলা প্রদেশের প্রকৃত শাসনকর্তা নবাব সিরাজদ্দৌলা তাদের এই পারমিট ব্যবহারে বাধা দেন। ফলশ্রুতিতে মীর জাফর, রায়দুর্লভ, ঘষেটি বেগমের মতো বিশ্বাসঘাতকদের দুরভিসন্ধির ফলে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে তিন হাজার ইংরেজ সৈন্যের হাতে নবাব সিরাজুদ্দৌলার পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের পরাজয় ঘটে। ১৭৬৪ সালে মুঘল সম্রাট, আওধের নবাব এবং বাংলা ও বিহারের নবাবের সম্মিলিত শক্তি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত হয়। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় মুঘল নিজামত বিলুপ্ত করে। এর ফলে কোম্পানির নিয়মতান্ত্রিক শাসনের সূত্রপাত ঘটে। এক শতাব্দীকালের মধ্যেই তারা ভারত থেকে মুঘল সাম্রাজ্য সম্পূর্ণ অবলুপ্ত করে দেশে নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপন করে। ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের পর দ্বিতীয় আকবর শাহ ব্রিটিশ পেনশনভোগী হয়ে পড়েন। ব্রিটিশ নিরাপত্তায় তিনি আনুষ্ঠানিক প্রধান ছিলেন। ১৮৫০-এর দশকের মধ্যেই বর্তমান ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সহ ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলেই ব্রিটিশরা নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। তাদের নীতি ছিল ‘বিভাজন ও শাসন’। বিভিন্ন দেশীয় রাজ্য, সামাজিক ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পারস্পরিক কলহের সুযোগ নিয়ে তারা তাদের অধিকার রক্ষায় সক্ষম হয়। ব্রিটিশ শাসনকালে ভ্রান্ত সরকারি নীতির কারণে একাধিক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ১৭৫৭ সালে শতাব্দীকালের ব্রিটিশ গোলামির যে জিঞ্জির পরেছিল ভারতবাসী, সেই গোলামির শিকল ভেঙ্গে আজাদীর স্বাদ দিতে বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ জেগে উঠেছিল ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে। আজাদী আন্দোলন ও স্বাধীন ভারত চেতনার দাবানলে ভস্মিত হয় দু’শত বছরের গোলামীর জিঞ্জির। আর তাই ১৮৫৭’র মহাবিদ্রোহকেই সকল ইতিহাসবেত্তা প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে উল্লেখ করেন। এই পুনর্জাগরণ কাদের চিন্তার ফসল ছিল? সকলেই না বললেও কেউ কেউ ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদী, শহিদ আল্লামা কেফায়েত উল্লাহ কাফি রহমাতুল্লাহি আলায়হি’র নাম নিঃসঙ্কোচেই নিয়েছেন। উপমহাদেশের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী ইংরেজ রাজ-শক্তির বিরুদ্ধে তাঁরাই প্রকাশ্যে রুখে দাঁড়ান।

ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদী
আজাদী আন্দোলনের এই কিংবদন্তী আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদী ছিলেন মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলিফা সাইয়্যেদুনা উমর বিন খাত্তাবের ৩২তম বংশধর। তিনি ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে ১২১২ হিজরিতে উত্তর প্রদেশের সিতাপুরের খায়রাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আল্লামা ফজলুল ইমাম খায়রাবাদী ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন সুপরিচিত আলিম। তিনি দিল্লির দরসে নিজামিয়া নামে প্রসিদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় তাত্ত্বিক ও দার্শনিক দিকগুলোর উপর জোর দিয়ে পাঠ্যক্রম সংশোধনে সহায়ক ভূমিকা রাখেন। তাঁর লেখা বই আল-মিরকাত, যা অন্তর্ভুক্ত করা হয় মালাবারে প্রচলিত মাখদুমি পাঠ্যসূচিতেও। এছাড়াও আল্লামা ফজলুল ইমাম খায়রাবাদী সর্বপ্রথম দিল্লি প্রদেশের সর্বোচ্চ পদবী ছদরুস সুদুর লাভ করেন। তিনি ১৮২৭ সাল পর্যন্ত এ পদেই দায়িত্ব পালন করেন। আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদী রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর দ্বিতীয় পুত্র। ফজলে হক খায়রাবাদী মাত্র ২৮ বছর বয়সে পিতার স্থলাভিষিক্ত হন।

শিক্ষাজীবনের তিনি আরবি সাহিত্য এবং ইসলামী আইনশাস্ত্রের ব্যুৎপত্তি অজর্ন করেন। তিনি শিক্ষাগুরু হিসেবে নিজ পিতা আল্লামা ফজলুল ইমাম খায়রাবাদী, দিল্লির শাহ আবদুল কাদির মুহাদ্দিস দেহলভি এবং শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দিস দেহলভি রহিমাহুমুল্লাহর দরসে শামিল হন। তিনি এসময়ে শাহ আব্দুল কাদির দেহলভির হাদিস শাস্ত্রে, শাহ আব্দুল আজিজ দেহলভি হতে হানাফি ফিকহ এবং হজরত হাফিয মুহাম্মাদ আলী রহিমাহুল্লাহর নিকট হতে মাত্র সাড়ে চার মাসে পবিত্র কুরআন মুখস্থ করেন। তুহফাতু ইসনা আশারিয়াহ শাহ আব্দুল আজিজ দেহলভির লিখিত কিতাব। যেখানে শিয়াদের একটি দল ইসনা আশারিয়ার সমালোচনা করা হয়। তৎকালীন ইরানী শিয়াদের মধ্যে এ কিতাব ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। তাই শিয়া নেতা মীর বাকিরের অনুরাগীরা উক্ত কিতাব সম্পর্কে শাহ আব্দুল আজিজ দেহলভীর সাথে বিতর্কের জন্য দিল্লিতে আসেন। পথিমধ্যে তারা আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদীর সাক্ষাৎ পান, তিনি তখনও দেহলভির দরসের একজন ছাত্র। আল্লামা ফজলে হক শিয়া নেতা মীর বাকির রচিত উফকুল মুবিন বইয়ে শিষ্টাচার বহির্ভূত ভুল লেখনীর যথাযথ কাউন্টার দেন। আল্লামার সামনে শিয়ারা অস্বস্তিতে পড়ে যায় এবং উত্থাপিত আপত্তির জবাব দিতে ব্যর্থ হয়। যেহেতু তারা শাহ আব্দুল আজিজ দেহলভির একজন শিষ্যের মোকাবিলায় বিজয়ী হতে পারেনি, তাই তারা আব্দুল আজিজ দেহলভির লিখিত কিতাব সম্পর্কে আলোচনা না করেই পালিয়ে যায়।

বৃটিশ সরকারের প্রশাসনে ব্যাপক প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তার এবং মুসলমানদের সামাজিক অবস্থানকে সুসংহত রাখতে শাহ আবদুল আজিজ দেহলভি নিজেই তাঁর জামাতা মৌলভি আবদুল হাই বাদায়ুনিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে একটি প্রশাসনিক পদের জন্য পরামর্শ দেন। আল্লামা খায়েরাবাদী রহমাতুল্লাহি আলায়হি ১৮১৬ সালে মাত্র উনিশ বছর বয়সে তাঁর পিতার নির্দেশে প্রথম স্যার রিশতাদার পদে অধিষ্ঠিত হন। স্যার রিশতাদার দিল্লি সিভিল কোর্ট প্রধানের পদ। ১৮২৭ সালে তিনি সরকারি পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৮৩২ সালে জাজ্জারের নবাব ফয়েজ হোসেন খানের সাথে তার প্রাসাদে চলে যান। জাজ্জার প্রাসাদে আল্লামা খায়েরাবাদীর দরস জমে উঠে মহাসমারোহে। ১৮৩৫ সালে নবাব ফয়েজ হোসেন খানের মৃত্যুর পর তিনি সাহারানপুর, আলওয়ার, টোনাকে চলে যান এবং সেখানে তাঁর দরস অব্যাহত রাখেন। ১৮৪০ সালে মুহাম্মদ সাঈদ খানের শাসনামলে আল্লামা তাঁর আমন্ত্রণে রামপুর আসেন। তারপর আউধা রাজবংশের শেষ শাসক ওয়াজিদ আলী শাহ লখনৌর দায়িত্ব গ্রহণের পর তাঁর বিশেষ আমন্ত্রণে রামপুর থেকে লখনৌ ফিরে আসেন। সেখানে ওয়াজিদ আলী শাহ আল্লামাকে আউধা রাজ্যের সর্বোচ্চ পদ কিচেহরি হুসুরে তাহসিল এবং আউধা রাজ্যের ছদরুস সুদুর পদে নিযুক্ত করেন। রাজ্যের সরকারি দায়িত্বের পাশাপাশি তিনি দরসও প্রদান করতেন। পরবর্তীতে ১৮৫৬ সালে ব্রিটিশরা আউধা দখল করলে আল্লামা দায়িত্ব হতে পদত্যাগ করেন। পরে তিনি আলওয়ারে ফিরে আসেন, যার অধিপতি ছিলেন রাজা বিনয় সিংহ। আল্লামা সেখানে দেড় বছর দায়িত্ব পালন করেন।

কর্মজীবনে মাত্র তেরো বছর বয়সে সব পাঠ সমাপ্ত। সমগ্র উস্তাদের অনুমতিতে তিনি মৃত্যুদ-ের রায় প্রদান ও কার্যকর এর মতো উচ্চ পর্যায়ের পদে উন্নীত হন। কৈশোরের সূচনায় শিক্ষকতা পেশায় আল্লামার অভিষেক ঘটে। ১৮১০ থেকে ১৮৫৭ সাল। পাঁচ দশকের একটি উল্লেখযোগ্য সময় ব্যয় করেছেন ইলমের খেদমতে। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আল্লামার দরসে ছাত্রদের আগমন হতো। আল্লামার শিষ্যদের সংখ্যা এত বিশাল ছিল যে সংখ্যায় বলা মুশকিল। তিনি ভারত বর্ষের যে প্রান্তেই গিয়েছেন, সেখানে ইলমে দ্বীনের খেদমতে আত্মনিয়োগ করেছেন। দিল্লি, জাজ্জার, আলওয়ার, সাহারানপুর, রামপুর, টোনাক, লক্ষেèৗ এবং খয়রাবাদ থেকে প্রচুর সংখ্যক ছাত্র আল্লামার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিল। জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় আল্লামা ফজলে হকের প্রধান চার শিষ্যকে আন্তর্জাতিক স্কলারগণ ঋড়ঁৎ ঈষধংংরপধষ ঊষবসবহঃং-চারটি শাস্ত্রীয় উপাদান উপাধিতে ভূষিত করেন। ১. শামসুল উলামা আল্লামা আব্দুল হক বিন ফজলে হক খায়রাবাদী রহিমাহুল্লাহ- মানতিক ও দার্শনিক বিষয়। ২. মাওলানা ফয়সুল হক সাহারানপুরী রহিমাহুল্লাহ- আরবি সাহিত্যের কবিতা (তাফসিরুল জালালাইন, তাফসিরুল বাইযাভি, মিশকাতুল মাসাবিহ এবং বিভিন্ন দারসি কিতাবের শরাহ রচনা যেমন- হুমাসা, সাবয়া’ মুয়াল্লাকা ইত্যাদি)। ৩. মাওলানা হিদায়াতুল্লাহ খান জৌনপুরী- তাফসির, হাদিস,ফিকহ। ৪. আশিকে রসুল মাওলানা আব্দুল কাদির উসমানি বাদায়ুনি রহিমাহুল্লাহ। রচিত গ্রন্থ- সাইফুল ইসলামিল মাসলুল আলাল মান্নায়ি লি আমালিল মাউলিদ ওয়াল ক্বিয়াম, আহসানুল কালাম ফি তাহকিকি আকাইদিল ইসলাম। এছাড়াও ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক শিষ্য এখানে সম্মিলিত হয়েছিল। তৎকালীন প্রধান শিষ্যদের মধ্যে রয়েছেন পুত্র আবদুল হক খায়রাবাদী, তাঁর কন্যা সাইদুন্নিসা হিরমানি, মাওলানা হিদায়াতুল্লাহ জৈনপুরী, নবাবের সন্তান ইউসুফ আলী খান, কাসিম আলী খান, মাওলানা আবদুল আলী খান, মাওলানা হিদায়াত আলী, দিল্লিতে হাকিম ইমামুদ্দিন দেহলভি, মাওলানা নুরুল হাসান কান্দালভি, হাকিম মাওলানা কালান্দার আলী জুবাইরি পানিপতি এবং মোল্লা ফতহুদ্দিন লাহোরি এবং সাহারানপুরে মাওলানা আবদুল কাদির উসমানী বাদায়ুনী, মাওলানা নূর আহমদ উসমানী বাদায়ুনী, মাওলানা সৈয়দ আবদুল্লাহ বালগ্রামী, মাওলানা আবদুল হক কানপুরী’র নাম উল্লেখযোগ্য।

পারিবারিক জীবনে আল্লামা ফজলে হক খায়েরাবাদী রহমাতুল্লাহি আলায়হি দুই স্ত্রীর মধ্যে; প্রথম স্ত্রী ছিলেন সৈয়দ ফজল আহমদ বিন হাসান মিয়া খায়রাবাদীর কন্যা সাইয়্যিদাহ ওয়াজরিন বিবি। তিন কন্যা ও এক পুত্র শামসুল উলামা আল্লামা আব্দুল হক খায়রাবাদীসহ এ পরিবারে আল্লামার চারজন সন্তান ছিল। বিবি সাইদুননিসা হিরমানি ছিলেন জ্যেষ্ঠ কন্যা। তিনি পিতার ন্যায় অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং জ্ঞানী ছিলেন। তিনি বিখ্যাত উর্দু কবি সৈয়দ আহমদ হুসেন রুজওয়ার স্ত্রীও ছিলেন। তাদের দুই পুত্র- সৈয়দ বিসমিল খায়রাবাদী এবং সৈয়দ মুস্তওয়ার খায়রাবাদী, যারা বিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত উর্দু কবি ছিলেন। আল্লামা ফজলে হক খারাবাদির অন্য দুই কন্যা ছিলেন সৈয়দাতু নাজমুন্নিসা এবং সৈয়দাতু মাখমুর নিসা। আল্লামার পরবর্তী স্ত্রী ছিলেন ইমরু বেগম। এ সংসারে তাঁদের দুই ছেলে- মাওলানা শামসুল হক ও মাওলানা আলাউল হক। জেষ্ঠ্যপুত্র শামসুল উলামা আব্দুল হক খায়রাবাদী রহমাতুল্লাহি আলায়হি পিতার ন্যায় ইলমে দ্বীনের খেদমতে আত্মনিয়োগ করেন। মাদরাসাতুল খায়রাবাদী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পিতার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজনন ক্ষেত্রকে সক্রিয় করেছিলেন। তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে শামিল হন। এছাড়াও তিনি শিক্ষকতার পাশাপশি আরবি ও উর্দু ভাষায় চল্লিশের অধিক কিতাব রচনা করেন। মানতিক শাস্ত্রের বিখ্যাত কিতাব মিরকাত এর ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ শরহে শামসুল উলামা, শরহু মুসাল্লামুস সুবূত, শরহু হাশিয়াতু জাহিদিয়্যাহ এবং সারুহ সালাসিল কালাম তার মধ্যে অন্যতম। ভারত ও পাকিস্তান জুড়ে বিস্তৃত ছিল আল্লামা ফজলে হক খায়েরাবাদী রহমাতুল্লাহি আলায়হি’র বংশধারা। তাঁর প্রপৌত্র মুহাম্মদ নুরুল হক বর্তমানে সিতাপুর জেলায় বসবাস করছেন। তিনি এখন বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

আল্লামা ফজলে হক খায়েরাবাদী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় চার হাজারেরও অধিক কিতাব রচনা করেন। সিপাহী বিদ্রোহের সময় বৃটিশরা আল্লামা খায়েরাবাদী রহমাতুল্লাহি আলায়হি’র ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ধ্বংস করে দেয়। তবে বিভিন্ন গবেষকদের অনুসন্ধানে ১৭টি গ্রন্থের অস্তিত খুঁজে পাওয়া যায়। সেগুলো হল : ১. তাহক্বীক্ব আল ফাওয়া ফী ইতাল আল ত্বাওয়া, ২. তাহক্বীকু হাক্বীক্বাত আল আজসাম, ৩. আল রাওদ্ধ আল মাওজুদ ফী তাহক্বীক্ব হাক্বীক্বাত আল ওয়াজুদ, ৪. শরহু তাহযীব আল কালাম, ৫. আল হাদীয়া আল সাঈদীয়া, ৬. আল-জিনস আল গালী ফী শরহি আল জাওহার আল আলী, ৭. ইমতিনা’ আল নযীর, ৮.ক্বাসায়ীদ-ই ফিৎনাহ্ আল হিন্দ, ৯. মাজমূ’আহ্ আল ক্বাসায়ীদ, ১০. রিসালাহ্ তাহক্বীক আল ইলম ওয়াল মা’লূম, ১১. রিসালাহ্ ফীল ইলাহিয়্যাত, ১২. রিসালাহ কুল্লী ত্বাবাঈ, ১৩. রিসালাহ্ তাশকীক মাহিয়্যাত, ১৪. রিসালাহ মাবহাছ কাযীগুরিয়াস, ১৫.হাশীয়াহ্ উফুক আল মুবীন, ১৬. হাশীয়াহ্ তালখীছ আল শিফা ও ১৭. হাশীয়াহ্ ক্বাযী মুবারক। এছাড়াও তিনি আল্লামা প্রায় ৪০০০ লাইন কবিতা (কাসিদা) রচনা করেন। যার অধিকাংশই রাসুলুল্লাহ ﷺ এর প্রশংসা। আরবি বর্ণমালার বিভিন্ন অক্ষর দিয়ে শেষ হওয়া তাঁর সমস্ত কাসিদার সমাপ্তি রহমাতুল্লিল আলামিন নবীর প্রশংসার মাধ্যমে হয়েছে। আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদী তাঁর অনন্য সাহিত্য প্রতিভা দিয়ে প্রিয় রসুলুল্লাহ ﷺ এর শানে অসংখ্য নাত রচনা করেন। তাঁকে এ জন্যই তিনি হাসসানুল হিন্দ (হিন্দুস্তানের হাসান বিন সাবিত) নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। এছাড়াও উর্দূ সাহিত্যের অমর কাব্যগ্রন্থ ‘দীওয়ানে-গালিব’ এর পা-ুলিপি পরিমার্জিত ও সংশোধন করে সর্বাঙ্গসুন্দর দীওয়ানে রুপান্তরিত করার জন্য মির্জা গালিব আল্লামা খায়রাবাদীর এই পরিশ্রমকে উচ্ছাসিত ভাষায় স্বীকার করেছেন।

১৮৫৭’র মহাবিদ্রোহের দামামা ও ফজলে হক খায়েরাবাদী’র ঐতিহাসিক ফতোয়া
১৮৫৭ সালের ১০ মে, মিরাট থেকে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের শিঙা বাজে। আল্লামা ফজলে হক খায়েরাবাদী আলভার থেকে দিল্লি পৌঁছেন। দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেক ব্যাটালিয়ন দিল্লিতে আসতে থাকে। অবশেষে জেনারেল বখত খানের নেতৃত্বে দিল্লিতে সকল ফৌজ একত্রিত হয়। সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত যোদ্ধাদের সাহস ও শক্তির আল্লামা খায়েরাবাদী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বৃটিশ রাজের বিরুদ্ধে জিহাদকে ফরজ বলে ঘোষণা করেন। জুমার পর আল্লামা খায়েরাবাদী তাঁর ঐতিহাসিক খুতবায় জিহাদের অপরিহার্যতা তুলে ধরেন। মুফতি সদরুদ্দিন খান আসরদ, কাজী ফয়লুল্লাহ দেহলভি, মাওলানা ফয়েজ আহমদ বদায়ুনি রহিমাহুমুল্লাহসহ অনেক প্রখ্যাত উলামা এই ফতোয়ার প্রতি সমর্থন জানান। ২৬ জুলাই ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ দিল্লির পত্রিকা সাদিকুল আখবার এবং তার পূর্বে আখবারে জাফর পত্রিকাতেও ফতোয়াটি ছাপানো হয়েছিলো।

আল্লামা খায়েরাবাদীর ফতোয়া মুসলিম জনগণের উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। তারই সূত্র ধরে ১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহের দামামা বেজে উঠে। বিদ্রোহের দাবানল ভারতের অনেকটা অংশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। তারই ফলশ্রুতিতে বাহাদুর শাহ জাফর আশি বছর বয়সে ক্ষমতা ফিরে পান। আবার লালকেল্লা ভারতীয়দের প্রশাসনিক রাজধানী হয়ে ওঠে। আল্লামা খায়েরাবাদী ভারত শাসনের জন্য একটি সংবিধান রচনা করেন এবং বাহাদুর শাহ জাফরের হাতে তুলে দেন। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! মাত্র চার মাসের মাথা ব্রিটিশরা দিল্লি পুরোপুরি দখল করে নিতে সক্ষম হয়। বাহাদুর শাহ জাফরকে উৎখাত করে ব্রিটিশরা দিল্লির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয়। এভাবে শুরু হয় বিদ্বেষ ও নিপীড়নের দিন। কঠোর বর্বরতার সেই অন্ধকার দিনগুলি পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বেদনা অধ্যায়ের হয়ে ওঠে। ক্ষুধার্ত সিংহ হরিণ বা ছাগলকে যেভাবে শিকার করে ব্রিটিশরা ভারতীয় মুসলমানদের সাথে এমন আচরণ করেছিল। তাদের সামনে ধরা পড়া সব যোদ্ধা নিহত হয়। তারা মসজিদ, মাদ্রাসা ও কুরআন ধ্বংস করে দেয়। বিপুল সংখ্যক উলামাকে তারা হত্যা করে। এমনি সব তিক্ত অভিজ্ঞতা ও বেদনার বর্ণনা দিয়ে আল্লামা আন্দামানে নির্বাসনের পর আরবী ভাষায় কাঠ কয়লা দিয়ে কাফনের কাপড়ে লিখেন “আস সউরাতুল হিন্দিয়া”। লেখা শেষ করে আল্লামা বইটি মৌলভী ইনায়েত আহমদ কাকূরীকে দেন তাঁর বড় ছেলেকে পৌছে দিতে। তিনিও আন্দামানে নির্বাসিত হয়েছিলেন। মুক্তির পর তিনি আল্লামা আব্দুল হক খায়রাবাদীর কাছে তা পৌঁছে দেন। যা পরবর্তীতে উর্দুতে বাগে হিন্দুস্তানি নামে অনূদিত হয়। বইটি ভারত ও পাকিস্তানে একাধিকবার মূদ্রিত হয়েছে। আজাদী আন্দোলন-১৮৫৭ নামে মাওলানা মহিউদ্দিন খান বাংলায় অনুবাদ করেন। যা বাংলাদেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও মদিনা পাবলিকেশন হতেও প্রকাশিত হয়। এছাড়াও ডক্টর সাইদ মুইনুল হক ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন The Story of great war of independence 1857 ১৮৫৭’ এবং করাচি হতে প্রকাশিত হয়। আর এটাই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত।

গ্রেফতারকৃত সিপাহীদের মৃত দেহ দীর্ঘ দিন ঝুলিয়ে রাখা হয় উন্মুক্ত স্থানে। বাহাদুর শাহ জাফরকে বন্দী করা হয়। আত্মগোপনে চলে যান। তিনি পুরো সময় জুড়ে বিদ্রোহীদের উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। সারা ভারত জুড়ে তাঁর অনেক ছাত্র ছিল যারা পরবর্তীতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করে। তন্মধ্যে খাইরুদ্দিন দেহলভী (আবুল কালাম আজাদের পিতা), মোহাম্মদ হাদি দেহলভি, সাদুল্লাহ মোরাদাবাদী, ফয়জুল হাসান সাহারানপুরী, ইউসুফ আলী খান (রামপুরের নবাব), নবাব জিয়াউদ্দিন খান নায়ার, নবাব মোস্তফা খান শাইফতা, সামিউল্লাহ দেহলভি, ফকির মোহাম্মদ জাহলামীর নাম ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য। অবশেষে ১৮৫৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন এফএভি টারবান আল্লামা খায়েরাবাদীকে গ্রেফতার করেন। সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে নির্বাসিত করা হয় মিয়ানমারের রেগুনে। শুরু হয় ফজলে হক খায়েরাবাদীর বিচার কার্য। বিচারক তাঁর ফতোয়া প্রত্যাহার করার জন্য পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি তাতে অসম্মতি প্রকাশ করেন। দৃঢ়চিত্তে স্বীকার করে নেন, দিল্লির মসজিদে ব্রিটিশ বিরোধী জিহাদের ফতোয়া তিনিই দিয়েছেন। বিচারক তাঁকে আন্দামানে সেলুলার জেলে নির্বাসনের শাস্তি প্রদান করে। ১৮৫৯ সালের ৮অক্টোবর কলকাতা হতে জাহাজে করে নিয়ে যাওয়া হয় আন্দারমানে। শুরু হয় অবর্ণনীয় নির্যাতন। সাধারণ কয়েদীদের মতই ময়লাযুক্ত খাবার, ছেঁড়া পোষাক আর নোংড়া থাকা জায়গা ছিল তাঁর জন্য। অমানুষিক পরিশ্রমের কাজ ছিল তার প্রতিদিনকার দায়িত্ব। আন্দামানের তদানীন্তন ডেপুটি জেলার প্রাচ্য জ্ঞান বিজ্ঞানের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। বিশেষতঃ উপমহাদেশের জ্যাতির্বিদ্যা সম্পর্কে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। জেলার সাহেবের কাছে জ্যাতির্বিদ্যা সম্পর্কিত ‘তাকবীমুল বুলদান’ নামে একটা পুরাতন ফারসী পা-ুলিপি ছিল। এই পুস্তকটির পাঠোদ্ধারের জন্য তিনি সেটিকে জনৈক শিক্ষিত কয়েদীর হাতে সমর্পণ করেন। সেই কয়েদী আল্লামা খায়রাবাদীকে দেন পুস্তকটি। তিনি প্রয়োজনীয় টীকা ব্যাখ্যা সংযোজন করেন। জেলার সাহেব এতে আল্লামা খায়রাবাদীর বিশেষ অনুরক্ত হয়ে পড়েন। গুণগ্রাহী ইংরেজ জেলার তাঁর মুক্তির জন্যও বিশেষভাবে সরকারের নিকট সুপারিশ করেছিলেন। তিনি তাতে আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদীর কোন ভ্রুক্ষেপ ছিল না। দেশে বিশিষ্টজন, আল্লামা খায়েরাবাদীর অগণিত ভক্ত-অনুরক্তের প্রচেষ্টায় ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে বৃটিশ সরকার তাঁর মুক্তির আদেশ দেন। শামসুল হক খায়রাবাদী পিতার মুক্তি আদেশ নিয়ে আন্দামান পৌঁছে জানতে পারেন আল্লামা খায়রাবাদী রহমাতুল্লাহি আলায়হি’র ইন্তোকালে সংবাদ। তিনি জনাকীর্ণ জানাযার নামাজের পর আন্দামানেই দাফন করে দেশে ফিরে আসেন।

আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদী ইতিহাসের এক মজলুম অধ্যায়
এই আজাদী আন্দোলনের বীজকে নির্মূল করার জন্য ব্রিটিশ রাজ অবর্ণনীয় নির্মম নির্যাতনের যে ইতিহাসের সূত্রপাত ঘটায়। তাতে ইমামে আহলে সুন্নাত ফজলে হক খায়রাবাদীর নির্বাসন; কেফায়েত উল্লাহ কাফিকে ফাঁসিতে ঝুলানো; দিল্লির চাঁদনি চকে আল্লামা আহমদুল্লাহ শাহ মাদরাসি’র কাটা মাথা ঝুলিয়ে রাখা হয়। ফতোয়ায় দস্তখত করায় আল্লামা সদরুদ্দিন খান আজুরদা দেহলভি সম্পত্তির একটি বড় অংশ বাজেয়াপ্ত করা হয়। তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত প্রায় তিন লক্ষ কিতাব ধ্বংস করে দেয় হয়। অগণিত সুন্নি উলামায়ে কেরাম নির্মম নির্যাতনের শিকার হন। অথচ এসব আজ ইতিহাসের এক ধামাচাপা অধ্যায়। আল্লামা রেজা আলি খান বেরলভী রহমাতুল্লাহি আলায়হি’র মত কত বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের মুজাহিদদের নাম ইতিহাসে অনুপস্থিত। অনেক ইতিহাসবেত্তাই আজাদী আন্দোলনের ইতিহাসে এই বীরদের নাম উল্লেখ করতে কার্পণ্য প্রদর্শন করেন। বিশেষ করে আল্লামা খায়রাবাদীকে এক্ষেত্রে সবচেয়ে মজলুম বলা যায়। সেখানে অনেকটাই ধর্মীয় এবং মতাদর্শগত পক্ষপাতিত্ব সুস্পষ্ট। পুরো আজাদী আন্দোলনকে কেবল স্ব-ধর্মীয় অনুগামীদের অবদান বলে পরিচিত করানোর হীনমন্যতা। ইতিহাসবেত্তাদের এই পক্ষপাত মূলক আচরণের পিছনে বেশ কয়েকটি কারণ থাকতে পারে।

প্রথমত: ভারত বর্ষে আরবের ভ্রান্ত খারেজি সম্প্রদায়ের ইবনে আবদুল ওয়াহাব নজদির ঈমান বিধ্বংসী আত তাওহিদ-এর আদলে ১৮২৫ সালে ইসমাইল দেহলভি তাকবিয়্যাতুল ঈমান নামে ভ্রান্ত কিতাবের খ-ন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভির নাতি হওয়ায় তৎকালীন অনেক আলেম ইসমাইল দেহলভির বিরোধিতা করেননি। ইসমাইল দেহলভি ইসলামের মূলধারা আহলে সুন্নাতের আক্বিদায় বিশ্বাসীদের কাফির বলা এবং প্রিয় মুহাম্মদ রসুলুল্লাহ ﷺ-এর শাফাআতের ক্ষমতা নেই, ‘নবুয়তের শৃঙ্খল এখনও সমাপ্ত হয়নি এবং প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ ﷺ এর পরও নবী আসতে পারেন’ বলে রায় দিয়েছিল। ফলে উপমহাদেশে ভ- নবী দাবিদার কাদিয়ানি সম্প্রদায়ের উদ্ভব সহজলভ্য হয়েছিল। তাছাড়াও ‘আল্লাহ মিথ্যা’ বলতে পারেন এবং তিনি এতে সক্ষমও। এমন সব ঈমান বিধ্বংসী আকিদার খ-নে আল্লামা ফজলে হক তাকরিরু ইহতিরাজাত আলা তাকবিয়াতুল ঈমান শিরোনামে একটি বই লিখেন। একারণে, দেওবন্দী ওহাবী মতবাদের বিরাট একটা অংশ আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদীর প্রতি বিরাগভাজন ছিল। ভারতে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে দেওবন্দী ওহাবীদের অনেকেই বৃটিশ আমল হতে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য স্যার সৈয়দ আহমদ-এর মত অনেককেই ওহাবী মতবাদে বিশ্বাসী ছিল। বৃটিশদের সহচর হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে ইসমাঈল দেহলভীর আমদানিকৃত ওহাবী মতবাদের অনুসারীদের নানা আন্দোলন ১৮৫৭ পরবর্তী সময়ে ব্যাপক হারে প্রচারিত হয়।
দ্বিতীয়ত: আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদী রহমাতুল্লাহি আলায়হি একই সাথে শিয়া সম্প্রদায়, ওহাবী মতবাদ এবং বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। আর বৃটিশদের পৃষ্ঠপোষকতায় ভারত বর্ষে নানা ফেরকার জন্ম এবং ওহাবী মতবাদ প্রচারে বিশেষ সহায়তার বিশদ বর্ণনা বৃটিশ গোয়েন্দা হাম্পারের উদ্ধারকৃত ডায়েরিতে পাওয়া যায়। আল্লামা খায়েরাবাদী রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর গবেষণা ও লিখনীর জন্য এসব মতবাদের অনুসারীদের কাছে বিরাগভাজন ছিলেন।
তৃতীয়ত: হিন্দুরাও খ্রিস্টান বৃটিশের ন্যায় মুসলমানদের অবস্থানকে নিজেদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করত। আল্লামা খায়রাবাদী রহমাতুল্লাহি আলায়হি ও তাঁর অনুসারীগণ মুসলমানদের স্বকীয়তায় বিশ্বাসী ছিলেন।
চতুর্থত: আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদী রহমাতুল্লাহি আলায়হি’র মতাদর্শ তথা আকায়েদে আহলে সুন্নাতে বিশ্বাসীদের রাজনৈতিক অবস্থান ভারত ও বাংলাদেশে খুবই নাজুক। গত দেড়শ বছর এই বাংলা ছিল না বললেই চলে।
উল্লেখ্য যে, একথা ১৯৬৬ সালে মদিনা মাওলানা মহিউদ্দীন খানের উদ্যোগে “আস সউরাতুল হিন্দিয়া” এর বাংলা অনুবাদ “আজাদী আন্দোলন-১৮৫৭” বাংলা একাডেমি পক্ষ হতে সাবেরী পাবলিকেশান্স প্রথম মূদ্রণ করেন। এড. মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার তাঁর রাজনীতি আড়াইশ বছর বইসহ বিভিন্নজন তাদের লিখনীতে আজাদী আন্দোলনের এই কিংবদন্তীর কথা তুলে আনেন। আল্লামা খায়রাবাদীর বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন ও অবদানের তুলনায় যা যৎসামান্যই বলা যায়। জাতীয় দৈনিকগুলোর মধ্যে দৈনিক ইনকিলাবে সিপাই বিপ্লবের দেড়শ বছর উপলক্ষে ১৯৭৯ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন হতে প্রকাশিত ফজলে হক খায়রাবাদীর অমূল্য গ্রন্থটি প্রবন্ধকারে প্রকাশ করেন। কিন্তু তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবন ও কর্ম সম্পর্কিত তেমন কোন গ্রন্থ ছিলনা বললেই চলে। ২০২২ সালে বইসই প্রকাশনী হতে অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে “আজাদী আন্দোলনের কিংবদন্তি ফজলে হক খায়রাবাদী” একটি জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ করেন।
এই মহান মনীষী আন্দামান জীবনের এক বছর এগারো মাস অতিবাহিত করে মহান সর্বশক্তিমান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে ১২ সফর ১২৭৮ হিজরি, ২০ আগস্ট ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। আমাদের আত্ম-সন্ধানের নিমিত্তে ইতিহাসের পাঠার্বতে ফিরতে হবে। নতুবা আল্লামা ফজলে হক খায়রাবাদীর মত বহুজনের অবদানের কথা ইতিহাসের পাতা হতে হারিয়ে যাবে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে সত্য-ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও দেশ মাতৃকার স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে এই মহান মনীষীকে অনুসরণের তৌফিক দান করুন। আমিন।

টিকা.
বাহাদুর শাহ জাফরের শেষ দিনগুলো : মুল-উ তাঁ হাফিজ, অনুবাদ-বিপ্রদাশ বড়ুয়া, ঐতিহ্য, ফেব্রুয়ারী ২০০৪, পৃষ্ঠা-১০
ভারতের মুসলমান ও স্বাধীনতা আন্দোলন : ড. মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা। ফেব্রুয়ারী ২০২২, পৃষ্ঠা: ১-২।
উপমহাদেশের আলিম সমাজের বিপ্লবী ঐতিহ্য (চতুর্থ খণ্ড), মূল: মাওলানা মুহাম্মদ মিয়াঁ, অনুবাদ : মাওলানা মাযহারুল হক ও মাওলানা গোলাম সোবহান সিদ্দিকী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারী ২০২১, পৃষ্ঠা-৪২৪।
মাওলানা ফযলে হক খায়রাবাদী আযাদী আন্দোলন ১৮৫৭: মাওলানা মহিউদ্দীন, মদিনা পাবলিকেশান্স, ঢাকা, সপ্তম সংস্করণ-২০০৭, পৃ-৬।
আজাদী আন্দোলনের কিংবদন্তি ফজলে হক খায়রাবাদী : রাশেদুল বারী, বইসই, ২০২২, পৃষ্ঠা-৩১।
আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী (রহ.): ইসলামী শিক্ষা ও আরবী সাহিত্যে তাঁর অবদান, ড. মুহাম্মদ সাইফুল আলম, মমতাজ দিদার পাবলিকেশ, চট্টগ্রাম ২০২১, পৃষ্ঠা-৩৬৬-৩৬৭।
গুলেরা’না, পৃষ্ঠা-৩১২।
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ : মহসিন হোসাইন, মোস্তফা জাহাঙ্গীর আলম, জ্যোতিপ্রকাশ, ঢাকা, মার্চ ২০০৯, পৃষ্ঠা-৯।
জঙ্গে আযাদী মে আল্লামা ফদ্বলে হক্ব খায়রাবাদী কা কিরদার: ড. মুহাম্মদ মাসউদ আহমাদ, পাকিস্তান, নূরী মিশন মালীগাঁ, ২০০৫।
The Indian Uprising of 1857–8 Prisons, Prisoners and Rebellion, Clare Anderson, Publisher: Anthem Press, Cambridge University press.
ফজলে হক খয়রাবাদী ভারত বিপ্লব ১৮৭৫ : মাওলানা আবরারুল হক, সেপ্টেম্বর ২০২১, পৃষ্ঠা-৮।
উপমহাদেশের আলিম সমাজের বিপ্লবী ঐতিহ্য (চতুর্থ খ-), মূল: মাওলানা মুহাম্মদ মিয়াঁ, অনুবাদ : মাওলানা মাযহারুল হক ও মাওলানা গোলাম সোবহান সিদ্দিকী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারী ২০২১, পৃষ্ঠা-৩৭০।
Confession of the British spy, Hakikat Kitabevi, Istanbul, Turkey, Twentieth Edition-NOVEMBER-2021, Pag: 74-103.

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা প্রধান, বইসই, ঢাকা।