ইবনে তাইমিয়ার জঘন্য ভ্রান্ত বিশ্বাস

ইবনে তাইমিয়ার জঘন্য ভ্রান্ত বিশ্বাস

মুফতি মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান আল কাদেরী>

ইলমে হাদীসের সকল শাখা-প্রশাখায় নজীরবিহীন বিচরণকারী ও পারদর্শী, ইলমের মৌলিক উৎস ক্বোরআন-সুন্নাহর ওপর সফল অনুসন্ধানকারী, অসাধারণ ধর্মীয় প্রতিভার নির্মল ও মনোমুগ্ধকর গুণাবলীর অধিকারী, মুসলিম জাহানের সর্বমান্য ইমাম, বিশ্ববিখ্যাত ও সমাদৃত ইসলামি আইন ও ইলমে ফিকহ এর রূপকার, আমিরুল মু‘মিনিন ফিল হাদীস ইমাম ইবনে মোবারক রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এর সরাসরি উস্তাদ, বিশ্ব বিখ্যাত হাদীস বিশারদ ইমাম বুখারী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির সম্মানিত দাদা উস্তাদ, সকল বিদ্বান সমাজ কর্তৃক ইমামই আযম উপাধিতে ভূষিত, ইমামুল আইম্মাহ্ ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি হানাফী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা।

এ মহান ইমামের কথা শুনলে গাত্রদাহ হয় মাযহাব বিরোধী কিছু লোকের। এমন মন্তব্য করে বসে যা একান্তই অর্বাচীন। হানাফী মাযহাব নিয়ে তারা যা বলে থাকে তা তো একেবারেই বিশ্বাসযোগ্যতার মাপকাঠিতে শূন্যের কোঠায়। তাদের উদ্ভট দাবী মাযহাব মানা যাবে না, এমনকি বলে বেড়ায় তা নাকি শিরিক। কখনো বলে থাকে হানাফী মাযহাব মতে নামায আদায় করলে তা সহীহ হবে না। বরং এ নামাযের ফলে যেতে হবে জাহান্নামে। না‘ঊযুবিল্লাহ্!
তাদের মূল দাবী মাযহাব মানা কিংবা কোন ইমামের অনুসরণ করা যাবে না মোটেই। এটা তাদের মুখের কথা, আদতে তারা নির্দ্বিধায় অনুসরণ করে ইবনে তাইমিয়াসহ কতেককে। কাজেই এ প্রবন্ধে ইমাম আজমকে নিয়ে নয় আলোচনা হবে এ ইবনে তাইমিয়ার আক্বিদা- বিশ্বাস ও চরিত্র কী রকম ছিল এবং কোন পর্যায়ের লোক ছিল। তাও আবার বিশ্বজোড়া ইসলামি স্কলারদের উদ্বৃতি ও রেফারেন্স উপস্থাপনার মাধ্যমে।

ইমাম ইবনে হাজার মক্কী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এর ভাষ্য: হেরম শরীফের প্রসিদ্ধ মুফতি শায়খ ইবনে হাজর মক্কী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর গ্রন্থে বর্ণনা করেন- ইবনে তাইমিয়ার আক্বিদা হচ্ছে মহান রবকে ওয়াজিব বিযযাত (সত্তা সহকারে থাকা নিশ্চিত) এবং স্বেচ্ছায় কর্ম- ব্যবস্থাপক নন, (অথচ মহান রব তা থেকে পবিত্র)। সে (ইবনে তাইমিয়া) আল্লাহ তা‘আলার জন্য সশরীর হওয়া, দিক থাকা, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হওয়ায়ও বিশ্বাসী। সে আল্লাহ তা‘আলাকে আরশের বরাবর তথা সমান মনে করে। আর বলে যে, তিনি আরশ অপেক্ষা ছোটও নন, বড়ও নন। অথচ মহান রব এমন মন্দ ও জঘন্য অপবাদ এবং প্রকাশ্য ও সুস্পষ্ট কুফর থেকে পবিত্র ও বহু ঊর্ধ্বে। সে তার অনুসারীদেরকে অপমানিত করেছে এবং তাদেরকে বিভিন্ন দলে বিক্ষিপ্ত করেছে। সে বলেছে, দোযখ বিলীন হয়ে যাবে।

সম্মানিত নবীগণ আলায়হিমুস সালাম মা’সুম তথা নিষ্পাপ নন। নিশ্চয় রাসূল করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর কোন মহত্ব ও গুরুত্ব নেই, তাঁর সত্তার ওসিলা নেওয়া যাবে না। যিয়ারতের উদ্দেশ্যে তাঁর দিকে সফর করা গুণাহ, এমন সফরে কসরের নামায পড়া যাবে না। এমন কাজ যারা করবে তারা কিয়ামত দিবসে নবীজির সুপারিশ থেকে বঞ্চিত হবে। ইবনে তাইমিয়ার আক্বিদা সম্পর্কে ইবনে হাজর রাহমাতুল্লাহি আলায়হি আরো লিখেন- সে বলে থাকে- নিশ্চয় জেনে-বুঝে যদি কেউ নামায ছেড়ে দেয়, তবে সেটার কাযা দেওয়া ওয়াজিব নয়। নিশ্চয় ঋতুবর্তী নারীর জন্য বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করা বৈধ। সেটার কারণে কোন ধরনের কাফ্ফারা অপরিহার্য হয় না, তিন তালাককে এক তালাকই ধরে নেওয়া হবে। অথচ সে এ দাবী করার পূর্বে এ বিপরীত অভিমতের ওপর সকল মুসলমানের ইজমা উদ্ধৃত।১

হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এর ব্যাপারে ইবনে তাইমিয়ার ধারণা : হযরত আলী মুরতাদ্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়ার বাতিল আক্বিদা পোষণের কথা উল্লেখ করে ইবনে হাজর রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন- ইবনে তাইমিয়া বলেছে- হযরত আলী মুরতাদ্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নাকি তিন শতেরও বেশি জায়গায় ভুল ফাতওয়া প্রদান করেছেন।২

হাফেজ ইবনে হাজর আসকালানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, তার সম্পর্কে বিশ্ব বরেণ্য ইমাম আসকালানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি- তার গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ইবনে তাইমিয়া বলেছে- হযরত আলী শৈশবে ইসলাম গ্রহন করেছেন। আর শিশুর ইসলাম গ্রহণ বিশুদ্ধ নয়।৩

বিশ্ববিখ্যাত এ মহান ইমাম আরো ব্যক্ত করেন- কোন কোন আলেম ইবনে তাইমিয়াকে যিনদীক তথা অবিশ্বাসী-নাস্তিক বলে ফতওয়া দিয়েছেন। কেননা সে বলেছে নবীজি থেকে সাহায্য চাওয়া জায়েয নয়, এ বক্তব্যে নবীজিকে হেয় করা হয়েছে এবং তাঁর সম্মানের অস্বীকার করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ তাকে মুনাফিক হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন, কেননা সে বলেছে, হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সতের জায়গায় ভুল করেছেন। এ ব্যক্তি পবিত্র ক্বোরআনের বিরোধিতা করেছে। কাজেই সে পরাভূত হয়েছে যেখানে গিয়েছে সেখানে, সে বারবার খেলাফত অর্জনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। তার সংগ্রাম ছিল মসনদের জন্য দ্বীনের উদ্দেশ্য নয়। সে আরো বলেছে হযরত ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র সম্পদের ভালোবাসা ছিল। আর হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ছিলেন বৃদ্ধ লোক, ফলে তিনি জানতেন না তিনি করতেন। সে এটাও বলেছে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু শিশু অবস্থায় ইসলাম গ্রহণ করেছেন, ছোট বয়সে ইসলাম গ্রহণ একটি মতের আলোকে গ্রহণযোগ্য নয়।৪

ইবনে বতুতার ভাষ্য: বিশ্বখ্যাত মুসলিম পর্যটক ইবনে বতুতা তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে লেখেন- তিনি ভ্রমণে বের হয়ে একবার দামেশকে পৌঁছে জুমার নামায পড়ার জন্য জামে মসজিদে প্রবেশ করলেন। দেখলেন মসজিদের মিম্বরে ইবনে তাইমিয়া বক্তব্য প্রদান করতে গিয়ে বলল- আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আসমান থেকে এমনভাবে অবতরণ করেন যেমন আমি মিম্বর থেকে অবতরণ করেছি। এতে উপস্থিত মুসল্লিগণ তাকে ধোলাই ও জুতা পেটা করেন।৫
ইমাম সুয়ূতী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র অভিমত: বরেণ্য আলেম আল্লামা নাবহানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ইমাম সুয়ূতী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এর বক্তব্য স্বীয় কিতাবে উল্লেখ করেন, ইবনে তাইমিয়া (বাতিল ও বিদআতের প্রবর্তক হবার ভিত্তিতে) মানুষের নিকট অন্ধকারাচ্ছন্ন, গ্রহণাক্রান্ত ও ধূলি-বালিতে আবৃত হয়ে পড়েছে। সে আহলে সুন্নাতের নিকট দাজ্জাল, অপবাদ রচনাকারী ও কাফির সাব্যস্ত হয়েছে।৬

মোল্লা আলী ক্বারী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির বক্তব্য : হানাফী মাযহাবের প্রখ্যাত ইসলামিক স্কলার আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তার ব্যাপারে বলেন- নবীজির যিয়ারত করাকে সে অস্বীকার করেছে. যে কাজটি মুস্তাহাব হবার ওপর আলিমদের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমন কাজকে হারাম সাব্যস্ত করা কুফর। কেননা আলিমদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, যেই বিষয়টি সর্বসম্মত ভাবে মুবাহ হয়, সেটাকে হারাম সাব্যস্ত করা কুফর।৭

ইমাম তকীউদ্দীন সুবকী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির অভিমত: ইমাম সুবকী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি স্বীয় রচিত কিতাবে উল্লেখ করেন- নবীজির ওসিলা গ্রহণ, তাঁর নিকট সাহায্য চাওয়া ও শাফায়াত কামনা করা দ্বীনদার লোকদের কেউ কোন যুগে অস্বীকার করেনি একমাত্র ইবনে তাইমিয়া ব্যতীত। দুর্বল আক্বিদা সম্পন্নদের আক্বিদায় সন্দেহ ঢুকে যায় এমন এক পন্থা অবলম্বন করল, যা কোন যুগেই কেউ অবলম্বন করেনি।৮

অনুরূপ, আল্লামা যারকানী, ইমাম যাহাবী, শায়খ শিহাব উদ্দীন সোহরাওয়ার্দী, ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী, আল্লামা শিহাব উদ্দীন খাফফাযী, ইমাম মাজদুদ্দীন ফিরোযাবাদী, আল্লামা আবু হাইয়্যান, আল্লামা সাভী, আল্লামা ইয়ূসুফ নাবহানী, আল্লামা শাহ ফযলে রাসূল বাদায়ুনী, আবদুল হক সহ অসংখ্য ইসলামিক স্কলার ইবনে তাইমিয়ার ভ্রান্ত ও ভ্রষ্ট আক্বিদার কথা তুলে ধরছেন স্ব-স্ব যুগে।

বলাবাহুল্য, প্রিয় নবীজির সুসংবাদে ধন্য বহু আসহাবে রসূলের চাক্ষুষ দ্রষ্টা, নবুয়তী ইলমের নির্যাসকারী বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানদের হৃদয়ের স্পন্দন, বিশ্বের অসাধারণ হাদীস বিশারদ ইমাম আযম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর মাযহাব ও তাঁর আদর্শ ও দর্শন অনুসরণ করলে তাদের কথায় যদি বিদয়াত-শিরক হয়ে থাকে, তাহলে নষ্ট আক্বিদাকারী ইবনে তাইমিয়াকে যারা হৃদয়ের গভীরে জায়গা দেয়, তার ভ্রান্ত মাযহাবকে মানে, তার তথাকথিত দর্শনে বিশ্বাসী, সেই মাযহাব বিরোধীদের ব্যাপারে কী মন্তব্য ও ফয়সালা হতে পারে সহজে অনুমেয়। একটি কথা পরিষ্কার যে, ইবনে তাইমিয়ার আক্বিদা ছিল ভয়ংকর ও মারাত্মক, এমনকি আল্লাহ তা‘আলার পবিত্র সত্তার ব্যাপারেও। মহান রব সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য বুঝার যেন তাওফিক দান করেন সবাইকে ।

[তথ্যসূত্র:
১. ফাতওয়ায়ে হাদিসিয়াহ-পূ: ১০০, মিশর থেকে মুদ্রিত,

২.ফাতওয়ায়ে হাদিসিয়্যাহ পৃ:১০০, মিশরে মুদ্রিত,

৩.আদ দুরারুল কামিনাহ ১:১৫৫,

৪.আদ দুরারুল কামিনাহ ১:১৫৫ -দাউরুল জীল, বৈরুত,

৫.রেহলাহ ইবনে বতুতা ১:১১-১২, দারু ইহয়িয়ারুল উলুম, বৈরত,

৬.শাওয়াহিদুল হক পৃ: ১৮৪, মুদ্রিত মিশর থেকে,

৭.শরহুশ শিফা ২:১৫২, দারুল কুতুবল ইলমিয়া, বৈরুত,

৮.শিফাউসসিকাম-১১৯, হায়দারাবাদ থেকে মুদ্রিত]

লেখক: প্রধান ফকিহ্, কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল মাদরাসা, ঢাকা।