রাসূল-ই আকরামের মহান চরিত্র

রাসূল-ই আকরামের মহান চরিত্র

ড. আল্লামা মুহাম্মদ ইসমাইল নোমনী>

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র সুন্দর চরিত্র
মহানবী রাসূলে মুজতবা সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল। সকল পয়গাম্বরের মধ্যে যত সুন্দর গুণাবলি ছিল সবই তাঁর মধ্যে বিদ্যমান ছিল। তাই তিনি সবচেয়ে সুন্দর চরিত্রের অধিকারী। আল্লাহ তা‘আলা সে সম্পর্কে বলেছেন-وَإِنَّكَ لَعَلٰى خُلُقٍ عَظِيمٍۢ আপনি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর চরিত্র হুবহু কুরআন। যেমন হযরত আয়শা সিদ্দীকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেছেন-كان خلقه القران (তাঁর চরিত্র কুরআন)-এর মর্ম হলো কুরআনের উপর পূর্ণাঙ্গ আমলই তাঁর জিন্দেগী শরীফ। কুরআন রাসূলের থিউরিক্যাল, আর তিনি হলেন কুরআনের জীবন্ত রূপ। অথবা কুরআন হলো রাসুলের হাল, তিনি হলেন ক্বাল।

রাসূলের ধৈর্য
একদা ইহুদি আলিম যায়দ ইব্ন সানা’আ রাসূলের দরবারে এসে ঋণের খেজুর ফেরত দেওয়ার দাবি করল। ধার করা খেজুর ফেরত দেওয়ার সময় আরো কয়েক মাস বাকি ছিল। তবু সে মেয়াদের পূর্বে সাহাবা-ই কিরামের এক মজলিসে হঠাৎ অযথা কথা ও অকথ্য ভাষায় গালি দেয়া শুরু করল। আর নবীর চাদর ধরে টানাটানি করতে লাগলো। হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তার অনাকাঙ্খিত আচরণ দেখে বললেন- যদি রাসূলে আকরামের আদবের খেলাপ না হতো তাহলে তলোয়ার দিয়ে তোমার মাথা উড়িয়ে দিতাম। রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন- ঠিক হয়নি, ওমর! তখন ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু একাকিত্বে তাকে ডেকে তার পরিচয় জানতে চাইলেন। পরিচয় পেয়ে ওমর বললেন- তুমি তো ইহুদিদের বড় আলেম। তাহলে এমন আচরণ করলে কেন? তিনি বললেন- এ রাসূলের কিছু চরিত্র আসমানী কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। সব গুণ আমি তাঁর নিকট পেয়ে়ছি। কিন্তু কিছু পরীক্ষা করা বাকি ছিল। তাহলো তিনি ধৈর্যশীল কি না? এখন আমি তাঁর সাথে এত রূঢ় ব্যবহার করে দেখলাম, সেটাও পেয়ে়ছি। তিনি অত্যন্ত ধৈর্যশীল। তারপর লোকটি আশহাদু আন লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ বলে ঈমান আনলেন।

চাদর ছিনিয়ে নেয়া ব্যক্তিকে দান করা
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পরনে এক ইয়ামেনের চাদর ছিল। হঠাৎ করে এক বেদুইন চাদরের ভিতরে ঢুকে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল- আমাকে কিছু দান করো। নবীজি তার দিকে দেখে হাসলেন এবং চাদরটি দান করে দিলেন। অপর বর্ণনায় রয়েছে- হুনায়নের যুদ্ধের গণিমত বন্টন শেষে এক ব্যক্তি এসে নবীকে বাবুল গাছের সাথে ছেপে ধরে নবীর পরিহিত চাদর কেড়ে নিল। নবী পাক বললেন- আমার হাতে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ আসলে আমি তোমাকে আরো দেব।

ব্যক্তিগত প্রতিশোধ না নেওয়া
বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে وماانتقم رسول الله صلى الله عليله وسلم রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কোনো সময় নিজের স্বার্থে প্রতিশোধ নেননি। যে সব কাফিরকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তা নিজের কোনো ব্যক্তিগত কারণে ছিল না। তারা আল্লাহর সম্মানে আঘাত ও কুফরি করেছিল। ইমাম যুহরী সূত্রে বর্ণিত আছে ولاضرب بيده قط তিনি নিজের হাতে কাউকে আঘাত করেননি; কিন্তু দ্বীনের জন্য তিনি কাব ইব্ন আশরাফ, ইব্ন খাতল প্রমুখকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

গুনাহ্গারদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা
গুনাহ্গার উম্মতের জন্য তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করে বলতেন اللهم أغفرله اللّٰهُمَّ اَرْحَمْهُ (হে আল্লাহ্ তাকে ক্ষমা করো, তাকে দয়া করো) মদ্যপানকারী আব্দুল্লাহ নামি এক ব্যক্তিকে রাসূলের নিকট আনা হলে শাস্তি দিলেন এবং এরপর সাহাবীরা তাকে তিরস্কার করলে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন- لاتلعنوه فوالله ماعلمت انه يحب الله ورسوله তোমরা তাকে অভিসম্পাত করো না। আল্লাহর কসম! আমি জানি সে আল্লাহ ও রাসূলকে ভালোবাসে।

রাসূলের বিনয় ও অনুপম চরিত্র
হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- خدمت النبي عشرسنين فما قال
لي افولالماصنعتولا الاصنعتআমি রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দশ বছর খেদমত করেছিলাম, তিনি আমাকে উফ্ শব্দও বলেননি। কেন তা করেছ ও কেন করনি-তাও বলেননি।
হযরত আয়শা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূল নিজের কাপড় নিজে সেলাই করতেন ও জুতা মেরামত করতেন।
হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন আমির রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামা মসজিদের দিকে যাচ্ছেন। আমি তাঁর সাথে ছিলাম। তাঁর জুতা মোবারকের ফিতা ছিঁড়ে যায়। আমি ঠিক করতে চাইলে তিনি ঠিক করতে দিলেন না। তিনি নিজ হাতেই ঠিক করলেন। আর বলতে লাগলেন আমি তোমাদের চেয়ে উঁচু মর্যাদার অধিকারী নই।
বাদশা নাজাশীর প্রতিনিধি দল আসলে তিনি নিজেই তাদের খেদমত করেন। উপস্থিত সাহাবা-ই কিরাম বললেন- আমরা তো যথেষ্ট। আমরা খেদমত করি। তিনি বললেন- তারা তো আমার সম্মানিত সাহাবী। اني احب انا كافئهم আমি চাই তাদের উপহারের বিনিময় দিব।

রাসূলের ওয়াদা পূরণ
হযরত আবুল হামাসা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে বেচাকেনা করেছিলাম। তাঁর কিছু মূল্য আমার কাছে পাওনা ছিল। আমি রাসূলকে বললাম- আপনি এখানে দাঁড়ান। আমি নিয়ে আসছি ঘর থেকে। আমি ঘরে গিয়ে সম্পূর্ণ ভুলে গেলাম। তিন দিন পর আমার স্মরণ হলে আমি সেখানে গিয়ে দেখি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে আছেন। আর বললেন,
হে যুবক! তুমি আমাকে কষ্ট দিয়েছ। আমি এখানে আছি, তিন দিন ধরে আমি তোমার অপেক্ষায় আছি।

ন্যায়পরায়ণতা
বনী মাখযুমের এক মহিলার চুরির অপরাধের কথা নবীর নিকট উপস্থাপন করা হল। তার ওপর দণ্ডবিধি আরোপ করার জন্য নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ দিলেন। চুরি করলে হাত কাটতে হয়। সে বনী মাখযুমের লোকেরা তা নিজেদের জন্য অপমান বোধ করল। তাই ওসামা বিন যায়দকে সুপারিশ করার জন্য তারা রাসূলের দরবারে প্রেরণ করলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন-
তুমি কি আল্লাহর দণ্ডবিধির ব্যাপারে আমাকে সুপারিশ করছ? তিনি বলেন, মুহাম্মদ তনয়া ফাতিমা চুরি করলেও মুহাম্মদ তার হাত কাটবেন।

সর্বোচ্চ তাকওয়াবান
হযরত আয়শা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- বাসূল পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাধ্যের মধ্যে আছে এমন কাজের হুকুম দিতেন। এক সময় সাহাবা-ই কিরাম বললেন- আমরা তো আপনার মতো নই। আল্লাহ আপনার পূর্বাপর সব পাপ মার্জনা করে দিয়েছেন। দয়ালু নবী এমনভাবে রেগে গেলেন যে, তাঁর নুরানী চেহারায় তার প্রভাব লক্ষ্য করা গিয়েছে।

তিনি বললেন-নিশ্চয় আমি তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে মুত্তাকী ও জ্ঞানী।
সর্বোপরি বলতে হয় নবী রাসূলগণের মধ্যে যত গুণাবলী বিদ্যমান ছিল সে সবগুলোর অধিকারী ছিলেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম। সব সুন্দর চরিত্রের সমাহার মহানবীর মহান চরিত্রে ছিল। তাই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নবীর চরিত্র রূপায়িত করে বলেন- وانك لعلى خلق عظيم (এবং নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের উপর আধিষ্ঠিত)।
আল্লাহ আমাদেরকে নবীর চরিত্রে চরিত্রবান হওয়ার তৌফিক দান করুক। আমিন!

লেখক: অধ্যক্ষ, আল আমিন কামিল মডেল মাদ্রাসা, চান্দগাঁও, চট্টগ্রাম।