পরিবেশ ও প্রকৃতি আল্লাহর এক অফুরান্ত নিয়ামত

পরিবেশ ও প্রকৃতি আল্লাহর এক অফুরান্ত নিয়ামত

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ>

সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ মূলত সামাজিক জীব। মানুষকে ঘিরেই পরিবেশ-প্রকৃতি ও সমাজের সৃষ্টি। আর পরিবার, পরিবেশ ও সমাজ নিয়ে ইসলামের পরিবেশগত চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘তাদের জন্য নিদর্শন একটি মৃতভূমি। আমি একে সঞ্জীবিত করি এবং তা থেকে উৎপন্ন করি শস্য, তারা তা আহার করে। [সূরা ইয়াসিন : ৩৩]
পরিবেশের বাহ্যিক আরেকটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হচ্ছে আলো। কোরআনে কারিমে আলো-আঁধার, দিন-রাত সম্পর্কে অনেক আয়াত রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা কি অনুধাবন করে না যে, আমি রাত সৃষ্টি করেছি তাদের বিশ্রামের জন্য এবং দিনকে করেছি আলোকিত। এতে মুমিন সম্প্রদায়ের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।’ [সূরা নমল : ৮৬]
পরিবেশ সুস্থ, সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন রাখতে রয়েছে ইসলামের তাগিদ।
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুণ সমুদ্র ও স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে।’ [সূরা আর রুম : ৪১]
তাই প্রকৃতি মানুষ ছাড়া বাঁচতে পারে। কিন্তু মানুষ প্রকৃতিহীন বেঁচে থাকা অসাধ্যপর। আবার প্রকৃতি মানুষ থেকে কিছুই না নিয়ে বাঁচতে পারে। কিন্তু প্রকৃতির সাহায্য ছাড়া জীবনযাপন, মানুষের জন্য অসম্ভব। মানুষের উপকারার্থেই মহান আল্লাহ প্রকৃতি সৃষ্টি করেছেন। কোরআন-হাদীসে এ মর্মে বক্তব্য ও দিক-নির্দেশনা এসেছে। প্রকৃতি এক তরফা নয়। আর প্রকৃতির রকমফের ও বহুবিধতা আছে। প্রকৃতির প্রাণকেন্দ্র হলো পৃথিবী; পৃথিবীর মূল সম্পদ হলো ভূমি, পানি ও পরিবেশগত বৈচিত্র্য। আর পরিবেশ-বৈচিত্র্যের অন্যতম কারিগর উদ্ভিদ।

পৃথিবীর মোট উদ্ভিদ প্রজাতির ভেতরকার ২৫ ভাগই বৃক্ষ
বৃক্ষ আমাদের জন্য অমূল্য সম্পদ। বৃক্ষ ছাড়া প্রাকৃতিক পরিবেশ কল্পনা করা অবান্তর। তাই ইসলাম প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বারোপ করেছে। পাশাপাশি বৃক্ষরোপণে জনসচেতনতা তৈরিতে কালজয়ী দিক-নির্দেশনা দিয়েছে।

ইসলামে পরিবেশ-প্রকৃতি সংরক্ষণ
প্রতিটি প্রাণিকুলেরই ভারসাম্যপূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশ দরকার। সুস্থ ও সুন্দরভাবে জীবন ধারণের জন্য এর বিকল্প নেই। আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে যেমন- গাছপালা, মাটি, পানি, বায়ু, জীবজন্তু, পশুপাখি, রাস্তাঘাট, নদীনালা, পাহাড়-পর্বত, যানবাহন, বাড়ি-ঘর ও কল-কারখানা ইত্যাদি নিয়েই পরিবেশ। কোন পরিবেশে বাস করলে মানুষের সুবিধা হবে বা মানুষ বেঁচে থাকতে পারবে, ইসলাম তা সুনিশ্চিত করেছে। তাই ইসলাম প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে।
আমাদের চারপাশে যা কিছু রয়েছে এবং যা প্রাকৃতিক পরিবেশ হিসেবে খ্যাত, এগুলো মহান আল্লাহ্র অপার নিয়ামত। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছি ও এতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং আমি পৃথিবীতে প্রতিটি বস্তু সুপরিমিতভাবে উৎপন্ন করেছি। আমি তোমাদের জন্য তাতে জীবিকার ব্যবস্থা করেছি এবং তোমরা যাদের রিজিকদাতা নও, তাদের জন্যও। প্রতিটি বস্তুর ভাণ্ডার আমার কাছে আছে এবং আমি তা প্রয়োজনীয় পরিমাণেই সরবরাহ করে থাকি। আমি বৃষ্টিগর্ভ বায়ু প্রেরণ করি, অতঃপর আকাশ থেকে বারিধারা বর্ষণ করি এবং তা তোমাদের পান করতে দিই, বস্তুত এর ভাণ্ডার তোমাদের কাছে নেই।’ [সুরা হিজর, আয়াত: ১৯-২২]
পৃথিবীতে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা জীবজগতের অস্তিত্ব রক্ষায় আল্লাহ তাআলা বৃক্ষ সৃষ্টি করেছেন। কোরআনে তিনি ইরশাদ করেন, ‘আমি ভূমিকে বিস্তৃত করেছি ও তাতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং নয়নাভিরাম বিবিধ উদ্ভিদরাজি উৎপন্ন করেছি। এটি আল্লাহর অনুরাগী বান্দাদের জন্য জ্ঞান ও উপদেশস্বরূপ।’ [সুরা কাফ, আয়াত: ৭-৮]
আল্লাহ তা‘আলা প্রাকৃতিক পরিবেশকে মানুষের সুস্থ, সুন্দর ও স্বাভাবিক বাসোপযোগী করে অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ করে সৃষ্টি করেছেন। তাই তো আমরা দেখি প্রচণ্ড শীতপ্রধান অঞ্চলগুলোতে যেখানে বছরের প্রায় পুরোটা জুড়ে মাঠ, ঘাট, নদী-নালা সর্বত্রই বরফে ঢাকা থাকে, সেখানেও প্রাকৃতিক উদ্ভিদকুল সবুজের ডানা মেলে এবং বরফ আচ্ছাদিত মৎস্যকুল স্বাভাবিক জীবন পরিচালনের মাধ্যমে স্রষ্টার অপার মহিমার জানান দেয়।

প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণে মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম
মানুষের অপরিকল্পনা, অদূরদর্শিতা ও অমানবিক কর্মকাণ্ডের কারণে বর্তমানে প্রকৃতিতে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। এটি সারা বিশ্বের মানুষের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ফলে বায়ুতে দূষণ, তাপমাত্রা, রোগ-বালাই ও প্রাকৃতিক নানান দুর্যোগ বেড়ে চলেছে। তাই এসব বিপর্যয় থেকে বাঁচার জন্য বিজ্ঞানীরা বনরক্ষা ও বৃক্ষ রোপণকে অন্যতম উপায় বলে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
অথচ মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সেই চৌদ্দশ বছর আগে বৃক্ষ বা বন রক্ষার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। বৃক্ষ বা শস্য নষ্ট করাকে নিরুৎসাহিত করে তিনি মানুষকে উপদেশ দিয়েছেন। জনৈক ব্যক্তি একটি গাছের পাতা ছিঁড়লে রাসুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘প্রত্যেকটি পাতা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করে। ’
গাছ-পালা, লতা-পাতা মানুষ ও জীবজন্তুর জন্য খাদ্য সরবরাহ করে, মানুষ ও জীবের জন্য অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং পরিবেশকে দূষণমুক্ত করে। গাছপালা ঝড়-ঝঞা প্রতিরোধ করে এবং মাটির ক্ষয়রোধ করে। এ প্রসঙ্গে হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত এক হাদিসে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো মুসলমান যদি একটি বৃক্ষের চারা রোপণ করে অথবা ক্ষেতখামার করে, অতঃপর তা মানুষ, পাখি কোনো জন্তু ভক্ষণ করে, তা তার জন্য সদকার সওয়াব হবে। ’ [মুসলিম, হাদিস: ৫৫৩২]
হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত হাদীসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যদি নিশ্চিতভাবে জানো যে, কিয়ামত এসে গেছে, তখন হাতে যদি একটি গাছের চারা থাকে যা রোপণ করা যায়, তবে সেই চারাটি লাগাবে।’ [মুসলিম, হাদীস: ৫৫৬০]

পশুপাখি, জীবজন্তু মানুষের কল্যাণে সৃষ্টি করেছেন
মূলত মহান আল্লাহ আমাদের অশেষ কল্যাণে ও উপকারের জন্য নানা প্রজাতির পশুপাখি ও জীবজন্তু সৃষ্টি করেছেন। মানুষ ও প্রাণিকুলের বেঁচে থাকার জন্য উদ্ভিদ ও গাছপালা সৃষ্টি করেছেন। আবার পানি ও বায়ুর প্রয়োজন উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের। অন্যদিকে পাহাড়-পর্বত রক্ষা করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। আর নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর পরিবেশের অন্তর্নিহিত প্রাণপ্রবাহ অব্যাহত রাখে। তাই আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কোরআনে পৃথিবীর মানুষকে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার দিকনির্দেশনা দিয়ে ঘোষণা করেছেন, ‘তিনিই আল্লাহ, যিনি বায়ু প্রেরণ করেন। অতঃপর তা (বায়ু) মেঘমালাকে সঞ্চালিত করে। অতঃপর তিনি (আল্লাহ) মেঘমালাকে যেভাবে ইচ্ছা আকাশে ছড়িয়ে দেন এবং তাকে (মেঘমালাকে) স্তরে স্তরে রাখেন। এরপর তুমি দেখতে পাও, তার মধ্য থেকে বারিধারা নির্গত হয়। তিনি তার বান্দাদের মধ্যে যাদের ইচ্ছা তা (বৃষ্টি) পৌঁছান, তখন তারা আনন্দিত হয়। [৩০ : ৪৮]
সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য চাই সুস্থ ও মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ। অনুকূল ও সুন্দর পরিবেশ ছাড়া কোনো জীবের অস্তিত্ব দীর্ঘায়িত হতে পারে না। বনভূমি ও পশুপাখি আল্লাহ তা‘আলার অকৃত্রিম দান ও প্রকৃতির অনিন্দ্য শোভাবর্ধক। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রকৃতি, পরিবেশ সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশেষভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন।

প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে ইসলামের মৌলনীতি
পরিবেশ সংরক্ষণ ও তাপমাত্রা কমানোর জন্য প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য অতীব প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। এ জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার দাবিতে দুনিয়াজুড়ে আজ সম্মিলিত রব উঠেছে। কিন্তু কিছু মানুষের অদূরদর্শিতা ও অমানবিক আচরণের কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশ দিন দিন ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। অথচ প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে ইসলামের মৌলনীতি হলো, প্রকৃতির অন্যান্য সৃষ্টির কোনোরূপ ধ্বংস বা বিনাশ, অপচয় বা অপব্যবহার করা সমীচীন নয়। কেননা প্রতিটি সৃষ্টিই কোনো না কোনোভাবে মানুষ বা অন্য কোনো সৃষ্টিকে সেবা দানে সদা অবিচল। এ জন্য পরিবেশ ধ্বংসের যেকোনো ধরনের উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা মানুষসহ অন্যান্য সৃষ্টিকে আল্লাহ প্রদত্ত সেবা থেকে বঞ্চিত করার নামান্তর। তাই বিনা প্রয়োজনে অযৌক্তিকভাবে সৃষ্টিকে কোনো সেবা থেকে বঞ্চিত না করা প্রকৃত মুমিনের পরিচায়ক। তাই মানুষের উপকারার্থেই মহান আল্লাহ প্রকৃতি সৃজন করেছেন। আমরা চারপাশে যা কিছু দেখি তা নিয়েই আমাদের পরিবেশ।
সুনীল আকাশ, জীবন বাঁচানোর জন্য অতি প্রয়োজনীয় বাতাস ও পানি, মাটি ও গাছপালা এবং সম্প্রসারিত বিশাল দিগন্ত এসব মিলেই আমাদের পরিবেশ। আমাদের সবার দায়িত্ব যার যার অবস্থান থেকে পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা পালন করা।
আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের সকলকে পরিবেশ রক্ষায় ইসলামি যে দিকনির্দেশনা রয়েছে তা পালন করার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক: প্রাবন্ধিক