আত্মসমালোচনা একটি উত্তম আমল

আত্মসমালোচনা একটি উত্তম আমল

মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ্ আল-মাসুম>

মানুষ হিসেবে আমরা সামাজিক পরিবেশে বাস করি। মিশতে হয় নানা মানসিকতার, নানা মতের মানুষের সাথে। আর যেখানে যত বেশি মানুষ, সেখানে ততবেশি মতামতের সমাগম ঘটে। মন্দ সমালোচনা করা আমাদের এমন একটি নিয়মিত অভ্যাস যা থেকে বেঁচে থাকতে পারেন এমন ব্যক্তির সংখ্যা সমাজে খুবই কম, যা খুবই নিকৃষ্ট অভ্যাস। আর এটি শিষ্টাচার বিরোধী এবং অসামাজিক কার্যকলাপের অন্তর্ভুক্ত। যার দোষ বর্ণনা করা হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে যদি সেই দোষ তার মধ্যে থাকে তাহলে গীবত হিসেবে ধর্তব্য হবে। আর যদি না থাকে, তাহলে তা অপবাদ হিসেবে গণ্য হবে। অথচ অপবাদ গীবতের চেয়েও নিকৃষ্ট ও ঘৃণিত। পক্ষান্তরে পরচর্চা ও অতি প্রশংসা মানুষের ব্যক্তিত্বকে ক্ষুণœ করে, সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। তাই ইসলামে এমন বাড়াবাড়িমূলক কাজকেও খুবই নিন্দনীয় ও হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। অনুরূপ আত্মপ্রশংসাও দোষের। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতএব তোমরা আত্মপ্রশংসা করো না, তিনিই সম্যক জানেন কে আল্লাহভীরু।’ আর মানুষ যদি আত্মসমালোচনায় প্রবৃত্ত হয়, তাহলে অন্য কারও তার কাজের সমালোচনা করার সুযোগ থাকে না। আত্মসমালোচনার আরেকটি ইতিবাচক দিক হলো ভবিষ্যৎ পথচলায় তা টর্চলাইটের কাজ করে। পথ চলতে টর্চের আলো যেমন পথিককে সঠিক পথের দিকনির্দেশ করে, আত্মসমালোচনাও একই ভুল দ্বিতীয়বার করা থেকে মানুষকে বিরত থাকতে সহায়তা করে। তাই বলা হয় সমালোচনা করার প্রথম ও প্রধান এবং উত্তম উপায় হলো আত্মসমালোচনা করা।
ইরশাদ হচ্ছে-
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَا قَدَّمَتْ لِغَدٍ وَاتَّقُوا اللهَ إِنَّ اللهَ خَبِيْرٌ بِمَا تَعْمَلُوْنَ، وَلاَ تَكُونُوْا كَالَّذِيْنَ نَسُوا اللهَ فَأَنْسَاهُمْ أَنْفُسَهُمْ أُوْلَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُوْنَ ‘
অর্থাৎ- হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য উচিত আগামী কালের জন্য (অর্থাৎ আখিরাতের জন্য) সে কি প্রেরণ করেছে, তা চিন্তা করা। আর তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা আল্লাহ্কে ভুলে গিয়েছে, ফলে আল্লাহ তাদেরকে আত্মভোলা করে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই তারা ফাসিক’।
আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম বলেন, এই আয়াতের মাধ্যমে রব্বে করিম প্রত্যেক মুমিনের জন্য আত্মসমালোচনাকে ওয়াজিব করে দিয়েছেন এবং পরের সমালোচনা বর্জন করার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। পবিত্র কুরআনুল করিমে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, তোমাদের অবশ্যই চিন্তা করা আবশ্যক যে, আগামী দিনের জন্য তুমি যা প্রেরণ করেছ তা তোমার জান্নাতের পথ সুগম করছে, না-কি তোমাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে? অথচ মানুষ অপরের সমালোচনা করা, কে কোথায় কী করল? সেই চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত থেকে দিনের একটি বড় অংশ ব্যয় করে। বস্তুত অন্যের সমালোচনা গর্হিত কাজ, যার কারণে আমলনামায় গুনাহ লেখা হয়।
ইসলামে পরনিন্দা, পরচর্চা,অহেতুক সমালোচনা ও অনর্থক তিরস্কার যেমন নিষিদ্ধ, তেমনি সমাজ-সংস্কৃতি, গণমানুষের স্বার্থ, সর্বজনীন নীতিনৈতিকতা ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সঠিক সমালোচনাও শর্ত সাপেক্ষে অনুমোদিত। আলোচনা-সমালোচনায় বা উপদেশ প্রদানে কারও প্রতি অসম্মান, অশ্রদ্ধা প্রকাশ বা প্রদর্শন এবং এসব উদ্রেকের সহায়ক হওয়া বৃহৎ পাপের কারণ। প্রকৃতপক্ষে বিকৃত সমালোচনা এবং ভুলভাবে উপদেশ প্রদান সমস্যা সমাধান করে না, বরং আরও বৃদ্ধি করে। সর্বোপরি সমালোচক পূর্বাপর সব পাপের ভাগীদার হন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনুল করিমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা অনুমান হতে বেঁচে থাকো, নিশ্চয়ই ধারণা করা অনেক ক্ষেত্রেই পাপ; আর তোমরা অন্যের গোপন বিষয় সন্ধান কোরো না এবং পরের পশ্চাতে নিন্দা কোরো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তা ঘৃণাই করবে। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, অল্লাহ তওবা গ্রহণকারী, পরম দয়ালু।’ তবে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজনের তাগিদে অন্যের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করার সুযোগ রয়েছে; যখন তা শরিয়ত-সমর্থিত হয়। যথা-

১. অন্যায় থেকে বাঁচতে
কারো জুলুম থেকে বাঁচার জন্য মজলুম ব্যক্তি, শাসকের কাছে জালিমের বিরুদ্ধে বিস্তারিত অভিযোগ করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে তার যে দোষ রয়েছে তা সবিস্তারে তুলে ধরার অনুমতি আছে।

২. অসৎ কাজ থেকে বারণ করার জন্য
কাউকে অসৎ কাজ থেকে ফেরানোর জন্য কারো কাছে সাহায্য চাওয়ার ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির দোষ বর্ণনা করা জায়েয।

৩. ফতোয়া জানার জন্য
কোন বিজ্ঞ মুফতির কাছে মাসআলা জানতে চাওয়া, অর্থাৎ এভাবে বলা যে অমুক ব্যক্তি আমার ওপর অন্যায় করেছে, সে আমার প্রাপ্য কেড়ে নিয়েছে অথবা সে আমাকে ভালো কাজে বাধা দিচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আমার করণীয় কী? এভাবে সুনির্দিষ্ট কোন ব্যক্তির ব্যাপারে জানতে চাওয়া বৈধ। তার খারাপ স্বভাবের ফিরিস্তি বয়ান করা যাবে। এ প্রসঙ্গে হযরত আয়েশা ছিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, একদা হযরত মুআবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মা হিন্দা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামাকে বললেন, আবু সুফিয়ান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) একজন কৃপণ ব্যক্তি। এ অবস্থায় আমি যদি তার সম্পদ থেকে গোপনে কিছু গ্রহণ করি, তাতে কি গুনাহ হবে? তিনি বলেন, তুমি তোমার ও সন্তানদের প্রয়োজন অনুযায়ী ন্যায়ভাবে গ্রহণ করতে পারো।

৪. সাধারণ মুসলমানদের সতর্ক করার জন্য
যদি কোনো সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি কোনো ফাসেক ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে, তাহলে সে ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তিকে সতর্ক করার জন্য তার দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা বৈধ। যাতে সেই ফাসেক ব্যক্তির রোগ তার ভেতর সংক্রমিত না হয়, আর ওই সম্মানিত ব্যক্তি তার সঙ্গে চলার কারণে অভিযুক্ত না হয়। কিংবা কেউ কোনো শ্রমিক ভাড়া নেয়, আর তার ভেতর যদি কোনো গোপন ত্রুটি থাকে, যেমন চুরি করা, খিয়ানত করা বা কোনো ব্যক্তি তার পণ্যে ভেজাল মিশ্রণ করে, তাহলে এসব বিষয়ে সেবা গ্রহণকারীকে বলতে সমস্যা নেই; বরং ক্ষেত্রবিশেষে বলা অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
আত্মসমালোচনা হলো নিজের সমালোচনা অর্থাৎ নিজের ইহকালিন বা পরকালীন জীবনের ভালো-মন্দ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সংশোধন মূলক আলোচনা-পর্যালোচনা, চিন্তা-ভাবনা করাই আত্মসমালোচনা। এটা জান্নাতী মানুষেদের গুণ, জান্নাতী সাহাবীর আমল। হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার দরবারে (মসজিদে নববীতে) উপবিষ্ট ছিলাম। এমতাবস্থায় তিনি বললেন, তোমাদের নিকট এখন একজন জান্নাতী মানুষ আগমন করবে। (বর্ণনাকারী বলেন) অতঃপর একজন সাহাবী আগমন করলেন। তাঁর দাড়ি থেকে সদ্যকৃত অযুর পানির ফোটা ঝরে পড়ছিল। তিনি তার বাম হাতে জুতা নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করলেন। তার পরদিনও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে অনুরূপ কথা বললেন এবং প্রথম দিনের মতো সেই সাহাবী যথা নিয়মে আগমন করলেন। যখন তৃতীয় দিন হল, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম সেই কথা আবার বললেন এবং যথারীতি সেই সাহাবী পূর্বের অবস্থায় আগমন করলেন। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন আলোচনা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন তখন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সেই সাহাবীর অনুগামী হলেন। তিনি তাঁকে বললেন, আমি আমার পিতার সাথে ঝগড়া করে শপথ করেছি, তিনদিন পর্যন্ত তার ঘরে যাব না। এই তিনদিন আমাকে যদি আপনার ঘরে থাকার অনুমতি দেন, তবে আমি সেখানে থাকতাম। তিনি বললেন, হ্যাঁ,থাকতে পারেন। বর্ণনাকারী হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তিনি (আবদুল্লাহ) তাঁর সাথে সেখানে সেই তিন রাত অতিবাহিত করলেন। তিনি তাঁকে রাতে উঠে তাহাজ্জুদ নামায পড়তে কিংবা বিশেষ কোন ইবাদত করতে দেখলেন না। তবে তিনি যখন ঘুমাতেন, বিছানায় পার্শ্ব পরিবর্তন করে আল্লাহর যিকির করতেন। হযরত আবদুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তাঁর মুখ থেকে কিন্তু ভালো কথা ছাড়া কোনো মন্দ কথা শুনিনি। যখন তিনদিন অতিবাহিত হয়ে গেল এবং তার আমলকে সাধারণ ও মামুলি মনে করতে লাগলাম, তখন তাঁকে বললাম, হে আল্লাহর বান্দা! আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে আপনার সম্পর্কে তিনবার একথা বলতে শুনেছি যে, এখনই তোমাদের নিকট একজন জান্নাতী মানুষ আগমন করবে। উক্ত তিনবারই আপনি আগমন করেছেন। তাই আমি ইচ্ছা করেছিলাম আপনি কী আমল করেন তা দেখতে আপনার নিকট থাকব। যাতে আমিও তা করতে পারি। আপনাকে তো বেশি আমল করতে দেখিনি। তাহলে কোন গুণ আপনাকে এই মহান মর্যাদায় অভিসিক্ত করেছে, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন? তিনি বললেন, আপনি যা দেখেছেন, ঐ অতটুকুই। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, যখন আমি ফিরে আসছিলাম তখন তিনি আমাকে ডাকলেন। তারপর বললেন, আমার আমল বলতে ঐ অতটুকুই, যা আপনি দেখেছেন। তবে আমি আমার অন্তরে কোনো মুসলমানের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করি না এবং আল্লাহ তা‘আলা কাউকে কোনো নেয়ামত দান করলে সেজন্য তার প্রতি হিংসা রাখি না। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এ গুণই আপনাকে এত বড় মর্যাদায় উপনীত করেছে। আর সেটাই আমরা করতে পারি না। রব্বে করিম আত্মসমালোচনাকারীদের প্রসংশা করে বলেন,
إِنَّ الَّذِيْنَ اتَّقَواْ إِذَا مَسَّهُمْ طَائِفٌ مِّنَ الشَّيْطَانِ تَذَكَّرُواْ فَإِذَا هُمْ مُّبْصِرُوْنَ-
অর্থাৎ ‘যাদের মনে আল্লাহর ভয় রয়েছে তাদের উপর শয়তানের আগমন ঘটার সাথে সাথেই তারা সতর্ক হয়ে যায় এবং তখনই তাদের বিবেচনা শক্তি জাগ্রত হয়ে উঠে’। আর এটি দু ধরনের। যথা- ১. নিজে নিজের সমালোচনা এবং ২. পারষ্পরিক আলোচনা (আলেম/ দক্ষ-অভিজ্ঞ ব্যক্তি)। এক্ষেত্রে হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র নিম্নোক্ত বাণীটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন- ‘তোমরা নিজেদের আমলনামার হিসাব নিজেরাই গ্রহণ কর, চূড়ান্ত হিসাব দিবসে তোমাদের কাছ থেকে হিসাব গৃহীত হবার পূর্বেই। আর তোমরা তোমাদের আমলনামা মেপে নাও চূড়ান্ত দিনে মাপ করার পূর্বেই। কেননা আজকের দিনে নিজের হিসাব নিজেই গ্রহণ করতে পারলে আগামীদিনের চূড়ান্ত মুহূর্তে তা তোমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে। তাই সেই মহাপ্রদর্শনীর দিনের জন্য তোমরা নিজেদেরকে সুসজ্জিত করে নাও, যেদিন তোমরা (তোমাদের আমলসহ) উপস্থিত হবে এবং তোমাদের কিছুই সেদিন গোপন থাকবে না’। বস্তুত সৎকর্মশীল বান্দাগণ নিজেদের অবহেলার ব্যাপারে আত্মসমালোচনা করতেন, ভুলত্রুটির জন্য নিজেকে নিজে তিরস্কার করতেন, নিজের ‘নাফস’-এর জন্য তাকওয়ার বিষয়টিকে অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য বিষয় বলে ধারণ করতেন এবং তাকে নিজের খেয়াল-খুশি মত চলা থেকে বিরত রাখতেন। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
وَأَمَّا مَنۡ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفۡسَ عَنِ الْهَوٰى فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوٰى-
অর্থাৎ “আর যে তার রবের অবস্থানকে ভয় করে এবং কুপ্রবৃত্তি হতে নিজকে বিরত রাখে; জান্নাতই হবে তার আবাসস্থল।” এ প্রসঙ্গে নবী করিম সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন
্র الْكَيِّسُ مَنْ دَانَ نَفْسَهُ ، وَعَمِلَ لِمَا بَعْدَ الْمَوْتِ ، وَالْعَاجِزُ مَنِ أَتْبَعَ نَفْسَهُ هَوَاهَا ، وَتَمَنَّى عَلَى اللَّهِ .
অর্থাৎ “বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি, যে তার নফসের হিসাব নেয় এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের জন্য কাজ করে; আর দুর্বল ঐ ব্যক্তি, যে নিজের নফসের কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং আল্লাহর কাছেও আশা-আকাঙ্খা রাখে।”

কেন আত্মসমালোচনা করবো
১. নিজের দোষ-ত্রুটি নিজের সামনে প্রকাশ করার মাধ্যমে মানুষ স্বীয় ভুল-ত্রুটি জানতে পারে। ফলে তার হৃদয় ভাল কাজের দিকে আকৃষ্ট হয় এবং মন্দ কাজ থেকে দূরে থাকতে পারে।
২. আত্মসমালোচনা দ্বীনের উপর দৃঢ়তা অর্জনের সবচেয়ে কার্যকরী মাধ্যম, যা মানুষকে আল্লাহর দরবারে মুহসিন ও মুখলিস বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করে।
৩. আত্মসমালোচনার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নে‘মতসমূহ, অধিকারসমূহ জানতে পারে। আর সে যখন আল্লাহর নে‘মত ও তার অবস্থান সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে, তখন সে আল্লাহর নি‘মাতের শুকরিয়া আদায়ে উদ্বুদ্ধ হয়।
৪. আত্মসমালোচনার মাধ্যমে মানুষের মাঝে পরকালীন জওয়াবদিহিতার উপলব্ধি সৃষ্টি হয়। মাইমুন বিন মিহরান বলতেন, ‘মুত্তাক্বী ব্যক্তি সেই, যে নিজের জওয়াবদিহিতা এমন কঠোরভাবে গ্রহণ করে যেন সে একজন অত্যাচারী শাসক’।

আত্মসমালোচনা না করার কুফল
ইবনুল ক্বাইয়িম বলেন, মুহাসাবা পরিত্যাগ করার অর্থ কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে চলা। এতে মানুষের অন্তর পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। অর্থাৎ মুহাসাবা পরিত্যাগ করার ফলে দ্বীনের প্রতি তার শিথিলতা চলে আসে, যা তাকে নিশ্চিতভাবেই দুনিয়াবী জীবন ও পরকালীন জীবনে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। কেবলমাত্র আত্মগর্বী, প্রতারিত আত্মাই মুহাসাবা পরিত্যাগ করতে পারে। ফলশ্রুতিতে সে কোন কিছুর পরিণাম চিন্তা করে না। সমস্ত পাপ তার কাছে অত্যন্ত সহজ বিষয় হয়ে যায়। অবশেষে একসময় পাপ থেকে বেরিয়ে আসাটা তার কাছে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। কখনো যদি সে সৎপথের সন্ধান পায়ও, তবুও সে তার অন্যায় অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসা অত্যন্ত কঠিন বলে মনে করে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَلَقَدۡ ذَرَاۡنَا لِجَهَنَّمَ کَثِیۡرًا مِّنَ الۡجِنِّ وَ الۡاِنۡسِ ۖ لَهُمۡ قُلُوۡبٌ لَّا یَفۡقَهُوۡنَ بِهَا ۫ وَ لَهُمۡ اَعۡیُنٌ لَّا یُبۡصِرُوۡنَ بِهَا ۫ وَ لَهُمۡ اٰذَانٌ لَّا یَسۡمَعُوۡنَ بِهَا ؕ اُولٰٓئِکَ کَالۡاَنۡعَامِ بَلۡ هُمۡ اَضَلُّ ؕ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡغٰفِلُوۡنَ-
অর্থাৎ আর আমি তো বহু জ্বিন ও মানুষকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি; তাদের হৃদয় আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা উপলব্ধি করে না, তাদের চক্ষু আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা দর্শন করে না এবং তাদের কর্ণ আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা শ্রবণ করে না। এরা চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায়; বরং তা অপেক্ষাও অধিক বিভ্রান্ত! তারাই হল উদাসীন।

লেখক: আরবি প্রভাষক, তাজুশ শরী‘আহ দরসে নিযামী মাদরাসা, ষোলশহর, চট্টগ্রাম।