গীবত (পরচর্চা) জঘন্য পাপ

গীবত (পরচর্চা) জঘন্য পাপ

অধ্যক্ষ হাফেয কাজী আবদুল আলীম রিজভী>

–بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ – আল্লাহর নামে আরম্ভ যিনি পরম দয়ালু করুণাময়

وَیْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةِ ﹰ(1) الَّذِیْ جَمَعَ مَالًا وَّ عَدَّدَهٗ(2) یَحْسَبُ اَنَّ مَالَهٗۤ اَخْلَدَهٗ(3) كَلَّا لَیُنْۢبَذَنَّ فِی الْحُطَمَةِ(4) وَ مَاۤ اَدْرٰىكَ مَا الْحُطَمَةُﭤ(5) نَارُ اللّٰهِ الْمُوْقَدَةُ(6)

الَّتِیْ تَطَّلِعُ عَلَى الْاَفْـٕدَةِﭤ(7) اِنَّهَا عَلَیْهِمْ مُّؤْصَدَةٌ(8) فِیْ عَمَدٍ مُّمَدَّدَةٍ(9)

তরজমা: ধ্বংশ ঐ ব্যক্তির জন্য, যে লোক-সম্মুখে বদনামী করে এবং অগোচরে পাপাচার করে; যে ব্যক্তি সম্পদ সঞ্চয় করেছে এবং গুনে গুনে রেখেছে; সে কি একথা মনে করে যে, তার সম্পদ তাকে পৃথিবীতে চিরকাল রাখবে? কখনো না, অবশ্যই সে পদদলিতকারীর মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবে; তুমি কি জানো পদদলিতকারী কি? আল্লাহ্ তা‘আলার আগুন, যা প্রজ্জ্বলিত হচ্ছে; ওটা, যা অন্তরসমূহের উপর সমুদিত হবে। নিশ্চয় ওটা তাদের উপর বন্ধ করে দেয়া হবে, দীর্ঘ দীর্ঘ স্তম্ভসমূহে। [সূরা হুমাযাহ্, আয়াত ১-৯]

আনুষঙ্গিক আলোচনা – শানে নুযুল: উদ্ধৃত সূরার শানে নুযুল বর্ণনায় তাফসীর শাস্ত্রবিশারদগণ উল্লেখ করেছেন- আলোচ্য সূরায় আখনাছ বিন শুরায়ক, ওয়ালীদ বিন মুগীরা এবং উমাইয়া বিন খালাফ প্রমুখ কাফের সর্দারগণের প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছে। যারা স্বীয় সম্পদের প্রাচুর্যের উপর অহংকারী হয়ে রাসূলে আকরম নূরে মুজাস্সাম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুম) এর শানে তিরস্কার করতো। এ সূরা অবতীর্ণ করে সম্মুখে পশ্চাতের সকাল প্রকার নিন্দাবাদ-কুৎসা রটনাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। [তাফসীরে আযিজী খাজায়েনুল ইরফান ও নূরুল ইরফান শরীফ]

আলোচ্য সূরা হুমাযাহ্য় তিনটি জঘন্য গুনাহ্ এর শাস্তি ও তার তীব্রতা বর্ণিত হয়েছে। আর তা হলো-همز (হুমাযা) বা গীবত করা, لمز (লুমাযা) বা সম্মুখে দোষারোপ করা বা মন্দ বলা আর তৃতীয়টি হচ্ছে সম্পদ সঞ্চয় করা তথা অর্থ লিপ্সা। আরবী ভাষা তত্ববিশারদগণের বর্ণনানুসারে همز (হুমাযা) আর لمز (লুমাযা) শব্দদ্বয় هامز (হামিযুন) এবং لامز (লামিযুন) এর সমার্থক। আরهمزة (হুমাযাতুন) শব্দটি هامز (হামিযুন) এর বহুবচন। لامزة (লুমাযাতুন) শব্দটি لامز (লামিযুন) এর বহুবচন। মুফাস্সেরীনে কেরাম همز (হুমাযা) ও لمز (লুমাযা) শব্দদ্বয়ের বিভিন্ন প্রকারের অর্থগত পার্থক্য বর্ণনা করেছেন। যথা সম্মুখে মন্দ বলাকে همز (হুমাযা) আর পশ্চাতে মন্দ বলাকে لمز (লুমাযা) বলা হয়। অথবা মৌখিকভাবে মন্দ বলাকে همز (হুমাযা) আর ইঙ্গিতে মন্দ বলাকে لمز (লুমাযা) বলা হয়। আবার সরাসরি কাউকে মন্দ বলাকে همز (হুমাযা) এবং ঐ ব্যক্তির কোন জিনিসকে মন্দ বলাকে لمز (লুমাযা) বলা হয়। অধিকাংশ তাফসীর কারকের মতে- لمز (হুমাযা) এর অর্থ গীবত করা অর্থাৎ পশ্চাতে পরনিন্দা করা এবং لمز (লুমাযা) এর অর্থ সামনাসামনি দোষারোপ করা ও মন্দ বলা। এ দুটি কাজই জঘন্য গুনাহ্। পশ্চাতে পরনিন্দা তথা গীবতের শাস্তির কথা কুরআন-হাদীসে বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। এর কারণ, এরূপ হতে পারে যে, এগুনাহে মশগুল হওয়ার পথে সামনে কোন বাধা থাকে না। যে এতে মশগুল হয় সে কেবল এগিয়েই চলে ফলে গুনাহর পরিমাণ বৃহৎ থেকে বৃহত্তর হয়ে থাকে। সম্মুখের নিন্দার গুনাহ্ এরূপ নয়। এতে প্রতিপক্ষ বাধা দিতে প্রস্তুত থাকে। ফলে গুনাহ্ দীর্ঘ হয় না। তাছাড়া, কারো পশ্চাতে নিন্দা করা এ কারণেও বড় অন্যায় যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জানতেও পারে না যে, তার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ উত্থাপন করা হচ্ছে। ফলে সে সাফাই পেশ করার সুযোগ পায় না।
আবার এক বিবেচনায় لمز (লুমাযা) তথা সম্মুখের নিন্দা গুরুতর। যার মুখোমুখি নিন্দা করা হয় তাকে অপমাণিত ও লাঞ্ছিত করা হয়। এর কষ্টও বেশী, ফলে শাস্তিও গুরুতর। হাদীসে পাকে রাসূলে খোদা আশরফে আম্বিয়া সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
شرار عباد الله المشاءون بالنميمة المفرقون بين الا حبة الباغون للبراء العث
অর্থাৎ – আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে নিকৃষ্টতম তারা,যারা পরোক্ষ নিন্দা করে, বন্ধুদের মাঝে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে এবং নিরপরাধ লোকদের দোষ খুঁজে ফিরে।

গীবত করা মানে মৃত ভাইয়ের গোস্ত আহার করা
কুরআনে করীমের বিভিন্ন আয়াতে গীবতের কুফল সম্পর্কে অধিক গুরুত্বসহকারে বর্ণনা করা হয়েছে। সূরা হুজুরাতের এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
ايحب احدكم ان ياكل لحم اخيه ميتافكر هتموه واتقو الله
অর্থাৎ- তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভ্রাতার গোস্ত ভক্ষণ করতে পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তো একে ঘৃণাই কর। অতএব (এ বিষয়ে) তোমরা আল্লাহকে ভয় কর।
উপরিউক্ত আয়াতাংশে গীবতকে মৃত ভ্রাতার গোস্ত ভক্ষণের সমতুল্য উল্লেখ করে এর নিষিদ্ধতা ও নীচতাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তাই সকল মু’মিন নর-নারীর উপর অপরিহার্য কর্তব্য হলো গীবত থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকা এবং কারো গীবত শুনলে তার অনুপস্থিত ভাইয়ের পক্ষ থেকে সাধ্যানুসারে তা প্রতিরোধ করা। আর প্রতিরোধের শক্তি না থাকলে কমপক্ষে তা শ্রবণ থেকে বিরত থাকা। কেননা ইচ্ছাকৃত ভাবে গীবত শ্রবণ করাও নিজে গীবত করার মতই।
সাইয়্যেদুনা হযরত ময়মুন রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন-একদিন আমি স্বপ্নে দেখলাম জনৈক সঙ্গী ব্যক্তির মৃতদেহ পড়ে আছে এবং এক ব্যক্তি বলছে যে, একে আহার করো। আমি বললাম আমি একে কেন আহার করবো? সে বলল কারণ তুমি অমুক ব্যক্তির সঙ্গী গোলামের গীবত করেছ। আমি বললাম আল্লাহর কসম- আমি তো তার সম্পর্কে কখনো কোন ভালমন্দ কথা বলিনি, সে বলল, হ্যাঁ এ কথা ঠিক, কিন্তু তুমি তার গীবত শুনেছ এবং এতে সায় দিয়েছ। এ ঘটনার পর হযরত ময়মুন রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু নিজে কখনো কারও গীবত করেননি এবং তাঁর মজলিশে কাউকে গীবত করতে দেননি।
সাইয়্যেদুনা হযরত হাসান বিন মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু কর্তৃক বর্ণিত শবে মে’রাজে হাদীসে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন- জান্নাত-জাহান্নাম পরিদর্শনে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলে আমি এমন এক সম্প্রদায়ের কাছ দিয়ে গেলাম যাদের নখ ছিল তামার। তারা তাদের মুখম-ল ও দেহের গোস্ত আঁচড়াচ্ছিল। আমি হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস সালামকে জিজ্ঞাসা করলাম এরা কারা? তিনি বললেন- এরা তাদের ভাইয়ের গীবত করত এবং তাদের ইজ্জতহানী করত। [তাফসীরে মাযহারী]
সাইয়্যেদুনা হযরত আবূ সায়ীদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ও সাইয়্যেদুনা জাবের রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু’র রেওয়ায়াতে রাসূলে করীম রউফুর রহীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- اَلْغِيْبَةُ اَشَدُّ مِنَ الزِّنَا অর্থাৎ- গীবত ব্যভিচারের চেয়েও মারাত্মক গুনাহ॥ সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুম আরজ করলেন- এটা কিরূপে? তিনি বললেন এক ব্যক্তি ব্যভিচার করার পর তাওবা করলে তার গুনাহ্ মাফ হয়ে যায়, কিন্তু যে, গীবত করে তার গুনাহ্ প্রতিপক্ষ মাফ না করা পর্যন্ত মাফ হয় না। [তাফসীরে মাযহারী শরীফ]
এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, গীবত এর মাধ্যমে আল্লাহ্র হক ও বান্দার হক উভয় নষ্ট করা হয়। তাই যার সম্পর্কে করা হয় তার কাছ থেকে মাফ নেয়া জরুরি।

الذى جمع مالا وعدده
উদ্ধৃত আয়াতাংশের ব্যাখায় মুফাসসেরীনে কেরাম বলেন- সম্পদ সংগ্রহ করা আর গুণে গুণে সঞ্চয় করে রাখা সব সময় নিষিদ্ধ কিংবা মন্দ নয় বরং বিশেষ কয়েক অবস্থায় মন্দ ও আযাবের কারণ হয়। আর তা হলো এক. প্রথমত হারাম পন্থায় সম্পদ সংগ্রহ করা। হারাম খাবারের ইবাদত কিংবা দোয়া কোনটাই কবুল হয় না। দুই. সঞ্চিত সম্পদ হতে শরিয়তের নির্ধারিত হক যাকাত-ফিতরা ইত্যাদি আদায় না করা। তিন. সম্পদ সংগ্রহ ও সঞ্চয়ে এমনিভাবে মাশগুল হয়ে যাওয়া যাতে মহান আল্লাহর স্মরণকে পর্যন্ত বিস্মৃত হয়ে যায়। চার. সম্পদের প্রাচুর্যকে বিপদাপদ হতে মুক্তির একমাত্র অবলম্বন মনে করে আল্লাহ্র উপর ভরসা না করা।
সূফিয়ায়ে কেরাম বলেন- কাফির- মুশরিকের পক্ষে ধন-সম্পদ উপার্জন করাও গুনাহ্র সামিল, জমা করাও অপরাধ। আর মু’মিন-মুসলিমের জন্য উভয় কাজই ইবাদত। যে সম্পদ রিপুর কু-প্রবৃত্তিকে চরিতার্থ করার জন্য কিংবা শয়তানকে সন্তুষ্ট করার জন্য ব্যয় হয়-তা ধ্বংসশীল আর যে সম্পদ আল্লাহ্-রাসূলের সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে ব্যয় হয় তার জন্য ধ্বংস নেই, বরং তা চিরস্থায়ী। যেমন ইরশাদ হয়েছে ويربى الصدقاتঅর্থাৎ- আল্লাহ্ পাক সদকাহ্ খয়রাত তথা আল্লাহ-রাসূলের নির্দেশিত পথে ব্যয়কৃত সম্পদকে বর্ধিত ও স্থায়ী করে রাখেন।

লেখক: অধ্যক্ষ-জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসা, চট্টগ্রাম।