ইসলামে অমুসলিমদের অধিকার

ইসলামে অমুসলিমদের অধিকার

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি>

عَنْ صفوان بنِ سليم رضى الله عنه عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال اَلَا مَنْ ظَلَمَ مُعَاهِدًا اَوْ اَنْتَقَصَهُ اَوْ كَلَّفَهُ فَوْقَ طَاقَتِهِ اَوْ اَخَذَ مِنْهُ شَئْيًا بِغَيْرِ طِيْب نَفْسٍ فانا حَجْيِجُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ (سنن ابى داؤد رقم الحديث ٣٠٥٢)
عَنْ مُصَعَبْ بن عُمَيْر رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ كُنْتُ فِىْ الْاُسَارٰى يَوْمَ بَدَرٍ فَقَالَ رَسُوْل الله صلى الله عليه وسلم استو صَوْا بِالْاسارٰى خَيْرًا وَكُنْتُ فِىْ نفر من الانصارفَكَانُوْا اذا قَدّمُوا غَدَاء هُمْ اَوْ عشاءهُمْ اكلُوْا التمُر واطْعَمُوْنِىْ الْخُبْزَ بِوَصية رسول الله صلى الله عليه وسلم ايَّاهُمْ (المعجم الصغير رقم اللحديث ٤٠٩)

অনুবাদ: হযরত সাফওয়ান ইবনে সুলাইম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মনে রেখো! যদি কোনো মুসলমান অমুসলিম নাগরিকদের উপর নিপীড়ন চালায় তার অধিকার খর্ব করে তার কোন বস্তু জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয় তাহলে কিয়ামতের দিন আমি আল্লাহ্র আদালতে তার বিরুদ্ধে অমুসলিম নাগরিকের পক্ষ অবলম্বন করব। [আবূ দাউদ: হাদীস-৩০৫২]
হযরত মুসয়াব ইবনে উমাইর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বদর যুদ্ধে বন্দীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বন্দীদের সাথে ভাল ব্যবহারের নির্দেশ দিলেন, আমি একজন আনসারীর অধীনে ছিলাম, যখন তারা দুপুর ও রাতের খাবার সামনে আনতেন, তখন তারা নিজেরা খেজুর খেতেন এবং আমাকে রুটি খেতে দিতেন। এটা ছিল রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের উপদেশের ফল। [মুজামুস সগীর: হাদীস- ৪০৯]

প্রাসঙ্গিক আলোচনা
বর্ণিত হাদীস শরীফদ্বয়ে ইসলামে অমুসলিমদের অধিকার বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, ইসলামে রয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনুপম আদর্শ ও বাস্তব দৃষ্টান্ত।

অমুসলিম’র পরিচয়
আল্লাহ্ তা‘আলার একত্ববাদ ও প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর রিসালতে যারা বিশ্বাস করেনি, সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর খতমে নুবূওয়ত তথা সর্বশেষ নবী হওয়াকে যারা মনে প্রাণে আক্বিদা বিশ্বাসে মেনে নেয়নি উপরন্তু ক্বোরআন ও সুন্নাহ্র শাশ্বত বিধানকে যারা মেনে নেয়নি তারা অমুসলিম হিসেবে গণ্য।
মানুষ হিসেবে মুসলিম-অমুসলিম সকলের সমান অধিকার রয়েছে। একটি রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের বসবাস রয়েছে। বাংলাদেশ একটি মুসলিম রাষ্ট্র হলেও এতে রয়েছে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সহ বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী মানুষের বসবাস। সমাজ জীবনে ও রাষ্ট্রীয় জীবনে কথায়-কাজে, ব্যবহারে-আচরণে লেন-দেনে পারস্পরিক মুসলিম অমুসলিম সকলের সমান অধিকার রয়েছে, ব্যক্তি মালিকানা ও ভূমি মালিকানা সূত্রে রাষ্ট্রে বসবাস করার অধিকার থেকে কোনো অমুসলিম নাগরিককে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন-
يَٓأَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنٰكُمْ مِّنْ ذَكَرٍ اَوْأُنثٰى وَجَعَلْنٰكُمۡ شُعُوْبًا وَقَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوٓاْ اِنَّ أَكۡرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللهَ عَلِيْمٌ خَبِيْرٌ۝
অর্থ: হে মানব মন্ডলী! আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহ্র নিকট সেই অধিক মর্যাদা সম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন, নিশ্চয় আল্লাহ্ তো সর্বজ্ঞ সম্যক অবহিত। [সূরা হুজরাত: আয়াত-১৩]
মুসলিম রাষ্ট্রে কোনো অমুসলিমকে ধর্মত্যাগে বাধ্য করা যাবে না। ইসলামী জীবন বিধান ও রাষ্ট্রীয় সংবিধানে ধর্মীয় স্বাধীনতা স্বীকৃত। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মদীনায় বসবাসকারী সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি, সম্প্রীতি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য এক ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি সম্পাদন করেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে ‘‘ঞযব ঈযধৎঃবৎ ড়ভ গধফরহধ’’ বা মদীনা সনদ নামে পরিচিত। মদীনা সনদে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে প্রত্যেক ব্যক্তির বাক স্বাধীনতা, জীবন সম্পদ সম্ভ্রমের নিরাপত্তা সকল নাগরিকের সহাবস্থান নিশ্চিত করে শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়। মদীনা সনদের ২৫ নং ধারায় উল্লেখ রয়েছে-لليهود دينهم وللمسلمين دينهم অর্থাৎ ইয়াহুদীদের জন্য তাদের ধর্ম আর মুসলমানদের জন্য তাদের ধর্ম। মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসকারী কোনো অমুসলিমকে জোরপূর্বক ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা যাবে না। কোন ধর্মীয় গুরুর, ধর্মের প্রচারক, ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মীয় স্থাপনার বিরুদ্ধে কটূক্তি, অশালীন ও অরুচিকর, আপত্তিকর মন্তব্য করা যাবে না। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন- لَاۤ اِكۡرَاهَ فِى الدِّيۡن দ্বীন গ্রহণের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই। [সূরা বাক্বারা: আয়াত-২৫৬]
মানুষকে ইচ্ছা ও কর্মের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। মহান প্রভুর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ সত্য বিধান, সত্য পয়গাম ইসলামের মর্মবাণী, ইসলামের সত্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করা যাবে। মুক্তিকামী সত্যান্বেষী মানুষগুলোর অন্তর চাইলে ঈমান গ্রহণ করবে, যাদের ইচ্ছা কুফরি করবে, মানুষকে ইচ্ছা শক্তি ও কর্মের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে, তার উপর জোরপূর্বক কোনো বিধান চাপিয়ে দেয়া হয়নি। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন- وَقُلِ الْحَقُّ مِن رَّبِّكُمْ فَمَن شَآءَ فَلْيُؤْمِن وَمَنْ شَآءَ فَلْيَكْفُرْ۝
বলুন! সত্য তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে, সুতরাং যার ইচ্ছা সে যেন ঈমান আনে, যার ইচ্ছা সে যেন কুফরি করে। [সূরা কাহফ: আয়াত-২৯]

অমুসলিমদের প্রতি সহনশীলতা ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির দৃষ্টান্ত
ইসলাম এতো সুন্দর ও উদারনীতি প্রদর্শন করেছে, অমুসলিম পিতা-মাতার প্রতিও সুসম্পর্ক রাখা ও সম্মান জানানোর শিক্ষা দিয়েছে; হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
عَنْ اسماء بنت ابى بكر رضى الله عنهما قالت قَدِمَتْ عَلَىَّ اُمِّى وَهَىَ مُشْرِكَةٌ فِى عهدِ قريشٍ اذ عَاهَدُوا رسُوْل الله صلى الله عليه وسلم فقالت يا رسول الله ان اُمِّى قَدِمَتْ عَلَىَّ وَهِىَ رَاغِبَةٌ اَفَا صِلُهَا قَال نَعَمْ صِلِيْها- (رواه البخارى-۳۱۸۳)
অর্থ: হযরত আসমা বিনতে আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার মা মুশরিকা থাকা অবস্থায় কুরাইশদের সাথে চুক্তির সময় আমার নিকট আসলেন, কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ও আসমার পিতার সাথে সন্ধি চুক্তি করেছিল। আসমা জিজ্ঞেস করল হে আল্লাহ্র রাসূল! আমার মা আমার নিকট আগমন করেছে তিনি আমার সাথে সুসম্পর্ক রাখতে আগ্রহী আমি কি তাঁর সাথে সুসম্পর্ক রাখব? রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন হ্যাঁ তুমি তাঁর সাথে সুসম্পর্ক রাখো। [সহীহ বুখারী শরীফ: হাদীস- ৩১৮৩]

অমুসলিমদের প্রয়োজনে আশ্রয় দেয়া ইসলামের অনুপম শিক্ষা
অমুসলিম ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিকে প্রয়োজনে আশ্রয় দান করা, তাকে শংকামুক্ত ও নিরাপদ জীবন লাভে সাহায্য করা, মুসলমানদের নৈতিক দায়িত্ব। অমুসিলমকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা, তার ব্যবসা-বাণিজ্য, ধন-সম্পদ ক্ষয়-ক্ষতি করা, তাদের প্রতি উগ্রতা ও অমানবিকতা প্রদর্শন করা, ইসলাম আদৌ সমর্থন ও অনুমোদন করে না। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন- وَإِنْ أَحَد مِّنَ الْمُشْرِكِيْنَ اسْتَجَارَكَ فَأَجِرْهُ- অর্থ: আর যদি মুশরিকদের কেউ আপনার কাছে আশ্রয় চাই- তাহলে তাকে আশ্রয় দান করুন। [সূরা আত্ তাওবা: আয়াত-৯:৬]

অমুসলিমদের দেবদেবী নিয়ে গালমন্দ করবে না
অমুসলিমদের দেবদেবী, প্রতিমা নিয়ে গালমন্দ ও তাদের সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য করা সম্পূর্ণ নিষেধ। মুসলমানরা অমুসলিমদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হলে মুসলমানরা শংকামুক্ত থাকবে। অন্যথায় অমুসলিমরা আমাদের প্রতিপালক মহান আল্লাহ্ তা‘আলা সম্পর্কে গালমন্দ করবে। ধৃষ্টতা প্রদর্শন করবে, ধর্ম অবমাননার পথ সুগম হবে। সুতরাং নিজেদের ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার স্বার্থে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ব্যাপারে সংযত আচরণ করা ইসলামের সুমহান আদর্শ- ও রাসূলুল্লাহ্র শিক্ষা। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন- وَلَا تَسُبُّوا الَّذِيْنَ يَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ فَيَسُبُّوا اللهَ عَدْوًۢا بِغَيْرِ عِلْمٍۢ ۗ অর্থ: আর তোমরা তাদেরকে গালমন্দ করো না, আল্লাহ্ ছাড়া যাদেরকে তারা ডাকে ফলে তারা গালমন্দ করবে আল্লাহ্কে। [সূরা আন‘আম: আয়াত-১০৮]

অমুসলিমদের প্রতি উত্তম পন্থায় ইসলামের দাওয়াত দেওয়া
দুনিয়ার সৃষ্টির সূচনা থেকে সম্মানিত নবী-রাসূলগণ, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তবে-তাবেঈন, আউলিয়ায়ে কামেলীন, সুফীয়ায়ে কেরাম ব্যবহারিক জীবনের উত্তম আদর্শ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও মাহন ত্যাগের বদৌলতে বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটেছে। আজ পর্যন্ত কোনো মুসলিম রাষ্ট্রে অমুসলিমদের প্রতি জোরজবরদস্তি করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে কাউকে বাধ্য করা হয়নি।
উগ্রতা ও অহেতুক বিতর্ক নয়, উত্তম পন্থা কৌশল ও পদ্ধতি অবলম্বন ছিল ইসলাম ধর্ম ও আদর্শ প্রচারের এক অনুপম অনুসরণীয় নীতি। পবিত্র ক্বোরআনে এরশাদ হয়েছে- اُدْعُ إِلىٰ سَبِيْلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ ۖ وَجـَادِلْهُمْ بِالَّتِىْ هِىَ أَحْسَنُ اِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيْلِهِ وَ هُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِيْنَ-
অর্থ: আপন প্রতিপালকের পথে আহ্বান করুন, জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে ও উপদেশ শুনিয়ে উত্তমরূপে এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন উত্তম পন্থায়। নিশ্চয় আপনার পালনকর্তা ওই ব্যক্তি সম্পর্কে বিশেষভাবে জ্ঞাত রয়েছেন যে, তার পথ থেকে বিচ্যূত হয়ে পড়েছে। এবং তিনি ভালো জানেন তাদের যারা সঠিক পথে আছে। [সূরা আন নাহল: আয়াত-১২৫]
কথায় ও কাজে একজন মুসলিমকে কষ্ট দেয়া যেভাবে হারাম তেমনিভাবে একজন অমুসলিমকেও কষ্ট দেয়া ইসলামে নিষিদ্ধ, একজন মুসলিমের যেভাবে ক্ষতি করার চিন্তা করা যাবে না, তেমনি অমুসলিমের ক্ষেত্রেও ক্ষতি সাধনের চিন্তা করা নিষিদ্ধ। আল্লাহ্ তা‘আলা অমুসলিমদের অধিকার সুরক্ষায় ইসলামের আদর্শ ও শিক্ষা অনুসরণ করার তাওফিক নসীব করুন-আমীন।

লেখক: অধ্যক্ষ- মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া ফাযিল (ডিগ্রি), বন্দর, চট্টগ্রাম।