সৃষ্টির সেরা নবীর শুভাগমনে পুলকিত বিশ্ব ও সুরভিত পরিবেশ

সৃষ্টির সেরা নবীর শুভাগমনে পুলকিত বিশ্ব ও সুরভিত পরিবেশ

মাওলানা মুহাম্মদ মুনিরুল হাছান>

চন্দ্র বৎসরের উজ্জ্বল জ্যোতির্ময় মাস হল রবিউল আউয়াল। এই মাসের ১২ তারিখ বিশ্ব জগতে তশরিফ এনেছেন নবীকুলের সরদার, আল্লাহ তা‘আলার সর্বোত্তম সৃষ্টি, পূতঃপবিত্র ও সুমহান চরিত্রের অধিকারী রাহমাতুল্লিল আলামীন হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম। এই দিন সৃষ্টি জগতের জন্য মহাখুশির দিন। অজ্ঞতার তিমিরে নিমজ্জিত পৃথিবীতে আলোর দিশা দিতেই আগমন ঘটেছিল প্রিয় নবীজির। বিশ্ববাসীর কাছে করুণার বারতা নিয়ে আনন্দের হিল্লোল তৈরির উৎসব হলো ঈদে মিলাদুন্নবীর উৎসব। ঈদে মিলাদুন্নবী প্রিয় নবীজির ভালোবাসা ও আদর্শ অনুসরণের চেতনা অনুভব করার ঈদ। যার কারণে নবী প্রেমিকগণ আজ আনন্দের অতিশয্যে আত্মহারা হয়ে শরীয়ত সম্মত উপায়ে খুশি উদযাপনে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে থাকে। ইবলিশ শয়তানের জন্য দিনটি খুবই কষ্টের। শয়তান এদিনে রাহমাতুল্লিল আলামিন এর আগমনে অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আহাজারি করতে থাকে।
বর্ণিত আছে, শয়তান চারবার উচ্চস্বরে কেঁদেছিল: যখন আল্লাহ তা‘আলা তাকে অভিশপ্ত হিসেবে আখ্যায়িত করেন, যখন তাকে বেহেশত থেকে বের করে দেওয়া হয়, যখন রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র বেলাদত তথা ধরাধামে শুভ আগমন হয় এবং যখন সূরা ফাতেহা নাযিল হয়। [ইবনে কাসীর, আল-বেদায়া ওয়ান নেহায়া,২/১৬৬]
মহান আল্লাহ তা‘আলার অপার অনুগ্রহসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম একটি অনুগ্রহ হলো সৃষ্টি জগতের জন্য প্রিয় নবী সাইয়েদুল মুরসালিন, রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ। কারণ আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে এমন বৈশিষ্ট্য দান করেছেন যা অন্য কোন নবী রাসূলকে দেননি। স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা নিজেই তার চরিত্রকে শ্রেষ্ঠ ও সুমহান বলে ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আর নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের উপর রয়েছেন।
[সূরা আল কলম-৪]
আল্লাহ তা‘আলা প্রিয় নবীজির প্রসংশাকে সর্বোচ্চ আসনে সমাসীন করেছেন। দুনিয়ার কোন মানুষ তাঁর প্রসংশা করুক বা না করুক প্রিয় নবীজির প্রসংশা কখনো বন্ধ হবেনা। কেননা প্রিয় নবীজির প্রশংসাকারী স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ رَفَعۡنَا لَکَ ذِکۡرَکَ আর আমি আপনার (মর্যাদা বৃদ্ধির) জন্য আপনার স্মরণকে সমুন্নত করেছি। [সূরা ইনশিরাহ-৪]

নবীজির স্মরণই আল্লাহ তা‘আলার স্মরণ
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর মর্যাদা এতই সুমহান যে, তাঁর বরকতমন্ডিত নামখানা পৃথিবীতে সারাক্ষণ আলোচিত হয়। আযানে, ইকামতে, খুতবায়, নামাজের তাশাহুদে মহান আল্লাহর নামের সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের নামকেও স্মরণ করা হয়। সময়ের পরিক্রমায় পৃথিবীতে কোথাও ফজর, কোথাও যোহর হয়, কোথাও মাগরিব আর কোথাও এশা ইত্যাদি। এভাবে কোথাও আজান-ইক্বামত হয়, কোথাও নামাজের জামাত হয়। কোথাও হাদীসের দরস হয়, কোথাও খুতবা হয়। সবখানেই প্রিয় নবীজির আলোচনা চলছে। অর্থাৎ, সারা বিশ্বে প্রতি মুহূর্তেই যতবার আল্লাহ তা‘আলার পবিত্র নাম উচ্চারিত হয় ততবার তার প্রিয় হাবিবের নামও আলোচিত হচ্ছে । পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহে নবীজির নাম এবং গুণাবলী বিস্তারিতভাবে বর্ণনা হয়েছে। ফেরেশতাদের মাঝেও তাঁর সুনাম ও সুখ্যাতির আলোচনা চলছে।
হাদীসে রয়েছে,
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : قَالَ لِي جِبْرِيلُ عَلَيْهِ السَّلَامُ : إِنَّ رَبَّكَ عَزَّ وَجَلَّ يَقُولُ لَكَ : أَتَدْرِي كَيْفَ رَفَعْتُ ذِكْرَكَ ؟ قُلْتُ : اللَّهُ أَعْلَمُ قَالَ : قَالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ : إِذَا ذُكِرْتُ ذُكِرْتَ مَعِي
অর্থ: হযরত আবু সাঈদ খুদুরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন আমার কাছে জিব্রাইল এসে বলেছেন, নিশ্চয়ই আপনার প্রতিপালক বলেন, আপনি কি জানেন আমি আপনার স্মরণকে কিভাবে উচ্চ করেছি? আমি বললাম, আল্লাহ তাআলাই অধিক জানেন। তিনি বলেন, যখন আমাকে স্মরণ করা হবে তখন আমার স্মরণের সাথে সাথে আপনাকেও স্মরণ করা হবে। [যুরকানি আলাল মাওয়াহিব,৬/৩৬৪]

প্রিয় নবী হলেন সর্বপ্রথম সৃষ্টি
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের অন্যতম আজমত হল তিনি আল্লাহ তা‘আলার প্রথম সৃষ্টি। বিশ্বে যখন আল্লাহ তা‘আলা কিছুই সৃষ্টি করেননি তখন প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের নূর মোবারক সৃষ্টি করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلۡ اِنَّ صَلَاتِیۡ وَ نُسُکِیۡ وَ مَحۡیَایَ وَ مَمَاتِیۡ لِلّٰهِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ
لَا شَرِیۡکَ لَهٗ ۚ وَ بِذٰلِکَ اُمِرۡتُ وَ اَنَا اَوَّلُ الۡمُسۡلِمِیۡنَ
আপনি বলুন! নিশ্চয়ই আমার আমার নামাজ আমার কোরবানি আমার জীবন ও মৃত্যু আল্লাহ তা‘আলার জন্য। তার কোন শরীক নেই। আমি এ বিষয়ে আদিষ্ট। আর আমিই প্রথম মুসলমান। [সূরা আনআম-১৬৩, ১৬৪]
আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টিতে কোনো নবী বা ফেরেশতা কেউই নিজেকে প্রথম মুসলমান বলে দাবি করেননি। একমাত্র প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর ব্যাপারে তা বলা হয়েছে। যার মাধ্যমে এ কথাটিই প্রমাণিত হয় যে,হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন আল্লাহর সর্বপ্রথম সৃষ্টি।
হাদীসে রয়েছে, হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, আমি আরজ করলাম ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কোরবান হোক। আমাকে এই খবর দেন যে আল্লাহপাক সর্বপ্রথম কোন বস্তুটি সৃষ্টি করেছেন?তিনি বললেন, হে জাবের! নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা আপন নূর থেকে তোমার নবীর নূরকে সকল কিছুর আগে সৃষ্টি করেছেন। সেই নূর আল্লাহর কুদরতের ইচ্ছায় প্রদক্ষিণ করতে থাকে। সেই সময় লাওহ, কলম, জান্নাত, জাহান্নাম কিছুই ছিল না। ফেরেস্তা, আসমান-জমিন, চন্দ্র-সূর্য, জিন ও মানুষ এক কথায় কিছুই ছিল না। [ইমাম আব্দুর রাজ্জাক, আল মুসান্নাফ]
হযরত সাহ্ল ইবনে সালেহ হামদানি থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ইমাম মুহাম্মদ বাকের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে হযরত রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছি যে তাঁর আগমন তো সকলের শেষে হয়েছে। তিনি কিভাবে সকলের অগ্রবর্তী হলেন? তিনি জবাবে বললেন, আল্লাহ তা‘আলা যখন সমগ্র মানবজাতিকে আদম আলায়হিস্ সালাম-এর পৃষ্ঠ থেকে বের করেছিলেন তখন সকলকে প্রশ্ন করেছিলেন, আমি কি তোমাদের রব নই? সবাই উত্তরে বলেছিলেন, হ্যাঁ, অবশ্যই। আর এই কথাটি সবার আগে যিনি বলেছেন তিনি হলেন প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম।
নবীজি হলেন সৃষ্টি জগতের রূহ। কেননা তার একটি গুণ হল محي বা জীবনদাতা। রূহ না থাকলে দেহ যেমন গুরুত্বহীন হয়ে যায়, তেমনি নবীজির নূরের অস্তিত্ব না থাকলে সমগ্র সৃষ্টি অসাড় দেহের মতো হয়ে যায়। ইমাম মুহাম্মাদ আল মাহ্দী বলেন, هو روح الاكوان وحياتُها وسرُّ وجودِها لولاه لذهبت وتلاشت
অর্থ: রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম সৃষ্টি জগতের রূহ ও এর অস্তিত্বের রহস্য। যদি তিনি না হতেন তাহলে সৃষ্টি জগত অস্তিত্বহীন ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। [মাওলানা মুহাম্মদ নুরুল হক, নূরে মুজাসসাম -১৩৯]

প্রিয় নবীজি হলেন সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ নি’মাত
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম হলেন আল্লাহর শ্রেষ্ঠতম নিয়ামত বা নেয়ামতে উজমা। যার কারণে তার একটি লকব হলো نعمة الله বা আল্লাহর নি’মাত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَإِن تَعُدُّواْ نِعْمَةَ ٱللَّهِ لَا تُحْصُوهَآ ۗ إِنَّ ٱللهَ لَغَفُورٌ رَّحِيمٌ
তরজমা: এবং যদি আল্লাহর অনুগ্রহ সমূহ গণনা করো, তবে সেগুলোর সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবেনা। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাপরায়ণ, দয়ালু।
[সূরা আন নাহাল- ১৮]
হযরত সাহ্ল তাসতারি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি উক্ত আয়াতের তাফসিরে বলেছেন, نعمته محمد صلى الله عليه وسلم
অর্থ: তাঁর নি’মাত হল হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম । [যারকানী-৩/১৮৬]
আল্লাহ তা‘আলার নি’মাত অসংখ্য এবং বর্ণনাতীত। কিন্তু সকল নেয়ামতের শ্রেষ্ঠ নি’মাত হলো প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র সত্তা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আমি আপনাকে জগৎসমূহের রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি’। [সুরা আম্বিয়া-১০৭]
রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি তো আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রহমত। [তাবরানী, মুজামুল আওসাত- ৩০০৫, মুস্তাদরাক হাকিম- ১০০]
তিনি কোনো অভিশাপ দেননি। তিনি বলেছিলেন, আমি অভিশাপকারীরূপে প্রেরিত হইনি, আমি কেবল করুণারূপে প্রেরিত হয়েছি। [সহীহ মুসলিম- ২০০৬]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
لَقَدۡ مَنَّ اللّٰهُ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اِذۡ بَعَثَ فِیۡهِمۡ رَسُوۡلًا مِّنۡ اَنۡفُسِهِمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡهِمۡ اٰیٰتِهٖ وَ یُزَکِّیۡهِمۡ وَ یُعَلِّمُهُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ ۚ وَ اِنۡ کَانُوۡا مِنۡ قَبۡلُ لَفِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ
তরজমা: আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অবশ্যই অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকে তাদের কাছে রাসূল পাঠিয়েছেন, যিনি তাঁর আয়াতসমূহ তাদের কাছে তেলাওয়াত করেন, তাদেরকে পরিশোধন করেন এবং কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেন, যদিও তারা আগে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতেই ছিল। [সূরা আলে ইমরান-১৬৪]

নবীজিকে সম্মান করা ফরজ
মুমিন মুসলমানের কাছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বোচ্চ সম্মানিত ও সর্বাধিক প্রিয়। নবীজিকে তাজীম করা ফরজ। প্রিয় নবীজির তাজীম ঈমানের শাখা সমূহের অন্তর্গত বিষয়। তার প্রতি তাজীম মহব্বতের চাইতেও অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই তাজীম বা সম্মান প্রদর্শনের মধ্যেই মুমিন-জীবনের সফলতা নির্ভর করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
فَالَّذِيْنَ آمَنُوْا بِهِ وَعَزَّرُوْهُ وَنَصَرُوْهُ وَاتَّبَعُوا النُّوْرَ الَّذِيْ أُنْزِلَ مَعَه أُولَۤئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ،
তরজমা: সুতরাং যারা তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তাঁকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং যে আলো তাঁর সাথে অবতীর্ণ হয়েছে, তার অনুসরণ করে তারাই হবে সফলকাম। [সূরা আ‘রাফ-১৫৭]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اِنَّاۤ اَرۡسَلۡنٰکَ شَاهِدًا وَّ مُبَشِّرًا وَّ نَذِیۡرًا ۙ.لِّتُؤۡمِنُوۡا بِاللّٰهِ وَ رَسُوۡلِهٖ وَ تُعَزِّرُوۡهُ وَ تُوَقِّرُوۡهُ ؕ وَ تُسَبِّحُوۡهُ بُکۡرَۃً وَّ اَصِیۡلًا
তরজমা: হে নবী! নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষীরূপে, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে। যাতে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন এবং তাঁর শক্তি যোগাও ও তাঁকে সম্মান কর, আর সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর (আল্লাহর) পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর। [সূরা ফাতাহ,৮-৯]
সাহাবীগণ প্রিয় নবিজীকে সকল কিছুর চাইতে এমনকি নিজের জীবনের চাইতেও বেশী ভালোবাসতেন। তাঁর সম্মানকে সবার উপরে স্থান দিতেন। হযরত উরওয়াহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, আল্লাহর কসম! আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কখনো থুথু ফেললে তা সাহাবীদের হাতে পড়তো এবং তা তাঁরা গায়ে মুখে মেখে ফেলতেন। তিনি তাদের কোন আদেশ দিলে তা তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে পালন করতেন। তিনি ওযূ করলে তাঁর ওযূর পানির জন্য সাহাবিদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হত। তিনি যখন কথা বলতেন, তখন তারা নীরবে তা শুনতেন এবং তাঁর সম্মানার্থে সাহাবীগণ তাঁর দিকে তীক্ষè দৃষ্টিতে তাকাতেন না। অতঃপর উরওয়াহ তার সঙ্গীদের নিকট ফিরে গেলেন এবং বললেন, হে আমার কওম, আল্লাহর কসম! আমি অনেক রাজা- বাদশাহর নিকটে প্রতিনিধিত্ব করেছি। কায়সার, কিসরা ও নাজাশীর নিকট দূত হিসাবে গিয়েছি। কিন্তু আল্লাহর কসম করে বলতে পারি যে, কোন রাজা-বাদশাকেই তাঁর অনুসারীদের মত এত সম্মান করতে দেখিনি, যেভাবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর অনুসারীরা তাঁকে করে থাকে। আল্লাহর কসম! আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম যদি থুথু ফেলেন, তখন তা কোন সাহাবীর হাতে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে তারা তা তাদের গায়ে মুখে মেখে ফেলেন। তিনি কোন আদেশ দিলে তারা তা সঙ্গে সঙ্গে পালন করেন। তিনি ওযূ করলে তাঁর ওযূর পানি নিয়ে সাহাবীগণের মধ্যে প্রতিযোগতিা শুরু হয়। তিনি কথা বললে, সাহাবীগণ নিশ্চুপ হয়ে শুনেন। এমনকি তাঁর সম্মানার্থে তারা তাঁর চেহারার দিকেও তাকান না।
[সহীহ বুখারী ২৭৩২]

জান্নাত-জাহান্নাম নবীজির সামনে
সৃষ্টি জগতের কোন কিছুই প্রিয় নবীজির দৃষ্টি থেকে গোপন নয়। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
مَا مِنْ شَىْءٍ لَمْ أَكُنْ أُرِيتُه إِلاَّ رَأَيْتُه فِي مَقَامِي حَتَّى الْجَنَّةِ وَالنَّارِ،
অর্থ: যা কিছু আমাকে ইতোপূর্বে দেখানো হয়নি, তা আমি আমার এ স্থানেই দেখতে পেয়েছি। এমনকি জান্নাত এবং দোযখও। [সহীহ বুখারী-৮৬]
প্রিয় নবীজির উম্মত দুই ভাগে বিভক্ত হবে একদল হবে জান্নাতি আরেকদল হবে দোযখী। আল্লাহ তা‘আলা প্রিয় নবীজিকে সুসংবাদদানকারী এবং ভয় প্রদর্শক রূপে প্রেরণ করেছেন। অর্থাৎ তিনি বেহেশতের যেরকম সুসংবাদ দেবেন অনুরূপ দোযখের ভয়ও প্রদর্শন করবেন। কারা জান্নাতি এবং কারা দোযখী এর জ্ঞান প্রিয় নবীজির কাছে ছিল। প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ১০ জন বিশিষ্ট সাহাবীকে বেহেস্তের সুসংবাদ দিয়েছেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম দুটি গ্রন্থ তাঁর দুই হাতে নিয়ে আমাদের নিকট এসে বললেন, তোমরা এই দুটি গ্রন্থের ব্যাপারে কি জান? আমরা বললাম, না, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম। তবে যদি আপনি আমাদেরকে জানিয়ে দেন। তিনি তাঁর ডানহাতের গ্রন্থের দিকে ইশারা করে বললেন, এটা রাব্বুল আলামীনের পক্ষ হতে একটি কিতাব। এতে জান্নাতী সকল ব্যক্তির নাম, তাদের বাপ-দাদার নাম ও তাদের গোত্রের নাম লিখা আছে। আর শেষে এর যোগফল রয়েছে এবং এতে কম-বেশি করা হবে না। তারপর তিনি তাঁর বামহাতের গ্রন্থের দিকে ইশারা করে বললেন, এটাও আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ হতে একটি গ্রন্থ। এতে দোযখী সকল ব্যক্তির নাম, তাদের বাপ-দাদার নাম ও গোত্রের নাম লিখা আছে। এর শেষেও যোগফল রয়েছে। এতে কখনো কমানো-বাড়ানো হবে না। তাঁর সাহাবীগণ বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, বিষয়টি এরূপভাবেই চূড়ান্ত হয়ে থাকলে তবে আর আমলের কি প্রয়োজন? তিনি বললেন, তোমরা সঠিক পথে থেকে সঠিকভাবে কাজ করতে থাক এবং আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য হাসিলে চেষ্টা কর। কেননা, জান্নাতী লোকের শেষ মুহুর্তেরআমল জান্নাতীদের আমলই হবে, সে পূর্বে যে আমলই করুক না কেন। আবার জাহান্নামীর শেষ মুহুর্তের কাজ জাহান্নামীদের আমলই হবে, সে পূর্বে যে আমলই করুক না কেন। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তার দু’হাতে ইশারা করেন এবং কিতাব দুটি রেখে দিয়ে বলেন, তোমাদের রব তাঁর বান্দাদের আমল চূড়ান্ত করে ফেলেছেন। একদল জান্নাতে প্রবেশ করবে আর অন্যদল জাহান্নামে প্রবেশ করবে। [তিরমিজি-২১৪১]

তিনি চাঁদের সাথে খেলা করতেন
হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন
عن العباس بن عبد المطلب رضي الله تعالى عنه قال: قلت يا رسول الله دعاني إلى الدخول في دينك أمارة لنبوتك، رأيتك في المهد تناغي القمر وتشير إليه بإصبعك فحيث ما أشرت إليه مال. قال: “كنت أحدثه ويحدثني ويلهيني عن البكاء وأسمع وجبته حين يسجد تحت العرش”.
হে আল্লাহর রাসূল আপনার নবুওতের একটি নিদর্শন আমাকে আপনার দ্বীনে প্রবেশ করার জন্য বাধ্য করেছে। আপনি যখন দোলনায় ছিলেন তখন চাঁদের সাথে কথা বলতেন। আপনি নিজ আঙ্গুল দ্বারা চাঁদের প্রতি ইশারা করতেন। আপনি যেদিকে ইশারা করতেন চাঁদ সেদিকেই হেলে যেত। তিনি (রাসূল) বললেন, আমি ওটার সাথে কথা বলতাম এটাও আমার সঙ্গে কথা বলতো। ওটা আমাকে ক্রন্দনে সান্ত্বনা দিত যখন তা আরশের নিচে সিজদায় পতিত হত আমি এর ওই পতনের শব্দ শুনতে পেতাম। [বায়হাকি, তাবরানী। যুরকানী, ১/১৪৬]
আবু জাহল ও ওয়ালিদ বিন মুগিরাহসহ মক্কার কোরাইশরা একবার প্রিয় নবীজিকে বলল, আপনি যদি নবী হন তাহলে চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করুন। সাথে সাথে তার আঙ্গুল মোবারকের ইশারায় চাঁদ দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়। এরপর আবার তার হাতের ইশারায় দ্বিখণ্ডিত চাঁদ জোড়া লেগে পূর্ণ চাঁদে পরিণত হয়।

আল্লাহ তা‘আলার দরবারে নবীজির সম্মান
প্রিয় নবীজির শান ও মর্যাদা এতই মহান যে, আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে অন্য নবীদেরকে যেভাবে নাম ধরে সম্বোধন করেছেন সেভাবে আমাদের নবীকে নাম ধরে ডাকেননি। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন স্থানে পূর্ববর্তী নবীদেরকে হে আদম, হে দাউদ, হে ইবরাহীম, হে ইয়াহইয়া ইত্যাদি নামে ডেকেছেন। আর রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা কোথাও ‘ইয়া মুহাম্মদ’ বা হে মুহাম্মাদ! বলেননি। বরং আল্লাহ তা‘আলা অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার সাথে নবীজিকে ডেকেছেন يس ইয়া-সিন, طه তা-হা, المزمل মুজ্জাম্মিল, المدثر মুদ্দাস্সির, বাশীরুন, নাযিরুন, সিরাজুম মুনির ইত্যাদি উপাধি ব্যবহার করে।
তাছাড়া, সাথে সাথে আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদেরকে নবীজির সাথে কীভাবে কথা বলবে তার রূপরেখাও বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
لَا تَجۡعَلُوۡا دُعَآءَ الرَّسُوۡلِ بَیۡنَکُمۡ کَدُعَآءِ بَعۡضِکُمۡ بَعۡضًا
তরজমা: তোমরা রাসূলের আহ্বানকে তোমাদের একে অপরের আহ্বানের মত গণ্য করো না ।
[আন-নূর: ৬৩]
উক্ত আয়াতটি অবতীর্ণের পর যখনই সাহাবায়ে কেরামগণ প্রিয় নবীজিকে সম্বোধন করতেন তখন ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ’, ‘ইয়া নাবীয়্যাল্লাহ’, ‘ইয়া হাবীবাল্লাহ’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইত্যাদি মর্যাদা সূচক বাক্য ব্যবহারের মাধ্যমে সম্বোধন করতেন। নবীজিকে সর্বোচ্চ সম্মান জানিয়ে তারা বলতেন, “আপনার জন্য আমার পিতা-মাতা উৎসর্গ হউক।
আল্লাহপাক রাসূলুল্লাহকে বেশি ভালোবাসেন। কিবলা পরিবর্তনের ঘটনায় এর নমুনা পাওয়া যায়। হিজরতের পর ষোলো-সতেরো মাস নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে ফিরে নামাজ আদায় করেন। কিন্তু তাঁর আন্তরিক ইচ্ছা ছিল হযরত ইব্রাহিম আলায়হিস্ সালাম কর্তৃক নির্মিত কা’বা ঘরকে যেন কিবলা নির্ধারণ করা হয়। তিনি বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছিলেন। আল্লাহপাক তাঁর সেই ইচ্ছানুযায়ী কিবলা বানিয়ে নামাজ আদায়ের নির্দেশ দেন। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
قَدۡ نَرٰی تَقَلُّبَ وَجۡهِکَ فِی السَّمَآءِ ۚ فَلَنُوَلِّیَنَّکَ قِبۡلَۃً تَرۡضٰهَا ۪ فَوَلِّ وَجۡهَکَ شَطۡرَ الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ-
অবশ্যই আমি আকাশের দিকে আপনার বারবার তাকানো লক্ষ্য করছি। সুতরাং অবশ্যই আমি আপনাকে এমন কিবলার দিকে ফিরিয়ে দেব যা আপনি পছন্দ করেন। অতএব আপনি মসজিদুল হারামের দিকে চেহারা ফিরান। [সূরা বাকারা-১৪৪]
প্রিয়নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম যা চেয়েছেন আল্লাহ তা‘আলা তা পূরণ করেছেন। তিনি যে আল্লাহপাকের সর্বাধিক নৈকট্যের অধিকারী এ আয়াতে তা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
প্রিয় নবীজির শুভাগমনে সমগ্র পৃথিবী পুলকিত হয়েছিল। জীন-ইনসান, পশু-পাখি, গাছপালা, বৃক্ষ-লতা এককথায় আল্লাহর সকল সৃষ্টিজগত পুলকিত হয়েছিল। সুরভিত হয়েছিল পরিবেশ। তিনি ছিলেন সকল শ্রেণী পেশার মানুষের জন্য প্রকৃত আদর্শ। অভিভাবক হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে, ব্যবসায়ী হিসেবে, সেনাপতি হিসেবে, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে, পরিবারের জন্য আদর্শ কর্তা হিসেবে সর্বোপরি মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাহমাতুল্লিল আলামীন হলেন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠতম আদর্শ। আ’লা হযরত ইমামুল ইশক ওয়াল মুহাব্বাত ইমাম আহমদ রেজা খান রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এর ভাষায় প্রিয় নবীজির শানে একটি পংক্তির অবতারণা করে শেষ করছি। ভারতের উত্তরপ্রদেশের বাহারাইচ জেলার নানপারার একজন ব্যক্তি আ’লা হযরতের দরবারে এসে বললেন যে, নানপারার রাজার প্রশংসায় আমাকে একটা কসীদা লিখে দিন যাতে আমি আমার পক্ষ থেকে তার সামনে উপস্থাপন করে কিছু পুরস্কার গ্রহণ করতে পারি। আ’লা হযরত বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। কারণ তিনি কোনো রাজা-বাদশার প্রশংসা করে দুনিয়াবী কিছু অর্জন করার আগ্রহী ছিলেন না। সাথে সাথে তিনি কলম নিয়ে সৃষ্টির অদ্বিতীয় রাসূলের প্রশংসায় কলম ধরলেন এভাবে,
وہ کمال حسن حضور ہے کہ گمان نقص جہاں نہیں
یہی پھول خار سے دور ہے یہی شمع ہے کہ دھواں نہیں
কী অনিন্দ্য রূপ মোর নবীজির, ভাবনা ত্রুটিরও নাই যেথায়,
সে যে ফুল এমন, যাতে কাঁটা নেই, সে তো দ্বীপ এমন, নাহি ধোঁয়া তায়।
[আ’লা হযরত, আল্লামা বদরুদ্দিন আহমেদ কাদেরী রেজবী]

লেখক: সিনিয়র শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা), চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল এন্ড কলেজ।