মহানুভবতা রাসূলল্লাহ্’র অনুপম আদর্শ

মহানুভবতা রাসূলল্লাহ্’র অনুপম আদর্শ

মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ্ আল-মাসুম>

রাসূলে করীম শাফী‘ঈ ইয়াওমুন নুশুর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ছিলেন এই বসুন্ধরার বুকে সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু। তাঁর অবিস্মরণীয় ক্ষমা, মহানুভবতা, বিনয়-নম্রতা, সত্যনিষ্ঠা প্রভৃতি আদর্শ চরিত্র মাধুর্য দিয়েই বর্বর আরব জাতির আস্থাভাজন হতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনুল করিমে ইরশাদ হচ্ছে,
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللهِ لِنْتَ لَهُمْ وَ لَوْ كُنْتَ فَظَّا غَلِیْظَ الْقَلْبِ لَا نْفَضُّوْا مِنْ حَوْلِكَ۪.
অর্থাৎ ‘আল্লাহর দয়ায় আপনি তাদের প্রতি কোমলহৃদয় হয়েছিলেন। যদি আপনি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতেন, তবে তারা আপনার আশপাশ থেকে সরে পড়তো।’ হাদীস শরীফের ভাষায় তাঁর বিনয় ও মহানুভবতার বৈশিষ্ট্য এভাবে বর্ণিত হয়েছে-
أَجْوَدُ النَّاسِ صَدْرًا، وَأَصْدَقُ النَّاسِ لَهْجَةً، وَأَلْيَنُهُمْ عَرِيكَةً، وَأَكْرَمُهُمْ عِشْرَةً، مَنْ رَآهُ بَدِيهَةً هَابَهُ، وَمَنْ خَالَطَهُ مَعْرِفَةً أَحَبَّهُ.
অর্থাৎ ‘তিনি ছিলেন প্রশস্ত হৃদয়-মহানুভব। সত্যবাদিতায় সবার আগে; নম্রতা আর কোমলতায় অনন্য, আচার-আচরণে অভিজাত। প্রথম যে তাঁকে দেখতো ভয় করত কিন্তু যখনই কেউ তাঁর সঙ্গে মিশতো তাঁকে ভালোবাসতো।’ আলোচ্য নিবন্ধে রাসূলুল্লাহর মহানুভবতা সম্পর্কে আলোকপাত করার প্রয়াস পেলাম।
উম্মতের প্রতি ছিল রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামার গভীর মায়া, সীমাহীন মমতা এবং তাদের কল্যাণ সাধনে ছিলেন সদা ব্যাকুল, ব্যতিব্যস্ত। তাদেরকে তিনি নিঃস্বার্থ ভালোবাসতেন। পবিত্র ক্বোরআনে ইরশাদ হচ্ছে,
لَقَدۡ جَآءَکُمۡ رَسُوۡلٌ مِّنۡ اَنۡفُسِکُمۡ عَزِیۡزٌ عَلَیۡهِ مَا عَنِتُّمۡ حَرِیۡصٌ عَلَیۡکُمۡ بِالۡمُؤۡمِنِیۡنَ رَءُوۡفٌ رَّحِیۡمٌ
অর্থাৎ নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট তাশরীফ এনেছেন তোমাদের মধ্য থেকে ওই রাসূল, যিনি তোমাদের বিপন্নতায় কষ্ট পান, তিনি তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল ও পরম দয়ালু। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম মুমিনদের ব্যাপারে এতটুকু স্নেহ-মমতা রাখেন, যতটুকু মুমিনরা স্বীয় সত্তা সম্পর্কে স্নেহ-মমতা রাখেন না। অর্থাৎ আমরা নিজেকে যতটুকু ভালোবাসি, প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামার তার চেয়েও বেশি আমাদের ভালোবাসেন। অন্যত্র ইরশাদ করেছেন-
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَالَمِيْنَ.
অর্থাৎ হে নবী! আমি আপনাকে বিশ্ব জগতের জন্য কেবল রহমত করেই পাঠিয়েছি। উপর্যুক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ত্ববারী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন-
أن الله أرسل نبيه محمدا صلى الله عليه وسلم رحمة لجميع العالم، مؤمنهم وكافرهم. فأما مؤمنهم فإن الله هداه به، وأدخله بالإيمان به، وبالعمل بما جاء من عند الله الجنة. وأما كافرهم فإنه دفع به عنه عاجل البلاء الذي كان ينزل بالأمم المكذّبة رسلها من قبله.
অর্থাৎ হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম জগতের সকলের প্রতি আল্লাহ পাকের রহমত। মুমিন-কাফির নির্বিশেষে সকল মাখলুকই কিয়ামত পর্যন্ত এই মহান রহমতের মাধ্যমে উপকৃত হতে থাকবে। মুমিনকে তো আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মাধ্যমে হিদায়াত দান করেছেন। তাঁর উপর ঈমান আনা এবং তিনি আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে যে পয়গাম নিয়ে এসেছেন সে অনুযায়ী আমল করার কারণে তাকে জান্নাত দেবেন। আর এই উম্মতের অবিশ্বাসীকে তাঁর কারণে পূর্ববর্তী উম্মতের অবিশ্বাসীর মতো নগদ শাস্তি দেবেন না। তাঁর বিনয় ও মহানুভবতার সংক্ষিপ্ত চিত্র নিম্নরুপ।

ক. মানবজাতিকে বাঁচানোর চিন্তা
রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম উম্মতের ক্ষতি হবে এমন সব বিষয়ের ব্যাপারে খুব বেশি চিন্তা করতেন। উম্মতকে ক্ষতি থেকে বাঁচাতে তিনি সব সময় আমল-উপদেশসহ সমস্যা সমাধানের চিন্তা-ভাবনায় নিয়োজিত থাকতেন। আপনজন কিংবা সম্মানিত কোন ব্যক্তি ঈমান না আনলে তাঁর চিন্তা-পেরেশানি আরও বেড়ে যেত। এ ব্যাপারে রব্বে করিম নবীজিকে সম্বোধন করে ইরশাদ করেন-
لَعَلَّکَ بَاخِعٌ نَّفۡسَکَ اَلَّا یَکُوۡنُوۡا مُؤۡمِنِیۡنَ
অর্থাৎ ‘হে হাবীব! ওই সব লোক ঈমান আনছে না, এ কারণে কি তাদের চিন্তায় ও পেরেশানিতে আপনি নিজেকে শেষ করে দেবেন।’

খ. উম্মতের প্রতি নবীজিরর ভালোবাসা
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতের প্রতি বিশেষ দয়াশীল ছিলেন। এমনকি তাঁর জীবদ্দশায় যেসব উম্মতের জন্ম হয়নি অর্থাৎ অনাগত উম্মত; তাদের প্রতিও ছিল তাঁর অগাধ ভালেবাাসা। কেননা তারা না দেখেই বিশ্বনবির রেসালাতের স্বীকৃতি দেবে। এ প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন,
أَنّ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: تَلَا قَوْلَ اللهِ عَزّ وَجَلّ فِي إِبْرَاهِيمَ: رَبِّ اِنَّهُنَّ اَضْلَلْنَ كَثِیْرًا مِّنَ النَّاسِ فَمَنْ تَبِعَنِیْ فَاِنَّهٗ مِنِّیْ، وَقَالَ عِيسَى عَلَيْهِ السّلَامُ: اِنْ تُعَذِّبْهُمْ فَاِنَّهُمْ عِبَادُكَ وَ اِنْ تَغْفِرْ لَهُمْ فَاِنَّكَ اَنْتَ الْعَزِیْزُ الْحَكِیْمُ، فَرَفَعَ يَدَيْهِ وَقَالَ: اللهُمّ أُمّتِي أُمّتِي، وَبَكَى، فَقَالَ اللهُ عَزّ وَجَلّ: يَا جِبْرِيلُ اذْهَبْ إِلَى مُحَمّدٍ، وَرَبّكَ أَعْلَمُ، فَسَلْهُ مَا يُبْكِيكَ؟ فَأَتَاهُ جِبْرِيلُ عَلَيْهِ الصّلَاةُ وَالسّلَامُ، فَسَأَلَهُ فَأَخْبَرَهُ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِمَا قَالَ، وَهُوَ أَعْلَمُ، فَقَالَ اللهُ: يَا جِبْرِيلُ، اذْهَبْ إِلَى مُحَمّدٍ، فَقُلْ: إِنّا سَنُرْضِيكَ فِي أُمّتِكَ، وَلَا نَسُوءُكَ.
অর্থাৎ, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এই আয়াত পাঠ করলেন, যাতে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কথা উল্লেখ আছে- “হে আমার প্রতিপালক! এসব প্রতীমা বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। সুতরাং যে আমার অনুসরণ করবে সে আমার দলভুক্ত হবে।” [(আর সেই আয়াতও পড়লেন যেখানে আছে)। “এবং ঈসা আলায়হিস সালাম বললেন,] যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন তবে তারা তো আপনারই বান্দা। আর যদি তাদেরকে ক্ষমা করেন তবে নিশ্চয়ই আপনার ক্ষমতাও পরিপূর্ণ এবং হিকমতও পরিপূর্ণ।”
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম দু’হাত তুলে কেঁদে কেঁদে বললেন- ‘হে আল্লাহ, আমার উম্মত! আমার উম্মত!’ যা প্রতক্ষ করে আল্লাহ তাআলা হযরত জিবরিল আলায়হিস সালামকে বললেন, ‘হে জিবরাইল! আমার হাবীবের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করো, হে রাসূল! আপনি কাঁদছেন কেন?’ মহান আল্লাহ সব কিছুই অবগত আছেন। হযরত জিবরাইল আলায়হিস সালাম এসে জিজ্ঞাসা করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাকে নিজের মনের কথা ব্যক্ত করলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে জিবরাইল! তুমি রাসূলে পাকের কাছে গিয়ে বলো, আমি শীঘ্রই আপনার উম্মতের ব্যাপারে আপনাকে সন্তুষ্ট করব এবং আমি আপনাকে কষ্ট দেব না।’

গ. অমুসলিমদের অধিকার রক্ষা
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম অমুসলিম সংখ্যালঘুদের সার্বিক নিরাপত্তা এবং সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করেছিলেন। নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মালয়কে সুরক্ষিত রাখার সুযোগ দিয়েছিলেন তিনি। কোন দিন তাঁর প্রচারিত ধর্ম কোন অমুসলিমের প্রতি চাপিয়ে দেননি। তিনি তার প্রজ্ঞা ও চারিত্রিক মাধুর্য দিয়ে ইসলাম গ্রহণের জন্য আহ্বান জানাতেন। এ জন্য তিনি জীবনে অনেক যাতনা-লাঞ্ছনা সহ্য করেছেন, কিন্তু কোন দিনই ব্যক্তিগত কারণে কোন অমুসলিমের প্রতি প্রতিশোধ নেননি। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোন অমুসলিম নাগরিককে কষ্ট দিলো আমি তার (অমুসলিমের) বাদি হবো। আর আমি যার বিরুদ্ধে বাদি হবো, কিয়ামতের দিনে আমি হবো বিজয়ী’।

ঘ.শত্রুদের প্রতি মহানুভবতা
ইসলামের চরম শত্রুদের অন্তরগুলোকে আল্লাহ যেন ইসলামের দিকে ধাবিত করেন এ জন্য দোয়া করতেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। কেউ ইসলামের শত্রুদের ধ্বংস কামনা করলেও তিনি তাদের জন্য দোয়া করতেন। আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একদা আবু তোফায়েল ও তার সঙ্গীরা এসে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! (ইয়েমেনের) দাউস গোত্রের লোকেরা ইসলাম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং কুফরি করেছে। আপনি তাদের বিরুদ্ধে বদদো‘আ করুন। উপস্থিত লোকেরা বলতে লাগল ‘দাউসের লোকেরা ধ্বংস হয়ে গেছে। দাউস ধ্বংস হয়ে গেছে। হুযুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদদোয়া না করে তাদের জন্য দো‘আ করলেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি দাউস গোত্রের লোকদের হেদায়েত দিন এবং তাদেরকে (আমার কাছে) এনে দিন।
এক ইহুদি কিশোর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামার খেদমত করত। সে অসুস্থ হয়ে পড়লে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাকে দেখতে গেলেন। তার শিয়রে বসলেন। তাকে ইসলাম গ্রহণ করতে আহ্বান জানালেন। সে তখন নিজের বাবার দিকে তাকাল। বাবা বলল, তুমি আবুল কাসেমের কথা মেনে নাও। এবার ছেলেটি ইসলাম গ্রহণ করল। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় বললেন, ‘সব প্রশংসা আল্লাহর। তিনি ছেলেটিকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করেছেন’।

ঙ.মসজিদ অপবিত্রকারী বেদুইনকে ক্ষমা
রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম একবার সাহাবীদের সঙ্গে মসজিদে বসা ছিলেন। এমন সময় একজন বেদুঈন এসে সেখানে পেশাব করা শুরু করলে সাহাবিরা তাকে ধমক দিয়ে থামতে বললেন। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তাকে ছেড়ে দাও; বাঁধা সৃষ্টি কর না।’ তারপর তিনি লোকটিকে ডেকে বললেন, ‘এটা মসজিদ, এ স্থান অপবিত্রতা কিংবা পেশাব পায়খানার জন্য উপযুক্ত নয়।’ অতঃপর হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজনকে বললেন, তুমি পানিভর্তি একটা বালতি নিয়ে আসো। এরপর এর ওপর ঢেলে দাও। তিনি বালতিতে পানি এনে তার ওপর ঢেলে দিলেন। (মুসনাদে আহমদ,হাদীস: ১২৯৮৪) বস্তুত পেশাব আটকে রাখলে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা হতে পারে, এই চিন্তা থেকে মহাবিজ্ঞানী রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম লোকটিকে পেশাবের মাঝে বাঁধা দিতে নিষেধ করেন এবং মসজিদে পেশাব করার সাময়িক অনুমতি দেন। যারা উগ্র মানসিকতা সম্পন্ন, তাদের জন্য এটি একটি শিক্ষণীয় ঘটনা। যা থেকে প্রমাণিত হয় উগ্রতা ইসলাম সমর্থন করে না। ভিন্নমতাবলম্বী মানুষের সঙ্গে ইসলাম কী ধরনের ব্যবহার করতে বলেছে, তার এটি একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

চ.অমুসলিমের লাশের প্রতি সম্মান
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম মানুষকে মানব হিসেবেই সম্মান করার শিক্ষা দিতেন। তাঁর মনে অমুসলিমদের প্রতি কোনো ঘৃণা ছিল না। এমনকি কোনো ইহুদির লাশ দেখলেও সম্মান প্রদর্শনে দাঁড়িয়ে যেতেন। একবার রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার পাশ দিয়ে এক ইহুদির লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তিনি তা দেখে দাঁড়ালেন। উপস্থিত সাহাবারা বললেন, এ তো ইহুদির লাশ। নবীজি তখন তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘আলাইসাত নাফসা? অর্থাৎ, সেকি মানুষ নয়?’

ছ. অকৃতজ্ঞ তায়েফবাসীর প্রতি দয়া
অকৃতজ্ঞ উম্মতের ধৃষ্টতার সামনেও তাঁর দয়ার বাঁধ ছিল অটল। তায়েফবাসীর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন তাওহীদের বাণী, হেদায়েতের পয়গাম। তাদেরকে দেখাতে চেয়েছিলেন মুক্তির পথ। কিন্তু তাদের অজ্ঞতা তাদের উপর চেপে বসল। চরম ধৃষ্টতা দেখিয়ে তারা নবীজীর উপর চড়াও হয়েছিল। পাথরের আঘাতে তাঁকে জর্জরিত করল। আঘাতে আঘাতে তাঁকে রক্তাক্ত করে ফেলল। কেঁপে উঠল আল্লাহর আরশ। পাঠালেন জিবরাইল আমীনকে। হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম বললেন-
إِنّ اللهَ عَزّ وَجَلّ قَدْ سَمِعَ قَوْلَ قَوْمِكَ لَكَ، وَمَا رَدّوا عَلَيْكَ، وَقَدْ بَعَثَ إِلَيْكَ مَلَكَ الْجِبَالِ لِتَأْمُرَهُ بِمَا شِئْتَ فِيهِمْ، قَالَ: فَنَادَانِي مَلَكُ الْجِبَالِ وَسَلّمَ عَلَيّ، ثُمّ قَالَ: يَا مُحَمّدُ، إِنّ اللهَ قَدْ سَمِعَ قَوْلَ قَوْمِكَ لَكَ، وَأَنَا مَلَكُ الْجِبَالِ وَقَدْ بَعَثَنِي رَبّكَ إِلَيْكَ لِتَأْمُرَنِي بِأَمْرِكَ، فَمَا شِئْتَ، إِنْ شِئْتَ أَنْ أُطْبِقَ عَلَيْهِمُ الْأَخْشَبَيْنِ
অর্থাৎ আপনার কওম আপনার উদ্দেশে যা বলেছে এবং আপনার সাথে যে আচরণ করেছে আল্লাহ তা দেখেছেন। আপনার আদেশ পালনে পাহাড়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ফিরিশতাকে পাঠিয়েছেন। তখন পাহাড়ের ফিরিশতা আমাকে সম্বোধন করে সালাম দিল এবং বলল, আমি পাহাড়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ফিরিশতা। হে রাসূল! আপনার কওমের বক্তব্য আল্লাহ শুনেছেন। আমাকে পাঠিয়েছেন আপনার আদেশ পালন করতে। আপনি আমাকে কী আদেশ করবেন করুন। আপনি যদি আদেশ করেন তাহলে আমি দুই পাহাড়ের মাঝে এদেরকে পিষে ফেলব। কিন্তু দয়ার সাগর নবীজী জবাব দিলেন-
بَلْ أَرْجُو أَنْ يُخْرِجَ اللهُ مِنْ أَصْلَابِهِمْ مَنْ يَعْبُدُ اللهَ وَحْدَهُ لَا يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا.
অর্থাৎ (আমি এটা চাই না;) বরং আমি আশা রাখি, আল্লাহ তাআলা এদের বংশধরদের মাঝে এমন মানুষ বের করবেন, যারা এক আল্লাহ্র ইবাদত করবে, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না।

জ. যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে মানবিক আচরণ
যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করতেন নবীজি। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামার সমরনীতিতে অনর্থক রক্তক্ষয়ের উন্মাদনা ছিল না। তাই অল্প লোকক্ষয় ও সীমিত সময়ে মুসলিম সেনাবাহিনী বিজয়ী হত। যুদ্ধে যেসব অমুসলিম নিহত হতো, তাদের লাশ যেন বিকলাঙ্গ না করা হয়, সে ব্যাপারে নবীজি ছিলেন সদা তৎপর। আর যারা বন্দি হতো, তাদের সঙ্গেও করতেন কোমল ও সম্মানপূর্বক আচরণ। এ প্রসঙ্গে সাহাবীদের ইরশাদ করেন , ‘যে মুসলিম তার বন্দির সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’

ঝ. উম্মতের জন্য বিশ্বনবির কোরবানি
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম উম্মতের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি পেতে পৃথক পশু কোরবানি করতেন। যা ছিল উম্মতের জন্য রাসূলুল্লাহর ভালোবাসার অনন্য দৃষ্টান্ত। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু রাফে রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কোরবানির সময় দুইটি মোটা-তাজা শিং বিশিষ্ট দুম্বা ক্রয় করতেন। নামায আদায় করে খুতবা দিতেন। এরপর তিনি নামাযের স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতেই একটি দুম্বা নিয়ে আসা হতো। তা তিনি নিজ হাতে কোরবানি করতেন আর বলতেন-‘হে আল্লাহ! এটা আমার পুরো উম্মতের পক্ষ থেকে, যারা আপনার তাওহিদের সাক্ষ্য দিয়েছে এবং আমার রেসালাত পৌঁছে দেওয়ার সাক্ষ্য দিয়েছে।’

ঞ. অন্যান্য আমলে উম্মতের প্রতি দয়া প্রদর্শন
সূরা তাওবার ১২৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে সিরাতুল জিনানে মুসলমানের প্রতি হুযুর পুরনূর এর দয়া ও মমতার কিছু নমুনা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন-(১) উম্মত দুর্বল, অসুস্থ এবং কাজকর্ম সম্পাদনকারী লোকের কষ্ট হবে বলে ইশার নামাযকে রাতের তৃতীয়াংশ পর্যন্ত দেরী করেননি। (২) দুর্বল, অসুস্থ এবং শিশুদের প্রতি লক্ষ্য রেখে নামাযের কিরাতকে বেশি দীর্ঘ না করার আদেশ দিয়েছেন। (৩) রাতের নফল সর্বদা আদায় করেননি, যাতে তা উম্মতের উপর ফরয হয়ে না যায়। (৪) উম্মত কষ্টে পতিত হওয়ার আশঙ্কায় তাদেরকে সওমে বিছাল রাখতে নিষেধ করে দেন (ইফতার করা ছাড়াই পরবর্তি রোযা রেখে দেয়া এবং এভাবে লাগাতার রোযা রাখাকে সওমে বিছাল বলা হয়)। (৫) উম্মতের কষ্টের কারণে প্রতি বছর হজ্ব ফরয করেননি। (৬) মুসলমানদের প্রতি দয়া করে শুধুমাত্র তাওয়াফের তিন চক্করে রমলের নির্দেশ দিয়েছেন, সকল চক্করে নয়। (৭) প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম সম্পূর্ণ রাত জেগে ইবাদতে লিপ্ত থাকতেন এবং উম্মতের মাগফিরাতের জন্য আল্লাহ পাকের দরবারে খুবই অস্থিরতার সাথে কান্নাকাটি করতে থাকতেন, এমনকি দাঁড়াতে দাঁড়াতে প্রায় তাঁর পা মুবারক ফুলে যেতো। এ প্রসঙ্গে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন কিয়ামতের দিন সকল আম্বিয়ায়ে কিরাম আলায়হিমুস সালাম স্বর্ণের মিম্বরে উপবিষ্ট থাকবেন, আমার মিম্বর খালি থাকবে, কেননা আমি আপন দয়ালূ রবের নিকট চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবো যে, এমন যেনো না হয়, আমাকে জান্নাতে প্রবেশের আদেশ দিয়ে দিবেন আর আমার উম্মতরা আমার অবর্তমানে কষ্টে পতিত হতে থাকবে। আল্লাহ পাক ইরশাদ করবেন: হে মাহবুব! আপনার উম্মতের ব্যাপারে সেটাই সিদ্ধান্ত নিবো, যা আপনার ইচ্ছা। আমি আরয করবো: اَللّٰهُمَّ عَجِّلْ حِسَببَهُم
অর্থাৎ হে দয়ালু আল্লাহ! তাদের হিসাব দ্রুত নিয়ে নিন।” এবং এরূপ বারবার আরয করতে থাকবো, এক পর্যায়ে আমাকে দোযখে যাওয়া উম্মতদের তালিকা প্রদান করা হবে (যারা দোযখে প্রবেশ করেছে তাদের শাফায়াত করে আমি তাদেরকে বের করতে থাকবো) আর এভাবে আল্লাহর আযাবের জন্য আমার উম্মতের মধ্যে কেন ব্যক্তিই অবশিষ্ট থাকবে না। (৮) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম উম্মতের প্রতি ভালোবাসা থেকেই বারবার গিয়ে ৫০ ওয়াক্ত নামাজকে ৫ ওয়াক্তে নির্ধারণে সুপারিশ ও বাস্তবায়ন করেছেন। (৯) আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় আমল মেসওয়াক করাকে বাধ্যতামূলক করেননি। বরং সুন্নাত আমলে রেখেছেন; কারণ বাধ্যতামুলক করলে এসব আমল পালন না করলেই গুনাহগার হতে হতো। সর্বোপরি তিনি সব সময় উম্মতের কষ্ট কমানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন।
একান্ত জাগতিক বিষয়েও উম্মতের বিপদাপদে নবীজী ছিলেন নিঃস্বার্থ সহযোগিতার আধার। প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবূ হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَا مِنْ مُؤْمِنٍ إِلّا وَأَنَا أَوْلَى النّاسِ بِهِ فِي الدّنْيَا وَالآخِرَةِ، اقْرَءُوا إِنْ شِئْتُمْ: اَلنَّبِیُّ اَوْلٰی بِالْمُؤْمِنِیْنَ مِنْ اَنْفُسِهِمْ فَأَيّمَا مُؤْمِنٍ تَرَكَ مَالًا فَلْيَرِثْهُ عَصَبَتُهُ مَنْ كَانُوا، فَإِنْ تَرَكَ دَيْنًا، أَوْ ضَيَاعًا فَلْيَأْتِنِي فَأَنَا مَوْلاَهُ.
অর্থাৎ, দুনিয়া ও আখেরাতে আমি প্রত্যেক মুমিনেরই সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতর। ইচ্ছা হলে তোমরা এ আয়াতটি তিলাওয়াত কর- اَلنَّبِیُّ اَوْلٰی بِالْمُؤْمِنِیْنَ مِنْ اَنْفُسِهِمْ (অর্থাৎ মুমিনদের পক্ষে নবী তাদের প্রাণ অপেক্ষাও বেশি ঘনিষ্ঠ।) তাই সম্পদ রেখে কোনো মুমিন মারা গেলে আত্মীয়-স্বজন তার ওয়ারিস হবে। আর যদি সে ঋণ কিংবা অসহায় পরিজন রেখে যায়, তবে তারা যেন আমার নিকট আসে। আমিই তাদের অভিভাবক।
সুহৃদ পাঠক, স্বার্থহীনতার কেমন আদর্শ ছিলেন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম। একদিকে অসহায় উম্মতের অভিভাবক তিনি। কিন্তু অপরদিকে তাদের বিত্ত বৈভবের দাবিদার নন। আর তাই তো অন্যত্র নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- إِنّمَا أَنَا لَكُمْ مِثْلُ الْوَالِد.
অর্থাৎ, আমি তোমাদের জন্য পিতৃতুল্য। বরং তিনি কি জন্মদাতা পিতার চেয়েও বেশি ঘনিষ্ঠ নন? ইহলোক পাড়ি দিয়ে আখিরাতের কঠিন মুহূর্তেও এ উম্মতের মুক্তির সুপারিশ করবেন তিনি। এই প্রসঙ্গে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لِكُلِّ نَبِيٍّ دَعْوَةٌ مُسْتَجَابَةٌ يَدْعُو بِهَا فَيُسْتَجَابُ لَهُ، فَيُؤْتَاهَا، وَإِنِّي اخْتَبَأْتُ دَعْوَتِي شَفَاعَةً لِأُمَّتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ.
অর্থাৎ, প্রত্যেক নবীকে এমন একটি বিশেষ দুআর অধিকার দেয়া হয়েছে, যা কবুল করা হবে। তারা (দুনিয়াতে) সে দুআ করেছেন এবং তা কবুলও করা হয়েছে। আর আমি আমার দুআ কিয়ামতের দিন আমার উম্মতের শাফাআতের উদ্দেশ্যে মূলতবী রেখেছি। অতএব প্রত্যেক মুসলমানের উচিত, রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামার আদর্শ ও হুকুম-আহকাম বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ ভালোবাসার প্রতিদান দেওয়া। কুরআন-সুন্নাহর উপর আমল করার মাধ্যমে রাসূলের ভালোবাসা অর্জন করা।
হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামার মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে কাফের-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই তাঁকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন। ফলে শত বাধা-বিপত্তি ও বিপদসঙ্কুুল পথ পাড়ি দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই ইসলাম বিজয়ী আদর্শরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আজো নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামার মহানুভবতার আলোকে নিজেদের জীবনকে গড়ে তুললে সর্বত্র শান্তি নিশ্চিত হবে ইনশা আল্লাহ। রব্বে করিম আমাদেরকে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামার আদর্শ অনুসরণ ও অনুকরণ করে সত্যিকারে আশেকে রাসূল হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন বিজাহিন নবীয়্যিল আমিন সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম।

টিকা:

– সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯
– জামে তিরমিজি
– সূরা তাওবা,আয়াত: ১২৮
– সূরা আহযাব, আয়াত: ৬
– সূরা আম্বিয়া,আয়াত: ১০৭
– তাফসীরে ত্ববারী ১৮/৫৫২,সূরা আম্বিয়া,আয়াত: ১০৭
– সূরা শুআরা, আয়াত:৩
– সূরা মায়েদা, আয়াত:১১৮
– সহিহ মুসলিম, হাদীস ২০২
– মা’রিফাতুস সুনান ওয়াল আসার, হাদীস: ৫৭৫০
– সহিহ বুখারী
– সহিহ বুখারী
– সহিহ বুখারী, হাদীস: ১৩১২
– সহিহ বুখারী, হাদীস: ৩২৩১; সহিহ মুসলিম, হাদীস: ১৭৯৫
– মুসনাদে আহমদ,হাদীস: ৩২
– মুসনাদে আহমদ
– সীরাতুল জিনান, ৫/২৬৭
– কানযুল উম্মাল, কিতাবুল কিয়ামতি, ৭/১৭৮, হাদীস:৩৯১১১
– সহিহ বুখারী, হাদীস: ৪৭৮১
– সহিহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস:৮০; সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদীস: ১৪৩১
– সহিহ মুসলিম,হাদীস:১৯৯

লেখক : আরবি প্রভাষক, তাজুশ শরী‘আহ দরসে নিযামী মাদরাসা, ষোলশহর, চট্টগ্রাম।