আ’লা হযরত ও আলে রাসূলের প্রতি সম্মান

আ’লা হযরত ও আলে রাসূলের প্রতি সম্মান

মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ্ আল-মাসুম>

রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামার প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও ভালোবাসার পূর্ণতা হলো তাঁর আহলে বায়ত তথা নবী পরিবার, রাসূলুল্লাহর বংশধরকে ভালবাসা এবং তাঁদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা। ইরশাদ হচ্ছে -قُل لَّا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلَّا الْمَوَدَّةَ فِي الْقُرْبَى
অর্থাৎ হে হাবিব! আপনি বলুন,‘আমি সেটার (আমার কৃত দাওয়াতের) জন্য তোমাদের নিকট থেকে কোন পারিশ্রমিক চাই না, কিন্তু চাই আমার স্বজনদের (আহলে বাইতদের) প্রতি ভালোবাসা।’ এ প্রসঙ্গে হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কোনো ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবেনা যতক্ষণ পর্যন্ত সে আমাকে ভাল না বাসবে। আমার ভালবাসা অর্জন হবেনা, যে পর্যন্ত সে আমার আহলে বাইত (এবং বংশধর)কে ভালবাসবে না। যার বাস্তব অনুশীলন সরকারে আ’লা হযরত শাহ আহমদ রেযা খান রাহমাতুল্লাহি আলায়হির বরকতময় হায়াতে পরিলক্ষিত হয়। হায়াতে আ’লা হযরত গ্রন্থের বর্ণনা মতে, একজন অল্প বয়স্ক ছেলে ঘরের কাজ কর্মে সাহায্য করার জন্য ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি আলায়হির ঘরে চাকরি নেয়। হুযূর পরে জানতে পারলেন যে, ইনি হচ্ছেন সৈয়্যদজাদা। অতঃপর তিনি পরিবারের সদস্যদের সতর্ক করে দিলেন যে, সাবধান! সাইয়িদজাদাকে দিয়ে কোন কাজ করাবে না, কেননা ইনি হচ্ছেন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামার বংশধরদের অন্তর্ভূক্ত। তাঁর থেকে খেদমত গ্রহন করবে না বরং তাঁর খেদমত করা উচিৎ। সুতরাং পানাহার এবং যা কিছুই প্রয়োজন হয় তাঁর খেদমতে পেশ করবে। যে বেতনের কথা হয়েছিলো তা উপহার স্বরূপ পেশ করতে থাকবে। এভাবে হুযূরের আদেশ অনুযায়ী আমল হতে থাকলো। কিছুদিন পর সেই সাইয়িদজাদা নিজ থেকেই বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।

একবার ভারত বর্ষের বেরেলী শহরের এক মহল্লায় ইমাম আহমদ রযা খানঁ রাহমাতুল্লাহি আলায়হিকে দা’ওয়াত দেয়া হল। নির্ধারিত দিনক্ষণে দাওয়াত দাতা তাঁকে আনার জন্য পালকির ব্যবস্থা করলেন। আ’লা হযরত রাহমাতুল্লাহি আলায়হি পালকিতে আরোহণ করলেন আর চারজন পালকি বহনকারী কাঁধে নিয়ে যাত্রা শুরু করল। কিছু দূর যেতে না যেতেই ইমাম আ’লা হযরত রাহামাতুল্লাহি আলায়হি হঠাৎ পালকির ভিতর থেকে আওয়াজ দিলেন: “পালকি থামাও।” পালকি থামানো হলো। তিনি দ্রুত পালকি থেকে বাইরে নেমে এলেন। আবেগময় স্বরে পালকি বহনকারীদের উদ্দেশ্যে বললেন: “সত্য করে বলুন, আপনাদের মধ্যে সাইয়িদজাদা কে? কেননা, আমি আমার ঈমানের অনুভূতি শক্তিতে তাজেদারে মদীনা, হুযুর এর সুগন্ধ পাচ্ছি।” এক পালকি বাহক সামনে অগ্রসর হয়ে আরয করল: “হুযুর! আমি সৈয়্যদ।” এ কথা বলতে না বলতেই ইমাম আ’লা হযরত নিজ আমামা (পাগড়ি) শরীফ ঐ সায়্যিদজাদার কদমের উপর রেখে দিলেন। আ’লা হযরত রাহমাতুল্লাহি আলায়হির চোখ মুবারক হতে টপটপ করে অশ্রু ঝরছিল আর হাত জোর করে আরয করছিলেন: “সম্মানিত শাহজাদা! আমার অপরাধ মাফ করে দিন। অজানা বশতঃ আমার ভুল হয়ে গেছে। হায়, আফসোস! একি ঘটল? যাঁর পবিত্র জুতা মুবারকে আমার সম্মানের মুকুট হওয়া উচিত, তাঁরই কাঁধে আমি আরোহী হয়ে গেলাম। যদি কিয়ামতের দিন তাজেদারে রিসালাত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাকে জিজ্ঞাসা করেন: হে আহমদ রযা! আমার বংশের সন্তানের নরম কাঁধ কি এজন্যই ছিল যে, তা তোমার আরোহণের বোঝা বহণ করবে? তখন আমি কি জবাব দিব! তখন হাশরের ময়দানে আমার ইশ্কের কতই না অবমাননা হবে?” কয়েকবার শাহজাদার মুখে ক্ষমার স্বীকারোক্তি নেয়ার পর হুযূর আ’লা হযরত রাহমাতুল্লাহি আলায়হি পরিশেষে এই অনুরোধটুকু জানালেন: “সম্মানিত শাহজাদা! এ অজানা বশতঃ হয়ে যাওয়া ভুলের কাফ্ফারা তখনই পরিশোধ হবে যখন আপনি পালকিতে উঠে বসবেন আর আমি আমার কাঁধে পালকিটি বহন করব।” এ অনুরোধ শুনে উপস্থিত লোকজনের চোখ থেকে পানি ঝরতে লাগল। হাজারো অস্বীকৃতির পরও শেষ পর্যন্ত শাহজাদাকে পালকিতে আরোহণ করতেই হল। যা ছিল অকল্পনীয় দৃশ্য। ইমাম আ’লা হযরত রাহমাতুল্লাহি আলায়হি মজুরের কাতারে শামিল হয়ে স্বীয় সুখ্যাতি সম্মানকে আল্লাহর মাহবুব হুযুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামার সন্তুষ্টি অর্জনার্থে অপরিচিত কুলী শাহজাদার কদমে উৎসর্গ করছেন।

ইমাম মালেক ইবনে আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে যখন আব্বাসি খলিফার নির্দেশে কোড়া মারা হলো, তখন তিনি স্মৃতিশক্তি ফিরে পেয়ে তাৎক্ষণিক বললেন, ‘হে লোকসকল! তোমরা সাক্ষী থাকবে, আমি এ জুলুম ক্ষমা করে দিলাম। কারণ আমার লজ্জা হচ্ছে যে, হাশরের ময়দানে আমার কারণে আমার প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামার চাচার বংশধরদের কেউ যেন জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় আটকা পড়ে না যায়!’ তাই সাইয়িদজাদা বা নবী বংশের সঙ্গে দূরতম সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তিদেরকেও সর্বোচ্চ সম্মান-আদব দেখাতে হবে। তাঁদের প্রতি প্রেম-ভালোবাসা থাকা, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামার প্রতি প্রেম-ভালোবাসারই একটা অংশ ও শাখাতুল্য। এটি মনে-প্রাণে বুঝে নিতে হবে। তাদের হাদিয়া-সম্মানী, উপহার প্রদান, তাদের অন্যান্য প্রয়োজনের প্রতি খেয়াল রাখা নিজ দায়িত্ব বলে মনে করতে হবে। আর যিনি সাইয়িদ বা নবী বংশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হবেন তাদেরকেও সকল অন্যায়-অপকর্ম থেকে বেঁচে থাকতে হবে।

আ’লা হযরত রাহমাতুল্লাহি আলায়হি থেকে সাইয়িদ বংশীয়দের সাইয়িদ হওয়ার প্রমাণ চাওয়া এবং না পাওয়াতে গালমন্দকারী ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি উত্তরে বলেন: ফকির (অর্থাৎ নিজেকে তিনি ফকির বলে উল্লেখ করেছেন) অনেক ফতোয়া দিয়েছি যে, কাউকে সাইয়িদ মনে করা এবং তাঁকে সম্মান করার জন্য আমাদের নিজেদের ব্যক্তিগতভাবে তার সাইয়িদ হওয়া সম্পর্কে জানা আবশ্যক নয়, যে লোকেরা সাইয়িদ পরিচয় দেয়, আমরা তাঁদের সম্মান করবো, আমাদের অনুসন্ধান করার প্রয়োজন নেই, সাইয়িদ হওয়ার প্রমাণ চাওয়ারও আমাদের আদেশ দেয়া হয়নি এবং জোরপূর্বক প্রমাণ দেখানোর প্রতি বাধ্য করা এবং না দেখানোতে গালমন্দ করা, বদনাম করা নাজায়িয তথা বৈধ নয়। তবে হ্যাঁ! যাদের পূর্বপুরুষ সম্পর্কে আমরা ভালভাবে জানি যে, তারা সাইয়িদ নয় এবং তারা নিজেকে সাইয়িদ দাবী করছে, তবে তাদের সাইয়িদ হিসেবে সম্মান করবো না, না তাদের সাইয়িদ বলবো আর উচিৎ হবে যে, অনবহিতদেরকে তাদের ধোকা সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া।

যাদের সাইয়িদ বংশীয়দের সম্মান ও মর্যাদা এবং আদব রক্ষা বা তাঁদের চাহিদা পূরণ করার ততক্ষণ পর্যন্ত মানসিকতাই তৈরী হয়না, যতক্ষণ সাইয়িদ বংশীয়রা নিজেদের বংশনামা সম্পর্কে কোন সাক্ষ্য উপস্থাপন করতে পারে না বা সনদ দেখাতে পারে না- এরূপ লোকদের ভয় করা উচিৎ যে, তাদের এই মন্দ স্বভাবের কারণে যদি নানায়ে হাসানাইন, তাজেদারে মদীনা, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম অসন্তুষ্ট হয়ে যান এবং কিয়ামতের দিন তার থেকে মুসলমান হওয়ার প্রমাণ চান, তবে মনে রাখুন! তখন ভয়াবহ লজ্জায় পরতে হবে। সাইয়িদ বংশীয়দের কেনইবা ভালবাসবো না, কেননা এই ব্যক্তিত্বদের প্রতি ভালবাসা পোষন করার জন্য তো স্বয়ং রাব্বুল ইজ্জত নির্দেশ দিয়েছেন। উপর্যুক্ত আয়াতে করিমার তাফসীরে আ’লা হযরত, ইমামে আহলে সুন্নাত মাওলানা শাহ ইমাম আহমদ রযা খাঁন রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন:قربي দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সাইয়িদ বংশীয়রা এবং আহলে বাইতগণ। সাইয়িদ বংশীয়দের সম্মান করা ফরয এবং তাঁদের অসম্মান করা হারাম বরং ওলামায়ে কিরামগণ বলেন: যে ব্যক্তি কোন আলিমকে মাওলাভীয়া বা কোন মীর (সাইয়িদ)কে মীরুয়া তুচ্ছ করে বলবে, সে কাফির সাব্যস্ত হবে।

সাবধান! যে ব্যক্তি আহলে বায়তে রাসূলের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে মৃত্যুবরণ করে, কিয়ামতের দিনে তার কপালে লেখা থাকবে সে আল্লাহ তা’আলার রহমত হতে বঞ্চিত। এমনকি সে জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। সুতরাং মহান প্রতিপালক ও তাঁর হাবীব হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামার সন্তুষ্টি লাভ করতে হলে প্রত্যেক উম্মতের জন্য দায়িত্ব হলো নবী পরিবার এবং আলে রাসূলের প্রতি সুধারণা পোষণ করা, তাঁদেরকে মুহাব্বত করা ও সম্মান-ইজ্জত করা। রব্বে করিম আমাদেরকে সাইয়িদজাদাদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রর্দশন করার তাওফিক দান করুন, আমিন বিজাহিন নবিয়্যিল আমিন সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম।

টিকা:
. সূরা শুরা,আয়াত: ২৩
. সুনানে ইবনে মাজাহ
. আল্লামা জাফরুদ্দীন বাহারী, হায়াতে আ’লা হযরত, ১/১৭৯
. আনওয়ারে রযা, ৪১৫ পৃষ্ঠা
. মাদারিজ
. ইমাম আহমদ রেযা খান, ফতোয়ায়ে রযবীয়া, ২৯/৫৮৭ ও সা’আদাতে কিরাম কি আযমত, ১৪-১৫ পৃ:
. সূরা শুরা, আয়াত ২৩
. মলফুযাতে আ’লা হযরত, ৫০১ পৃ:
. ইমাম আহমদ রেযা খান, ফতোয়ায়ে রযবীয়া, ২২/৪২০
. তাফসীরে কাবির,২৭/১৬৫, (মিশর); তাফসীরে কাশশাফ ওয়াল বায়ান,৩/৬৭, (মিশর); তাফসীরে কুরতুবি,১৬/২২ (মিশর)

লেখক: আরবী প্রভাষক, তাজুশ শরীআহ (দরসে নেজামী) মাদ্রাসা, বিবিরহাট, পাঁচলাইশ, চট্টগ্রাম