আত্মবিস্মৃত যুবসমাজ ও প্রিয়নবী’র জীবনাদর্শ

আত্মবিস্মৃত যুবসমাজ ও প্রিয়নবী’র জীবনাদর্শ

মুহাম্মদ আনোয়ার শাহাদাত>

মানবজীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সময়ের নাম হলো যৌবন। জীবন ধারাপাতের বিভিন্ন অধ্যায়ের মধ্যে খুবই মূল্যবান, অর্থবহ, কর্মবহুল এবং সাধনার অধ্যায় হলো ’যৌবন কাল’। জীবনের মোড় নির্ধারণী এই যৌবনেই মানুষের চেতনার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটে। অফুরন্ত প্রাণশক্তি ও সৃষ্টির উন্মাদনায় বিভোর থাকা যৌবনকাল হলো পুরাতনকে ভেঙ্গে নতুন করে সাজাবার সময়। অপ্রতিরোধ্য ঝড়-ঝাঞ্চা আর বাঁধভাঙ্গা উচ্ছাসে দৃপ্ত শপথে এগিয়ে যাওয়ার সময় হলো যৌবনকাল। সকল প্রতিবন্ধকতা আর অসম্ভবকে দু’পায়ে মাড়িয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনার জন্য যুবসমাজ সবসময় যেন উন্মুখ হয়ে থাকে। কেননা যৌবনের অনুরণন-ই এরকম। সকল অন্যায়- অবিচার, জোর-জুলুম, নির্যাতন-নিপীড়ন, অনিয়ম আর অত্যাচারের অবসান ঘটিয়ে সুন্দর ও সাবলীল পরিবেশ সৃষ্টি করে সমাজকে নিরাপদ বাসযোগ্য করার জন্য যুগে যুগে যুবসমাজের ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় পাতায় অনুকরণীয় ও স্মরণীয় উদাহরণ হয়ে আছে। পৃথিবীর সকল সফলতা আর বিজয়ের অগ্রপথিক হলো যুব সমাজ। প্রতিটি দেশের সংগ্রাম, আন্দোলন, যুদ্ধ এবং যে কোন কঠিন পরিস্থিতি ও বাধার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সেই দেশের তরুণ ও যুব সমাজের ভূমিকা সর্বাগ্রে। অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা, সামাজিক আন্দোলন, মানব সম্পদ উন্নয়ন, মানবাধিকার, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, সাহিত্য, ধর্ম-দর্শন সহ এমন কোন বিভাগ নেই যেখানে যুব সমাজ মুখ্য ভূমিকা পালন করে না। তরুণ ও যুব সমাজের মেধা-মনন, সুশিক্ষা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, ও কর্মদক্ষতার উপর নির্ভর করে একটি দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। নৈতিক গুণাবলী সম্পন্ন তরুণ ও যুব সমাজের অংশ গ্রহণ ব্যতীত কোন অর্জন টেকসই হতে পারে না। প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে যুবকদের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪ কোটিরও বেশি। এই বিশাল তরুণ ও যুব সমাজের সফলতার উপর নির্ভর করবে আমাদের দেশ-জাতির আগামী।

আল্লাহর মনোনীত দ্বীন ইসলামে যৌবনের গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামের দৃষ্টিতে যৌবনকাল আল্লাহর পক্ষ হতে বড়ই নেয়ামত। যৌবনের যথাযথ মূল্যায়ন, পরিচর্যা ও সঠিক পথনির্দেশনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যৌবনের নৌকা যদি একবার অনৈতিকতার প্রবল স্রােতে ভেসে যায় তাহলে তা জীবনের প্রকৃত মোহনায় মিলিত হওয়া দূরূহ হয়ে উঠে। যৌবনকে যদি জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সফল করার সিঁড়ি বানাতে না পারে, ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির সোপান বানাতে না পারে তাহলে পুরো জীবনই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। একটি জাতিকে উন্নয়নের চূড়ায় পৌঁছাতে যুবসমাজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করি তাহলে দেখা যাবে পৃথিবীতে যত পরিবর্তন, উন্নয়ন, সভ্যতার বিকাশ, শিল্প বিপ্লব, তথ্য-প্রযুক্তির আকাশ ছোঁয়া উন্নতি সবকিছুর মূলে মূখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে এই যুবসমাজ। তেমনিভাবে ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও আমরা দেখতে পাই তরুণ-যুবকদের অমর কীর্তি ইসলামের ইতিহাসের পাতায় সোনালি হরফে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ইতিহাসের প্রতিটি আন্দোলনে বিজয় কিংবা সাফল্যের পেছনে আছে যুবসমাজের সংগ্রাম আর আত্মত্যাগ। অথচ আজকে যদি আমরা দেশের তরুণ-যুবকদের দিকে দৃষ্টি দিই তাহলে যে চিত্র ভেসে উঠে তা মোটেও স্বস্তিদায়ক বা আশাব্যঞ্জক নয় বরং হতাশাজনক। আজকের যুবসমাজ তাদের আত্মপরিচয় ভুলে গিয়ে অন্ধকারের সর্বনাশা গলিপথে উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা ভুলে গেছে তাদের পরিচয়, ক্ষমতা, দক্ষতা ও শক্তি সামর্থ্যের কথা। নব-সৃষ্টির উন্মাদনা আজ তাদের মাঝে নেই। তারা জানে না, তাদের কী পরিচয়, কোথায় তাদের গন্তব্য! তারা ভুলে গেছে তাদের অতীত স্বর্ণালী ইতিহাস। অনৈতিকতা আর নেশার সর্বনাশী প্রলোভনে নিজেদের মূল্যবান জীবনকে সপেঁ দিয়ে দিন- দিন অমানিশার অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। আর সাথে সাথে অনিশ্চতায় ঠেলে দিচ্ছে ব্যক্তিজীবন, পরিবার, সমাজ ও দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে। আজকের যুবসমাজ ভুলে গেছে তাদের রক্তের বিনিময়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়েছে অসংখ্য শাসক-শোষকের রাজ্যসীমা, রচিত হয়েছে হাজারো নতুন ইতিহাস। অথচ খুবই দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজকে তারা এমন কোন হীন কাজ নেই যা করছে না। চাঁদাবাজি, গুম, খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ, হল দখল, মাদকাসক্তি, ইভটিজিং এবং সবচাইতে ভয়ঙ্কর হলো জঙ্গীবাদের মতো ভয়াবহ সন্ত্রাসেও জড়িত। যুবসমাজের এই অধঃপতনের প্রধান কারন হলো মানবজীবনের জন্য ¯্রষ্টা কর্তৃক প্রেরিত বিধান আল-কোরান এবং মানবতার সার্বজনীন কল্যানকামী এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুকরণীয় আদর্শ প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের প্রদর্শিত পথ অনুসরন না করা। তাছড়াও নৈতিক শিক্ষার অভাব, অর্থনৈতিক সংকট, বেকার সমস্যা সহ চলমান সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বহুলাংশে এর নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। যুবসমাজ যখন নিজেকে অধিকার বঞ্চিত ভাবে, সমাজ বা রাষ্ট্রকে নিজের ব্যর্থতার জন্য দায়ী মনে করে এবং তা থেকে পরিত্রানের কোন সদুপায় জানা না থাকে, তখনই প্রতিক্রিয়াশীল কার্যক্রমে নিজেকে জড়িয়ে নেয়। জগাখিচুড়ি মার্কা আদর্শে পরিপুষ্ঠ আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার কারনে অত্যাচার, নির্যাতন, সহিংসতা, মিথ্যাচার, প্রতারণা, দ্বিচারিতা, অমানবিকতা, অযৌক্তিকতা, দলীয়করণ, মেধার অবমূল্যায়ন, সম্পদের অসম বন্টন, বিচারহীনতা, ঘুষ, দূর্ণীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রাচুর্য্যরে লোলুপতা, নৈতকতাহীন নেতৃত্ব আমাদের মুক্ত বিবেকের দুয়ারে প্রতি মুহুর্তে প্রবলভাবে যে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে, আবেগপ্রবণ তরুণ-যুবকদের পক্ষে তা সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের চিত্তমানস জুড়ে আকুলি-বিকুলি করতে থাকে হাজারো ভাবনা আর পরিকল্পনা। জীবনের এই সংশয়াচ্ছন্ন বয়সে যারা সঠিক শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা পেয়েছে, সঠিক আদর্শের পরশ পেয়েছে, সঠিক নেতৃত্বের সংস্পর্শে আসতে সক্ষম হয়েছে তারা এক সময় সমাধানের উপায় বা পথ খুঁজে নেয়। কিন্তু যারা কোন পথভ্রষ্ট, আদর্শহীন, চরিত্রহীন ও স্বার্থবাদী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর খপ্পরে পড়ে তারা সমাজবিধংসী ও আত্মবিনাশী রাস্তাকেই সমাধানের যথার্থ পথ ভেবে বসে। আত্মবিস্মৃতির অতলে ভাসিয়ে দেয় জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় যৌবনকাল। এই অবস্থা থেকে আমাদের যুবসমাজকে বেরিয়ে আসতে হবে। আত্মবিস্মৃত হওয়া বা আপন অস্তিত্ব ভুলে গেলে চলবে না। মানুষ হিসেব সৃষ্টির যে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা এবং সময় হিসেবে জীবনের সবচাইতে মূল্যবান সময় ’যৌবনকাল’ যেন কোনভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত না হয় সেই পদক্ষেপ নিতে হবে। খুঁজে নিতে হবে মানবজীবনের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ, সবচাইতে সফল ও নিস্কলুস জীবনচরিত। যে আদর্শের পরশ পেয়ে ইয়াসরিব নামক ধূ-ধূ মরুভূমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শহর সোনার মদিনায় পরিণত হয়। যে আদর্শের সংস্পর্শে এসে বর্বর একটি জাতি পৃথিবীর অন্যতম সভ্যজাতিতে পরিণত হয়। নেশার প্লাবনে যে শহরের অলি-গলি ভেসে যেত সেই শহরের প্রতিটি গলি পবিত্রতা আর জান্নাতি খুশবোয় বিভোর হয়। কণ্যাশিশুর জীবন্ত কবরের পরিবর্তে নারীকে মানবেতিহাসের অভূর্তপূর্ব অনন্য আসনে অধিষ্ঠিত করেছে যে আদর্শ, চরম শত্রুরা তাদের অর্থ সম্পদ জমা রাখতো যার কাছে এবং আল-আমিন উপাদিতে ভূষিত করেছে যে আদর্শকে এবং যে আদর্শের কোন কলুষতা নেই, কোন ব্যর্থতা নেই, কোন তুলনা নেই, কোন কৃত্রিমতার আবরণ নেই, যে আদর্শ মানবজীবনের সর্বক্ষেত্রে শতভাগ সফল, যে আদর্শ সৃষ্টি থেকে প্রলয় পর্যন্ত সমভাবে কার্যকর ও অনুসরনীয়, যে আদর্শের মধ্যে মানবতার একমাত্র মুক্তি ও শান্তি, যে আদর্শকে মহান রাব্বুল আলামীন শ্রেষ্ঠতম আদর্শ করে সমগ্র সৃষ্টির জন্য পাঠিয়েছেন সেই অনুপম আদর্শ বা উসওয়াাতুন হাসানাহ। হ্যাঁ আমি বলছিলাম মানব চরিত্রের সর্বোত্তম আদর্শ, ঐশীগ্রন্থ আল-কোরানের প্র্যাকটিক্যাল মডেল, মানবতার মুক্তির দূত, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ সংস্কারক, রাষ্ট্রনায়ক, দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, সমরবিদ ও পৃথিবীর প্রলয়কাল পর্যন্ত অদ্বিতীয় অনুকরণীয় আদর্শ, আরবের মরুদুলাল, নবীকুল শিরমণি, মহান আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ মোস্তাফা আহদম মোজতবা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা। মানবজীবনের সর্বক্ষেত্রে সববয়সে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের আদর্শকে অনুকরণ-অনসরনের মাঝেই সফলতা নির্ভর করে। মহান আল্লাহর ঘোষণা, ‘তোমাদের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লামের জীবনেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ’। (সূরা আহযাব)। তাই যৌবনের মতো জীবনের সর্বোত্তম এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়টিকে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের জীবনাদর্শে সাজাতে হবে তবেই কেবল আজকের অধঃপতিত ও আত্মবিস্মৃত যুবসমাজ খুজেঁ পাবে মুক্তি ও সফলতার পথ। যৌবনকালকে কলুষতা ও পঙ্কিলতা মুক্ত করতে হলে যুবসমাজকে অনুসরন করতে হবে পৃথিবীর সর্বকালের সর্বোত্তম ও সর্বোৎকৃষ্ট চারিত্রিক মডেলকে যা কেবল প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের জীবনাদর্শেই খুঁজে পাওয়া যায়। যেমনটি পবিত্র কুরআনুল করীমে আল্লাহ পাক ঘোষণা দেন, ‘হে রাসূল, আপনি সর্বোত্তম চারিত্রিক মাধুর্যের উপর প্রতিষ্ঠিত।’ (সূরা কলম)। যুবসমাজকে আল্লাহর প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুবই মুল্যায়ন করতেন। হাদিস শরীফে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম ’যৌবন’ কে গণিমতের মাল তথা ’মূল্যবান সম্পদ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তাই সময় থাকবে এই মূল্যবান সম্পদকে সঠিক পথে ব্যয় করতে হবে। হযরত আমর ইবনে মায়মুন আল আওদি (রাঃ) বলেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে উপদেশ দিয়ে বলেন, ’পাঁচটি বিষয় আসার আগে পাঁচটি বিষয়কে মূল্যবান সম্পদ মনে কর। বার্ধক্য আসার আগে যৌবনকে, অসুস্থ হওয়ার আগে সুস্থতাকে, দারিদ্র আসার আগে সচ্ছলতাকে, ব্যস্ততা আসার আগে অবসরকে এবং মৃত্যু আসার আগে অমূল্য জীবনকে।’ [তিরমিজি শরীফ]

হাদিস শরীফের ভাষ্য মতে শেষ বিচারের দিন ৫টি প্রশ্নের উত্তর দেয়া ছাড়া কোন বান্দা এক পা ও নড়তে পারবে না। তার একটি হলো- তোমার যৌবনকাল কোন কাজে ব্যয় করেছ? আজকে আমাদের ভাবতে হবে আমরা আমাদের যৌবনকে কী কাজে ব্যবহার করছি। এই ’যৌবন’ কে আমাদের দান করেছেন এবং কী আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য? আমরা কি আমাদের দায়িত্ব কর্তব্য টিকমতো মতো পালন করছি, না শুধু দুনিয়াবি সফলতার মিছে মায়ায় অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছি! আমরা যত বড় শিক্ষিত হই না কেন, যত ডিগ্রী অর্জন করি না কেন আমাদের মাঝে যদি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের আদর্শ না থাকে তাহলে জীবন বৃথা। আমরা জানি, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম তরুণ বয়সে সততা ও বিশ্বস্ততার কারণে ’আল-আমিন’ বা বিশ্বস্ত উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। সভ্যতা বিবর্জিত অন্ধকার যুগে একজন তরুণ বা যুবক কতখানি বিশ্বস্ত হলে অসভ্য ও বর্বর জাতির লোকজনও তাঁকে সম্মানের সঙ্গে স্বতন্ত্র এক অভিধায় ভূষিত করতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। যৌবনে পদার্পণকারী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরবের গোত্র কলহ আর বিবাদ-বিসম্বাদের ভয়াবহ অবস্থা থেকে উত্তরণে স্বীয় মেধা ও প্রজ্ঞার সমন্বয়ে গঠন করেছিলেন মানবেতিহাসের প্রথম শান্তিসংঘ, যা ইতিহাসে ’হিলফুল ফুযুল’ নামে অভিহিত। ধবংসোন্মুখ একটি জাতিকে অনিবার্য বিপর্যয়ের হাত থেকে পরিত্রাণের এক সফল প্রচেষ্টার নাম ছিল হিলফুল ফুযুল। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের এসব যুগান্তকারী ও মানবিক সকল কর্মকান্ড যুবসমাজকে নিজেদের জীবনে লালন করতে হবে তবেই নৈতিক অবক্ষয়ের এই সময়ে যুবসমাজ তাদের অভীষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারবে। ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, পৃথিবীর চারপাশে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিতে সবচাইতে বেশি ভূমিকা ছিল যুবক সাহাবিদের। তরুণ সাহাবি মুসআব ইবনে উমায়ের রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে পাঠানো হয়েছিল মদিনায় ইসলামের গুরু দায়িত্ব দিয়ে। অপর তরুণ সাহাবি আলী বিন আবু তালিব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে অসাধারণ বীরত্বেও জন্য ’আসাদুল্লাহ’ উপাদিতে ভূষিত করা হয়েছিল। হযরত উসামা বিন যায়েদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে তরুণ বয়সেই রোম অভিযানে সেনাপতি করে পাঠানো হয়েছিল। স্পেন বিজয়ী তারেক বিন জিয়াদও ছিলেন একজন টসবগে যুবক। বদরের যুদ্ধে হযরত মুআজ ও মুআওয়িজ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নামে দুজন তরুণ সাহাবি ইসলামের ঘোর শত্রু আবু জাহেলকে হত্যা করেন। খায়বার বিজয়ী বীর হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু যুবক বয়সেই কামুছ দুর্গের লৌহকপাট উপড়িয়ে ফেলে এক মুষ্টিতে নিয়ে এটিকে যুদ্ধের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। মুতার যুদ্ধের সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ ও ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন হযরত বেলাল রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ছিলেন বয়সে যুবক। হযরত ইব্রাহিম আলায়হিস্ সালাম যখন অগ্নিকু-ে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন, হযরত ইউছুপ (আঃ) যখন কারাগারে ছিলেন তখন তারা ছিলেন বয়সে যুবক। হযরত ইউনুছ আলায়হিস্ সালামকে যৌবনেই সমুদ্রের মাছ গিলে ফেলে আর হযরত দাউদ আলায়হিস্ সালাম যখন জালিম শাসক জালুতকে হত্যা করেন তখন তিনিও ছিলেন বয়সে যুবক। তাছাড়াও ইসলামের অন্যান্য যুদ্ধের সেনাপতি হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত জাফর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত তালহা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত যুবায়ের রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সহ প্রায় সাহাবায়ে কেরামগণ ছিলেন বয়সে তরুণ। তৎকালীন ভারতবর্ষে ইসলামের পতাকা যিনি সমুন্নত করেছিলেন সেই মুহাম্মদ বিন কাসিমও ছিলেন বয়সে তরুণ। এই ধরনের আরো অনেক উপমা উপস্থাপন করা যাবে যেখানে যুবকদের বলিষ্ঠ ভূমিকা রয়েছে। পৃথিবীর বুকে যত বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে এবং ভবিষ্যতেও আসেেব তা কেবল যুবকদের হাত ধরেই। তাই যুবসমাজকে তৈরি হতে হবে আগামীর জন্য। শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে ইসলামের স্বর্ণালী যুগের এসব অমর ইতিহাস থেকে। হতে হবে নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন, সৃষ্টিশীল, বিচক্ষণ ও নেতৃত্ব দেয়ার মতো চৌকস ও উন্নত মানসিকতার। যাদের অন্তকরণে থাকবে আল্লাহভীতি আর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের প্রতি নিঃশর্ত ও অফুরন্ত প্রেম। যৌবনের এই উত্তাল ও সৃষ্টিশীল সময়কে কল্যাণকর কাজে ব্যবহার করার জন্য আমাদেরকে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামের জীবনদার্শকে শক্ত করে আকড়ে ধরতে হবে এবং ভবিষ্যতের সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এই মহান আদর্শকে কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায় সে বিষয়ে আরো অধিকতর গবেষণা করতে হবে। কারন জীবনের এমন কোন স্তর, জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমন কোন শাখা নেই যা আমরা নববী আদর্শ থেকে গ্রহণ করতে পারি না। মানব ইতিহাসে তিনিই সর্বোত্তম ও অতুলনীয় যুবসমাজ উপহার দিতে সক্ষম হয়েছেন। অথচ আজকে আমাদের যুবসমাজ তাদের মিশন ও ভিশন ভুলে আত্মবিস্মৃতির চোরাবালিতে তলিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে শ্রেষ্ঠতম আদর্শ ও আধ্যাত্মিক শক্তিতে বলীয়ান মুসলিম জাতির যুবসমাজের এই অধঃপতন। আজকের যুবসমাজ যদি সুন্নাতে নববীর পথ ধরে হাটে তাহলে সকল হতাশা, ব্যর্থতা ও অমানিশা কেটে গিয়ে সফলতা পায়ের নীচে এসে ধরা দেবে।

মানবতার এই মহান দূতের সকল আদেশ-নিষেধ সৃষ্টিজগতের সবার জন্য অনুসরণীয় ও অবশ্য পালনীয় হিসেবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন স্বয়ং মহান রাব্বুল আলামীন। মহাগ্রন্থ আল-কোরানের সূরা হাশরে আল্লাহ ঘোষণা করেন, ’রাসুল তোমাদের যা দান করেন তা গ্রহণ কর আর যা বারণ করেন তা থেকে বিরত থাক’। সুতরাং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রদর্শিত পথ ব্যতীত অন্য কোথাও যাওয়ার যেমন সুযোগ নেই তেমনি কওে এই পথ ব্যতীত মুক্তির কোন গ্যারান্টিও নেই। আমারা চাই আমাদের যুব সমাজ সকল মিথ্যা ও ভ্রান্তি ছেড়ে ইসলামের সুমহান সৌন্দর্য্যে নিজেদের যৌবনকে রাঙিয়ে নিক এবং দেশ ও ইসলামের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করুক। কারন এই যুবকদের জন্যই আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ’যেদিন আরশের ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না, সেদিন সাত শ্রেণির মানুষ আরশের নিচে প্রশান্তির সঙ্গে থাকবে। তার মধ্যে এক শ্রেণির মানুষ হলো ওই যুবক, যার যৌবন কেটেছে আল্লাহর অনুগত বান্দা হিসেবে।’ (বুখারি শরীফ)। আল্লাহ যেন আমাদের সকলকে তার অনুগত বান্দা হিসেবে কবুল করেন। আমিন। ছুম্মা আমিন।

লেখক: প্রবাসী প্রাবন্ধিক, সৌদি আরব।