মসনবীয়ে আ’লা হযরত : একটি পর্যালোচনা

মসনবীয়ে আ’লা হযরত : একটি পর্যালোচনা

মাওলানা মুহাম্মদ নেজাম উদ্দীন <>

[এক]
মসনবী মানে দ্বিপদী কবিতা। ফারসি ভাষায় অনেক কবি অসংখ্য মসনবী কাব্যের কীর্তি গড়েছেন। কিন্তু অতুলনীয় গুরুত্বের কারণে সাধারণত মসনবী বলতে আমরা মাওলানা রূমির মসনবী শরীফকেই মসনবী বলে জানি ও বুঝি। মাওলানা রূমির মসনবীর প্রকৃত নাম ‘মসনবীয়ে মানবী’ (আধ্যাত্মিক দ্বিপদী কাব্য)। মাওলানা রূমির মসনবীর আদলে আ’লা হযরত (রহ) এ মসনবী রচনা করেন। মসনবীয়ে রূমির মত এটাকেও ‘মসনবীয়ে আ’লা হযরত’ নামে নামকরণ করা যায়। আ’লা হযরত (রহ) তাঁর এ মসনবীর নাম দিয়েছেন ‘মসনবীয়ে রদ্দে আমসালিয়াহ্’। ‘রদ’ মানে কারো ভুল কথা, কাজ বা আকীদাকে খ-ন করে প্রকৃত হাকীকত বা অবস্থা তুলে ধরা। ‘মিসল’এর বহুবচন আমসাল। ‘আমসাল’ শব্দের শেষে ‘ইয়া’ ও ‘তা’ নিসবতের জন্য যোগ করা হয়। এখানে ‘আমসালিয়া’ বলতে ‘ফির্কায়ে ওয়াহ্হাবিয়ায়ে আমসালিয়াহ্’ দলকে বুঝানো হয়েছে। যারা অতুলনীয় রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের সমকক্ষ বিদ্যমান থাকা এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন স্তরে আরো ছয়জন ‘খাতামুন্নবীয়্যীন’ বা শেষনবী মওজুদ রয়েছে বলে বিশ্বাস করে। তারা আরো বিশ্বাস করে যে, “নবীয়ে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা’আ‘লা আলায়হি ওয়া সাল্লাম একজন নিছক বশর বা মানুষ। তাঁর এবং অন্যসব মানুষের মাঝে নবূয়্যাতের পার্থক্য ছাড়া অন্য কোন পার্থক্য নেই; তাই উম্মতের কাছে একজন নবীর মর্যাদা বড় ভাইয়ের চেয়ে বেশী নয়।” আ’লা হযরত (রহ) তাঁর এ মসনবীতে উপরিউক্ত ভ্রান্ত মতবাদসমূহের খ-ন করেছেন বলে এটাকে ‘মসনবীয়ে রদ্দে আমসালিয়াহ্’ নামে নামকরণ করেন। অর্থাৎ আমসালিয়াহ্ ফির্কার খ-নে দ্বিপদী কাব্য। এ ফির্কার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। পাঠকের জ্ঞাতার্থে নিচে এ সম্পর্কে সংক্ষেপ আলোচনা করা হলো।

[দুই]
উপমহাদেশের বুকে বৃটিশরা তাদের শাসনক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য ‘বিভক্ত করো, শাসন করো’ নীতি প্রয়োগ করে। এ নীতির মাধ্যমে তারা এ দেশের মুসলমানদের ধর্মীয় বোধ-বিশ্বাসে নানান মত পার্থক্যের সৃষ্টি করে। যার ফলশ্রুতিতে এ উপমহাদেশে ইসলামের নামে নানা ভ্রান্ত দল-উপদলের সৃষ্টি হয়। বৃটিশ শাসনের শুরুর দিকে ইংরেজরা যখন দেখলো সারা উপমহাদেশে ধর্মীয় ও বুদ্ধিভিত্তিক আন্দোলনে শাহ্ ওয়ালী উল্লাহর পবিরারের এক বিরাট প্রভাব রয়েছে, তাই তাঁর পরিবারেরই একজন সদস্য ইসমাঈল দেহলভীর দ্বারা ‘তাকভীয়াতুল ঈমান’ নামক ঈমানবিধ্বংসী পুস্তক রচনার মাধ্যমে ইংরেজরা মুসলমানদের মাঝে ধর্মীয় অনৈক্যের সর্বপ্রথম বীজটি বপন করে। তখন কিন্তু শাহ্ ওয়ালী উল্লাহর চিন্তাধারা ও আন্দোলনের অগণিত কর্মী ও বিদগ্ধ ধর্মীয় প-িতজন জীবিত ছিলেন বলে ইসমাঈল দেহলভীর ধর্মনাশা চিন্তাধারা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে যায়। তাকভীয়াতুল ঈমানের খ-নে ওই সময় শতশত পুস্তক রচিত হয়। ইসমাঈল দেহলভী এতে পুরোপুরি সফল হতে না পেরে ইংরেজদের ইশারায় শিখ বিরোধী আন্দোলেনের নামে সীমান্তবর্তী এলাকার পাঠান সুন্নী মুসলমান ও শিখদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত বালাকোটের যুদ্ধে সীমান্তবর্তী পাঠান সুন্নী মুসলমাদের হাতে ইসমাঈল দেহলভী ও তার পীর সৈয়দ আহমদ রায়বেরলভী মারা যায়। অন্যদিকে শাহ্ আবদুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলভী কর্তৃক সৃষ্ট ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনকে তাঁর ভাবশিষ্যগণ উপমহাদেশে সকল স্তরের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে গড়ে তোলার প্রয়াস পান। ফলে ১৮৫৭ সালে আযাদী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। নানা কারণে শেষ পর্যন্ত এ আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ইংরেজরা এ আন্দোলনের জন্য একমাত্র মুসলমানদেরকে দায়ী করে তাদের উপর নির্যাতনের স্টীম রোলার চালাতে থাকে। আযাদী আন্দোলনের সাথে জড়িত থাকা শতশত আলিম-ওলামা ও সাধারণ মুসলমানগণ ইংরেজদের রোষানলে পড়ে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলেন। কেউ কেউ মাল্টা বা আন্দামান দ্বীপে নির্বাসিত হন। অনেকে কারা অন্তরালে অন্ধকার কক্ষে তিলে তিলে ক্ষয় হন। অনেকে আবার হিজরত করে পবিত্র মক্কা ও মদীনা শরীফে চলে যান। সুন্নী আলিম-ওলামা ও বুদ্ধিজীবীদের বিশাল শুন্যতার এ সুযোগে ইংরেজরা ইসমাঈল দেহলভীর ভাবশিষ্যদেরকে একজোট করে দেওবন্দ মাদরাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উপমহাদেশের মুসলমানদের ধর্মীয় বোধ-বিশ্বাসে (আকীদায়) ফাটল সৃষ্টি করতে দ্বিতীয়বার মাঠে নামে। এ সময় রচিত হয় ‘তাহযীরুন্নাস’ ও ‘বারাহীনে কাতিআ’ নামক ঈমানবিধ্বংসী পুস্তক। ফলে আকীদাগত পার্থক্যের কারণে এ দেশের মুসলমানরা বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে- যা এ দেশে ব্রিটিশ রাজত্বকে দীর্ঘস্থায়ী করতে যথেষ্ট সাহায্য করে। দেওবন্দ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা কাসিম নানূতবী ‘তাহযীরুন্নাস’ পুস্তক রচনা করে ইসমাঈল দেহলভীর ‘নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের সমকক্ষ থাকা সম্ভব’- এ ভ্রান্তমতবাদকে পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ প্রচেষ্টার পাশাপাশি ‘নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম শেষ নবী, তাঁর পর কোন নবী আসা অসম্ভব’- এ সর্ববাদী মতবাদকে অস্বীকার করে ‘নতুন নবী আসার সম্ভব’ হওয়ার ভ্রান্ত মতবাদ তুলে ধরেন। যেমন তিনি তাঁর এ পুস্তকে লিখেছেন- “বরং ধরে নিন, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর যমানায়ও যদি কোথাও কোন নবী আসতো, তথাপি হুযূরের ‘খাতাম’ (শেষ নবী) হওয়া দস্তর মতো বহাল থাকতো; বরং ধরে নিন, নবী করীমের যমানার পরেও যদি কোন নবী পয়দা হয়, তবুও ‘খাতামিয়াতে মুহাম্মদী’ (হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শেষ নবী হবার মর্যাদা)’তে কোন পার্থক্য দেখা দেবে না। জনসাধারণের খেয়ালে তো রসূলুল্লাহ্ ‘খাতাম’ বা ‘শেষ নবী হওয়া’ এ অর্থেই যে, তিনি সর্বশেষ নবী; কিন্তু বুঝশক্তিসম্পন্নদের নিকট একথা স্পষ্ট যে, যমানায় অগ্রবর্তী হওয়া ও পরবর্তী হওয়ার মধ্যে আসলে কোন ফযীলত বা প্রাধান্য নেই।”

অথচ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদা হলো, হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ নবী। দুনিয়াতে তাঁর প্রকাশ্য হায়াত এবং ইন্তেকালের পর অপ্রকাশ্য হায়াত উভয় অবস্থায় কোন সময়ই কোন নবীর আগমন হওয়া অসম্ভব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের ‘খাতামুন্নাবীয়্যিন’ গুণটির অর্থ ‘সর্ব শেষ নবী’ হওয়া দীনের অত্যাবশ্যকীয় বিশ্বাস্য বিষয়। ‘খাতামুন্নাবীয়্যিন’ এর অর্থ ‘সর্বশেষ নবী’; এ অর্থটিকে ‘মুর্খ লোকদের ধারণা’ বলা অথবা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের যুগে অথবা তাঁর ইন্তেকালের পর অন্য কেহ নবুওয়াত পেতে পারে বা সম্ভাবনা রয়েছে বলা কুফরী। তেমনিভাবে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের কতেক বিশেষ গুণ ও বৈশিষ্ট্যে সৃষ্টির কেউ তাঁর সমকক্ষ হওয়া সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব (মুহাল বিয্যাত)। আসল কথা হলো, স্রষ্টা হিসেবে যেমন মহান আল্লাহর যাত (সত্তা) একক, অদ্বিতীয় এবং তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই; তেমনি সৃষ্টির মাঝে হুযূর নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামও একক, অদ্বিতীয় ও তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। যেমন, মোল্লা আলী কারী (রহ.) ইমাম কাযী আয়ায (রহ.)-এর শিফা শরীফের ব্যাখা গ্রন্থে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা’আ‘লা আলায়হি ওয়া সাল্লামের আল্লাহ তা’আ‘লা প্রদত্ত বিশেষ গুণাবলীর বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন: من المعلوم استحالة وجوده مثله بعده অর্থাৎ ‘হুযূর সাল্লাল্লাহু তা’আ‘লা আলায়হি ওয়া সাল্লামের পর তাঁর সমকক্ষ হওয়া সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব।’

সুতরাং হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু তা’আ‘লা আলায়হি ওয়া সাল্লামের সমকক্ষ থাকার বিশ্বাস, তাঁর শেষ নবী হওয়াকে অস্বীকার করা অথবা অন্য কোন নবী আসা সম্ভব বলে বিশ্বাস করা সুস্পষ্ট কুফরী মতবাদ। এ কারণে ইসমাঈল দেহলভী ও কাসিম নানূতবীর ভ্রান্তমতবাদের খ-নে শতশত পুস্তক রচিত হয়। এ বিষয়ে আযাদী আন্দোলনের বীর সিপাহসালার আল্লামা ফযলে হক খায়রাবাদির ‘ইমতিনাউন নাযীর’ গ্রন্থটি অদ্বিতীয় ও সর্বশ্রেষ্ঠ। আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা(রহ)ও পূর্বসুরী ওলামায়ে আহলে সুন্নাতের পদাঙ্খনুসরণে দেওবন্দী ওহাবীদের উক্ত ভ্রান্ত মতবাদ খণ্ডন করে মুসলিম জাতিকে সঠিক পথের দিশা দিতে নানা পুস্তক রচনা করেন। কিন্তু এ মসনবীতে তিনি নানা উপমা ও উৎপেক্ষার মাধ্যমে নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সৃষ্টির মাঝে অনন্য, অসাধারণ, উপমাহীন হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরার মধ্য দিয়ে দেওবন্দী ওহাবীদের ভ্রান্তমতবাদ খণ্ডনে এক অভিনব পদ্ধতির আশ্রয় নেন। যা ফারসী মসনবী কাব্যমোদিদেরকে আনন্দ দেওয়ার সাথে সাথে প্রিয় রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে আমাদের ঈমান-আকীদাকেও মজবুত করবে নিঃসন্দেহে।

[তিন]
ইমাম আ‘লা হযরত (রহ.) এ নাতি দীর্ঘ মসনবীর বক্তব্য বিশ্লেষণ করে এটাকে বিভিন্ন স্তবকে ভাগ করা যায়। মসনবীর ১ থেকে ১০ লাইনের ১ম স্তবকের বয়েতসমূহে আ‘লা হযরত (র.) প্রত্যেক নবীপ্রেমিক সুন্নী-মুসলমানকে দীনে ইসলাম নিয়ে নামধারী মুসলমানদের গভীর ও সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রের চিত্র তুলে ধরার মাধ্যমে নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে নিজেও অশ্রু বিসর্জন করেছেন এবং সুন্নী-মুসলমানদেরকেও দুঃখ-বেদনার এ কান্নায় শরীক হতে আহ্বান জানান। কারণ নবীর উম্মত দাবী করে নবীর সাথে এমন গোস্তাখী ও অমর্যাদা কোন মতে একজন সত্যিকারের নবীপ্রেমিক মুসলমান মেনে নিতে পারেন না। আর ইমাম আ‘লা হযরত (রহ.)-এর সময়কালে ইংরেজ শাসিত ভারতে ইসলামের নামে এতোধিক ফিতনার জন্ম নিয়েছিলো, যার থেকে মুক্তির কোন উপায় কারো জানা ছিলো না, তাই তিনি সর্বশেষ উপায় হিসেবে ধরার বুকে হযরত ঈসা ও হযরত ইমাম মাহদীর শুভাগমনের জন্য মহান রবের সমীপে আবেদনও করেন। কারণ, তাঁর জানা ছিলো যে, তাঁদের শুভাগমনের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বুক থেকে সকল ফিতনার অবসান হবে। যদিও তাঁদের আগমন যথাসময়ে হবে, তারপরও ইমাম আ‘লা হযরত তাঁর যুগের প্রতিটি ফিতনার মূলোৎপাটনে প্রাণপন চেষ্টা করার সাথে সাথে দোয়া প্রার্থনার মাধ্যমেও এসব ফিতনার বিনাশ কামনা করেছেন। যেমন তিনি লিখেছেন:
کُن ظُہور اے مَہدیؔ عالی جناب
بر زمین آ عیسیِ گَردوں قِباب
কুন যুহূরে আয় মাহদী আলী জনাব,
বর যমীনে আ ঈসা গরদো কেবাব।
[ওহে মহান ইমাম মাহদী! আপনি আগমন করুন। ওহে আসমানে সমাসীন হযরত ঈসা! এখন ধরায় অবতরণ করুন।]
মসনবীর ১১ থেকে ১৫ লাইনের এ দ্বিতীয় স্তবকে ইমাম আ‘লা হযরত (রহ.), সকল বাতিল ফিরকার গোমরাহী বা পথভ্রষ্টতার আসল কারণ খোঁজতে গিয়ে তাদের নফসপরস্তি বা প্রবৃত্তিপুজাকে চিহ্নিত করেন। কারণ তারা সাওয়াদে আযম তথা ইসলামের বৃহত্তমদলের ওলামায়ে কিরামের পথ ও মতকে ছেড়ে দিয়ে নিজেদের খেয়ালখুশি মত ইসলামের ব্যাখা দাঁড় করে। ফলে তারা ইসলাম থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। যেমন তিনি বলেন:
مَردُماں شہوات را دیں ساختند
صد ہزاراں رَخنَہا اَنداختند
মরদুমাঁ শাহওয়াত রা দীঁ সাখতন,
সদ হাযারাঁ রখনাহা আন্দাখতন।
[লোকেরা নিজেদের প্রবৃত্তির চাহিদাকে দীন বানিয়ে ফেলেছে। ফলে দীনে অসংখ্য ফাটল সৃষ্টি করেছে।]
ہر کہ نَفسَش رَفت راہے اَز ہَوا
ترکِ دیں گُفت و نَمودَش اِقتِدا
হার কেহ্ নফসশ রফত রাহে আয হাওয়া,
তরকে দীঁ গুফতও নমূদশ ইকতিদা।
[যার নফস তার বাসনার পথে চললো, সে দীন ছেড়ে দিয়ে নফসের আনুগত্য করলো।]
মসনবীর ১৬ থেকে ২৮ লাইলের এ স্তবকে ইমাম আ‘লা হযরত (রহ) বিভিন্ন উপমার মাধ্যমে ফিরকায়ে ওহাবীয়া আমসালিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ইসমাঈল দেহলভীর ভ্রান্ত মতবাদকে খ-ন করার প্রয়াস পান, যা আমি প্রবন্ধের শুরুতে উল্লেখ করেছি। যেমন তিনি লিখেছেন:
آں یکے گُویاں محمد آدمی سْتْ
چوں من و در وَحی اُو را بَرتَریْسْتْ
আঁ একেঁ গূয়াঁ মুহাম্মদ আদমিস্ত,
চূঁ মনও দর ওহী ওরা বরতরিস্ত।
[(‘‘ওই প্রবৃত্তি তাড়িতদের মধ্যে) একজন বলেছে যে, “মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাদের মতো মানুষ, তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা শুধুমাত্র ওহীর কারণে।”]
جُز رِسالت نیْسْت فَرقے درمیاں
من برادرِ خُورْد باشَم اُو کَلاں
জুয রেসালত নিস্ত ফরকে দরমিয়াঁ,
মান বেরাদরে খোর্দ বাশম উ কালাঁ।
[‘‘আমাদের এবং উনার মাঝে রিসালত ছাড়া আর কিছুতে কোন পার্থক্য নেই। আমি তার ছোট ভাই আর তিনি বড় ভাই’’।]
ইমাম আ‘লা হযরত তাদের উপরিউক্ত ভ্রান্ত মতের খ-ন করতে গিয়ে মণি-মুক্তা ও নুড়ি পাথরের উপমা দিয়ে বলেন:
گر بود مَر لعل را فضل و شرف
کے بَوَد ہم سنگِ اُو سنگ و خَزف
গর বোওদ মর লা’ল রা ফযলও শরফ,
কায় বোওদ হাম সঙ্গে উ সঙ্গেও হযফ।
[মণি-মুক্তা পাথর হওয়া সত্ত্বেও তা মূল্যবান ও সম্মানিত। সুতরাং পাথর ও নূড়ি উহার সমকক্ষ কীরূপে হতে পারে?]
آں خَزَف اُفتادَہ باشَد بر زمیں
بس ذلیل و خوار و ناکارہ مُہِیں
আঁ হযফ উফতাদা বাশদ বর যমীঁ,
বস যলীলও খারও নাকারাহ্ মুহীঁ।
[পাথর ও নূড়ির অবস্থা হলো এ যে, তা সর্বদা মাটিতে অযত্ন অবহেলায় পড়ে থাকে, যা মূল্যহীন ও অকেজো।]
لعل باشد زیبِ تاجِ سَروَراں
زینت و خوبی گُوشِ دِلْبَراں
লা‘ল বাশদ যেবে তাজে সরওয়ারা,
যীনতও খূবী গোশে দিল বরাঁ।
[(পক্ষান্তরে) মণি-মুক্তা তো রাজা-বাদশাদের রাজমুকুটে শোভা পায় আর প্রেমাষ্পদের কানের সৌন্দর্য্যরে কারণ হয়।]
ইমাম আ‘লা হযরত মসনবীর এ স্তবক থেকে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তাআ‘লা আলায়হি ওয়া সাল্লামের অতুলনীয় মর্যাদা তুলে ধরতে প্রয়াস পান। যেমন:
مُصطَفیٰ نورِ جنابِ اَمرِ کُن
آفتابِ بُرجِ عِلْمِ مِنْ لَّدُنْ
মুস্তাফা নূরে জনাবে আমরে কুন,
আফতাবে বুরজে ইলমে মিল্লাদুন।
[আর হুযূর(সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম) হচ্ছেন আল্লাহ তা‘আলার নূর, ইলমে লাদুন্নির মিনারের সূর্য।]
مَعدنِ اَسرارِ عَلّام الْغُیُوب
بَرزَخِ بحرینِ اِمکان و وُجوب
মা‘দানে আসরারে আল্লামুল গুয়ূব,
বরযখে বাহরাইনে ইমকানে ওয়া উজূব।
[হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম আল্লামুল গুয়ূব আল্লাহ তা‘আলার রহস্যের ভা-ার। “ইমকান” ও “ওজূব”-এ দু’সমুদ্রের মাঝে এক মহান মাধ্যম।]

بادشاہِ عَرشِیان و فرشیاں
جلوہ گاہِ آفتابِ کُن فَکاں
বাদশাহে আরশিয়ানেও ফারশিয়াঁ,
জালওয়াহ্ গাহে আফতাবে কুন ফাকাঁ।
[হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীবাসী ও আসমানবাসীর সরদার। তিনি তো আল্লাহর কুদরতের প্রকাশস্থল।]
راحتِ دل قامتِ زیبائے اُو
ہر دوعالم والِہ و شیدائے اُو
রাহাতে দিল কা-মাতে যেবায়ে উ,
হার দো-আলম ওয়ালিহি ওয়া শায়দায়ে উ।
[তাঁর মনোরম দেহ গড়ন আশেকের অন্তরের প্রশান্তি। দু‘জগতের সবাই তাঁর প্রতি উৎসর্গপ্রাণ।]
جانِ اِسماعیل بر رُویَش فدا
از دُعا گُویاں خلیلِ مجتبے
জানে ইসমাঈল বর রোয়শ ফেদা,
আয দোআ গো ইয়াঁ খালীলে মুজতাবা।
[হযরত ইসমাঈল আলায়হিস সালামের প্রাণ তাঁর নুরানী চেহারায় উৎসর্গ। হযরত ইবরাহীম খলীল আলায়হিস সালাম তাঁর শুভাগমনের জন্য দোয়াকারীদের একজন।]
مِہر تابانِ عُلومِ لَم یَزَل
بَحرِ مَکْنوناتِ اَسرارِ اَزَل
মহরে তাবানে উলূমে লাম ইয়াযাল,
বাহরে মাকনূনাতে আসরারে আযল।
[অনাদি অনন্ত মহান রবের জ্ঞান রাজ্যের তিনি দীপ্তমান সূর্য। তিনি আল্লাহর গোপন রহস্যের সমুদ্র।]
وصفِ اُو از قُدرتِ انساں وَ راسْتْ
حَاشَ للہ اِیں ہَمہ تفہیم راسْتْ
ওয়াসফে ঊ আয কুদরাতে ইনসাঁ ওয়া রাস্ত,
হাশা লিল্লাহ্ য়িঁ হামা তাফহীমে রাস্ত।
[হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লামের প্রশংসা করা মানুষের সাধ্যের বাইরে। আল্লাহর পবিত্রতা! এসব যা কিছু বর্ণিত হয়েছে তা শুধু বুঝানোর জন্য।]

ایں سخن آخِر نہ گَردَد از بیاں
صَد اَبد پایاں رَوَد اُو ہم چنان
য়িঁ সুখন আখের না গরদাদ আয বয়াঁ,
সাদ আবদ পায়াঁ রওয়াদ উ হাম চুনাঁ।
[হুযূরে পাকের প্রশংসা ও গুণগান এবং তিনি (সৃষ্টির মাঝে) অনন্য, অসাধারণ ও উপমাহীন হওয়ার বিবরণ বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না, এভাবে অনন্তকাল গত হবে, তবুও তা তেমনিই থেকে যাবে।]
نیست پایا نَش اِلٰی یَومِ التَّنَادْ
ختم کُن وَ اللّٰہُ اَعْلَمُ بِالرَّشَادْ
নিসত পায়ানশ ইলা ইয়াওমিদ তানাদ,
খতমে কুন ওয়াল্লাহ্ আ‘লাম বির রাশাদ।
[কিয়ামত পর্যন্তও তা শেষ হবেনা। আলোচনা শেষ করো। আল্লাহ কল্যাণের পথকে ভাল করেই জানেন।]
মসনবীর ৫৬ লাইন থেকে ইমাম আ‘লা হযরত পৃথিবীর বিভিন্ন স্তরে আরো ছয়জন ‘খাতামুন্নবীয়্যীন’ বা শেষনবী মওজুদ থাকার ভ্রান্ত আকীদার উল্লেখপূর্বক তাদের খ-ন করতে প্রয়াস পান। যেমন:
مُصطَفیٰ مِہْرِیْسْتْ تاباں بِالْیَقیں
مُنْتَشِر نُورَش بہ طبقاتِ زمیں
মুস্তাফা মেহরিস্ত তাবাঁ বিল ইয়াকীন,
মুনতাশির নূরশ বেহ্ তাবকাতে যমীন।
নিশ্চয় হুযূর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম দীপ্তমান সূর্য, তাঁর দীপ্তি ভূ স্তরের সবখানেই ছড়িয়ে আছে।]
مُسْتَنیر اَز تابشِ یک آفتاب
عالَمے وَ اللّٰہُ اَعْلَمُ بِالصَّوَاب
মুস্তানীর আয তাবিশে য়েক আফতাব,
আলমে ওয়াল্লাহ্ আ‘লামু বিস সাওয়াব।
[একটি সূর্যের দীপ্তিতে পুরো জগত আলোকিত। আর আল্লাহ্ সঠিকতা সম্পর্কে খুবই ভালো জানেন।]
گرچہ یک باشَد خود آں مِہرے سَنِی
اَحْوَلانَشْ ہَفت بِینَنْدْ اَز کَجی
গারচে য়েক বাশদ খোদ আঁ মেহরে সনী,
আখওয়ালানশ হাফত বিনন্দ আয কজী।
[যদিও ওই দীপ্তমান সূর্য একটিই, কিন্তু টেরা তার টেরাত্বের কারণে সাতটি দেখে থাকে।]
دو ہَمی بِینَنْدْ یک را اَحْوَلاں
اَلاماں زِیں ہفت بِیناں اَلاماں
দো হামে বিনন্দ য়েকে রা আহওয়ালাঁ,
আল আমাঁ যীঁ হাপ্ত বীনাঁ আল আমাঁ।
[টেরা তো একটাকে দু’টা দেখে। আর যে একটাকে সাতটি করে দেখে তার থেকে আল্লাহর পানাহ্!]
چَشم کَج کَردَہ چُو بِینی ماہ را
زِ اَحْوَلی بینی دو آں یکتاہ را
চশমু কজ কারদাহ্ চু বীনী মাহে রা,
যে আহওয়ালী বীনী দো আঁ য়েকতাহে রা।
[চোখ টেরা করে যখন তুমি চাঁদকে দেখবে, তখন চোখ টেরা করার কারণে আকাশের ওই একটি চাঁদকে দু’টি দেখবে।]
گوئی اَزْ حیرت عَجب اَمْرِیست اِیں
خواجہ دوشد ماہ روشن چیسْتْ اِیں
গোয়ী আয হায়রত আজব আমরীস্ত য়ীঁ,
খাজাহ্ দো শুদ মাহ্ রওশন চীস্ত য়িঁ।
[তখন তুমি আশ্চর্য হয়ে বলবে, এ কী আজব ব্যাপার যে, দু’টি চাঁদ উদয় ও আলোকিত হলো।]
راسْت کَردی چشم وشُد رَفع حجاب
یک نُمایَد ماہِ تاباں یک جواب
রাস্ত কারদি চশমও শুদ রফঈ হিজাব,
য়েক নুমায়দ মাহে তাবাঁ য়েক জওয়াব।
[যখন তুমি নিজ চোখ ঠিক করে নিলে, পর্দা সরে গেলো, তখন এক উজ্জ্বল চাঁদই দেখা যাবে আর একটিই জবাব হবে।]
راسْت کُن چشمِ خود از بہرِ خدائے
ہَفت بِیں کم باش اے ہر زہ درائے
রাস্ত কুন চশমে খোদ আয বহরে খোদা,
হাপ্ত বীঁ কম বাশ আয় হারযা দরা।
[খোদার দোহাই, নিজ চোখকে ঠিক ও সোজা করে নাও। হে প্রলাপকারী সাতটি দেখনে ওয়ালা হয়ো না।]

[চার]
ইমাম আহমদ রেযা মসনবীর এখান থেকে মুসলিম উম্মাহকে প্রিয় নবীর দামান আকঁড়ে ধরার আহ্বান জানান। যেমন:
اے بَرادر دست در احمد بزن
بر کجیِ نفسِ بد دیگر متن
আয় বেরাদর দস্তে দর আহমদ ব যন,
বর কজিয়ে নফসে বদ দিগর মতন।
[হে ভাই! আহমদে মুস্তাফার আঁচল শক্তভাবে আকড়ে ধরো। পুনরায় কুপ্রবৃত্তির বাঁকা পথে যেয়ো না।]
رو تَشَبُّثْ کُن بَذَیْلِ مُصطَفیٰ
اَحْوَلی بِگُذار سوگندِ خدا
রো তাশাব্বুস কুন ব যায়লে মুস্তফা,
আহওয়ালী বেগুযার সাওগান্দে খোদা।
[নবী মুস্তাফার দয়ার আঁচলে আবদ্ধ হও। খোদার শপথ! টেরাবাজি ছেড়ে দাও।]
در دو عالَم نیست مثلِ آں شاہ را
در فَضِیلَتہا و در قربِ خدا
দর দো ‘আলম নিস্ত মিসলে আঁ শাহে রা,
দর ফযীলত হা উ দর কুরবে খোদা।
[মর্যাদা ও আল্লাহর নৈকট্যধন্য হওয়ার মহত্ত্বে শাহেনশাহে দু’আলমের মতো দু’জগতে দ্বিতীয় কেউ নেই।]
مَا سِوَی اللّٰہ نیست مِثلَش اَزْ یکے
برتراَست اَزوَے خدا اے مُہْتَدے
মা সেওয়া আল্লাহ্ নিস্ত মিছলশ আয য়েকে,
বরতর আস্ত আয ওয়াই খোদা আয় মুহতাদে।
[খোদার সৃষ্টিতে কেউ তাঁর সদৃশ্য ও সমকক্ষ নেই। হে সৎপথপ্রাপ্ত! শুধু আল্লাহ তা‘আলাই তাঁর চেয়ে মহান ও শ্রেষ্ঠ।]
اَنبیائے سابِقِیں اَے مُحتشم!
شَمعہا بُودَنْدْ در لَیل و ظلم
আম্বিয়ায়ে সাবেকীঁ আয় মুহতাশাম,
শম’আ হা বূদন্দ দর লায়লও যুলম।
[হে প্রিয়! আগেকার নবীগণ ছিলেন রাত ও অন্ধকারে হেদায়তের বাতি।]
درمیانِ ظُلمت و ظلم و غُلو
مُسْتَنِیر از نورِ ہریَک قومِ اُو
দরমীয়ানে যুলমতও যুলম ওয়া গুলূ,
মুস্তানির আয নূরে হার য়েক কাওমে উ।
[অত্যাচার ও বাড়াবাড়ির অন্ধকারে নিমজ্জিত প্রত্যেক জাতি নিজ নিজ নবীগণ থেকে আলোকিত হতো।]
آفتابِ خاتَمِیَّت شُد بلند
مِہر آمَد شَمعہَا خامُش شُدَنْدْ
আফতাবে খাতামিয়্যাত শুদ বুলন্দ,
মেহরে আমদ শম’ঈ হা হামুশ শুদন্দ।
[যখন নবুয়্যতের সর্বশেষ সূর্য মধ্য আকাশে উদয় হলো, তখন অন্যসব বাতি নিশ্চুপ হয়ে গেলো।]
نورِ حق اَز شَرقِ بِیمِثلی بِتافْت
عالَمی اَز تابِشِ اُو کام یافْت
নূরে হক আয শরকে বে মিছলে বে তাফত,
আলমে আয তাবিশে উ কামে ইয়াপ্ত।
[আল্লাহর নূর উপমাহীন পূর্ব দিগন্তে উদয় হলো। আর সারা জগত তার নূরে আলোকিত হলো।]
دَفْعۃً برخاسْت اندر مَدحِ اُو
از زبانْہا شُور لَا مِثْلَ لَہٗ
দফ’আতান বর খাস্ত আন্দর মাদহে উ,
আয যুবাঁ হা শোরে লা মিসলে লা হু।
[ফলে আচমকা সবার মূখে তাঁর প্রশংসায় এ বলে উঠলো যে, তাঁর কোন দৃষ্টান্ত নেই। তিনি অনুপম।]
لَیک شَپر نا پَذِیرَفْت از عِناد
در جہاں اِیں بے بَصَر یا رَبّ مَباد
লায়ক শপির না পযীরপ্ত আয ‘ইনাদ,
দর জাহাঁ ইয়িঁ বে বাসার ইয়া রাব্বে মাবাদ।
[কিন্তু বাদুড় শত্রুতা ও জিদের কারণে তা গ্রহণ করে নি। হে রব! মর্ত্যে এমন অন্ধ যেন না থাকে।]
چوں نئی بے مِثلیش را مُعترِف
کَے شَوی از بحرِ فیضَش مُغترِف
চোঁ নায় বে মিসলেশ রা মু’তারিফ,
কায় শুবি আয বাহরে ফয়যশ মুগতারিফ।
[যখন তুমি তাঁর অনুপম হওয়াকে স্বীকারই করছো না, তবে কী করে তুমি তাঁর দয়ার সমুদ্র থেকে আবগাহন করবে।]
نست فضلَش بہرِ قومِ بے ادب
یَخْطَفُ اَبصَارَہُمْ بَرقُ الْغَضَب
নিস্ত ফযলশ বাহরে কাওমে বে আদব,
ইয়াখতাফু আবসারাহুম বারকুল গাযাব।
[তাঁর বিশেষ দয়া বেয়াদব কওমের জন্য নেই। তাঁর রাগের বিজলী তাদের চোখের জ্যোতিকে কেড়ে নিয়ে নেবে।]

[পাঁচ]
ইমাম আ‘লা হযরত মসনবীর ১০৫ লাইন থেকে ইসলামের প্রথম চার খলীফার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করার মাধ্যমে শিয়া ও খারেজি ফিরকার রদ করতে প্রয়াস পান। যেমন:
آں عَتیقُ اللّٰہ امامُ الْمُتَّقِیں
بود قلب خاشع سلطانِ دیں
আঁ আতীকুল্লাহ্ ইমামুল মুত্তাকীন,
বূরদ কালবে খাশে’ই সুলতানে দীন।
[তিনি (হযরত আবু বকর সিদ্দিক) আল্লাহর আযাদকৃত প্রিয় বান্দা, মুত্তাকিদের ইমাম, দীনের বাদশার নরম অন্তরের প্রতিচ্ছবি।]
واں عمر حق گو زبانِ آنجناب
یَنْطِقُ الْحَقُّ عَلَیْہِ وَ الصَّوَاب
ওয়াঁ উমর হক গো যুবানে আঁ জনাব,
ইয়ানতিকুল হাক্কু আলায়হি ওয়াস সাওয়াব।
[আর হযরত উমর হুযূরের সত্য বলার প্রকাশস্থল। সত্য ও সঠিক যার অনুরূপ বলে থাকে।]
بود عثماں شَرمگِیں چشمِ نبی
تیغ زن دستِ جوادِ او علی
বূদ উসমাঁ শরমাগীঁ চশমে নবী,
তেগে যন দস্তে জাওয়াদে উ আলী।
[হযরত উসমান ছিলেন হুযূরের লজ্জাশীল চোখ। আর হযরত আলী ছিলেন তাঁর তরবারিধারী ও দানশীল হাত।]
نیست گر دستِ نبی شیرِ خدا
چوں یَدُاللّٰہ نام آمَد مَر اُو را
নিস্ত গর দস্তে নাবী শেরে খোদা,
চোঁ ইয়াদুল্লাহ্ নাম আমদ মার উরা।
[যদি হযরত আলী হুযূরের পবিত্র হাত না হতেন, তবে তাঁর জন্য ‘ইয়াদুলালাহ্’ উপাধি কেন আসলো ? ]
دستِ احمد عَین دستِ ذُوالجلال
آمَد اندر بَیعت و اندر قِتال
দস্তে আহমদ আয়নে দস্তে যুল জালাল,
আমদ আন্দর বায়তও আন্দর কেতাল।
[হুযূরের পবিত্র হাত স্বয়ং মহান রবের হাত। যেমন বায়আত ও যুদ্ধের সময় তাঁর হাতকে আল্লাহর হাত বলা হয়েছে।]

[ছয়]
মসনবীর শেষ স্তবকে এসে ইমাম আ‘লা হযরত প্রিয় নবীর ওসীলা নিয়ে মহান রবের দরবারে দোয়া প্রার্থনা করার মাধ্যমে ৯৪ লাইনের এ দীর্ঘ মসনবী শেষ করার প্রয়াস পান। যেমন:
اے خدا اے مہرباں مولائے من
اے انیسِ خَلْوَتِ شَبْہائے من
আয় খোদা আয় মেহেরবাঁ মাওলায়ে মান,
আয় আনিসে খালওয়াতে শাবহায়ে মান।
[আয় খোদা, তুমি আমার দয়াবান মুনিব, তুমি আমার রাতের একাকীত্বের বন্ধু]
اے کریم و کار سازِ بے نیاز
دائم الاحساں شہِ بندہ نواز
আয় কারীমও কারে সাযে বেনিয়ায,
দায়িমুল ইহসাঁ শাহে বান্দা নাওয়ায।
[তুমি অমুখাপেক্ষিতার গুণে গুণান্বিত হওয়া সত্ত্বেও কর্ম সম্পাদনকারী দয়াবান। যিনি সর্বদা দয়াকারী, তুমি এমন বাদশা যিনি আপন বান্দাকে দান করেন।]
اے کہ نامَت راحت جان و دِلَم
اے کہ فضلِ تو کفیلِ مُشکِلَم
আয় কেহ্ নামত রাহাতে জানও দিলাম,
আয় কেহ্ ফযলে তু কাফীলে মুশকিলাম।
[তোমার পবিত্র নাম আমার অন্তর ও প্রাণের প্রশান্তি। আর তোমার দয়া আমার বিপদের রক্ষাকবচ।]
ہر دو عالم بندئہ اِکرامِ تو
صد چوں جانِ من فدائے نامِ تو
হার দু’আলম বান্দায়ে ইকরামে তু,
সাদ চোঁ জানে মান ফেদায়ে নামে তু।
[দু‘জগত তোমার দয়ার অধীনে। আমার মতো অসংখ্য প্রাণ তোমার নামে উৎসর্গিত।]
ما خطا آریْم و تو بخشِش کُنی
نعرئہ اِنِّیْ غَفُوْرٌ می زَنی
মা খাতা আরীমও তু বখশিশ কুনি,
না’রায়ে ইন্নী গাফূরুম মী যনী।
[আমরা পাপ করতে আছি আর তুমি ক্ষমা করছো। সাথে এও ঘোষণা করছো যে, নিশ্চয় আমি ক্ষমাশীল, দয়াবান।]
اللّٰہ اللّٰہ زیں طرف جرم وخطا
اللّٰہ اللّٰہ زاں طرف رحم وعطا
আল্লাহ্ আল্লাহ্ যীঁ তারাফ জুরমও খাতা,
আল্লাহ্ আল্লাহ্ যাঁ তারাফ রাহমও ‘আতা।
[আশ্চর্য একদিকে অপরাধ ও পাপ আর অন্যদিকে দয়া ও দান।]
از طفیلِ آں صِراطِ مستقیم
قُوَّتے اسلام را دِہ اے کریم
আয তুফাইলে আঁ সিরাতে মুস্তাকিম,
কুওয়াতে ইসলাম রা দেহ্ আয় কারীম।
[ওহে মাওলা দয়াবান! ওই সিরাতে মুস্তাকীম(কুরআন)এর উসিলায় ইসলামকে শক্তি দান কর।]
بہرِ اسلامے ہزاراں فِتنَہا
یک مہ و صَد داغ فریاد اے خدا
বাহরে ইসলামে হাজারাঁ ফিতনাহা,
য়েক মাহ্ও সাদ দাগ ফরীয়াদ আয় খোদা।
[এই এক ইসলামের দিগন্তে আজ হাজারো ফিতনা জন্ম নিয়েছে। যেন একটি চাঁদে হাজারো দাগ। আয় খোদা, তোমার কাছে আমাদের প্রার্থনা।]
اے خدا بہرِ جنابِ مصطفیٰ
چار یارِ پاک و آلِ باصَفا
আয় খোদা বাহরে জনাবে মুস্তাফা,
চার ইয়ারে পাকও আলে বা সাফা।
[ওহে দয়াবান রব! নবী মুস্তাফার সদকায়, চারজন পবিত্র সাথী এবং পুতঃপবিত্র নবীবংশের সদকায় ]

লেখক : পরিচালক-তাজুশ্ শরীআহ্ দরসে নিযামী মাদরাসা, চট্টগ্রাম।