প্রশ্নোত্তর : অধ্যক্ষ মুফ্তী সৈয়দ মুহাম্মদ অছিয়র রহমান 

প্রশ্নোত্তর : অধ্যক্ষ মুফ্তী সৈয়দ মুহাম্মদ অছিয়র রহমান 

 মুহাম্মদ ফারুকুর রহমান  
পটিয়া, বাস স্টেশন, চট্টগ্রাম।
 
প্রশ্ন: ১. মানুষের নিকট হতে টাকা ধার নিয়ে না দেওয়া এবং জনগণ হতে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে টাকা নিয়ে না দেওয়া আরো বিভিন্ন প্রলোভনের মাধ্যমে টাকা নিয়ে আর ফেরত না দিয়ে মানুষের হক নষ্ট করে মানুষকে বিপদে ফেলে- এ ধরণের  লোকের পেছনে ও সুদী লেন-দেনকারী, ছগিরা গুনাহে ইচ্ছাকৃত বার বার লিপ্ত হওয়া ও ওয়াদাভঙ্গকারী ইমাম সাহেবের পেছনে ও মুয়াজ্জিনের পেছনে নামায আদায় করলে নামায হবে কি না? জানালে কৃতজ্ঞ হবো। 
উত্তর: মিথ্যা বলে মানুষকে ধোঁকা দেয়া, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে টাকা-পয়সা, সম্পদ ছিনিয়ে নেয়া, মানুষের কাছ থেকে ধার নিয়ে টাকা-পয়সা পরিশোধ না করা, সুদখোর, বার বার সগীরা গুনাহকারী, ওয়াদা ভঙ্গকারী, মানুষকে কষ্ট প্রদানকারী, অশ্লীল ভাষায় গালি-গালাজ করে, অশ্লীল নাচ-গান দেখে এমন ব্যক্তি শরীয়তের দৃষ্টিতে ফাসেক। বরং জেনে-শুনে এ সমস্ত দুশ্চরিত্র ব্যক্তিকে ইমাম ও মুয়াজ্জিন নিয়োগ করা গুনাহ্ এবং এদের পেছনে নামায আদায় করা মাকরূহে তাহরীমী। উক্ত নামায ওয়াজিবুল  এ‘আদাহ’ অর্থাৎ ওই নামায পুনরায় পড়া ওয়াজিব। তাই ইমাম-মুয়াজ্জিন নিয়োগের সময় মসজিদ কমিটি এমন চরিত্রের ব্যক্তিকে ইমাম-মুয়াজ্জিন নিযুক্ত করবে না বরং ইমামতির দায়িত্ব থেকে এমন ফাসিক ব্যক্তিকে অপসারণ করা অপরিহার্য। জেনে-শুনে এদের পেছনে ইকতেদা করবে না, করলে গুনাহ হবে। আর যদি না জেনে ইকতেদা করে, জানার পর পুনরায় ওই নামায আদায় করে নেয়া ওয়াজিব। 
[দুররে মুখতার, তাহত্বাবী, গুনিয়া ও ফতোওয়ায়ে রজভীয়্যাহ, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২০৮,২০৪,২৫৩, ২৫৫ ইত্যাদি]
 
 প্রশ্ন: ২. যে সব ব্যানার/পোস্টারে বিসমিল্লাহ্, নারা ও আল্লাহ-রাসূলের নাম লেখা থাকে যেমন- মিলাদ-মাহফিল, জুলুস ও ওরশের ব্যানার। এসব ব্যানার/পোস্টারকে টেবিল ক্লথ হিসেবে টেবিলে ব্যবহার করা ও এতে খানা-পিনা আহার করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? জানালে উপকৃত হবো।
 উত্তর: ২. যে সব পোস্টারে ও ব্যানারে বিসমিল্লাহ্, নারায়ে তাকবির ও নারায়ে রেসালত, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নাম মোবারক বা আল্লাহ্র নাম মোবারক ইত্যাদি লেখা থাকে এ জাতীয় পোস্টার ও ব্যানার ঘরের টেবিলে ব্যবহার না করা অপরিহার্য ও খানার টেবিলে এসব ব্যানার-পোস্টার ব্যবহার করা সম্মানহানীর নামান্তর যার দরুন ঈমান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা আছে।
 
 মুহাম্মদ মোস্তাক আহমদ (প্রবাসী) 
ও মুহাম্মদ বোরহান উদ্দীন 
সাবেক ছাত্র- তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল মাদ্রাসা, হালিশহর, চট্টগ্রাম। 
 প্রশ্ন: আমরা দো‘আ করি কিন্তু আমাদের দো‘আ কেন কবুল হচ্ছে না! দো‘আ কবুল হওয়ার শর্তাবলী কি কি? বিস্তারিত জানিয়ে ধন্য করবেন। 
উত্তর: আল্লাহর সাথে বান্দার উত্তম সেতুবন্ধন হলো দো‘য়া । ইসলাম ধর্মে দো‘আকে স্বতন্ত্র ইবাদতের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। হাদিসে পাকে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম দো‘আকে ইবাদতের মগজ বা মূল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। নিষ্ঠা ও মুহব্বতের সাথে নেহায়ত বিনয়ের সাথে খালিস অন্তরে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ ও প্রার্থনা পেশ করাকে শরিয়তের পরিভাষায় মুনাজাত বলা হয়। দো‘আ ও মুনাজাতে উভয় হাত উঠানো সুন্নাত ও দো‘আর আদবের অন্তর্ভুক্ত। এবং দো‘আর গুরুত্ব মানব জীবনে অত্যাধিক। পবিত্র ক্বোরআনে আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন-
وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِى- (سورة البقرة-۸۶-۱)
অর্থাৎ হে প্রিয় রাসূল! যখন আপনার নিকট আমার বান্দারা আমি মাওলা সম্পর্কে জানতে চায় (আপনি বলুন) আমি একেবারে নিকটে, আমি আহ্বানকারীর আহ্বানে সাড়া দিই, যখন সে আমাকে ডাকে। [সুরা বাক্বারা, আয়াত-১৮৬] 
উক্ত আয়াতে করিমার মর্মার্থ হল- আমার নিকট বিনয় ও খালিস নিয়তে দো‘আ করলে তা আমি কবুল করি। অন্য আয়াতে ইরশাদ করেছেন-
اُدْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ
অর্থাৎ তোমরা আমার কাছে দো‘আ কর, আমি তোমাদের দো‘আ কবুল করব। 
[সূরা গাফির, আয়াত-৬০] 
আর হাদীসে পাকে প্রিয়নবী হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম দো‘আর ফজিলত বর্ণনা করতে গিয়ে এরশাদ করেছেন-  الدعاء هو العبادة  অর্থাৎ দোয়া-ই ইবাদত । শুধু ইবাদতই নয় বরং-  الدعاء مُخٌّ العبادةদো‘আ হলো ইবাদতের মগজ ও সার । 
[জামে তিরমিযী শরীফ, ২৯৬৯]
আর দো‘আর মত গুরুত্বপূর্ণ এ এবাদত কবুল হওয়ার কিছু শর্ত রয়েছে। যেমন-ক. আল্লাহর করুণার প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করা। খ. নিষ্ঠার সাথে অর্থাৎ ইখলাস সহকারে দো‘আ করা, গ. দো‘আ কবুল হওয়ার আশা রাখা, ঘ. হালাল রিযিক আহার করা, ঙ. হারাম বর্জন করা, চ. অলসতা প্রদর্শন না করা, (দো‘আর সময়) ছ. মনে উৎসাহ্-উদ্দীপনা থাকা, জ. পূর্ণ মনোনিবেশ সহকারে দো‘আ করা, ঝ. অন্তরকে কপটতা থেকে মুক্ত রাখা, ঞ. শরীর পবিত্র হওয়া, ট. গুনাহ্ থেকে তাওবা করা, চ. হামদ ও সানা এবং দরূদ শরীফের মাধ্যমে দো‘আ শুরু করা, ড. তাড়াহুড়া ও অধৈর্যতা প্রদর্শন না করা, কিবলা মুখী হয়ে দো‘আ করা। আর আউলিয়ায়ে কেরামের মাজার শরীফে দো‘আ করলে তাঁদের চেহারার দিকে তাদের ওসীলা নিয়ে দো‘আ করা, ঢ. উভয় হাত উঠিয়ে দো‘আ করা, ণ. বিনয় ও নম্রতার সাথে দো‘আ করা, ত, দো‘আর পরে মুখের ওপর দু’হাত মাসেহ করা, থ. দো‘আ-মুনাজাতের আগে-পরে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি নেহায়ত আদব ও ভক্তি সহকারে দরূদ/সালাম পাঠ করা, দ. আল্লাহর রহমত ও করুণা হতে নৈরাশ না হওয়া, ধ. দো‘আর উদ্দেশ্য সৎ ও নেক হওয়া তথা শরিয়তের পরিপন্থি না হওয়া ইত্যাদি । তদুপরি দো‘আ-মুনাজাত অনেক সময় তাড়াতাড়ি কবুল হয়ে যায় অর্থাৎ কবুল হওয়ার লক্ষণ তাড়াতাড়ি দেখা যায়, অনেক সময় বিশেষ হেকমত ও রহস্যের কারণে বান্দার দো‘আ- দেরীতে কবুল হয় । আর কিছু কিছু দো‘আ- মুনাজাত আল্লাহ্ তা‘আলা বান্দার নাজাতের উদ্দেশ্যে পরকালের জন্য রেখে দেন। বস্তুত বান্দার ভাল ও উপকার যেভাবে হবে আল্লাহ্ তা‘আলা বান্দার জন্য সেভাবে ফয়সালা করেন । সুতরাং দো‘আ কবুল হওয়ার বিষয়ে অস্থিরতা ও অধৈর্যের কোন কারণ নেই । বিনয় ও নিষ্ঠার সাথে ফরিয়াদ করতে থাকেন, ইনশাআল্লাহ্ আল্লাহর রহমত হতে বঞ্চিত হবেন না । আল্লাহ তা‘আলাও ইরশাদ করেছেন- তোমরা আমার রহমত হতে নিরাশ হইও না । 
[আল কওলুল বদি, কৃত-  ইমাম সাহাবী রহ. ইয়াহইয়ু উলুমিদ্দিন, কৃত- ইমাম  মুহাম্মদ গাজ্জালী রহ. ও মুকাশেফাতুল কুলুব, কৃত- ইমাম মুহাম্মদ গাজ্জালী রহ. ইত্যাদি ]
 
 
 মুহাম্মদ আসাদুল ইসলাম ও আবদুল করিম
দুরুইল, নবীনগর, বি-বাড়িয়া। 
 প্রশ্ন: ১. এক ব্যক্তি জোর দিয়ে বলছে মিসওয়াক করা ওয়াজিব যা ফরযের কাছাকাছি তা না করলে গুনাহ্ হবে। এ ব্যাপারে জানালে উপকৃত হবো।
 উত্তর: ১. মিসওয়াক করা সুন্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। ফরজ ও ওয়াজিব নয়। মিসওয়াক করার ব্যাপারে হাদিসে পাকে বর্ণনা রয়েছে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- যদি আমার উম্মতের ওপর আমি কঠিন ও কষ্টসাধ্য মনে না করতাম তবে প্রত্যেক নামাযের সময় মিসওয়াক করার নির্দেশ প্রদান করতাম। 
হযরত জাফর ইবনে আবি তালিব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, সাহাবায়ে কিরামের কয়েকজন নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমতে হাযির হলেন- প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, ‘‘তোমাদের কি হয়েছে যে, আমি তোমাদের দাঁত হলুদ দেখছি? তোমরা মিসওয়াক কর। যদি আমি আমার উম্মতের উপর এটা কঠিন মনে না করতাম তাহলে প্রত্যেক নামাযে মিসওয়াক করার নির্দেশ প্রদান করতাম।’’ অপর বর্ণনায় বর্ণিত আছে, “প্রত্যেক ওযুর সময় মিসওয়াক করার নির্দেশ প্রদান করতাম।”
[সহীহ বুখারী শরীফ: হাদীস নং ৮৮৭, ৭২৪০, মুসলিম শরীফ: ২৫২, তিরমিযী শরীফ: ২২, নাসায়ী শরীফ: ০৭, সুনানে আবূ দাউদ: ৪৬, মুওয়াত্ত্বা মালিক: ১৪৭, ১৪৮, দারমী: ৬৮৩, ১৪৮৪, মুসনাদে ইমাম আযম আবু হানিফা রাহ. ৪৮ ইত্যাদি]
তাছাড়া হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে মিসওয়াক সম্পর্কে ৬টি ও হযরত যায়িদ ইবনু খালিদ আল-জুহানী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে ১টি হাদিস শরীফ পাওয়া যায়। হাদীস গ্রন্থের প্রায় সকল ইমামগণ এ হাদীস শরীফগুলো বর্ণনা করেছেন। উক্ত হাদীস শরীফ দ্বারা মিসওয়াক করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা প্রমাণিত, ওয়াজিব বা ফরজ নয়। বিশেষ করে যখন দাঁত হলুদ থাকে ও মুখ থেকে দুর্গন্ধ বের হয় অথবা নিদ্রা থেকে এইমাত্র জাগ্রত হয়েছে এবং নামায আদায়ের ইচ্ছা করে, তখন উযু করার সময় মিসওয়াক করবে। যে সমস্ত রিওয়ায়েতে  عند كل وضوء বর্ণিত হয়েছে, সেখানে এর প্রকৃত অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ প্রত্যেক ওযুর সময় মিসওয়াক করবে- এটা সুন্নাত। এটাই ইমাম আযম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হানাফী মাযহাবের অভিমত। যে সমস্ত বর্ণনায় عند كل صلوة বর্ণিত রয়েছে- এর ব্যাখ্যা হলো, প্রতি নামাযের জন্য যে ওযু করা হয় ঐ ওযুর সময় মিসওয়াক করা। আর এটাই হাদিসের উদ্দেশ্য। কেননা মিসওয়াক করার মধ্যে যথেষ্ট উপকারিতা রয়েছে। এটার সাথে ওযূর সাথে সম্পর্ক; প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উম্মতের জন্য সহজ পন্থাকে গ্রহণ করে ওয়াজিব হওয়ার প্রতি নির্দেশ প্রদান করেননি। কেননা যদি ওয়াজিব করা হতো তবে ওয়াজিব আদায় না করলে উম্মতের ওপর শাস্তির বিধান নেমে আসত। সুতরাং সুযোগ অনুযায়ী কষ্টসাধ্য না হলে মিসওয়াক করা সুন্নাতে রাসূল- যাতে অনেক উপকারিতা রয়েছে। সুতরাং প্রত্যেক মুসলমানের উচিত প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাত সমূহ আদায়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করা। তবে অন্য কিছু দিয়ে মুখ পরিস্কার করলে যেমন দাঁতের মাজন, ব্রাশ ইত্যাদির মাধ্যমেও সুন্নাত আদায় হবে। অবশ্যই মিসওয়াকের মাধ্যমে মুখ/দাঁত পরিস্কার করলে পরিপূর্ণ সুন্নাত আদায় হবে- সাওয়াবও বেশী পাওয়া যাবে । মিসওয়াক সংক্রান্ত হাদীস শরীফ সহীহ বোখারী, সহীহ মুসলিম ও জামে তিরমিযী সহ অসংখ্য হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।
 
 প্রশ্ন: ২. ইদানিং মসজিদের ভিতরে জামাতে নামাযরত অবস্থায় মোবাইলে ‘কল’ আসলে কেউ কেউ মোবাইল বের করে রিংটোন বন্ধ করে। এতে নামাযের কোন ক্ষতি হবে কী না? জানালে উপকৃত হবো।
 উত্তর: ২. আমলে কাসীরের কারণে নামায ভঙ্গ হয়। আমলে কাসীর ঐ সকল কাজকে বলা হয় যে কাজ করতে দুই হাতের প্রয়োজন হয়, ঐ সব কাজ যদি এক হাতেও নামাযে করা হয় তবুও আমলে কাসীর হবে। অথবা আমলে কাসীর ওই কাজ যা দূর থেকে কেউ দেখলে মনে হয় যে, এই ব্যক্তি নামাযে নেই। তাই জামাআতে নামাযে শরীক হওয়ার পূর্বে মোবাইল ফোন বন্ধ করা উচিত। যাতে নামাযে নিজের ও অন্যের মনোযোগে ব্যাঘাত না ঘটে। আর নামাযরত অবস্থায় মোবাইল রিং আসলে উক্ত মোবাইল পকেট হতে বের করে রিং বন্ধ করলে নামায নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা বেশি- বিধায় নামায অবস্থায় এ রকম করবে না তবে মোবাইল পকেট হতে বের না করে এক হাতে যদি সহজে রিংটোন বন্ধ করা যায় তবে এটা আমলে কাসীরের পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত হবে না । নিরাপদ ও সতর্কতা হল নামায শুরু করার আগে মোবাইলের রিংটোন বন্ধ করা।   
 
 সৈয়দ মোস্তাফা রেজা ও আনিস আহমদ
শিক্ষার্থী: জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসা, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: আমার বাবা ইন্তেকাল করেছেন। কবরবাসী মা-বাবার ইসালের সাওয়াবের জন্য কি কি আমল করতে পারি? জানিয়ে কৃতজ্ঞ করবেন।
উত্তর: এ প্রসঙ্গে একদা জনৈক সাহাবী প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহ তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সমীপে হাজির হয়ে আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল। আমি আমার মাতা-পিতার জীবদ্দশায় তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করতাম, এখন তাঁরা উভয়ই এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন, তাঁদের সাথে উত্তম ব্যবহার করার কোন পন্থা আছে কি? প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহ তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রত্যুত্তরে ইরশাদ করলেন- 
 انَّ من البرّ بعد الموت ان تصلى لهما مع صلوتك      وتصوم لهما مع صيامك- (رواه الدار قطنى)
অর্থাৎ মৃত্যুর পর তাঁদের প্রতি সদ্ব্যবহার করার পন্থা এ যে, তোমরা নামাযের সাথে তাঁদের জন্যও (কিছু নফল) নামায পড় এবং তোমার রোযার সাথে তাদের জন্যও (কিছু নফল) রোযা রাখ। এ হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমামে আহলে সুন্নাত আলা হযরত শাহ্ আহমদ রেযা রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন, ‘যদি তুমি সাওয়াব অর্জনের উদ্দেশ্যে নিজের জন্য নফল নামায আদায় কর কিংবা রোযা রাখ, তাহলে তাঁদের পক্ষ থেকেও কিছু নফল নামায পড়, নফল রোজা আদায় কর, তবে তাদের নিকট এ সাওয়াব পৌছবে । অথবা নামায রোযা ও তোমার সম্পাদিত সকল নেক্কাজের সাওয়াব তাদের নিকট পৌঁছানোর নিয়্যত কর, তবে তাঁদের নিকট এ সাওয়াব (অবশ্যই) পৌছবে, আর তোমার এ সাওয়াব সামান্যও হ্রাস পাবে না।  
[ফতোয়া-ই রজভীয়া, ৮ম খন্ড]
  এভাবে মাতা-পিতার ইন্তিকালের পর কবর জিয়ারত, নামায, রোযা, হজ্ব, ফাতেহাখানি ও  দো‘আ-দুরূদ, সাদক্বাহ্-খায়রাত ইত্যাদির মাধ্যমে তাঁদের সাথে সদ্ব্যবহার করা এবং সাওয়াব পৌঁছানো প্রত্যেক সন্তানের জন্য অবশ্যই কর্তব্য। মাতা-পিতার মৃত্যুর পর ছেলে সন্তানের উপর যেসব হক বা কাজ বর্তায় পবিত্র কোরআন ও হাদীস শরীফের আলোকে তা নিন্মে পেশ করা হল।
১. মাতা-পিতার ইন্তিকালের পর সর্বপ্রথম, তাঁদের জানাযা প্রস্তুতকরণ, গোসল, নামাযে জানাযা, কাফন ও দাফন ইত্যাদি কার্যাদি সম্পন্ন করা। এসব কাজের মধ্যে অতি যত্ন সহকারে সুন্নাত ও মুস্তাহাবসমূহ পালন করা, যাতে তাদের জন্য সকল সৌন্দর্য্য, বরকত ও রহমত লাভ করাই কাক্সিক্ষত হয়। ২. তাদের জন্য আল্লাহ তাআলার দরবারে ক্ষমাপ্রার্থনা করা, ৩. স্বীয় সাদক্বাহ্ খায়রাত ও নেক কাজসমূহের সাওয়ার তাঁদের নিকট পৌঁছাতে থাকা। সাধ্যমত এসব নেককাজ অব্যাহত রাখা, স্বীয় নামায, রোযা ও হজ্ব এর সাথে মাতা-পিতার জন্যও এ সমস্ত ইবাদত সম্পাদন করা। 
৪. তাঁদের উপর যদি কারো কর্জ থাকে, যথাশীঘ্রই তা পরিশোধ করার ব্যবস্থা করা। নিজের সামর্থ না থাকলে আত্মীয়-স্বজন বা শুভাকাক্সক্ষীর নিকট থেকে কর্জ পরিশোধ করার জন্য সাহায্য কামনা করা। 
৫. যদি তাদের উপর কোন ফরয কাজ অনাদায়ী থেকে যায়, তাহলে সাধ্য মোতাবেক ফরয নামায বিতির সহ ও ফরয রোযার ফিদয়া তথা কাফ্ফারা আদায় করার জন্য চেষ্টা করা। যদি হজ্বব্রত পালন না করে থাকে, তাহলে তাঁদের পক্ষ হয়ে নিজে বা অন্য কারো দ্বারা হজ্ব আদায়ের ব্যবস্থা করা। যদি তাঁদের উপর যাকাত কিংবা উশর (ফসলের যাকাত) অনাদায়ী থাকে, তাহলে তার ফিদয়াহ্ বা কাফ্ফারা (ক্ষতিপূরণ) আদায় করা, এভাবে তাদেরকে দায়মুক্ত করার চেষ্টা করা। 
৬. মাতা-পিতা শরীয়ত সম্মত কোন অসিয়ত করে থাকলে তা যথাসম্ভব বাস্তবায়নের চেষ্টা করা। যদিও শরীয়তের দৃষ্টিতে সন্তানের ওপর তা পালন করা কর্তব্য নয় ।
৭. তাদের আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধবের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। সব সময় তাঁদেরকে সম্মান করা ।
৮. সম্ভব হলে প্রত্যেক দিন অথবা প্রতি জুমাবার তাদের কবর জিয়ারত করা এবং তথায় এমন স্বরে সূরা ইয়াসীন বা অন্য সূরা পাঠ করা যাতে তারা শুনতে পান এবং এর সাওয়াব তাদের রূহে পৌছানো। তাদের কবরের পাশ দিয়ে গমনকালে সালাম ও ফাতেহা পাঠ না করে অতিক্রম না করা। ৯. কোন সময় অন্য কারো মাতা-পিতাকে অশালীন ভাষায় গালি-গালাজ করার দরুন নিজ মাতাপিতাকে গালি না শুনানো। 
১০. ইন্তেকালের পর মাতা-পিতার বড়ই কষ্টের কারণ হয় যখন জীবিত সন্তানগণ পাপ কাজে লিপ্ত হয়। সুতরাং সন্তানগণ যেন কখনো কোন পাপ কাজ করে তাঁদেরকে কষ্ট না দেয়। কারণ, মাতা-পিতার নিকট সন্তান-সন্তুতিদের যাবতীয় নেক কাজের সংবাদ পৌঁছে থাকে । তখন তাঁরা পুলকিত হন । আর যখন তাঁরা সন্তানের কোন পাপ কাজ অবলোকন করেন, তখন তাঁরা ব্যথিত হন এবং দুঃখ পান। কবরের মধ্যে মাতা-পিতাকে কষ্ট প্রদান করা সন্তান-সন্তুতিদের জন্য অমঙ্গল ও নেহায়ত পরিতাপের বিষয়। মৃত্যুর পর মাতা-পিতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য সম্পর্কিত উল্লিখিত সকল বিধান পবিত্র হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে নেয়া হয়েছে । আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাদকায় আমাদেরকে এসব নেককাজ পালন করার তাওফীক দিন । আমিন । 
এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে আমার স্নেহভাজন ঢাকা মুহাম্মদপুর কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল মাদরাসার প্রধান ফকিহ্ মুফতি মাহমুদুল হাসান আলকাদেরী লিখিত ‘ঈসালে সাওয়াব ও ফতোহা’ নামক কিতাবটি পাঠ করার জন্য অনুরোধ রইল। 
 
 মুহাম্মদ আলী
মুরাদনগর, বায়েজিদ, চট্টগ্রাম।
 প্রশ্ন: ১. আমি প্রায় ৪৩ বৎসর পর্যন্ত মাসিক তরজুমান পড়ে আসছি। তরজুমান প্রশ্নোত্তর বিভাগের মধ্যে বিভিন্ন মাসায়েল ও ফতোয়া থাকে ঐগুলি তরজুমানের উদ্ধৃতি দিয়ে আমি যদি মানুষকে একা অথবা খতমে গাউসিয়া শরীফে বলি আমার কি গুনাহ হবে? এক আলেম আমাকে বলেছেন- আপনি তরজুমান পড়ে নিজে আমল করুন, অন্যকে বললে আপনার গুনাহ্ হবে, আমি বলি যেমন : নামাযে প্যান্টের নিচু অংশ পায়ের গোড়ালির উপরের দিকে উল্টিয়ে দিলে নামায মকরূহে তাহরিমা হবে ইত্যাদি।
এ জাতীয় মাসআলা তরজুমান প্রশ্নোত্তর হতে বললে আমি কি গুনাহগার হবো? জানালে ধন্য হবো। 
 উত্তর: ১. প্রশ্নোল্লিখিত নামাযে প্যান্ট/পায়জামার পায়া পায়ের গোড়ালির উপরের দিকে মুড়িয়ে দেওয়া ফোকাহায়ে কেরাম মাকরূহে তাহরীমী বলেছেন, গয়াল ও হরিন দ্বারা কোরবানী করা শুদ্ধ নয়, দুই সাজদার মাঝখানে দো‘আ পাঠ যায়েয ও মুস্তাহাব, যে আল্লাহর আনুগত্য করল, সে রাসূলের আনুগত্য করল। এ মাসআলাগুলো সঠিক। সুতরাং এগুলো যারা জানে না তাদেরকে তরজুমান প্রশ্নোত্তর বিভাগ হতে জানালে সাওয়াব হবে, গুনাহ হবে না। এ জাতীয় জরুরি প্রশ্নোত্তর ও মাসআলাগুলো মানুষকে বললে গুনাহ হবে বলা ও বাঁধা দেয়া অজ্ঞতা ও মুর্খতার নামান্তর। এবং এ মাসআলাগুলো মানুষকে বললে গুনাহ্ হবে বলাটাই গুনাহ্। সুতরাং ঐ মওলভী গুনাহগার হবে, আপনি গুনাহগার হবেন না। তবে তরজুমানের প্রশ্নোত্তরের মাসআলাগুলো ভালভাবে বুঝে বলবেন, না বুঝলে ভাল অভিজ্ঞ আলিম/মাওলানা হতে জেনে নিবেন। না বুঝে মাসআলা অশুদ্ধ বললে তখন আপনি অবশ্যই গুনাহগার হবেন।
 
 প্রশ্ন: ২. যদি কেউ মাকরূহে তাহরীমার সাথে নামায আদায় করে তাহলে তার নামায হবে কি না? জানালে উপকৃত হবো।
 উত্তর: ২. মাকরূহে তাহরীমী যদি নামাযে হয়ে যায় ওই নামায পুনরায় পড়া ওয়াজিব। যে কাজগুলো করলে নামায মাকরূহে তাহরীমী হয়- সাজদায়ে সাহু দিলেও ওই নামায শুদ্ধ হবে না। উক্ত নামায পুনরায় পড়তে হবে। ইচ্ছাকৃত মাকরূহে তাহরীমী সংগঠিত হলে গুনাহগার হবে। অনেক মুসল্লি অজানাবশত নামাযে এমন কাজ করে বসে যার দরুণ নামায মাকরূহে তাহরীমী হয়ে যায়। তাই প্রত্যেক নামাযীকে মাকরূহে তাহরীমী সমূহের ব্যাপারে মাসআলাগুলো ভালোভাবে অবগত হওয়া বা জেনে নেয়া জরুরি। যেমন- নামায অবস্থায় ইচ্ছাকৃত মুসল্লি কাপড়, দাড়ি বা শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে খেলা করা, অনর্থক বার বার নড়াচড়া করা, সাজদায় যাওয়ার সময় সামনে এবং পেছন থেকে ইচ্ছাকৃত জামার আস্তিন বা অন্য কোন কাপড় টানা, পায়জামা দু’হাতে টেনে ধরা, নামাযে জামার আস্তিন উপরের দিকে এমনভাবে কুড়িয়ে নেয়া, যাতে হাতের কুনুই গুলো প্রকাশ পায়, পায়খানা-প্রস্রাবের গতি ও বায়ু নির্গত হওয়ার অবস্থা প্রবল হওয়া সত্ত্বেও নামাযের নিয়ত বাঁধা, নামাযা অবস্থায় এদিক-ওদিক বার বার দেখা,  ইচ্ছাকৃত আঙ্গুল মটকানো ইত্যাদি নামাযে মাকরূহে তাহরীমী। আর ইচ্ছাকৃত এসব কর্ম সম্পাদন করলে উক্ত নামায পুনরায় পড়ে নেয়া ওয়াজিব।
[দুররে মুখতার, বাহারে শরীয়ত: ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৬৬, ফতোয়ায়ে রজভীয়্যাহ্: ১ম খণ্ড, ১০ম অধ্যায় ও আমার রচিত আনজুমান হতে প্রকাশিত- যুগজ্ঞিাসা ইত্যাদি। 
 
 মাওলানা মুহাম্মদ রবিউল হোসাইন 
কুমিল্লা সদর।
 প্রশ্ন: জুমার খুতবার আগের আযান মিম্বরের সামনে ইমাম সাহেবের সম্মুখে দাঁড়িয়ে দেবে নাকি মসজিদের দরজায় দাঁড়িয়ে দেবে। এ বিষয়ে কুমিল্লার বিভিন্ন জায়গায় কেউ কেউ ফেতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে। এমনকি তারা ইমাম/খতিবের সামনে উক্ত আযান দিলে হবে না মর্মে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে। এ বিষয়ে জানালে বেশী উপকার হবে। 
 উত্তর: খুতবার পূর্বে জুমার ২য় আযান সর্বসম্মতিক্রমে সুন্নাত। ওই আযান ইমামের সাসনা-সামনি মসজিদের দরজায় এবং মসজিদের ভিতরে মিম্বরের কাছে খতিবের সামনে দেয়া যায়। উভয়টা শরীয়ত সম্মত। উভয় পদ্ধতিতে সুন্নাত আদায় হয়ে যায়। মসজিদের দরজায় খুতবার আযান দেয়া হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। আর ইমামের সামনে দেয়া সম্পর্কে ওমদাতুর রিয়ায়া হাশিয়ায়ে শরহে বেকায়া ও হেদায়াসহ বহু ফিকহের কিতাবে বর্ণিত রয়েছে। সুতরাং যেখানে যেভাবে প্রচলন আছে সেভাবেই আমল করতে অসুবিধা নেই। অর্থাৎ খুতবার আযান মসজিদের দরজায় খতিবের সামনে অথবা মিম্বরের কাছে দেয়া উভয়টা জায়েয। তাছাড়া, জুমার ২য় আযান মিম্বরের কাছে খতিবের সামনে দেয়ার বিধান ও আমল যুগ যুগ ধরে চলে আসছে- যাকে বিভিন্ন ফিকহের কিতাবে جرى به التوراث হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ যুগ যুগ ধরে এ নিয়ম চলে আসছে। ‘তাওয়ারুস’ সম্পর্কে রদ্দুল মোহতার তথা ফতোয়ায়ে শামীতে উল্লেখ রয়েছে- المتوارث لايكون مكروها অর্থাৎ যা যুগ যুগ ধরে প্রচলিত তা মাকরূহ হতে পারে না। আরো উল্লেখ করা হয়েছে-
وكذالك تقول فى الاذان بين الخطيب فيكون بدعة حسنة اذ ما رأه المؤمنون او المسلمون حسنًا فهو عند الله حسن-
অর্থাৎ- যেভাবে তুমি বলবে খতিবের সামনে প্রদত্ত আযান সম্পর্কেও সুতরাং তা বিদআতে হাসানা। কেননা মুমিনগণ যে বস্তুকে ভাল হিসেবে জানে তা আল্লাহ্র কাছেও উত্তম হিসেবে পরিগণিত। সুতরাং হাজার বছরের চেয়েও আরো অধিককাল থেকে আপন আপন যুগের ফোকাহায়ে কেরাম ও মুমিনগণ যখন এটাকে আমলে পরিণত করেছেন তাহলে আমাদের বুঝে নিতে হবে এটা আল্লাহর কাছে উত্তম/ভাল। আর এটা চিরসত্য ও স্বীকৃত যে, ইমাম ইবনে আবেদীন শামী হানাফী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-(ফতোয়ায়ে শামীর লেখক) ও ইমাম মরগিনানী (হেদায়া গ্রন্থের লেখক) তাদের পরবর্তী ওলামায়ে কেরাম ও ফকিহগণের চেয়ে অনেক বেশি বিজ্ঞ ও ফিকহ্ ফতোয়া সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত। অতএব, এ মাসআলা নিয়ে অহেতুক বিতর্কে না জড়ানো উচিত। যেখানে যেনিয়ম  চালু আছে সেখানে সেভাবে আমল করবে। [হেদায়া শরহে বেকায়া, ওমদাতুর রিয়ায়া, রদ্দুল মুখতার- নামায অধ্যায়, আমার রচিত যুগ জিজ্ঞাসা ইত্যাদি]
 
 মুহাম্মদ মুজাম্মিল হক 
শিক্ষার্থী: জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসা, চট্টগ্রাম। 
 প্রশ্ন: মুহাররমের ১০ তারিখকে আশুরা কেন বলা হয়? আশুরা দিবসের ফজিলত এবং মুসলিম জীবনে এর গুরুত্ব সম্পর্কে জানালে উপকৃত হবো। আশুরা দিবসের ইবাদত-বন্দেগী সম্পর্কে আলোচনা করার অনুরোধ রইল। বর্তমান মিডিয়ার যুগে বিভিন্ন চ্যানেলে কোন কোন বক্তা/মাওলভী আশুরা দিবসের নফল রোযা ও নফল ইবাদত-বন্দেগী সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করতে দেখা যায়। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা কাম্য।
উত্তর: আশুরা শব্দটি আরবি, এটা ‘আশারুন বা আশেরুন’ থেকে নির্গত। আভিধানিক অর্থ হলো দশম। শরিয়তের পরিভাষায় মুহররম মাসের দশম তারিখকে আশুরা বলা হয়। মুহররমের দশম তারিখকে “আশুরা দিবস’’ নামকরণ করার পিছনে কিছু বর্ণনা পরিলক্ষিত হয়। ক. রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মতদেরকে আল্লাহ্ তা’আলা বিশেষ ফজিলত পূর্ণ যে দশটি দিন দান করেছেন তন্মধ্যে আশুরার দিনের অবস্থান ১০ম নম্বরে হওয়ার কারণে এটাকে “ইয়াওমে আশুরা’’ বা আশুরা দিবস বলা হয়। খ. আশুরা দিবসের নামকরণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ওলামায়ে কেরাম বলেছেন, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে দেখা যায় মুহররমের ১০ তারিখে রহমত ও বরকত মন্ডিত ১০ টি ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল বিধায় আশুরা নামকরণ করা হয়েছে । গ. তবে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে “যেহেতু এ দিনটি মহররমের দশ তারিখ- সেখান থেকেই এর নামকরণ “ইয়াউমে আশুরা’’ করা হয়েছে। এ দিবসটি পৃথিবীর সৃষ্টি লগ্ন থেকে বিভিন্ন কারণে সম্মানিত ও বরকতমন্ডিত। এ দিবসে যে সমস্ত ঘটনাবলী রয়েছে তন্মধ্যে সমগ্র বিশ্বে সাড়া জাগানো নজীরবিহীন ও হৃদয় বিদারক মর্মস্পর্শী ঘটনা হলো ৬১ হিজরির মুহররম মাসের ১০ তারিখে প্রিয় নবীজির (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) দ্বীন ইসলামকে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত পৃথিবীর বুকে সজীব রাখতে ঐতিহাসিক কারবালা প্রান্তরে নবীজির নয়নমনি ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সহ ৭২/৮২ জন আহলে বাইতে রাসূল ও তাদের অনুসারীদেরকে দুষ্ট ও পাপিষ্ঠ ইয়াজিদের জালেম বাহিনীর হাতে শাহাদাতের ঘটনা অবিস্মরণীয় হয়ে আছে আজও। 
নামকরণের প্রেক্ষাপট হতে আশুরার ফজিলত এবং তাৎপর্য কিছুটা হলেও উপলব্ধি করা যায়। আশুরা দিবসের ফজিলত অপরীসীম। রঈসূল মুফাস্সেরীন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমা হতে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি আশুরার দিবসে রোযা রাখলো আল্লাহ্ তা’আলা তার আমলনামায় দশ হাজার ফেরেশতার নেক আমলের সওয়াব দান করবেন। তাঁর আমলনামায় দশ হাজার শহীদ ও দশ বছর ইবাদতের সওয়ার দান করবেন। জাহিলিয়াতের যুগেও কুরাইশগণ এই দিবসে রোযা রাখতেন, হিজরতের পূর্বে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ দিবসে রোযা পালন করতেন। আর হিজরতের পরেও এ দিবসে রোযা রাখা ফরয ছিল। পরবর্তীতে রমযানের এক মাসের রোযা ফরয হওয়ার হুকুম আসলে আশুরা দিবসে রোযা রাখার ফরযিয়্যাতের হুকুম রহিত হয়ে যায়। তবে আশুরা দিবসের রোয়া মোস্তাহাব ও মসনুন হওয়ার ফজিলত ও সওয়াব বিদ্যামান আছে ।
অন্য এক হাদিসে পাকে এসেছে “যে ব্যক্তি আশুরার দিবসে রোযাদারকে ইফতার করালো, সে যেন সমস্ত উম্মতে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ইফতার করালো। আর যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে সহমর্মিতার সাথে কোন ইয়াতিম সন্তানের মাথায় হাত রাখলো, এর পরিবর্তে জান্নাতে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করা হবে।
হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, বনী ঈসরাইলের উপর সারা বছরে শুধু আশুরা দিবসের রোযা ফরয করা হয়েছিল। সুতরাং তোমরাও সেদিন রোযা রাখ আর পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয় কর। যে ব্যক্তি ঐ দিন উদার হস্তে (বৈধ পন্থায়) খরচ করবে আল্লাহ্ তা‘আলা সারা বৎসর সুখ স্বাচ্ছন্দে জীবন-যাপনের তাওফিক দান করবেন । আর তার চল্লিশ বৎসরের গুনাহের কাফ্ফারা হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি আশুরা রজনীতে সারারাত ইবাদত করে পরবর্তী দিন রোযা রাখবে তার মৃত্যু যন্ত্রণা অনুভব হবে না।
তাই আশুরার দিন রোযা রাখা, নফল নামায পড়া, সদকা- খায়রাত করা, কারবালার শহীদদের স্মরণে কোরআন খানীর ব্যবস্থা করা, ফাতিহা খানী করা, মিলাদ- মাহফিল, যিকর-আযকার ও আলোচনা সভা ইত্যাদি করা মুস্তাহাব অতি ফজিলত ও পুণ্যময় আমল এবং সওয়াব লাভের অন্যতম ওসিলা। হযরত নিযাম উদ্দীন আউলিয়া মাহবুবে এলাহী কুদ্দিসা সিররুহু হযরত বাবা ফরিদ উদ্দীন গঞ্জেশকরের বরাতে বর্ণনা করেছেন, “আশুরার এ মহান দিবসে ইবাদত-বন্দেগী, ক্বোরআন তেলাওয়াত, নামায-কলমা ও দুরূদ শরীফ পাঠ ব্যতীত অযথা দুনিয়াবী বাজে কাজে লিপ্ত বা মশগুল হওয়া উচিত নয়। এসব বর্ণনা সমূহ ফজিলত ও সওয়াব অর্জনের জন্য যথেষ্ট। সুতরাং সাধারণ মুসলমানগণকে ইবাদত হতে বঞ্চিত করতে এসব বর্ণনাসমূহকে জয়ীফ ও দুর্বল বলে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী ও ফজিলত অর্জন করা থেকে বঞ্চিত করা অজ্ঞতা ও বিভ্রান্তির পরিচায়ক। যেহেতু জয়ীফ হাদীস দ্বারা মুসতাহাব প্রমাণিত হয়। 
[গুনিয়াতুৎ তালেবীন কৃত-গাউসে আ‘যম পীরানে পীর শেখ সৈয়্যদ আবদুল কাদের জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ও যুগ-জিজ্ঞাসা ইত্যাদি] 
 
 নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক 
 প্রশ্ন: ৫১ বছর বয়সী জনৈক মহিলার সারা জীবনে অগণিত ক্বাযা নামায রয়েছে এবং নামাযের সূরা ক্বিারাত শুদ্ধভাবে জানে না, এমতাবস্থায় তিনি কী রূপ ফিদইয়া আদায়ের মাধ্যমে দায়মুক্ত হবেন- জানিয়ে সাহায্য করলে উপকৃত হবো। 
 উত্তর: ঈমান-এর পর নামায-এর স্থান। একজন হুশ-আকল সম্পন্ন মুসলমান বালেগ/বালেগার ওপর দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা ফরযে আইন। অস্বীকার করলে বেঈমান হয়ে যাবে। আর অবহেলা বশত না পড়লে শক্ত গুনাহগার হবে। আর নামাযে ক্বিরাত পড়া ফরয। ক্বিরাত পড়া ফরয হওয়া মানে সাধারণত  লম্বা ১ (এক) আয়াত পড়া, আর নামাযে সূরা ফাতেহা পড়া ওয়াজিব। নামাযে বা নামাযের বাইরে ক্বোরআন শরীফ তাজভীদ সহকারে পড়া জরুরি। যাতে কমপক্ষে ক্বোরাআন পাকের অক্ষরগুলোর উচ্চারণ সঠিকভাবে আদায় হয়। ক্বোরআন মজীদ ভুল পড়া থেকে বিরত থাকা ফরযে আইন। [ফাতওয়া-এ রজভীয়্যাহ: ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৩০]
ক্বোরনের সূরা ক্বিরাত জানা না থাকলে কম পক্ষে আকারে ছোট ছোট সূরাগুলো (সূরা ফাতিহা, কাউসার ও ইখলাস) শিখে নেয়া একজন মুসলমানের উপর ফরযে আইন। 
সুতরাং উক্ত ৫১ বছর বয়স্ক মহিলা কমপক্ষে ছোট ছোট সূরা ২/১টি ফাতেহা সহ শিক্ষা গ্রহণ করে কাযা হওয়া নামায সমূহ ১২ বৎসর হতে হিসাব করে দৈনিক বিতির সহ ছয় ওয়াক্ত কাযার নিয়তে আদায় করবে। সহীহ বুখারী শরীফে  প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম  ইরশাদ করেছেন-خيركم من تعلّم القران وَعَلَّمَه অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে ক্বোরআন মজীদ শিখে এবং অপরকে শিক্ষা দেয়। 
[বুখারী শরীফ: হাদীস নম্বর- ৪৬৩৯]
বালেগ-বালেগা হওয়ার পর হতে চেষ্টা করলে উপায় হয়। তাল-বাহানা করে নামায না পড়া শয়তানের প্রতারণা। শয়তানকে লাথি মার। মহান আল্লাহকে ভয় কর। এটাই প্রকৃত ঈমানদারের আদর্শ। আর যদি উক্ত মহিলা/ব্যক্তি বেনামাযী অবস্থায় মারা যায়- তার অলি-ওয়ারিস/ছেলে-সন্তান, তার পরিত্যক্ত সম্পত্তি হতে তার গোটা জীবনের (১২ বৎসর হতে হিসেব করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত) দৈনিক বিতির সহ ছয় ওয়াক্ত হিসেব করে প্রতি ওয়াক্তের জন্য এক ফিতরা পরিমাণ গম বা গমের আটা অথবা সমপরিমাণ টাকা গরীব/মিসকিনকে অথবা সুন্নি মাদরাসার মিসকিন ফাণ্ডে নামাযের ফিদয়া/কাফ্ফারার নিয়তে প্রদান  করবে আর যদি পরিত্যক্ত সম্পত্তি রেখে না যায় ছেলে-সন্তানরা তাওফিক বা সামর্থ থাকলে আদায় করবে। নতুবা সামর্থ অনুযায়ী আদায় করবে। বাকী/অবশিষ্ট থাকলে আল্লাহ্র দরবারে মৃত ব্যক্তির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে। সাধ্যানুযায়ী সাদকা-খাইরাত করবে। উপরোক্ত বিষয়ে এটাই ইসলামী শরিয়তের বিধান।
 
দু’টির বেশি প্রশ্ন গৃহীত হবেনা  একটি কাগজের পূর্ণপৃষ্ঠায় প্রশ্ন লিখে নিচে প্রশ্নকারীর নাম, ঠিকানা লিখতে হবে  প্রশ্নের উত্তর প্রকাশের জন্য উত্তরদাতার সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ বাঞ্ছনীয় নয়।  প্রশ্ন পাঠানোর ঠিকানা: প্রশ্নোত্তর বিভাগ, মাসিক তরজুমান, ৩২১, দিদার মার্কেট (৩য় তলা), দেওয়ান বাজার, চট্টগ্রাম-৪০০০।