রাসূলে খোদার প্রতিটি বাণী আল্লাহর ওহী

রাসূলে খোদার প্রতিটি বাণী আল্লাহর ওহী

অধ্যক্ষ হাফেয কাজী আবদুল আলীম রিজভী>

بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
وَالنَّجْمِ إِذَا هَوٰى- ١ مَا ضَلَّ صَاحِبُكُمْ وَمَا غَوٰى- ٢ وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوٰىٓ- ٣ إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْىٌۭ يُوْحٰى- ٤ عَلَّمَهُۥ شَدِيْدُ الْقُوٰى- ٥ ذُو مِرَّةٍۢ فَاسْتَوٰى- ٦ وَهُوَ بِا لْأُفُقِ الْأَعْلٰى- ٧ ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى- ٨ فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنٰى- ٩ فَأَوْحٰٓى إِلٰى عَبْدِهۦ مَآ أَوْحٰى- ١٠ مَا كَذَبَ الْفُؤَادُ مَا رَأَىٰٓ- ١١ أَفَتُمٰرُونَهُۥ عَلٰى مَا يَرٰى- ١٢عِندَ سِدْرَةِ الْمُنْتَهٰى- ١٤ عِنْدَهَا جَنَّةُ الْمَأْوٰٓى- ١٥ إِذْ يَغْشَى السِّدْرَةَ مَا يَغْشٰى -١٦ مَا زَاغَ الْبَصَرُ وَمَا طَغٰى- ١٧ لَقَدْ رَأَى مِنْ اٰيَاتِ رَبِّهِ الْكُبْرٰٓى- ١٨ أَفَرَءَيْتُمُ اللّٰـتَ وَالْعُزّٰى- ١٩ وَمَنَوٰةَ الثَّالِثَةَ الْأُخْرٰى-

তরজমা: (মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন) ওই প্রিয় উজ্জ্বল নক্ষত্র হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শপথ, যখন তিনি মিরাজ থেকে অবতরণ করেন। (হে মুমিন!) তোমাদের সাহিব-সংগী (অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম না পথভ্রষ্ট হয়েছেন, না বিপথে চলেছেন। এবং তিনি কোন কথা নিজ প্রবৃত্তি থেকে বলেননা। তা তো ওহীই, যা তাঁর প্রতি নাযিল করা হয়। তাঁকে শিক্ষা দিয়েছেন প্রবল শক্তিসমূহের অধিকারী। শক্তিমান। অতঃপর ওই জ্যোতি ইচ্ছা করলেন, আর তিনি উচ্চাকাশের সর্বোচ্চ দিগন্তে ছিলেন। অতঃপর ওই জ্যোতি নিকটবর্তী হল। অতঃপর খুব নেমে আসলো। অতঃপর ওই জ্যোতি এই মাহবুব (অর্থাৎ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মধ্যে দুহাতের ব্যবধান রইল। বরং তদপেক্ষাও কম। তখন তিনি (অর্থাৎ আল্লাহ) ওহী করলেন আপন প্রিয় বান্দার প্রতি যা ওহী করার ছিল। অন্তর মিথ্যা বলেনি যা সে দেখছে। তবে কি তোমরা তাঁর সাথে তিনি যা দেখেছেন তাতে বিতর্ক করছো? এবং তিনি তো ওই জ্যোতি দুবার দেখেছেন। সিদরাতুল মুনতাহার নিকটে। সেটার নিকট রয়েছে জান্নাতুল মাওয়া। যখন সিদরার উপর আচ্ছন্ন করছিলো যা আচ্ছন্ন করছিলো। চক্ষু না কোন দিকে ফিরেছে, না সীমাতিক্রম করেছে। নিশ্চয় তিনি আপন প্রতিপালকের বহু বড় নিদর্শনাদি অবলোকন করেছেন। (হে মুশরিকগণ!) তোমরা কি দেখেছো লাত ও ওয্যা। এবং ওই তৃতীয় মানাত কে? [সুরা আন-নাজম ১-২০ নং আয়াত]

আনুষঙ্গিক আলোচনা
সুরা আন নাজম এর স্বতন্ত্র বিশেষত্ব: মুফাস্সেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন- ক্বোরআনে করীমের সুরা আন-নাজম প্রথম সুরা যা রাসূলে করিম রউফুর রাহিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম মক্কা মুর্কারামায় ঘোষনা করেন। [তাফসীরে কুরতুবি শরীফ]
এ সুরাতেই সর্বপ্রথম সাজদার আয়াত অবতীর্ণ হয় এবং রাসূলে খোদা আশরাফে আম্বিয়া সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তেলাওয়াতের সাজদা আদায় করেন। মুসলমান-অমুসলমান, কাফির-মুশরিক সবাই- এই সাজদায় শরিক হয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয় হলো- মজলিশে যত কাফির-মুশরিক উপস্থিত ছিলো, সবাই রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে আভূমি নত হয়ে যায়। কেবল এক অহংকারী ব্যক্তি, যার নাম সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে, সে সাজদা করেনি। কিন্তু সে এক মুষ্টি মাটি তুলে কপালে লাগিয়ে বলতে লাগল ব্যস এটুকুই যথেষ্ট। সাইয়্যেদুনা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন- আমি সেই লোকটাকে কাফির অবস্থায় মৃত্যু বরণ করতে দেখেছি। [তাফসিরে ইবনে কাছীর]
এ সূরার প্রারম্ভে রাসূলে পাক সাহেবে লাওলাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম সত্য ও বরহক নবী হওয়া এবং তাঁর উপর অবতীর্ণ হওয়া ক্বোরআনে করিম আল্লাহর বাণী হওয়ার বিষয়ে কোনরূপ সংশয়-সন্দেহের অবকাশ না থাকায় বিষয়টি তাগিদ সহকারে বর্ণনা করা হয়েছে।
والنجم اذا هوي
আরবি ভাষা তাত্ত্বিকগণ এর মতে- নজম মানে নক্ষত্র। আর বহু বচন হলো النجوم। কখনো এই শব্দটি কয়েকটি নক্ষত্রের সমষ্টি সপ্তর্ষীমন্ডলের অর্থেও ব্যবহৃত হয়। তাফসীর শাস্ত্র বিশারদগণ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বিভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করেছেন। যেমন- প্রসিদ্ধ তাফসিরবেত্তা ইমাম মুজাহিদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেছেন- আন-নাজম মানে ‘সুরাইয়া’ কে বুঝানো হয়েছে। ইমাম সুদ্দী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেছেন- আন-নাজম বলে ‘যুহরা’ কে বুঝানো হয়েছে। আবার কেউ কেউ অভিমত ব্যক্ত করেছেন-আন-নাজম বলে কুরআন কে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। [তাফসিরে ইবনে কাছীর]
তাফসিরে খাযায়েনুল ইরফান ও নুরুল ইরফান এর আলোকে এখানে আন নজম বলে রাসূলে করিম রউফুর রাহিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসল্লামকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। অন্ধকার রজনীতে দিক ও রাস্তা নির্ণয়ের কাজে নক্ষত্র বড় উপকার দান করে। তেমনি রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বিশ^সৃষ্টির জন্য কল্যাণ আর মঙ্গলের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক এবং মহান আল্লাহর পথের হেদায়তের জন্য আলোকবর্তিকা হিসাবে আবির্ভুত হয়েছেন। দ্বিতীয়ত: এ আয়াতের পরবর্তী আয়াতসমূহে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শান-মান ও বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। তাই সূরার প্রারম্ভিক আয়াতে আন-নাজম বলে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। হযরত কাররা ও সাইয়্যেদুনা হযরত ইমাম হাসান বছরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হিমা ইমাম মুজাহিদ (রাহমাতুল্লাহি আলায়হি) এর অভিমত কে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। [তাফসিরে কুরতুবি]
ما ضل صاحبكم وماغوي
আল্লাহর পবিত্র বাণী তোমাদের সাহিব-সঙ্গী (অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম না পথভ্রষ্ট হয়েছেন না বিপথগামী হয়েছেন।” এ আয়াতের বিষয়বস্তুকে সন্দেহাতীত ও নিশ্চিত সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন والنجم اذا هوي প্রারম্ভিক আয়াতে শপথ করে তাগিদ দিয়েছেন। তাই আলোচ্য আয়াত হলো مقسسم عليه অর্থাৎ রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বিশ^ মানবকে যে পথের দিকে দাওয়াত দিয়েছিলেন তাই একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের বিশুদ্ধতম পথ। অন্য কোন বিকল্প পথ-পন্থা আর নেই। কেননা তিনি এ ক্ষেত্রে না পথভ্রষ্ট হয়েছেন না বিপথগামী হয়েছেন।

রাসূলে খোদাকে তথা ‘তোমাদের সঙ্গী ’ বলার মর্মকথা
আয়াতে রাসূলে খোদা আশরাফে আম্বিয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে নবী কিংবা রাসূল বা অন্য কোন বিশেষণে আখ্যায়িত না করে সঙ্গী হিসাবে অভিহিত করার রহস্য বর্ণনায় মুফাস্সেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন- আল্লাহর রাসুল ঈমানদারের দুনিয়া-আখেরাত, কবরে-হাশরে, পুলছেরাত অতিক্রমকালে সর্বত্র সর্বক্ষণ উম্মতের কান্ডারি-শাফায়াতকারী হয়ে সংগে থাকবেন। যেখানে দুনিয়ার সকল সঙ্গী-শুভাকাংখী থাকবে না, জাগতিক সকল বন্ধুত্ব-বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাবে সেই কবরে-হাশরের কঠিন সংকটময় সন্ধিক্ষণে মুমিন নর-নারীর একান্ত কল্যাণকামী- শাফায়াতকারী হিসেবে রাহমাতুল্লিল আলামিন নবী একমাত্র আল্লাহর দরবার হতে নাজাত নিশ্চিত করবেন। তিনি মুমিনের প্রাণের চেয়েও নিকটতম ঈমানের সঙ্গী। এই সুক্ষ্ম মর্মের প্রতি ইঙ্গিত করার জন্যই আয়াতে ‘তোমার সঙ্গী’ অভিহিত করা হয়েছে।

তাছাড়া আল্লাহর নবী আহমদ মুস্তফা মুহাম্মদ মুজতাবা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বহির্জগত থেকে আগত কোন আপরিচিত কেউ নন। যার সত্যবাদিতায় তোমরা মক্কাবাসীরা সন্দিগ্ধ হবে। বরং তিনি তোমাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে অবস্থানকারী। আরবদেশের পবিত্র মক্কা নগরীতে তিনি আবির্ভূত হয়েছেন। এখানেই তিনি শৈশব অতিবাহিত করে যৌবনে পদার্পন করেছেন। তাঁর জাগতিক জীবনের কোন দিক তোমাদের কাছে গোপন নয়। মক্কাবাসীরা পরীক্ষা করে দেখেছযে, তিনি কখনো মিথ্যা বলেন না। তোমরা তাঁকে শৈশবে ও কোন মন্দকাজে লিপ্ত দেখনি। তাঁর সুমহান চরিত্র, অভ্যাস, সততা ও বিশ^স্থতার প্রতি তোমাদের এতটুকু আস্থা ছিল, সমগ্র মক্কাবাসী তাঁকে ‘আল-আমিন’ বলে সম্ভোধন করত। এখন নুবূওয়াত দাবী করায় তেমারা তাঁকে মিথ্যাবাদী বলতে শুরু করেছো। সর্বনাশের কথা এই যে, যিনি মানুষের ব্যাপারে কখনো মিথ্যা বলেন নি, তিনি সর্বশক্তিমান ও সর্বস্রষ্টা মহান আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা বলেছেন বলে তোমরা তাঁকে অভিযুক্ত করছো। তাই আল্লাহ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন- وما ينطق عن الهوي ان هو الا وحي يوحى অর্থাৎ রাসূলে আকরাম নুরে মজাস্সাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজের পক্ষ থেকে কথা তৈরী করে আল্লাহর দিকে সম্বন্ধযুক্ত করেন না। এর কোন সম্ভাবনাই নাই। বরং তিনি যা কিছু বলেন তা সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রত্যাদেশ হয়। সহীহ বুখারি শরীফের বিভিন্ন হাদীসে ওহীর অনেক প্রকার বর্ণিত আছে। তন্মধ্যে এক প্রকার হলো-যার অর্থ ও ভাষা উভয়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ন হয় এর নাম হলো ওহীয়ে মাতলু অর্থাৎ আল-ক্বোরআন। আর দ্বিতীয় প্রকার হলো যার কেবল অর্থ আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয় আর আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) এই অর্থ নিজের ভাষায় ব্যক্ত করেন এর নাম ওহীয়ে গাইরে মাতলু তথা হাদীস ও সুন্নাহ। অতএব, ক্বোরআনে করীমের আলোকে প্রমাণিত হলো- আল্লাহর রাসূলের পবিত্র যবান নিঃসৃত প্রতিটি বাণী আল্লাহর ওহী। হয়তো ক্বোরআনের অন্তর্ভূক্ত অথবা হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অর্ন্তভূক্ত। মহান আল্লাহ প্রতিটি মুমিন নর-নারীকে উপরোক্ত দরসে ক্বোরআনের উপর আমল করত: উভয় জাহানে সফলকাম হওয়ার সৌভাগ্য নসীব করুন। আমিন।

লেখক: অধ্যক্ষ, কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল মাদরাসা, মুহাম্মদপুর, এফ ব্লক, ঢাকা।