ইসলামে দুআর ফযীলত ও বরকত

ইসলামে দুআর ফযীলত ও বরকত

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি>

عَنْ عُبَادَةَ بْنُ الصَّامِتْ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا عَلَى الْاَرْضِ مُسْلِمٌ يَدْعُوْا اللهَ بِدَعْوَةٍ اِلاَّ اَتَاهُ اللهُ اِيَّاهَا اَوْ صَرَفَ عَنْهُ مِنَ السُّوْءِ مِثْلِهَا مَالَمْ يَدْعُ بِاثْمٍ اَوْ قَطَيَعة رِحْمٍ فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ الْقَوْمِ اِذَا نُكْثِرُ قَالَ اللهُ اَكْثَرُ [رواه الترمذى]
وَعَنْ مُعَاذْ بِنُْ جَبَلٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الدُّعَاءُ يَنْفَعُ مِمَّا نَزَلَ اَوْ مِمَّا يَنْزِلْ فَعَلَيْكُمْ بِالدُّعَاءِ عِبَادَ اللهِ [رواه مسند احمد]

অনুবাদ: হযরত উবাদাহ্ ইবনে সামিত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ভূ-পৃষ্ঠে কোনো মুসলিম যখন দুআ করেন আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর দুআ কবুল করেন, তাকে তা দান করেন। অথবা তার থেকে অনুরূপ অনিষ্ঠতা দূর করেন। যতক্ষণ পর্যন্ত সে কোনো অন্যায় কাজের জন্য দুআ না করে অথবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন না করে। এক ব্যক্তি বলল, তাহলে আমরা অধিক পরিমাণ দুআ করব। রাসূলুল্লাহ্ এরশাদ করেন, আল্লাহ্ তাআলাও অধিক বেশি দিবেন। [তিরমিযী শরীফ, হাদীস নম্বর-৩৫৭৩]
হযরত মুআয ইবনে জাবাল রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন আগত অনাগত সমূহ বিপদাপদ থেকে (পরিত্রাণের জন্য) দুআ হচ্ছে উপকারী। হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা অবশ্যই দুআ করো। [মুসনাদে আহমদ, হাদীস নম্বর-২২০৪৪]

প্রাসঙ্গিক আলোচনা
বর্ণিত হাদীস শরীফদ্বয়ে দুআর ফযীলত, বরকত ও উপকারিতা বর্ণিত হয়েছে। মহান আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের জন্য দুআ হচ্ছে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। দুআ ইবাদতের নির্যাস। দুঃখ, বেদনা, বিপদে সংকটে, অভাবে-অনটনে, সুস্থতা-অসুস্থতা, শান্তি-অশান্তি, স্বচ্ছলতা-অসচ্ছলতা, সফলতা-ব্যর্থতা, সর্বাবস্থায় দুআ হচ্ছে মু’মিনের হাতিয়ার।
দুআ শব্দের অর্থ: দুআ শব্দটি আরবি, এর অর্থ ডাকা আবেদন করা, প্রার্থনা করা, যে কোনো অবস্থাতেই আল্লাহকে ডাকা, আল্লাহর নিকট চাওয়া, দুআ করা ইবাদতের শামিল। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন, ‘‘তোমরা আমার নিকট প্রার্থনা করো, আমি তোমাদের ডাকে (আহ্বানে) সাড়া দিবো। নিশ্চয় ওইসব লোক যারা আমার ইবাদত থেকে অহংকারে বিমুখ হয় তারা অবিলম্বে জাহান্নামে যাবে লাঞ্চিত হয়ে। [সূরা আল মু’মিন, পারা-২৪, আয়াত-৬০]
এতে দুআ করার নির্দেশ ও দুআ কবুল হওয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। আল্লাহর রহমত বান্দার সন্নিকটে রয়েছে, বান্দার দুআ বিফল হয় না।

দুআর মাধ্যমে রহমত লাভের পথ সুগম হয়
দুআর মাধ্যমে অন্তরের হতাশা দূর হয়, অন্তর আলোকিত হয়। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে,
عن عبد الله بن عمر رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم مَنْ فُتِحَ لَه مِنْكُمْ بَابُ الدُّعَاءِ فُتِحَتْ لَهُ اَبْوَابَ الرَّحْمَةِ وَمَا سُئِلَ اللهُ شَيْئًا اَحَبَّ اِلِيْهِ مِنْ اَنْ يُسْأَلَ الْعَافِيَةُ [رواه الترمذى]
অর্থ:হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমাদের মধ্যে যার জন্য দুআর দরজা উন্মুক্ত করা হবে তার জন্য রহমতের সকল দরজা উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। আর আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম প্রার্থনা হলো শারীরিক সুস্থতা কামনা করা। [তিরমিযী শরীফ, হাদীস নম্বর-৩৫৪৮]

দুআ কবুল হওয়ার কতিপয় শর্ত
আল্লাহর দরবারে দুআ কবুল হওয়ার জন্য বিশেষ কয়েকটি শর্ত রয়েছে।
১. বিনীতভাবে একনিষ্ঠ অন্তরে দুআ করতে হবে।
২. আল্লাহর কাছেই দুআ করতে হবে, অন্যদিকে অন্তর মনোনিবেশ করা যাবে না।
৩. হারাম ও অবৈধ কিছু লাভের জন্য দুআ করা নিষেধ।
৪. আল্লাহর রহমত লাভের দৃঢ় প্রত্যয়ী হতে হবে।
৫. এ অভিযোগ করা যাবে না দুআ করতে আছি কিন্তু কবুল হচ্ছে না।

বিলম্বে দুআ কবুল হওয়াতে হিকমত রয়েছে
বর্ণিত শর্তাবলী মেনে দুআ করলে বিফল হয়না, অনেক সময় বান্দার কল্যাণার্থে প্রার্থীত দুআ বিলম্বে কবুল করা হয়। অথবা ঐ দুআর বরকতে বান্দার এমন জটিল কঠিন বিপদাপদ মুসীবত দূরীভূত হয়ে যায় যা বান্দা কল্পনাও করেনি। অনেক সময় বান্দার দুআর প্রতিদান দুনিয়াতে না দিয়ে আমলনামায় লিপিবদ্ধ করা হয় তার সব প্রতিদান তাকে পরকালে দেয়া হবে। যা পেয়ে বান্দা সীমাহীন খুশী হয়ে যাবে।
আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বর্ণনা করেন যে, হযরত ইয়াহিয়া ইবনে সাঈদ রদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু আল্লাহ্ তা‘আলাকে স্বপ্ন দেখেন, আরজ করলেন! ইয়া আল্লাহ! আমি বেশী বেশী দুআ করি তুমি আমার দুআ কবুল করছোনা! আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করলেন, তোমার দুআর শব্দগুলো আমার নিকট অধিক প্রিয় এ কারণেই তোমার দুআ কবুলে আমি বিলম্ব করি। [আনোয়ারুল বায়ান, খন্ড-৩য়, পৃ. ৪৭৭]

সতর্কতা অপরিহার্য
আমরা আল্লাহর সমীপে দুআ করি, ইবাদত বন্দেগি করি, আবেদন নিবেদন ও ক্রন্দন করি, যদি ধারণা করি সবই নিস্ফল, অর্থহীন, সময়ের অপচয়। কখনো এমন ধারনা করা যাবে না। আমাদের কাজ হলো আল্লাহর দরবারে দুআ করতে থাকা, আল্লাহ্ তা‘আলা বান্দার দুআ অবশ্যই কবুল করবেন।
আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন, ‘‘এবং হে মাহবুব যখন আপনাকে আমার বান্দাগণ আমার স্বম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে তবে আমি তো নিকটই আছি। প্রার্থনা গ্রহণ করি আহ্বানকারীর, যখন আমাকে আহ্বান করে। সুতরাং তাদের উচিৎ যেন আমার নির্দেশ মান্য করে এবং আমার উপর ঈমান আনে যাতে পথের দিশা পায়। [সূরা বাক্বারা, পারা-২, আয়াত নম্বর-১৮৬]

দুআ কবুলের সময়
১. উত্তম সময়ে দুআ করার গুরুত্ব অনুধাবন করা। যেমন ৯ যিলহজ্ব আরাফার দিবসে।
২. রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজানুল মুবারকে।
৩. পবিত্র জুমাআর দিবসে
৪. ফরজ নামাযের পর দুআ কবুল হয়। [এয়াহিয়াউল উলুম, খন্ড-১, পৃ. ১৬৫]
৫. আজান ও ইকামতের মাঝখানে দুআ ফেরত হয়না। [মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল, খন্ড-২, পৃ. ৫০৫]

শ্রেষ্ঠ দুআ আলহামদুলিল্লাহ্!
হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে এরশাদ করতে শুনেছি, যিকর হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্, আর শ্রেষ্ঠ দুআ হলো ‘আলহামদুলিল্লাহ্’ [তিরমিযী শরীফ, হাদীস নম্বর-৩৩৮৩]

রাতের শেষ তৃতীয়াংশে আল্লাহ্ তা‘আলা দুআ কবুল করেন
হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
عن ابى هريرة رضى الله عنه انّ رَسُوْلَ اللهِ صَلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ يُنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالى كُلِّ لَيْلَةٍ اِلى السَّمَاءِ الدُّنْيَاءِ حِيْنَ يَبْقِىْ ثُلَثُ اللَّيْلِ الْاخِرِ يَقُوْلُ مَنْ يَدْعُوْنِىْ فَاسْتَجِيْبُ لَه مَنْ يَسْأَلُنِىْ فَاعْطِيَهُ مَنْ يَسْتَغْرُنِىْ فَاغْفِرَلَه [رواه البخارى]
অর্থ: হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমাদের প্রভু আল্লাহ্ তা‘আলা প্রত্যেক রাতের শেষ তৃতীয়াংশে দুনিয়ার আকাশে (তাঁর শান অনুযায়ী) অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন, কে আছো? আমাকে ডাকো, আমি তার ডাকে সাড়া দিবো। কে আছো? আমার কাছে প্রার্থনা করো, আমি তাকে দান করবো। কে আছো? আমার নিকট গুনাহ্ থেকে ক্ষমা চাও, আমি তাকে ক্ষমা করবো। [বুখারী শরীফ, হাদীস নম্বর-১১৪৫]
হযরত সালমান ফারসী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- اِنَّ رَبّكُمْ حَيٌّ كَرِيْمٌ يَستحى مِنْ عَبْدِه اِذَا رَفَعَ يَدَيْهِ اِلَيْهِ اَنْ يردهُمَا صِفْرًا
অর্থ: নিশ্চয় তোমাদে রব অত্যন্ত লজ্জাশীল ও দয়াময়, বান্দা যখন দুআর জন্য হাত উত্তোলন করে, তখন তিনি খালি হাত ফেরত দিতে লজ্জাবোধ করেন। [তিরমিযী শরীফ, হাদীস নম্বর-৩৫৫৬]

তিন শ্রেণির দুআ নিঃসন্দেহে কবুল হয়
হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তিন ব্যক্তির দুআ নিঃসন্দেহে কবুল হয়। ১. মাতা পিতার দুআ, ২. মুসাফিরের দুআ এবং ৩. মজলুমের দুআ। [ইবনে মাযাহ্ শরীফ, হাদীস নম্বর-৩৮৬২]

দরুদ শরীফের ওসীলায় দুআ কবুল হয়
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- ان الدعاء موقوف بين السماء والارض لايصعد منها شئ حتى تصلى على نبيك নিশ্চয় দুআ আসমান ও যমীনের মাঝখানে ঝুলন্ত থাকে দুআ উর্দ্ধালোকে পৌঁছে না যতক্ষণ না তুমি তোমার নবীর উপর দরুদ শরীফ পড়বে। [মিশকাত শরীফ, পৃ. ৮৭]

এছাড়া নি¤œবর্ণিত বরকতময় স্থানে দুআ কবুল হয়
১. বায়তুল্লাহ্ শরীফে দৃষ্টি পড়ার পর দুআ কবুল হয়। ২. মদীনা মুনওয়ারায় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর রওজা শরীফ যিয়ারতে দুআ কবুল হয়। ৩. আরাফাতের ময়দানে, ৪. মিনা ও জামারাতের নিকটে, ৫. মক্কা মুকাররমায় নবীজির পবিত্র জন্মস্থান মওলুদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের নিকটে। ৬. জান্নাতুল মুয়াল্লা মক্কা শরীফের প্রসিদ্ধ কবরস্থানে, ৭. মদীনা মুনাওয়ারার প্রসিদ্ধ কবরস্থান জান্নাতুল বাকীতে যিয়ারতের সময়, ৮. হেরা পর্বতে, এ পর্বতে সর্বপ্রথম ওহী নাযিল হয়, ৯. গারে সওর, নবীজির হিজরতের সময় এ নুরানী পাহাড়ে তিনদিন তিনরাত অবস্থান করেছিলেন, সাথে ছিলেন আমিরুল মু’মিনীন হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, ১০. মুলতাযিম ‘কাবা ঘর ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে, ১১. হাতিমে কা’বার ভিতরে, ১২. সাফা মারওয়া পাহাড়দ্বরে উপর, ১২. যমযম কুপের পানি পান করার সময় এবং মসজিদে তানঈম তথা হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার নামে প্রতিষ্ঠিত মসজিদে, যা মসজিদুল হারাম থেকে ৫. কি.মি. দূরত্বে অবস্থিত। হে আল্লাহ্ আমাদেরকে তোমারই সমীপে দুআ করার তাওফিক দান কর। আমীন।

লেখক: অধ্যক্ষ, মাদ্রাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া ফাযিল (ডিগ্রি), বন্দর, চট্টগ্রাম।