কুরবানি : মানব ইতিহাসে বিস্ময়কর ঈমানী পরীক্ষা

কুরবানি : মানব ইতিহাসে বিস্ময়কর ঈমানী পরীক্ষা

মুহাম্মদ আনোয়ার শাহাদাত >

ঈদুল আযহা মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তম উৎসব। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রতি অকুণ্ঠ ভালবাসা প্রমানের দিন। পরাক্রমশালী মহান রবের তরে সব কিছুকে উজাড় করে দেয়ার সার্বক্ষনিক প্রস্তুতি ঘোষনার দিন। এই ঈদ আমাদের জন্য নিয়ে আসে আত্নত্যাগের এক অনন্য ও চিরঞ্জীব দৃষ্টান্ত। মনুষ্য খেয়াল বা প্রবৃত্তির চাওয়া পাওয়ার উপর আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়া ও শর্তহীন আনুগত্য করার মহান শিক্ষা নিয়ে আসে এই ঈদ। প্রকৃত আনন্দের জন্য ভোগের চাইতে ত্যাগই যে বেশী প্রয়োজন এবং ফলপ্রসূ তা শিক্ষা নেয়ার দিন হলো পবিত্র এই দিনটি। মুমিন মুসলমান সার্বক্ষনিক যে আল্লাহর রাহে দেহ-প্রাণ সঁপে দেয়ার জন্য প্রস্তুত এবং শহিদি শূরা পান করার জন্যে হৃদয় তাদের তৃষিত তা প্রমানের শিক্ষনীয় ঘটনা হলো এই মহান ঈদুল আযহা। হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম এর পুত্র হাবিল আর কাবিলের কুরবানির মধ্য দিয়ে মূলত ইসলামে কুরবানির ধারা সূচিত হয় কিন্তু পরবর্তীতে হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম এর ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে কুরবানি শ্বাশত রূপ লাভ করে। হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম মহান রাব্বুল আলামীনের নির্দেশকে অকুণ্ঠ চিত্তে যেভাবে পালন করেছেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে একক ও অদ্বিতীয় হয়ে থাকবে। মুসলিম জাতির পিতার এই ত্যাগে আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়ে, মুসলিম মিল্লাতের জন্য ঐ দৃষ্টান্তকে চিরঞ্জীব করে রাখার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম কুরবানি বা ঈদুল আযহা উপহার দেন যাতে করে কিয়ামত পর্যন্ত উম্মতে মুহাম্মদী স্বীয় প্রভুর নির্দেশ পালনে হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম ও হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম এর জীবন থেকে ত্যাগ ও ধৈর্য্যরে কঠোর ও কঠিন শপথ নিয়ে নিজেদেরকে আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্ত বান্দাদের কাতারে শামিল করতে পারে।

হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম ও ইসমাঈল আলাইহিস সালাম এবং হযরত ইমাম হুসাঈন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে দিয়ে সমগ্র মানব জাতিকে শিক্ষা দিয়েছেন কীভাবে দ্বীনের পথে আল্লাহর তরে আত্নত্যাগ করতে হয় এবং প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য, অন্তরের-বাইরের শয়তানের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়। হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন একের পর এক কঠিনতর পরীক্ষার সম্মুখীন করেছিলেন যাতে করে মুসলিম জাতির পিতা হিসেবে কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর সন্তানরা এসব পরীক্ষা থেকে দীক্ষা নিয়ে আল্লাহর রজ্জুকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরবে। নিজ মাতৃভূমি ইরাক ত্যাগ করে চিরদিনের জন্য ফিলিস্তিনের কেনান শহরে হিজরত, নমরুদ কতৃক জ্বলন্ত অগ্নিকু-ে নিক্ষিপ্ত, তারপরে আল্লাহর নির্দেশে বিবি হাজেরা আলাইহিস সালাম ও একমাত্র পুত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালাম কে জনমানবহীন বিরাণ ভূমিতে বনবাস। এতসব ঈমানি কঠিন পরীক্ষার পর মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম কে উপনীত করলেন মানব ইতিহাসের এক বিস্ময়কর ও অভূতপূর্ব পরীক্ষার মুখোমুখি। নিজ পুত্র ইসমাঈলকে পিতা হয়ে আপন হাতে আল্লাহর রাহে কুরবানি করা! আর এই পরীক্ষায় ও মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম আল্লাহর প্রতি তার অবিচল আস্থা আর ভালোবাসার প্রমান দেন যা মহান রবের দরবারে কবুল হয়ে হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামের পরিবর্তে পশু কুরবানির ব্যবস্থা করে দেন। ঈমানের কঠিন থেকে কঠিনতর পরীক্ষায় যারা যত বেশি সফল তারা তত বেশি আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে মুক্তির প্রত্যাশা করতে পারেন। ঈদের প্রকৃত আনন্দ সুধা তাদের জন্য যারা কেবলই আল্লাহর রাহে বিনা শর্তে সার্বক্ষনিক সর্বস্ব ত্যাগে প্রস্তুত। ঈমানী পরীক্ষায় যারা যত বেশি সফল তারা তত বেশি জান্নাতি রঙে রঙ্গিন হতে পারবে। ঈদুল আযহা আমাদেরকে শুধু ত্যাগের মহিমা শিক্ষা দেয় না, নিজের জীবনের সর্বোত্তম এবং সবচাইতে প্রিয় বস্তুগুলো আল্লাহর পথে কুরবানির শিক্ষা দেয়। কুরবান(আরবী) শব্দটির মাঝেই বিধৃত আছে ঈদুল আযহার মাহাত্ন্য। কুরবান শব্দের অর্থ ত্যাগ বা বিসর্জন দেয়া। অন্য ভাবে বলতে গেলে কুরবান হলো নৈকট্য লাভের উপায় বা পথ। আল্লাহর রাহে নিজের সর্বস্ব বিসর্জন না দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি বা নৈকট্য অর্জন করা যায় না। কুরবানির পশুর সাথে সাথে আমরা যদি নিজের পশুত্বকে কুরবানি দিতে না পারি তাহলে ঈদের প্রকৃত শিক্ষা আমারা কাজে লাগাতে পারবো না। প্রতিটি কালে সময়ের চাহিদা অনুযায়ী মুসলিম জাতি তার আদর্শ সামনে রেখে জাতির অস্তিত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার প্রয়োজনে কুরবানি দিয়ে আসছে এবং পৃথিবীর প্রলয়কাল পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। কুরবানির পশু জবাই আসলে প্রতীকী ব্যাপার। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন- পশুর গোশত, চামড়া, রক্ত কিছুই তার নিকট পৌঁছে না, পৌঁছে শুধু তাকওয়া ও পরহেজগারি।

অকুণ্ঠ ঈমান আর ত্যাগের মহিমায় চির ভাস্বর পবিত্র এই কুরবানি বা ঈদুল আযহা। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতে হয়-’তোরা ভোগের পাত্র ফেলরে ছুঁড়ে, ত্যাগের তরে হৃদয় বাঁধ।’ সত্যিই আজকে ত্যাগের শিক্ষায় নিজেদের অন্তরাত্নাকে প্রস্তুত করতে পারলে কুরবানির পশু জবাই সার্থক হবে, বিকাশ ঘটবে প্রকৃত মনুষ্যত্বের এবং সুন্দর সমাজ গঠনে সহায়ক হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সৌদি আরব প্রবাসী।

Share:

Leave Your Comment