সেরা উপাদেয় ও সর্বোত্তম যমযমের পানি
মুফতি মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান আল-কাদেরী>
মহান আল্লাহর বহু কুদরতি নিদর্শন রয়েছে পবিত্র মক্কায়। যা আল্লাহ্ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করেছেন। মসজিদে হারাম, বায়তুল্লাহ শরীফ, হাযরে আসওয়াদ, মাকামে ইবরাহিম, সাফা-মারওয়া, আরাফা-মুযদালিফা, মিযাবে রহমত এন্তার খোদায়ী নিদর্শন। এর মাঝে অনন্য বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ও অনবদ্য হচ্ছে যমযমের পবিত্র পানি। বহুবিধ ফায়দা ও জান্নাতী ঝরনার এ পানির গুণাগুণ ও উপকারিতার আলোকপাত করব সম্মানিত পাঠক মহলের জন্য সংক্ষেপে।
ভূখন্ডে সর্বোত্তম পানি
নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-কূপ, সাগর-মহাসাগরে নানা রকম ও বৈচিত্রময় পানি বিদ্যমান এ পৃথিবীর বুকে পানির অপর নাম জীবন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় বাস্তবতার আলোকে। টিউবওয়েল ও প্রবাহিত ঝরনার পানি নজর কাড়ে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের নানা প্রান্তরে। নামী-দামী ব্র্যান্ডের মিনারেল ওয়াটারের অভাব নেই সব জায়গায়। আর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার মতো উন্নত দেশের তো কথাই নেই। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে সর্বোৎকৃষ্ট পানি হলো যমযমের পানি। যেমন, দয়াল নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- ধরণীতে শ্রেষ্ঠতর পানি যমযমের পানি। তাতে রয়েছে ক্ষুধা নিবারণে খাদ্য ও অসুস্থতার জন্য নিরাময়। (১)
হৃদয় মোবারক ধৌত করা হয়
যে পানি দিয়ে নূর নবীজির পবিত্র আত্মা ধৌত করা হয়েছে, নিশ্চয়ই সেটা সর্বোৎকৃষ্ট ও পবিত্রতম পানি। শ্রেষ্ঠ নবীর জন্য শ্রেষ্ঠ পানিই সাযুজ্য। আর এটাই যমযমের পানি। প্রিয় নবীজির পবিত্র জীবনে বক্ষ মোবারক বিদীর্ণ করা হয় মোট চার বার। পবিত্র হাদীসের বর্ণনানুসারে প্রতিবারই গোসল করা হয়েছে যমযমের পানি দ্বারা। (২) কাজেই আল্লাহ তা‘আলার প্রিয় হাবিব যেমন শ্রেষ্ঠ, তাঁর পবিত্র আত্মা শ্রেষ্ঠ, তেমনি শ্রেষ্ঠ যমযমের পানি।
থুথু মোবারকের ফলে বরকত বেড়ে যায়
যমযমের পানি পবিত্র ও বরকতময় নিঃসন্দেহে। এটাই বিশ্বের সকল মুসলিম মিল্লাতের আক্বিদা-বিশ্বাস। তবে এ পানি অধিক বরকতময় হবার নেপথ্যে এর সাথে নূর নবীজির পবিত্র থুথু মোবারক লাগার কারণে। যেমনি হাদিসে বর্ণিত আছে যে- বালতি দিয়ে যমযমের পানি উত্তোলন করে প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর খেদমতে পেশ করা হলে তিনি কুলি করে পবিত্র মুখ থেকে ফেলে দিলেন তাতে। ফলে তা আরও হয়ে যায় অমিয় ও রুচিকর পানি। (৩) আদতে সব কিছু ধন্য প্রিয় নবীজির বদৌলতে, আরো ধন্য যমযমের পানি। যা উদ্ধৃত হাদিস থেকে সহজে অনুমেয় স্পষ্টভাবে।
এতে রয়েছে অভাবনীয় পুষ্টি
মহান রবের অশেষ দয়া ও কৃপায় যমযমের পানিতে রয়েছে খাবার ও পুষ্টি, যা খুবই বিস্ময়কর। ইমাম কুরতুবী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বর্ণনা করেন আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতা প্রেরণ করে যমযমের পানিতে রসদ দান করেন। (৪) বর্ণিত আছে হযরত আবু যর গেফারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু পবিত্র মক্কায় এসে হেরেম শরীফে দীর্ঘদিন খাবার ছাড়া অবস্থান করছিলেন। এমনকি বর্ণনায় এসেছে দীর্ঘ এক মাস কেবল যমযমের পানি পান করে জীবন যাপন করেছেন। হাদিসটি ইমাম মুসলিম রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তদ্বীয় গ্রন্থে ফাযায়িলে সাহাবায় বিস্তারিত বর্ণনা করেন। (৫) ইমাম ইবনুল কাইয়ুম রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ব্যক্ত করেন- আমি এমন লোককে দেখেছি যারা কোন ধরনের খাবার গ্রহণ ও পানি পান না করে চল্লিশদিন পর্যন্ত দিনাতিপাত করেছেন। যাদের নির্ভরতা ছিল কেবল যমযমের পানির উপর। (৬) এ ধরনের বহু ঘটনা নির্ভরযোগ্য কিতাবে দেখা যায়। আসলে তা যমযমের পানির বরকত ও প্রভাব। যা আল্লাহ তা‘আলার কুদরতি শক্তির বহিঃপ্রকাশ।
প্রত্যেক রোগের ঔষধ
যমযমের পানির উল্লেখযোগ্য বিশেষত্ব হচ্ছে- এ পানি সকল রোগের ঔষধ ও অসুস্থতার পূর্ণ সুস্থতা। এ প্রসঙ্গে ইতিপূর্বে তাবরানী ও সহীহ ইবনে হিব্বানের বরাতে দয়াল নবীজির হাদিস উদ্ধৃত করেছি। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে হাযর আসকালানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি হাদিসের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেন- সকল রোগের চিকিৎসা রয়েছে যমযমের পানিতে। (৭) অন্য বর্ণনায় এসেছে প্রিয় নবীজি যমযমের পানি বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতেন এবং অসুস্থ ব্যক্তির শরীরে ঢেলে দিতেন। ফলে রুগ্ন ব্যক্তি আরোগ্য লাভ করতেন। (৮) তবে সবকিছুর জন্য প্রয়োজন বিশুদ্ধ চিত্তে তা পান করা। এ জন্য দেখা যায় ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, ইমাম যয়নুদ্দীন ইরাকী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, তকীউদ্দীন ফাসী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, আরিফ বিল্লাহ ইমাম আব্দুল ওহহাব শা’রানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ইমাম কাযবেনী সহ অনেক ইসলামী মনিষী বহু জটিল-কঠিন রোগ-বালাই থেকে মুক্তি পেয়েছেন যমযমের পানি পান করার ফলে।
দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি পায়
বহুবিধ উপকারের মাঝে অনন্য হচ্ছে যমযমের পানির দিকে তাকালে চোখের দৃষ্টিশক্তি বেড়ে যায়। যা অনন্য এক নিয়ামত। প্রখ্যাত তাবী হযরত দাহহাক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ব্যাক্ত করেন- যমযমের পানির ক্যারিশমায় দ্বিমুখিতা-কপটতা থেকে মুক্তি মিলে। মাথা ব্যাথা দূর হয় এবং এর বদৌলতে চোখের দৃষ্টি উজ্জ্বল্য ও মসৃণতা লাভ করে। (৯)
মনের বাসনা সফল হয়
মনের বাসনা পূর্ণতায় সম্মানিত সাহাবাগণ সহ বিশ্বের ইসলামিক স্কলারগণ যমযমের পানি পান করেছেন হৃদয় ভরে। যেমন বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবীদের প্রত্যক্ষ সাহচর্য লাভকারী সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম মাসয়ালা সমূহের মর্মোদঘাটনকারী বিশ্ব নন্দিত মহাপন্ডিত ইমাম আযম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি যমযমের পানি পানকালে দোয়া করেছিলেন- আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে যেন সর্বাধিক জ্ঞান দান করেন, মহান রবের দরবারে তা গৃহীত হয়েছে। (১০) যার বাস্তবতা আজও দুনিয়ার বুকে উন্মোচিত। এমনি করে ইমাম খতিব বাগদাদী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, ইমাম ইবনুল আরবী মালেকী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, ইমাম ইবনুল হুমাম হানাফী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, ইমাম জালাল উদ্দীন সুয়ূতী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি সহ কত জ্ঞানী-মহাজ্ঞানী রয়েছেন যাদের জ্ঞানের পরিধির ব্যাপকতায় রয়েছে যমযমের পানির ছাপ।
এ দিকে তাকানো ইবাদাত
মহান রব কত দয়ালু ও মেহেরবান যে কিছু কিছু জিনিস দর্শন করলেও ইবাদাতের সাওয়াব দান করেন। বর্ণিত আছে যে, প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- পাঁচটা বিষয় ইবাদাতের অন্তর্ভুক্ত। (ক) পবিত্র কুরআনের দিকে তাকানো, (খ) ক্বাবা শরীফের দিকে দৃষ্টিপাত করা, (গ) মাতা-পিতার দিকে নজর দেওয়া, (ঘ) যমযমের দিকে দৃষ্টি দেওয়া, যার ফলে গুনাহ ক্ষমা হয় এবং (ঙ) আলেমের (সত্যিকার) দিকে তাকানো।১১
বস্তুত, যমযমের পানির বরকত-উপকারিতা ও বিশেষত্বের শেষ নেই। এটা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর জন্য এক বিশেষ রহমত ও বরকত মহান রবের তরফ থেকে। এটা এমন রুচিকর পানি তৃপ্তির সৌকর্যে ধারে কাছে নেই পৃথিবীর কোন পানি। এটা বহন করে নিয়ে যাওয়া এবং হাদিয়া হিসেবে অন্যজনকে দেওয়া ও উত্তম আমল। আমরা আজ তা দেখতে পায় খোলা চোখে। এ সময় বিশ্বের নানা প্রান্তর থেকে লাখ লাখ মুসলিম ভাই-বোনের আগমন করতেছেন পবিত্র মক্কা ও মদিনা শরীফে। তারা লুফিয়ে নেয় এ পবিত্র পানি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকেও এ পবিত্রতম জায়গায় উপস্থিতির মাধ্যমে এ উপাদেয় যমযমের পানি বারং বার পান করার সুযোগ যেন দান করেন, এ প্রত্যাশা মহান রবের পাক দরবারে।
তথ্য সূত্র: [১. তাবরানী, সহীহ ইবনে হিব্বান কৃত- ইমাম ইবনে হিব্বান (রহ.), ২. ফাতহুলবারীকৃত- ইমাম আসকালানী (রহ.), ৩. মুসনাদে আহমদ কৃত- ইমাম আহমদ বিন হাম্বল(রহ.), ৪. তাফসীরে কুরতুবী কৃত- ইমামকুরতুবী (রহ.), ৫. সহীহ মুসলিম কৃত- ইমাম মুসলিম (রহ.), ৬. যাদুমুয়াদ কৃত- আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম (রহ.), ৭. ফাতহুল বারী কৃত- ইমাম আসকালানী (রহ.), ৮. তুহফাতুল মুহতাজ কৃত- ইমাম ইবনে হাযর হায়তামী (রহ.), ৯. আখবারু মক্কাতা কৃত- ইমাম আযরুকীফাকেহী (রহ.), ১০. কুররাতুল আইন কৃত- শায়খ গাসসান রুমী (রহ.), ১১. আলজামেয়ুছ ছাগীর কৃত- ইমাম সুয়ূতী (রহ.)]
লেখক: প্রধান ফকীহ, কাদেরিয়া তৈয়্যেবিয়া কামিল মাদ্রাসা, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।