তুমি কোন্ মু’জিযা চাও, তুমি যা চাইবে ওই মু’জিযা আমি দেখাতে পারবো

তুমি কোন্ মু’জিযা চাও, তুমি যা চাইবে ওই মু’জিযা আমি দেখাতে পারবো

হুযূর-ই আকরামের পবিত্র বক্ষ বিদারণ ও চন্দ্র বিদারণের মধ্যে সম্পর্ক এবং এ দু’টি মু’জিযার বিবরণ

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান

আমাদের আক্বা ও মাওলা হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বক্ষ মুবারক বিদারণ ও আকাশের চন্দ্র দ্বি-খন্ডিত হওয়া হুযূর-ই আকরামের বড় বড় দু’টি মু’জিযাই। আমি এ নিবন্ধে প্রথমে আকাশের চাঁদের সাথে হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নূরানী ক্বলবের সাথে সম্পর্কের বিষয়টি আলোচনা করার প্রয়াস পাবো। তারপর এ দু’-এর মধ্যকার সম্পর্কের আলোচনা করবো। তারপর মু’জিযা দু’টির বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করবো।
আল্লামা বূ-সীরী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির নিম্নলিখিত পংক্তিতে এ দু’টি মু’জিযার মধ্যে যে সম্পর্ক রয়েছে তা আলোকপাত করা হয়েছে। তিনি লিখেছেন-
اَقْسَمْتُ بِالْقَمَرِ الْمُنْشَقِّ اِنَّ لَه
مِنْ قَلْبه نِسْبَةً مَبْرُوْرَةَ الْقَسَم
অর্থ: আমি দ্বিখণ্ডিত চন্দ্রের শপথ করে বলছি- সেটার নূর অর্জনের ক্ষেত্রে হুযূর-ই আকরামের ক্বলব মুবারকের সাথে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। আমার এ ক্বসম অখণ্ডনীয় ও সত্য।
[ক্বসীদাহ্ বোর্দাহ শরীফ]
আর এ দু’-এর মধ্যকার সম্পর্কও কয়েকভাবে রয়েছে। যেমন- এক. রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বক্ষ মুবারক বিদীর্ণ হয়েছিলো যেভাবে চন্দ্র দ্বিখ-িত হয়েছিলো।
দুই. হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বক্ষ মুবারক বিদীর্ণ হওয়ার পর তা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে পূর্বের ন্যায় মিলিত হয়ে গিয়েছিলো। অনুরূপ চন্দ্রও দ্বিখ-িত হবার পর সেটার খ- দু’টি পুনরায় মিলিত হয়ে চাঁদ পূর্বের অবয়বে এসে গিয়েছিলো।
তিন. চাঁদে নূরানিয়াৎ (আলো) রয়েছে, আর হুযূর-ই আক্রামের ক্বলব মুবারক তো নূররাশির প্রস্রবণই।
চার. যেভাবে চাঁদ সূর্য থেকে নূর আহরণ করে অন্ধকার রাতে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটায়, তেমনি হুযূর সরওয়ার-ই আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আপন ফয়য ও নূরের উৎসস্থল থেকে নূর নিয়ে অন্ধকার হৃদয়গুলোকে আলোকিত করেন। আর ওইগুলো সারা বিশ্বকে আলোকিত করে।
পাঁচ. আল্লাহ্ তা‘আলার নৈকট্যের মানযিলগুলোতে ভ্রমণ ও সেগুলো অতিক্রম করার ক্ষেত্রে হুযূর-ই আক্রামের সবিশেষ মর্যাদা ও শান রয়েছে, তেমনি চাঁদও সেটার মানযিলগুলো অতিক্রম অতি দ্রুতগতিতে করে থাকে।

হুযূর-ই আকরামের বক্ষ শরীফ বিদারণের ঘটনা
হুযূর-ই আকরামের পবিত্র বক্ষ বিদারণের ঘটনা কয়েকবার ঘটেছিলোঃ
প্রথমত, ওই সময় হয়েছিলো, যখন হযরত হালীমা সা’দিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা হুযূর-ই আক্রামকে তাঁর ইচ্ছানুসারে তাঁর দুধ ভাইয়ের সাথে মেষ-ছাগলগুলো চরানোর জন্য পাঠিয়েছিলেন। হঠাৎ তাঁর দুধ ভাই ভীত-সন্ত্রস্থ অবস্থায় হযরত হালীমার নিকট দৌঁড়ে এসে বললো, ‘‘দু’জন সাদা পোশাকধারী লোক এসে আমার ভাইকে মাটিতে শুইয়ে তাঁর পেট মুবারক চিরে ফেলেছে।’’ এ খবর শুনে হযরত হালীমা অতিমাত্রায় চিন্তিত ও ভারাক্রান্ত হয়ে তাঁর স্বামীর নিকট দৌঁড়ে গেলেন এবং তাকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছলেন। আর বললেন, ‘‘আমি দেখলাম হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম একাকী অবস্থানরত আছেন, তবে পবিত্র চেহারায় কিছুটা ভয়ের নিদর্শন পরিলক্ষিত হচ্ছে। হুযূর-ই আকরামকে তাঁর দুধ-পিতা জড়িয়ে ধরলেন। আর বললেন, ‘‘প্রিয় বৎস! তুমি কেমন আছো?’’ তিনি বললেন, ‘‘আমার নিকট দু’জন সাদা পোশাকধারী আসলেন আর তাঁরা আমাকে মাটিতে শুইয়ে আমার বক্ষ বিদীর্ণ করেছেন এবং তা থেকে কিছু অংশ বের করে ফেলে দিয়েছেন।’’
দ্বিতীয়ত, হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু দ্বিতীয়বারের বক্ষ বিদারণের ঘটনা এভাবে বর্ণনা করেছেন- একদা হুযূর-ই আকরাম কয়েকজন খেলারত ছেলের পাশে ছিলেন। ইত্যবসরে হযরত জিব্রাঈল আমীন আসলেন। তিনি হুযূর-ই আকরামকে শুইয়ে তাঁর বক্ষ মুবারক বিদীর্ণ করলেন। আর ক্বলব মুবারক থেকে কয়েক ফোঁটা কালো রঙের রক্ত বের করে ফেলে দিলেন। আর বললেন, এটা শয়তানের প্রভাব ফেলার অংশ। আর ক্বলব মুবারককে একটি সোনার পাত্রে রেখে ঝমঝমের পানি দ্বারা ধুয়ে নিলেন। তারপর তা বক্ষ মুবারকে স্থাপন করে সেলাই করে দিয়েছেন।’’
হযরত আনাস বলেছেন, ‘‘আমি এখনো হুযূর-ই আকরামের বক্ষ মুবারকে সেলাইর চিহ্ণ দেখতে পাচ্ছি।’’ এ বক্ষ বিদারণ এ জন্য করা হয়েছে যেন হুযূর-ই আকরাম শিশুকাল থেকেই মা’সূম (নিষ্পাপ) ও শয়তানী ওয়াস্ওয়াসাহ্ (প্ররোচনা) কিংবা প্রভাব থেকে মুক্ত ও পবিত্র থাকেন।
তৃতীয়ত, তৃতীয়বারের বক্ষ বিদারণ হুযূর-ই আকরামের নুবূয়ত ঘোষণার নিকটবর্তী সময়ে সম্পন্ন হয়েছিলো। যেমন আবূ নু‘আয়ম ‘দালাইল’-এ উল্লেখ করেছেন। এ বক্ষ বিদারণে অতিরিক্ত বুযুর্গী ও নূররাশিই কাক্সিক্ষত ছিলো।
চতুর্থত, চতুর্থবার বক্ষ বিদারণ শবে মি’রাজে হয়েছিলো, যা সহীহাঈন (বোখারী ও মুসলিম)-এ উদ্ধৃত হয়েছে। তা এ জন্য ছিলো যেন ক্বলব মুবারকে আসমানী ও ফেরেশতা জগতের ভ্রমণ ও তাজাল্লিয়াতের দর্শন অনায়সে অর্জিত হয়ে যায়।

এখন দেখুন শক্বক্বে ক্বামার বা চন্দ্র বিদারণের মু’জিযাটি কেমন?
এ মু’জিযা মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে সকল মুফাস্সির একমত। (এ’তে তাঁদের ইজমা’ হয়েছে।) তাও এ আয়াত শরীফের তাফসীরে- اِقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَانْشَقَّ الْقَمَرُ তরজমা: নিকটে এসে গেছে ক্বিয়ামত এবং দ্বিখ-িত হয়েছে চন্দ্র। [সূরা ক্বামার: আয়াত-১, কান্যুল ঈমান] এ আয়াত শরীফে চন্দ্র বিদারণের মু’জিযাটির সত্যায়ন রয়েছে।

সহীহাঈন (সহীহ্ বোখারী ও সহীহ্ মুসলিম)-এ হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাস‘ঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে এ ঘটনা বা মু’জিযার বর্ণনা সংক্ষিপ্তভাবে পাওয়া যায়।
‘তাফসীর-ই খাযাইনুল ইরফান’-এ এ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে- এটা (চন্দ্র বিদারণ) নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সুস্পষ্ট মু’জিযাগুলোর অন্যতম। মক্কাবাসীগণ হুযূর বিশ্বকুল সরদার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট একটা মু’জিযা দেখানোর দরখাস্ত করেছিলো। তখন হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম চন্দ্রকে দ্বিখণ্ডিত করে দেখিয়েছিলেন। চন্দ্রের দু’টি খণ্ড হয়ে গিয়েছিলো। আর এরশাদ করেছিলেন, ‘‘তোমরা সাক্ষী থাকো।’’ ক্বোরাঈশগণ বললো, ‘‘মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) যাদু দ্বারা আমাদের ‘নজরবন্দ’ করে ফেলেছেন।’’ এর জবাবে তাদেরই দলের লোকেরা বললো, ‘‘যদি এটা ‘নজরবন্দ’-ই হয়, তবে বাইরে কেউ কোথাও চন্দ্রকে দ্বিখণ্ডিত অবস্থায় দেখতে পাবে না। এখন যে বণিকদল বাইরে থেকে আগমন করছে তাদের সন্ধান নিয়ে রাখো এবং মুসাফিরগণকেও জিজ্ঞাসা করো। যদি অন্যান্য স্থানে থেকেও চন্দ্রকে দ্বিখণ্ডিত অবস্থায় দেখার সংবাদ আসে, তা হলে এটা নিঃসন্দেহে মু’জিযাই।’’
সুতরাং তারা সফর থেকে আগমনকারী লোকদেরকে জিজ্ঞাসা করলো। তারা বর্ণনা করলো, ‘‘আমরা দেখতে পেলাম ওই দিবাগত রাতে চন্দ্র দ্বিখ-িত হয়ে গেছে।’’ অতঃপর মুশরিকদের তা অস্বীকার করার কোন অবকাশ থাকেনি। তবুও হতভাগারা হঠকারিতা করে সেটাকে যাদু বলতে থাকলো বৈ-কি।
সিহাহ্র বহু হাদীসে এ মহান মু’জিযার বর্ণনা এসেছে। আর এ (খবর তথা হাদীস) এমন পর্যায়ে প্রসিদ্ধ হয়ে গেছে যে, তা অস্বীকার করা বিবেক ও ন্যায় বিচারের প্রতি শত্রুতা করা ও বে-দ্বীনীরই শামিল হয়। [তাফসীর-ই খাযাইনুল ইরফান এ আয়াত]

এখানে আরো উল্লেখযোগ্য যে, মুলহিদ (নাস্তিক বিশেষ)-এর এক দল এ মু’জিযাকে অস্বীকার করে আর বলে বেড়ায়, ‘এ মু’জিযা বাস্তবে ঘটলে তা সারা দুনিয়ায় এক সাথে পরিলক্ষিত হয়েছে মর্মে ইতিহাসের সকল বই-পুস্তকে উল্লেখ করা হতো।’ আমি চাঁদের একটি বাস্তবাবস্থা ও এক ঐতিহাসিক ঘটনার আলোকে এ আপত্তির খ-ন করার প্রয়াস পাচ্ছিঃ
চাঁদের বাস্তবাবস্থা হচ্ছে- চাঁদ একবারে এক সাথে সমগ্র ভূ-খণ্ডকে আলোকিত করেনা; বরং সেটা প্রদক্ষিণকালে ভূ-পৃষ্ঠের যে অংশের মুখোমুখী হয় সে অংশটাকেই আলোকিত করে। এ কারণে চন্দ্র গ্রহণের অবস্থাও সাধারণ ও ব্যাপকভাবে সবাই জানতে পারেনা; বরং চন্দ্রগ্রহণের সময় সেটা ভূ-খ-ের যেসব অংশের মুখোমুখী থাকে, শুধু ওই ভূ-খন্ডের লোকেরাই সে সম্পর্কে জানতে পারে। চন্দ্রগ্রহণের অবসান ঘটার পর চাঁদ যেখানে যায় সেখানকার লোকেরা ওই চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কে অবগত থাকে না। এ কারণে, চন্দ্র বিদারণের পক্ষে ওইসব মুসাফির সত্যায়ন মূলক সাক্ষ্য দিয়েছিলো, যারা ঘটনাস্থলের পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে এসেছিলো।
এ প্রসঙ্গে একটি ঐতিহাসিক ঘটনাও প্রনিধানযোগ্য। তা হচ্ছে- যখন চন্দ্র বিদারণের খবর মালিবার (বা মালাবার)-এর শাসক সামেরীর নিকট আরব বণিকদের মাধ্যমে পৌঁছলো তখন তিনি বললেন, ‘‘যদি আমার দৈনন্দিন খবরের তালিকায় (নোটবুকে) এ খবরও লিপিবদ্ধ থাকে, তা হলে আমি মুসলমান হয়ে যাবো।’’ দৈনন্দিন খবরের তালিকার দপ্তরটি হাযির করা হলো। তিনি দেখলেন, সত্যি তাতে লিপিবদ্ধ ছিলো- অমুক তারিখে মালাবার বা মালিবারের নির্ভরযোগ্য লোকেরা চাঁদকে দ্বিখ-িত অবস্থায় দেখেছে, তখন তিনি এর সত্যতা পেয়ে মুসলমান হয়ে গিয়েছিলেন। [ত্বীবুল ওয়ার্দাহ্ শরহে ক্বসীদাহ্ বোর্দাহ্]

আল্লামা খরপূতীর বর্ণনা
শাফে‘ঈ মাযহাবের প্রসিদ্ধ মুফতী আল্লামা খরপূতী আলায়হির রাহমাহর বর্ণনার আলোকে চন্দ্র বিদারণের ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপঃ
একদিকে, চির ধিক্কৃত আবূ জাহল তার সঙ্গীগণসহ যখন হুযূর-ই আকরামের দিক থেকে অপারগ, অক্ষম ও ব্যর্থ হয়ে গেলো, তাদের যাবতীয় চক্রান্ত নস্যাৎ হয়ে গেলো, অন্যদিকে হুযূর-ই আকরাম দিন দিন উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁর দ্বীন ও শরীয়তের সূর্য-দ্রুত সমুজ্জ্বল হতে লাগলো, প্রতিদিন লোকেরা দলে দলে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নেয়ার ফলে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগলো, তখন হতাশ ও নিরূপায় হয়ে সে হাবীব ইবনে মালেক, সিরিয়া/ইয়ামনের আমীর (শাসক)কে একটি চিঠি লিখলো। চিঠিটার বক্তব্য নিম্নরূপঃ
اَمَّا بَعْدُ ! لِيَعْلَمِ الْمَلِكُ اَنَّه قَدْ ظَهَرَ بَيْنَنَا رَجُلٌ سَاحِرٌ كَذَّابٌ يَدَّعِىْ رَبًّا وَاحِدًا وَدِيْنًا جَدِيْدًا وَاَنَّه يَسُبُّ الِهَتَنَا وَكُلَّمَا قَابَلْنَاهُ بِالْحُجَّةِ غَلَبَ عَلَيْنَا فَلْيَوْمَ ضَعُفَ دِيْنُكَ وَدِيْنُ ابَآئِكَ فَالْحَقْ بِه قَبْلَ اَنْ يَّنْتَشِرَ دِيْنُه
অর্থ: ‘‘সালাম- দো‘আর পর। বাদশাহর সদয় অবগতির জন্য জানানো হচ্ছে যে, আমাদের মধ্যে এক মহান ব্যক্তির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, যাঁকে আমরা (আমাদের হীন ধারণানুসারে) যাদুকর ও মিথ্যাবাদী বলে জানি। তিনি আমাদেরকে বলেন যেন আমরা এক রবের উপাসনা করি এবং তিনি এক নতুন ধর্ম আমাদেরকে শিক্ষা দিচ্ছেন। আমাদের উপাস্যগুলোকে তিনি গালমন্দ করেন। আর আমরা যতটুকু দলীল-প্রমাণ সহকারে তাঁর মোকাবেলা করি, তিনি ততটুকুই আমাদের উপর বিজয়ী হয়ে আসছেন। ফলে এখন আপনার ধর্ম এবং আপনার বাপদাদার ধর্ম দুর্বল হতে চলেছে। সুতরাং খুব শীঘ্র এসে তাঁর সাথে মোকাবেলা করুন। অন্যথায় যদি তাঁর শিক্ষা আম হয়ে যায় (ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে), তবে আর কিছু করতে পারবেন না।’’

এ চিঠি পড়ে হাবীব ইবনে মালিক বারজন আরোহী সাথে নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন এবং মক্কা উপত্যকায় এসে নামলেন। আবূ জাহল মক্কার নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানালো। হাদিয়া ও কুশলাদি বিনিময়ের পর হাবীব আবূ জাহলকে নিজের ডানপাশে বসালো এবং হুযূর-ই আক্রামের অবস্থাদি জিজ্ঞাসা করলেন। আবূ জাহল বললো- اَيُّهَا السَّيِّدُ سَلْ بَنِىْ هَاشِمْ (ওহে সরদার! বনী হাশেম থেকে তাঁর অবস্থা জেনে নিন)! সুতরাং তারা সবাই বললো-نَعْرِفُه بِالصِّدْقِ فِىْ صِغَرِهِ وَلَمَّا بَلَغَ اَرْبَعِيْنَ سَنَةً جَعَلَ يَسُبُّ الِهَتَنَا وَيُظْهِرُ دِيْنًا غَيْرَ دِيْنِ ابَآئِنَا ـ অর্থ: আমরা তাঁকে শৈশব থেকে অত্যন্ত সত্যবাদী বলে জানি বা চিনি; কিন্তু যখন তাঁর বয়স চল্লিশ বছর হলো, তখন থেকে তিনি আমাদের উপাস্যগুলোকে মন্দ বলতে আরম্ভ করলেন। আর এক নতুন ধর্ম, যা আমাদের বাপ দাদাদের ধর্মের বিপরীত, প্রচার করতে লাগলেন।

তারপর হাবীব তাঁর রক্ষীকে হুযূর-ই আকরামের পবিত্র দরবারে গিয়ে তাঁকে এখানে তাশরীফ আনার দরখাস্ত পেশ করতে নির্দেশ দিলেন। রক্ষী তাই করলো। হুযূর-ই আকরাম সেখানে তাশরীফ নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হলে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব লালচে বর্ণের পোশাক ও কালো পাগড়ি শরীফ পেশ করলেন। হুযূর-ই আন্ওয়ার ওইগুলো পরিধান করে তাশরীফ নিয়ে গেলেন। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব তাঁর ডান পাশে এবং হযরত খদীজাতুল কুবরা তাঁর পেছনে ছিলেন। হাবীব ইবনে মালিক হুযূর-ই আকরামকে সদয় তাশরীফ আনতে দেখে তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে গেলেন। যখন হুযূর-ই আকরাম আসন গ্রহণ করলেন, তখন হাবীব দেখলেন হুযূর-ই আকরামের চেহারা মুবারক থেকে নূররাশি চমকাচ্ছে। আর তাঁর হৃদয়পটে হুযূর-ই আকরামের ভক্তিপ্রযুক্ত ভয় এমনভাবে ছেয়ে গেলো যে, তিনি চুপচাপ হুযূর-ই আকরামের সামনে অতি আদব সহকারে হাযির হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর হাবীব আরয করলেন- يَا مُحَمَّدُ ا َنْتَ تَعْلَمُ اَنَّ لِلْاَنْبِيَآءِ مُعْجِزَاتٍ اَلَكَ مُعْجِزَاتٌ؟ অর্থ: হুযূর! আপনি জানেন যে, সমস্ত নবী বিশেষ বিশেষ মু’জিযা নিয়ে এসেছিলেন, আপনার নিকটও কি কোন মু’জিযা আছে?) فَقَالَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ مَا ذَا تُرِيْدُ؟ (অতঃপর হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম বললেন, ‘‘তুমি কোন্ মু’জিযা চাও, তুমি যা চাইবে ওই মু’জিযা আমি দেখাতে পারবো”)।
হাবীব তাঁর এমন কঠিন প্রশ্নের হুযূর-ই আকরামের এমন দ্বিধাহীন জবাব শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন আর খুব চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তিনি এমন মু’জিযা চাইবেন যা অন্য কোন নবী থেকে এ পর্যন্ত প্রকাশ পায়নি। সুতরাং আরয করলেন-اُرِيْدُ اَنْ تُغِيْبَ الشَّمْسَ وَتُخْرِجَ الْقَمَرَ وَتُنْزِلَه اِلَى الْاَرْضِ وَتَجْعَلَه مُنْشَقًّا نِصْفِيْنِ ثُمَّ يَعُوْدَ اِلَى السَّمَآءِ قَمَرًا مُّنِيْرًا অর্থ: আমি চাই এখন সূর্য ডুবে যাক এবং পূর্ণিমা চাঁদ উদিত হোক। তারপর সেটাকে আপনি ভূ-পৃষ্ঠে নামিয়ে আনবেন এবং সেটাকে দ্বিখ-িত করবেন। তারপর তা আসমানে উঠে যাবে এবং আলো বিচ্ছুরণকারী চাঁদ হয়ে যাবে। তারপর নিয়ম মাফিক সূর্যও উদিত হবে।

হুযূর-ই আকরাম সদয় মনযোগ দিয়ে তাঁর কথা (দাবীগুলো) শ্রবণ করলেন। আর এরশাদ করলেন-اِنْ فَعَلْتُه اَتُؤْمِنُ بِىْ (অর্থ: আমি যদি তা করে দেখাই, তবে তুমি আমার উপর ঈমান আনবে তো?) হাবীব যখন হুযূর-ই আকরামকে এমন এমন কঠিন দাবীগুলো পূরণে অনায়াসে দৃঢ় প্রত্যয়ী দেখতে পেলেন, তখন মনে মনে বললেন, আমি এ সুযোগে আমার ব্যক্তিগত দুই/একটি বিষয়ও আরয করে নিই! সুতরাং হাবীব আরয করলেন, ‘‘জ্বী, হুযূর, তবে আরেকটা শর্ত আছে, যা আমার অন্তরে আছে। সেটারও সুসংবাদ শুনিয়ে দিন!’’
মোটকথা, অতঃপর হুযূর-ই আকরাম ‘আবূ ক্বোবায়স’ পর্ব্বতের উপর তাশরীফ নিয়ে গেলেন। সেখানে দু’ রাক‘আত নামায পড়লেন এবং দো‘আ করলেন। ইত্যবসরে হযরত জিব্রাঈল আমীন হাযির হয়ে গেলেন আর হুযূর-ই আকরামকে সুসংবাদ দিলেন- اَنَّ اللهَ تَعَالى سَخَّرَ لَكَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ وَالَّيْلَ وَالنَّهَارَ وَاَنَّ لِحَبِيْبِ بْنِ مَالِكٍ بِنْتٌ سَطِيْحَةٌ يَعْنِىْ سَاقِطَةٌ عَلى فَقَاهَا وَلَيْسَ لَهَا يَدَانِ وَلاَ رِجْلاَنِ وَلاَ عَيْنَانِ فَاَخْبِرْهُ بِاَنَّ اللهَ تَعَالى قَدْ رَدَّ عَلَيْهَا جَوَارِحَهَا ـ অর্থ: হুযূর! আল্লাহ্ তা‘আলা আপনার জন্য সূর্য, চন্দ্র, রাত ও দিনকে বশীভূত করে দিয়েছেন। আর হাবীব ইবনে মালিকের একটি এমন কন্যা সন্তান আছে, যার না দু’টি হাত আছে, না আছে পা দু’টি, না আছে চক্ষুযুগল। আপনি তাকে সুসংবাদ দিন আল্লাহ্ তা‘আলা তার কন্যাকে হাত, পা ও সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করেছেন।

অতঃপর হুযূর-ই আকরাম পাহাড় থেকে নিচে নেমে আসলেন আর হযরত জিব্রাঈল আমীন বাতাসের উপর বসে হুযূর-ই আক্রামের নির্দেশের অপেক্ষারত ছিলেন। আর ফেরেশতারা লাইনে দাঁড়িয়ে এসব অলৌকিক ঘটনা অবলোকন করছিলেন। হুযূর-ই আকরাম আপন শাহাদত আঙ্গুলি মুবারক দ্বারা সূর্যকে ইশারা করতেই তা অদৃশ্য হয়ে গেলো। ফলে ঘন অন্ধকার ছাইয়ে গেলো। ইত্যবসরে চাঁদ উদিত হয়ে গেলো। তখন তা ছিলো পূর্ণিমার সমুজ্জ্বল চাঁদ। হুযূর-ই আক্রাম সেটার দিকে ইঙ্গিত করলেন। তৎক্ষণাৎ তা কাঁপতে কাঁপতে নিচে নেমে আসলো। হুযূর সেটাকে দ্বিখ-িত করলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর আকাশে সেটার খ- দু’টি মিলিত হয়ে পূর্ণাঙ্গ চাঁদে পরিণত হয়ে গেলো। তারপর সূর্য ও পূর্বের ন্যায় পূর্ণাঙ্গ ও আলোকিত হয়ে উদিত হতে লাগলো। এবার হাবীব বললেন, ‘‘অন্য শর্তটি এখনো বাকী রয়ে গেছে। সে সম্পর্কেও বলুন!’’ হুযূর এরশাদ করলেন-اِنَّ لَكَ اِبْنَةً سَطِيْحَةً وَاللهُ تَعَالى قَدْ رَدَّ جَوَارِحَهَا অর্থ: তোমার কন্যা, যে অবশ হয়ে পড়ে রয়েছিলো আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ফিরিয়ে দিয়েছেন। এটা শুনে হাবীব ইবনে মালিক সানন্দে দ-ায়মান হলেন আর বললেন- يَااَهْلَ مَكَّةَ لاَ كُفْرَ بَعْدَ الْاِيْمَانِ ـ اِعْلَمُوْا اَنِّىْ
اَشْهَدُ اَنْ لاَّ اِلهَ اِلاَّ اللهُ وَاَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُه وَرَسُوْلُه অর্থ: ‘‘হে মক্কাবাসীরা! শোনো, এখন কুফর ইসলামের পর আর থাকতে পারে না। শোনো, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ ব্যতীত কোন মা’বূদ নেই। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁর খাস বান্দা ও তাঁর রসূল।’’
এটা শুনে আবূ জাহ্ল তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো আর বললো, اَتُؤْمِنُ بِهذَا السَّاحِرِ؟ (তুমিও কি এ যাদুকরের তীক্ষèদৃষ্টির শিকার হয়ে গেলে?) হাবীব এ মূর্খের জবাব নিরবতা দ্বারা দিলেন। আর সেখান থেকে সানন্দে নিজ দেশে চলে গেলেন। 
যখন তিনি দেশে ফিরে নিজ বাসভবনে পৌঁছলেন, তখন তাঁর ওই কন্যাই তাঁর সামনে আসলো আর বলতে লাগলো- اَشْهَدُ اَنْ لاَّ اِلهَ اِلاَّ اللهُ وَاَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُه وَرَسُوْلُه (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই, হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর খাস বান্দা ও তাঁর রসূল) হাবীব বললেন- يَا اِبْنَتِىْ مِنْ اَيْنَ عَلِمْتِ هذِهِ الْكَلِمَاتِ
(হে আমার কন্যা! তুমি এ কলেমাগুলো কোত্থেকে জানলে)? সে বললো, ‘স্বপ্নে আমাকে কেউ বললেন, ‘‘তোমার পিতা ইসলাম গ্রহণ করেছেন। যদি তুমিও মুসলমান হয়ে যাও, তাহলে এক্ষুণি তোমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ফিরে পাবে।’’ আমি কালবিলম্ব না করে মুসলমান হয়ে গিয়েছি। আর ভোরে এমতাবস্থায় (সুস্থ ও সুঠাম) হিসেবে নিজেকে দেখতে পেয়েছি, যেমনটি আপনি আমাকে দেখতে পাচ্ছেন।’’ সুবহানাল্লাহিল ‘আযীম।

মহাপরিচালক-আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।

 

Share:

Leave Your Comment