সে ব্যক্তি চরম হতভাগ্য, যে কুরআন দ্বারা আলোকিত ও উপকৃত হয়না

সে ব্যক্তি চরম হতভাগ্য, যে কুরআন দ্বারা আলোকিত ও উপকৃত হয়না

অধ্যক্ষ হাফেয কাজী আবদুল আলীম রিজভী

بسم الله الرحمن الرحيم
وَلَقَدْ صَبَّحَهُمْ بُكْرَةً عَذَابٌ مُّسْتَقِرٌّ(38فَذُوْقُوْا عَذَابِیْ وَ نُذُرِ(39وَ لَقَدْ یَسَّرْنَا الْقُرْاٰنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُّدَّكِرٍ(40( وَلَقَدْ جَآءَ اٰلَ فِرْعَوْنَ النُّذُرُ(41كَذَّبُوْا بِاٰیٰتِنَا كُلِّهَا فَاَخَذْنٰهُمْ اَخْذَ عَزِیْزٍ مُّقْتَدِرٍ(42اَكُفَّارُكُمْ  یْرٌ مِّنْ اُولٰٓىٕكُمْ اَمْ لَكُمْ بَرَآءَةٌ فِی الزُّبُرِ(43اَمْ یَقُوْلُوْنَ نَحْنُ جَمِیْعٌ مُّنْتَصِرٌ(44سَیُهْزَمُ الْجَمْعُ وَ یُوَلُّوْنَ الدُّبُرَ(45بَلِ السَّاعَةُ مَوْعِدُهُمْ وَالسَّاعَةُ اَدْهٰى وَاَمَرُّ(46اِنَّ الْمُجْرِمِیْنَ فِیْ ضَلٰلٍ وَّ سُعُرٍ(47یَوْمَ یُسْحَبُوْنَ فِی النَّارِ عَلٰى وُجُوْهِهِمْؕ-ذُوْقُوْا مَسَّ سَقَرَ(48اِنَّا كُلَّ شَیْءٍ خَلَقْنٰهُ بِقَدَرٍ(49وَ مَاۤ اَمْرُنَاۤ اِلَّا وَاحِدَةٌ كَلَمْحٍۭ بِالْبَصَرِ(50وَ لَقَدْ اَهْلَكْنَاۤ اَشْیَاعَكُمْ فَهَلْ مِنْ مُّدَّكِرٍ(51وَ كُلُّ شَیْءٍ فَعَلُوْهُ فِی الزُّبُرِ(52وَ كُلُّ صَغِیْرٍ وَّ كَبِیْرٍ مُّسْتَطَرٌ(53اِنَّ الْمُتَّقِیْنَ فِیْ جَنّٰتٍ وَّ نَهَرٍ(54فِیْ مَقْعَدِ صِدْقٍ عِنْدَ مَلِیْكٍ مُّقْتَدِرٍ(55

তরজমা: এবং নিশ্চয় প্রত্যুষে তাদের উপর স্থায়ী শাস্তি আসলো। অতএব আস্বাদন করো আমার শাস্তি ও সতর্কবাণী। এবং নিশ্চয় আমি সহজ করেছি কুরআনকে স্মরণ রাখার জন্য, সুতরাং অন্তরস্থকারী কেউ আছে কি? এবং নিশ্চয় ফেরআউনীদের নিকট সতর্ককারীগণ অর্থাৎ রাসূলগণ এলো। তারা আমার সকল নিদর্শনকে মিথ্যারোপ করেছিল। সুতরাং আমি তাদেরকে পাকড়াও করেছি এক পরাভূতকারী-পরাক্রমশালীর ন্যায়। তোমাদের কাফিরগণ কি তাদের চেয়ে অধিক উত্তম? না কিতাবসমূহে তোমাদের মুক্তির সনদ রয়েছে? কিংবা (তারা কি) এ কথা বলে, আমরা সবাই মিলে বদলা নিয়ে নেবো। এ দল তো সত্বরই পরাজিত হবে। এবং তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে। বরং তাদের প্রতিশ্রুতি কেয়মতের উপরই এবং কেয়ামত অতি কঠিন ও অত্যন্ত তিক্ত। নিশ্চয় অপরাধীরা হচ্ছে পথভ্রষ্ট ও উন্মাদ। যেদিন আগুনের মধ্যে তাদের মুখমন্ডলগুলোর উপর উপুড় করে হেঁচড়িয়ে টেনে নেয়া হবে। আর বলা হবে-আস্বাদন করো দোযখের ছোঁয়া। নিশ্চয় আমি প্রত্যেক বস্তুকে একটা নির্ধারিত পরিমাপে সৃষ্টি করেছি। এবং আমার কাজতো এক মূহুর্তে চোখের পলকের মত। এবং নিশ্চয় আমি তোমাদের সমমনা দলগুলোকে ধ্বংস করেছি। সুতরাং কোন চিন্তাশীল আছে কি? এবং তারা যা কিছুই করেছে সবই আমলনামার মধ্যে রেকর্ডকৃত রয়েছে। এবং প্রত্যেক ছোট-বড় বস্তু লিপিবদ্ধ রয়েছে। নিশ্চয় খোদাভীরুগণ থাকবেন জান্নাত ও নির্ঝরনী সমূহে। সত্যের মজলিশে, সর্বাধিপতি ¯্রষ্টার সান্নিধ্যে। (সুরা আল-ক্বামার ৩৮-৫৫ নং আয়াত)

আনুষঙ্গিক আলোচনা
وَلَقَدْ صَبَّحَهُم بُكْرَةً عَذَابٌ مُّسْتَقِر
উদ্ধৃত আয়াতদ্বয়ের ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন-সাইয়্যেদুনা হযরত লুত আলাইহিসসালামের সম্প্রদায় একেতো কাফির ছিল অধিকন্তু তারা এমন এক জঘন্য অপকর্ম ও লজ্জাস্কর অনাচারে লিপ্ত ছিল যা পূর্ববর্তী কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে পাওয়া যায় নি। এজন্য মহান আল্লাহ হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালামসহ কতিপয় ফেরেশতাকে কওমে লুতের উপর আযাব নাযিল করার জন্য প্রেরণ করেন। আল্লাহ যখন কোন জাতিকে আযাব দ্বারা ধ্বংস করেন, তখন তাদের কার্যকলাপের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আযাবই নাযিল করে থাকে। এক্ষেত্রেও ফেরেশতাগণকে নওজোয়ানরূপে প্রেরণ করেন। হযরত লুত আলাইহিস্ সালাম ও তাঁদের মানুষ মনে করে তাদের নিরাপত্তার জন্য উদ্বিগ্ন হলেন। কারণ মেহমানের আতিথেয়তা নবীর নৈতিক দায়িত্ব। পক্ষান্তরে দেশবাসির কুস্বভাব তাঁর অজানা ছিলনা।
মহান আল্লাহ তা‘আলা এ দুনিয়াকে শিক্ষাক্ষেত্র বানিয়েছেন। যার মধ্যে তাঁর অসীম কুদরত ও অফুরন্ত হেকমতের ভুরি ভুরি নিদর্শন রয়েছে। হযরত লুত আলায়হিস্ সালাম-এর ন্যায় একজন মহান নবীর স্ত্রী নবীর বিরোদ্বাচরণ করে কাফিরদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করত। আল্লাহর প্রেরিত ফেরেশতাগণ সুদর্শন নওজোয়ান আকৃতিতে হযরত লুত আলায়হিস্ সালাম-এর গৃহে উপনীত হলেন, তখন তাঁর অভিশপ্ত স্ত্রী সমাজের দুষ্ট লোকদেরকে খবর দিল যে, আজ আমাদের গৃহে এরূপ মেহমান আগমন করেছেন। (তাফসিরে কুরতুবি) আর তখনি তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা আত্মহারা হয়ে তার গৃহপানে ছুটে এলো।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত আছে যে, দৃর্বৃত্তরা যখন হযরত লুত আলায়হিস্ সালাম-এর গৃহদ্বারে সমবেত হল, তখন তিনি গৃহদ্বার রুদ্ধ করে দিলেন। আর ফেরেশতারা গৃহে অবস্থান করছিলেন। আড়াল হতে দুষ্টদের কথাবার্তা চলছিল। তারা দেওয়াল টপকিয়ে ভিতরে প্রবেশ ও কপাট ভাংতে উদ্যোগী হলো। এমন সংগীন মূহুর্তে হযরত লুত আলায়হিস্ সালাম ভীষন পেরেশান হলেন। ফেরেশতারা তাঁকে অভয় দান করলেন এবং গৃহদ্বার খুলে দিতে বললেন। তিনি দুয়ার খুলে দিলেন। হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম ওদের প্রতি তাঁর পাখার ঝাপটা দিলেন। ফলে তারা অন্ধ হয়ে গেল এবং পলায়ন করতে লাগল।
তখন ফেরেশতারা আল্লাহর নির্দেশক্রমে হযরত লুত আলায়হিস্ সালামকে বললেন-আপনি কিছুটা রাত থাকতে আপনার অনুগত মুমিন লোকদেরকে নিয়ে এখান থেকে অন্যত্র সরে যান। এবং সবাইকে সতর্ক করে দিন যে, তাদের কেউ যেন পিছনে ফিরে না তাকায়, তবে আপনার স্ত্রী ব্যতীত। কারন অন্যদের উপর যে আযাব আপতিত হবে তাকেও সে আযাব ভোগ করতে হবে।
কোন কোন রেওয়ায়তে আছে যে, তাঁর স্ত্রীও সাথে যাচ্ছিল কিন্তু পাপিষ্টদের উপর আযাব নাযিল হওয়ার ঘটনাটা শুনে পশ্চাতে ফিরে তাকাল এবং কওমের শোচনীয় পরিণতি দেখে দুঃখ প্রকাশ করতে লাগল, তৎক্ষনাৎ একটি প্রস্তরের আঘাতে সেও ধ্বংসপ্রাপ্ত হল। [তাফসীরে কুরতুবি ও মাযহারী শরিফ]
বর্ণিত আছে যে, চারটি বড় বড় শহরে কওমে লুতের বসতি ছিল। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের নির্দেশ পাওয়া মাত্র হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম তার পাখা উক্ত শহরের চতুষ্টয়ের যমীনের তলদেশে প্রবিষ্ট করত এমনভাবে মহাশুণ্যে উত্তোলন করলেন যে, সবকিছু নিজ নিজ স্থানে স্থির ছিল। এমনকি পানি ভর্তি পাত্র হতে এক বিন্দু পানিও পড়ল না কিংবা নড়লনা। মহাশুন্য হতে কুকুর-জানোয়ার ও মানুষের আর্তচিৎকার ভেসে আসছিল। ঐসব জনপদকে সোজাভাবে আকাশের দিকে তুলে উল্টিয়ে যথাস্থানে নিক্ষেপ করা হল। তারা আল্লাহর আইন ও প্রাকৃতিক বিধান কে উল্টিয়েছিল, তাই এটা ছিল তাদের উপয্ক্তু শাস্তি। সুরাহ হুদ এর মধ্যে এরশাদ হয়েছে- ان موعدهم الصبح اليس الصبح بقريب অর্থাৎ তাদের ধ্বংসের নির্ধারিত সময়কাল হলো ভোরে। আর সেই ভোর কি নিকটবর্তী নয়। অর্থাৎ অবশ্যই নিকটবর্তী। অতএব আস্বাদন করো আমার শাস্তি ও সতর্কবাণী।

انا كل شئ خلقناه بقدر
শানে নুযুল : উদ্ধৃত আয়াতের শানে নুযুল বর্ণনায় তাফসীর বিশারদগণ উল্লেখ করেছেন-মুসনাদে ইমাম আহমদ সহীহ মুসলিম শরীফ ও ইমাম তিরমিযি রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি প্রমুখের রেওয়ায়তে সাইয়্যেদুনা হযরত আবু হুরাইরা রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বর্ণনা করেছেন-একদা কুরাইশ কাফের মুশরিকরা রাসূলে কারিম রউফুর রহিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের সাথে তাকদির প্রসঙ্গে বিতর্ক শুরু করল। তাদের এ বিতর্কের প্রতি উত্তরে মহান আল্লাহ এ আয়াত অবতির্ণ করেন।
এ অর্থের দিক দিয়ে আয়াতের উদ্দেশ্য হলো-আমি আল্লাহ বিশে^র প্রত্যেকটি বস্তু তাকদির অনুযায়ী সৃষ্টি করেছি। অর্থাৎ আদিকালে সৃজিত বস্তু, তার পরিমাণ, সময়কাল, হ্রাস-বৃদ্ধির পরিমাণ বিশ^ অস্তিত্ব লাভের পূর্বেই লিখে দেয়া হয়েছিল। এখন বিশে^র যা কিছু সৃষ্টি লাভ করে, তা এই আদিকালীন তাকদির অনুযায়ীই সৃষ্টি লাভ করে। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় ‘কদর’ শব্দটি খোদায়ী তাকদির তথা বিধি-লিপির অর্থেও ব্যবহৃত হয়। অধিকাংশ তাফসীর বিশারদ কোন কোন হাদীসের ভিত্তিতে আলোচ্য আয়াতে এই অর্থই নিয়েছেন।
আভিধানিক দিক দিয়ে কদর শব্দের অর্থ পরিমাপ করা। কোন বস্তু উপযোগিতা অনুসারে পরিমিতরূপে তৈরী করা। অতএব এ অর্থও উদ্দেশ্য হতে পারে। অর্থাৎ মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন বিশ^ জাহানের সকল শ্রেণির বস্তু বিজ্ঞসূলভ পরিমাপ সহকারে ছোট-বড় ও বিভিন্ন আকার-আকৃতিতে তৈরী করেছেন। অঙ্গলী সমূহ একইরূপে তৈরী করেননি। দৈর্ঘ্য-প্রস্থ সংযোজিত করেছেন। এক এক অঙ্গের প্রতি লক্ষ্য করলে আল্লাহর কুদরত ও হিকমতের বিস্ময়কর দ্বার উন্মোচিত হতে দেখা যাবে। উল্লেখ্য যে, তাকদীর ইসলামের একটি অকাট্ট ধর্মবিশ^াসের অন্তর্ভুক্ত বিষয়। যে একে সরাসরি অস্বিকার করে, সে কাফির। আর যারা অস্বীকার করে তারা ফাসিক। মুসনাদে ইমাম আহমদ, আবু দাউদ ও তাবরানী কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেছেন- রাসূলে আকরাম নুরে মুজাস্সাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন-প্রত্যেক উম্মতে কিছুলোক মজুসী (অর্থাৎ অগ্নিপূজারী কাফির) থাকে। আমার উম্মতের মজুসী তারা, যারা তাকদীর অস্বীকার করে, মানে না। এরা অসুস্থ হলে এদের খবর নিওনা, এবং মরে গেলে দাফন-কাফনে অংশগ্রহণ করোনা। (নাউজুবিল্লাহ) [তাফসীরে রুহুল মায়ানী]
মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন ذكر মানে হয়তো মুখস্থ করা। অথবা উপদেশ ও শিক্ষা গ্রহণ করা। উদ্ধৃত আয়াতে উভয় অর্থই প্রযোজ্য হতে পারে। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন কুরআনে করীম মুখস্থ করার জন্য সহজ করে দিয়েছেন। ইতিপূর্বে অন্য কোন ঐশীগ্রন্থ এর এরূপ শান ছিলনা। তাওরাত, ইঞ্জিল ও যবুর শরিফের কোন হাফেজও ছিলনা। আর কুরআনে করিমকে সহজ করে দেওয়ার বদৌলতে বিশে^র দেশে-দেশে লক্ষ লক্ষ হাফেজে কুরআন বিদ্যমান রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। যদ্বারা কুরআন সকল প্রকার লয় ও ক্ষয় ও বিকৃতি থেকে অক্ষত-অবিকৃত রয়েছে ও থাকবে। এভাবে মহান আল্লাহর হেফাজতের ঘোষণা- انا نحن نزلنا الذكر وانا له لحافظون কার্যকর থাকবে।

লেখক: অধ্যক্ষ, কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল মাদরাসা, মুহাম্মদপুর, এফ ব্লক, ঢাকা।

 

Share:

Leave Your Comment