কলেমা শরীফের ফযীলত ও বরকত

কলেমা শরীফের ফযীলত ও বরকত

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি

عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِت رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ مَنْ شَهِدَ اَنْ لاَ اِلَهَ اِلاَّ اللهُ وَاَنَّ مُحَمَّدًا رَّسُوْلَ اللهِ حَرَّمَ عَلَيْهِ النَّارِ [رواه مسلم]
وَعَنْ عُثْمَانَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ مَّاتَ وَهُوَ يَعْلَمُ اَنَّه لاَ اِلهَ اِلاَّ اللهُ دَخَلَ الْجَنَّةَ [رواه مسلم]

অনুবাদ: হযরত ওবাদাহ্ ইবনে সামিত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে এরশাদ করতে শুনেছি, যে ব্যক্তি এ মর্মে সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ্ ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই এবং নিশ্চয়ই হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। আল্লাহ্ তা‘আলা তার উপর জাহান্নাম হারাম করে দেবেন। [মুসলিম]
হযরত ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি এটা জেনে ও মেনে নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে আল্লাহ্ ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। [মুসলিম শরীফ]

প্রাসঙ্গিক আলোচনা
বর্ণিত হাদীস শরীফদ্বয়ের প্রথমটিতে কলেমা শরীফের দুই অংশ, দ্বিতীয় হাদীসে কলেমা শরীফের প্রথমাংশ উল্লেখ করা হয়েছে।
এই কলেমা কায়মনোবাক্যে পাঠকারী কলেমার দাবী বাস্তবায়নকারীকে জান্নাতী বলা হয়েছে। এই কলেমা শরীফ হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের সেতুবন্ধন। এ কলেমা শরীফের আধ্যাত্মিক শক্তি এতো বেশী কার্যকর যে, এ কলেমা পাঠ করা মাত্রই মানুষের জীবনে এক বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটে যায়। এ কলেমাকে মনে প্রাণে বিশ্বাস ও নিষ্ঠার সাথে পাঠ না করার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত যে লোকটি জাহান্নামী ছিল সে লোকটি এ কলেমা শরীফ পাঠ করার পর মুহূর্তেই জান্নাতী হয়ে গেল। তাঁর নৈতিক ও চারিত্রিক পবিত্রতায় এক অভাবনীয় পরিবর্তন এসে গেলো। এ কারণেই দোজাহানের সরদার শাফাআতের কান্ডারী মুক্তির দিশারী নবী মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- مَنْ قَالَ لاَ اِلَهَ اِلاَّ اللهُ دَخَلَ الْجَنَّةَ [رواه الترمذى] অর্থ: যে ব্যক্তি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ বলল সে জান্নাতী হয়ে গেলো। [সুনানে তিরমিযী শরীফ, হাদীস নং-২৫২২]

কলেমা শরীফে তাওহীদ ও রিসালতের স্বীকৃতি
তাওহীদ ও রিসালতের প্রতি স্বীকৃতি ও পরিপূর্ণ বিশ্বাসই ঈমানের পূর্ণতা দান করে। তাওহীদের প্রতি বিশ্বাস, রিসালতের প্রতি অবজ্ঞা, অসম্মান, অশ্রদ্ধা কুফরীর নামান্তর।
নবীজি এরশাদ করেছেন- اَشْهَدُ اَنْ لاَ اِلهَ اِلاَّ اللهُ وَاَنِّىْ رَسُوْلُ اللهِ لاَ يَلْقى اللهُ بهما عبد غير شاكٍ ـ فيجب عن الجنة الا دخل الجنة ماكان
অর্থ: আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ্ ছাড়া কোনো ইলাহ্ নেই। আর আমি আল্লাহর রাসূল। কোনো বান্দা যদি কোনো সন্দেহ সংশয় না রেখে এ দু’টি বাক্য নিয়ে আল্লাহর নিকট হাজির হয়। সে জান্নাতে যাবে। তার অবস্থা যাই হোক না কেন? [তাবরানি কাবীর: ১/২১১]

কলেমা শরীফ আল্লাহ্ কর্তৃক প্রেরিত
এই কলেমার প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য আল্লাহ্ কর্তৃক অবতীর্ণ, এ কলেমার গুরুত্ব মাহাত্ম্য ফযীলত ও মর্যাদা বর্ণনাতীত অতুলনীয়। এ কলেমা শরীফ দিবারাত্রি সকাল সন্ধ্যা, বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানদের কণ্ঠে উচ্চারিত, বিশ্ব মুসলমানদের অন্তরাত্মার গভীরে প্র্রোথিত। এ কলেমার সুশীতল ছায়াতলে পৃথিবীর অগণিত মানুষ মুক্তির মোহনায় সমবেত ও আশ্রিত। সুখ-শান্তি, সমৃদ্ধি ও কল্যাণের অফুরন্ত সওগাত এ কলেমার প্রতিটি অক্ষরে অক্ষরে ধ্বনিত ও অনুরণিত।
নবীজি এরশাদ করেছেন- اَلْحَمْدُ لِلّهِ اَللّهُمَّ بَعَثْتَنِىْ بِهذِهِ الْكَلِمَةِ وَاَمْرَتَنِىْ بِهَا وَوَعَدَتَّنِىْ عَلَيْهَا الْجَنَّةَ وَاِنَّكَ لَاتُخْلِفُ الْمِيْعَادِ
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই, হে আল্লাহ্! তুমি এ কলেমা দিয়ে আমাকে প্রেরণ করেছ। আমাকে এর আদেশ দিয়েছো, আমাকে এর ভিত্তিতে জান্নাতের ওয়াদা দিয়েছো, নিশ্চয়ই তুমি প্রতিশ্রুতির ব্যতীক্রম কর না। [তাবরানি কাবীর, ৭/৩৪৭ (৭১৬৩]

কলেমা শরীফের ভিত্তিতে জানমাল সুরক্ষিত থাকবে
এ কলেমা শরীফ বিশ্ব মুসলমানের ঈমান ইসলামের রক্ষাকবচ। মুসলমানরা নিজেদের জীবনের বিনিময়ে কলেমার মর্যাদা ও পবিত্রতা সমুন্নত রাখবে। কলেমার প্রতি অবমাননা তাওহীদ ও রিসালতের প্রতি চরম ধৃষ্টতা ও অবমাননার শামিল। দ্বীনের শত্রুরা ইসলামের দুশমনরা কলেমার আওয়াজ স্তব্ধ করার যতই অপচেষ্টা করুক তারা কখনো সফল হবেনা। কলেমার হিফাযতের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলা নিজেই গ্রহণ করেছেন। মুসলমান মাত্রই তাওহীদ-রিসালত, কুরআন, হাদীস, নবী রসূল, ইসলামী নিদর্শন, ঐতিহ্য স্থাপনার প্রতি অবমাননা অসম্মান অপমান কখনো সহ্য করতে পারে না।
ইসলাম বিরোধী সকল প্রকার চক্রান্ত ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে সদা প্রস্তুত থাকতে হবে। এটাই কলেমার দাবী।
হযরত ইয়াদ আনসারি রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন,
اِنَّ لاَ اِلهَ اِلاَّ اللهُ كَلِمَةٌ عَلى اللهِ كَرِيْمَةٌ لَهَا عِنْدَ اللهِ مَكَانٌ مَنْ قَالَهَا صَادِقًا ادخلهُ اللهُ الْجَنَّةَ [كنز العمال]
অর্থ: লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু এমন এক বাক্য যা আল্লাহর কাছে সম্মানিত, আল্লাহর কাছে এর একটি মর্যাদা আছে, যে সত্যনিষ্ঠ হয়ে এটি বলে আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে এর বিনিময়ে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। [কানযুল উম্মাল: ১/৬৩-৬৪(২২৭)]

কলেমা শরীফ মৃত্যু যন্ত্রণা লাঘব করে
হযরত জাবির ইবনু আবদিল্লাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের পর হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু খলিফা মনোনীত হওয়ার পর আমি উমর ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তালহা ইবনু উবাইদিল্লাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর উদ্দেশ্যে বলতে শুনেছি ব্যাপার কী? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তেকালের পর আপনার চেহারা মলিন দেখতে পাচ্ছি। সম্ভবতঃ হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর খলিফা মনোনীত হওয়ায় আপনার ভালো লাগেনি। হযরত তালহা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, আল্লাহর কাছে পানাহ্ চাই! আমার দুশ্চিন্তার কারণ হলো আমি আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছিলাম।
اِنِّىْ لَاَعْلَمُ كَلِمَةً لاَ يُقُوْلُهَا رَجُلٌ عِنْدَ حَضْرَةِ الْمَوْتِ اِلاَّ وَجَدُ رُوْحَه لَهَا رَوْحًا حِيْنَ تَخْرُجُ مِنْ جَسَدِه وَكَانَتْ لَه نُوْرًا يَوْمِ الْقِيَامَةِ [رواه احمد]
আমি এমন একটি বাক্য জানি কোনো ব্যক্তি যদি তা মৃত্যুর সময় বলে তাহলে সে দেখতে পাবে তার আত্মা দেহ থেকে বের হবার সময় ওই বাক্যের জন্য সতেজতা অনুভব করেছে। আর ক্বিয়ামতের দিন যেটি হবে তার জন্য আলো স্বরূপ। [আহমদ ১/৩৭/২৫২]

কলেমা শরীফের ওসীলায় খ্রিস্টানের জান্নাত নসীব হলো
প্রখ্যাত তাবেয়ী হযরত হাসান বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর দরবারে এক খ্রিস্টান যাতায়াত করত, তিনদিন পর্যন্ত খ্রিস্টান লোকটি আসেনি। হযরত হাসান বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন। তিনি মৃত্যু শয্যায় শায়িত। হযরত হাসান বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু কাশফের মাধ্যমে তার অবস্থা জানতে চাইলেন, খ্রিস্টান বললেন, আমার অবস্থা ভালো নয়। জাহান্নাম অপেক্ষা করছে, আমার নেক আমল বলতে কিছু নেই। পুলসিরাত কিভাবে অতিক্রম করবো চিন্তায় আছি। করুণাময় আল্লাহর মেহেরবাণী একমাত্র অবলম্বন, সামনে জান্নাত দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু জান্নাতে প্রবেশের চাবি আমার নেই। হযরত হাসান বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বললেন, হতাশ হয়োনা, আমি তোমার জন্য জান্নাতের চাবি নিয়ে আসছি। একথা বলা মাত্র খ্রিস্টান বললো আমি চাবি দেখতে পাচ্ছি। তাৎক্ষণিক পড়া শুরু করলেন আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ্ কলেমা পড়ে মৃত্যু মুখে ঢলে পড়েন। তাঁর মৃত্যুর পর হযরত হাসান বসরী তাঁর নিকট মৃত্যু পরবর্তী অবস্থা জানতে চাইলে তিনি উত্তর দিলেন, মৃত্যুকালে আমি কলেমা শরীফ পাঠ করেছি, কলেমা শরীফের বদৌলতে আল্লাহ্ তা‘আলা আমাকে জান্নাত নসীব করেছেন। কলেমা শরীফের কেমন বিস্ময়কর শান! মৃত্যুর সময় কলেমা নসীব হওয়ার কারণে আল্লাহ্ তাকে জান্নাতী বান্দা হিসেবে কবুল করে নিলেন।
[আনোয়ারুল বয়ান, খ–৩য়, পৃ. ১৬৭, নুজহাতুল মাজালিস]

নবীজি মিরাজ রজনীতে আরশ আজীমে
কলেমা শরীফ দেখলেন-
وَاَخْرَجَ اِبْنُ عَسَاكِرٍ عَنْ عَلِىٍّ قَالَ قَالَ رُسْوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيْلَةً اُسْرى بِىْ رَاَيْتُ عَلَى الْعَرْشِ مَكْتُوْبًا لَا اِلهَ اِلَّا اللهُ مُحَمَّدً رَّسُوْلُ اللهِ [الدر المنثور]
ইমাম ইবনে আসাকির রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হযরত মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমি মিরাজের রজনীতে আরশে লিখা অবলোকন করেছি। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্। [আদদুররুল মনসুর, ৫/পৃ. ২১৯]
আল্লামা ইমাম সামসুদ্দীন যাহাবী কলেমা শরীফকে ‘কলেমাতুল ঈমান’ নামে আখ্যায়িত করেছেন- وَكَذَالِكَ كَلِمَةُ الْاِيْمَانِ وَهِىَ قَوْلٌ مَكْتُوْبًا لَا اِلهَ اِلَّا اللهُ مُحَمَّدً رَّسُوْلُ اللهِ
অর্থ: ঈমানের কলেমা হলো, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্’ [সিয়ারু আলামিন নুবালা, ১৪/পৃ, ৩৯]
ইমাম কুরতবী প্রণীত তাফসীরে কুরতুবীতে কলেমা শরীফকে ‘কলেমাতুল ইসলাম’ একনিষ্ঠতার কলেমা বলে উল্লেখ করেছেন।
كلمة الاخلاص لا اله الا الله محمد رسول الله কলেমা শরীফ আমাদের ঈমানী চেতনার বাতিঘর, তাওহীদ ও রিসালতের আলোকবর্তিকা, কলেমা শরীফের ফয়েজ ও বরকতের ওসীলায় আমাদের ইহকাল পরকাল আলোকিত করুন। আমিন।
লেখক: অধ্যক্ষ- মাদ্রাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রি), বন্দর, চট্টগ্রাম।

 

Share:

Leave Your Comment