স্মরণ: আলহাজ্ব মুহাম্মদ সিরাজুল হক

স্মরণ: আলহাজ্ব মুহাম্মদ সিরাজুল হক

আবু নাছের মুহাম্মদ তৈয়ব আলী>

আলে রাসূল, কুতুবুল আউলিয়া বাণীয়ে জামেয়া হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর প্রতি এদেশের সুন্নী মুসলমান চিরঋণী হয়ে থাকবে। তিনি আপন মাতৃভূমি সুদূর পাকিস্তান হতে এসে এদেশে আকায়িদে আহলে সুন্নাতের আলোকে দ্বীনি শিক্ষা প্রসারে অভূতপূর্ব অবদান রাখেন। কওমী ধারার বিপরীতে সুন্নীয়া মাদ্রাসা স্থাপনের যে বীজ বপন করেছিলেন তা আজ মহিরূহে পরিণত হয়েছে। এ মহান ওলী তাঁর মুরিদগণকে তরিকতের দীক্ষা দিয়ে ক্ষান্ত হননি, তরিকতের পাশাপাশি ইলমে শরীয়ত তথা দ্বীনি খেদমতের ধারা কিয়ামত অবধি জারি রাখার লক্ষ্যে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার প্রতি সদা উদ্বুদ্ধ করে গেছেন। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন বাতিল মতবাদিরা বিভিন্ন ভাবে মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করছে আহলে হাদীস, লা-মাযহাবী, শিয়ামতবাদিরা যে জঘন্য বিভ্রান্তি, কুফরি আক্বিদা ছড়িয়ে দিচ্ছে এসবের প্রতিকারে সঠিক আক্বায়িদে আহলে সুন্নাতের আলোকে দ্বীনি প্রতিষ্ঠান করার প্রয়োজনীয়তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছে সবাই। আর এটা বহু আগেই হুজূর সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হির বেলায়তি দৃষ্টিতে অনুভূত হয়েছিল। তাই তিনি দ্বীনি শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে আনজুমানে শুরায়ে রহমানিয়া নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৯২৫ সালে। তার নূরানী হস্তে প্রতিষ্ঠিত এ সংস্থার মাধ্যমে এশিয়া বিখ্যাত জামেয়া আমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া সহ সারা দেশে পরিচালিত হচ্ছে দুই শতাধিক মাদরাসা ও এতিমখানা।

হযরত সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হির এদেশে আসা ও তাঁর লক্ষ্য বাস্তবায়নে যেসব মনীষী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন- তাদের মধ্যে দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ্ব ইঞ্জিয়ার আবদুল খালেক, আলহাজ্ব নূর মুহাম্মদ আলকাদেরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, আলহাজ্ব সুফী আবদুল গফুর রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, আলহাজ্ব আমিনুর রহমান আলকাদেরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, আলহাজ্ব ওয়াজির আলী সওদাগর রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, আলহাজ্ব নুরুল ইসলাম সওদাগর রাহমাতুল্লাহি আলায়হি সহ আরো অনেক সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ। এসব সম্মানিত ব্যক্তি বর্গের পরিবারের সদস্যরা বংশ পরম্পরায় এ তরিকত ও সিললিসার খিদমতে নিয়োজিত থেকে আন্তরিকতার সাথে সম্পৃক্ততা বজায় রেখে চলেছেন। এমন এক সৌভাগ্যবান কৃতিপুরুষ আলহাজ্ব মুহাম্মদ সিরাজুল হক রহমতুল্লাহি আলায়হি তিনি আলহাজ ওয়াজির আলী প্রকাশ ওজির আলী সওদাগরের আপন ছোট ভাই। যিনি হযরত সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র পবিত্র হস্তে বায়াত গ্রহণের মাধ্যমে এ দরবারের সাথে সম্পৃক্ত হন। আমৃত্যু এ দরবারের খিদমতে নিয়োজিত ছিলেন। ৫ শাওয়াল তাঁর ওফাত বার্ষিকীতে স্মরণের উদ্যেশে এ নিবেদন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার তালুয়া চানপুর। পিতার নাম মরহুম আশরফ আলী মিয়া, মাতা মরহুমা আবু জান বিবির ৫ম সন্তান। তাদের জ্যৈষ্ট ভাই আলহাজ্ব ওয়াজের আলী তাঁর ভাইদের চট্টগ্রামে নিয়ে আসেন। চট্টগ্রামে এসে আলহাজ্ব ওয়াজের আলী প্রথমে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি এবং পরবর্তীতে নিজে বিভিন্ন ব্যবসা বাণিজ্য করে প্রতিষ্ঠিত হন। চট্টগ্রামের বাকলিয়ায় স্থায়ী নিবাস প্রতিষ্ঠা করেন। আলহাজ ওয়াজের আলী ছিলেন হযরত সিরিকোটি হুজুরের অত্যন্ত নৈকট্যধন্য মুরিদ এবং গাউসে জমান আলে রাসূল আল্লামা হাফেজ কারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হির খলীফা। সে সুবাদে আলহাজ্ব সিরাজুল হকও নৈকট্য পেয়েছিলেন হুজুর সিরিকোটি শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হির। ১৯৪৯/৫০ সনে কোন এক শুভক্ষণে হুজুর কিবলার সান্নিধ্যে আসেন চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায়। তখন তাঁর বয়স ১৯/২০ বছর হবে। তখন হুজুর আন্দরকিল্লাস্থ আলহাজ্ব আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের বাসায় অবস্থান করতেন। সিরাজুল হক সাহেব সময় পেলেই সেখানে ছুটে যেতেন এবং ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের বাসায় তথা খানকায় হুজুরের ইমামতিতে নামায আদায় করতেন। হযরত সিরিকোটি হুজুর তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন।

হুজুর কিবলা আলহাজ্ব ওয়াজির আলী সাহেবের কাছে তাঁর ছোট ভাই সিরাজ কি করেন জানতে চান। তিনি হুজুর কিবলাকে বলেন সে লেখাপড়া করছে, তখন হুজুর কিবলা বলেন সিরাজকে তোমাদের ব্যবসায় মনোনিবেশ করতে বল। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার বিবাহের ব্যবস্থা কর। মুরশিদে বরহক হুজুর কিবলার আদেশ যথাযথ পালন করা হয়। তিনি ১৯৫৬ সনে প্রথমে চা পাতার ব্যবসা শুরু করেন। হুজুর কিবলার নেক নজর ও দুআর বরকতে ব্যবসায় প্রচুর লাভবান হন তিনি।
হযরত সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ও হযরতুল আল্লামা তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁকে অনেক স্নেহ করতেন। তিন বহুবার সিরিকোট দরবার শরীফ জিয়ারত করেছেন এবং ১৯৭৮ সনে তিনি তাঁর স্ত্রীসহ হুজুর কিবলা হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র সাথে বাগদাদ শরীফ সফর করেছেন।

তিনি ১৯৮১ সনে থেকে ১৯৮৫ সন পর্যন্ত আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের সহকারী কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এডিশনাল জেনারেল সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০ সাল হতে ২০২১ সাল পর্যন্ত ফাইন্যান্স সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালন রত অবস্থায় ১৮ মে ২০২১ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব তিনি আজীবন আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করেন। তিনি হুজুর কিবলার প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন মাদ্রাসায় অকাতরে সাহায্য সহযোগিতা করতেন। এ ছাড়াও তিনি এ লাকার গরীব অসহায়দের প্রতি সদা দয়ার্দ্র ছিলেন সাধ্য মতো সকলকে সাহায্য করতেন। বিশেষত পীরভাই ও আনজুমান এর কর্মচারীদের প্রতি সদা দয়ার্দ্র ছিলেন উদার হস্তে সকলকে গোপনে সাহায্য করতেন। আল্লাহ্র দেয়া সম্পদকে তিনি অসহায় গরীব দুঃখিদের সাহায্যে বিলিয়ে দিতে সাচ্ছন্দ বোধ করতেন। আনজুমান অফিসে তিনি নিয়মিত অফিস করতেন বিধায় অফিসের সকল কর্মচারিদের তিনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন। কর্মচারীদের তিনি বিপদে-আপদে ব্যক্তিগতভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন।

তাঁর ইন্তিকালের পর দরবারে আলিয়া কাদেরিয়ার সাজ্জাদানশীন মুরশিদে বরহক আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ (মু. জি. আ.) সিরিকোট দরবার শরীফে তাঁর মাগফিরাত কামনায় বিশেষ দুআ করেন। নামাযে জানাযার পূর্বে জামেয়ার সবুজ গম্বুজের নিচে যখন তাঁর লাশ রাখা হয় তখন জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার শিক্ষক, আলিম-ওলামাগণ তার মধুর ব্যবহার সম্মান ও আন্তরিকতাপূর্ণ সম্বোধন ইত্যাদি সদগুণের কথা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেন। আলিম ওলামা, মাদ্রাসার ছাত্র-তালিবে ইলমদের তিনি অত্যন্ত সম্মান-শ্রদ্ধা ও স্নেহ করতেন। জামেয়ার সাবেক অধ্যক্ষ আল্লামা মুফতি সৈয়দ অছিয়র রহমান তাঁর স্মৃতি চারণ করে বলেন, আলহাজ সিরাজ সাহেব একজন নিষ্ঠাবান সহজ সরল অমায়িক ব্যক্তি ছিলেন, যখনই দেখা হতো বাজি বলে অত্যন্ত সম্মান স্নেহের সাথে হাসি মুখে যে সম্বোধন করতেন। তাঁর হাসিমুখে সুন্দর ব্যবহারে জন্য তিনি আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর নামাযে জানাযার পূর্বে আনজুমানের একজন কর্মচারীকে দেখেছি অশ্রুসিক্ত হয়ে তার বোনের বিয়ের সময় দেয়া সাহায্যের কথা স্মরণ করে বললো গরীব অসহায়দের অভিভাবক আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে গেলেন। একবার মাসিক তরজুমান অফিসে সীতাকুণ্ডের এক পীরভাই যিনি মাসিক তরজুমানের এজেন্ট ছিলেন। তার অসুস্থতা ও নানা কারণে একটি মোটা অঙ্কের টাকা তরজুমান এজেন্ট বাবদ বকেয়া পড়ে যায় ফলে সে অনেক চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ে মাসিক তরজুমানের ম্যানেজার সৈয়দ মনছুরুর রহমান সাহেব ফ্যাইন্যান্স সেক্রেটারী আলহাজ্ব সিরাজুল হক সাহেবকে বলার সাথে সাথে তিনি তাঁর পকেট থেকে সমস্ত বকেয়া টাকা পরিশোধ করে দেন। এ রকম অনেক কর্মচারী ও পীর ভাইদেরকে তিনি গোপনে সাহায্য করেছেন। সর্বোপরি তিনি সদা-সর্বদা সকলের সাথে হাসি মুখে মধুর সম্বোধনে কথা বলতেন, ভাল ব্যবহার করতেন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামার হাদীস শরীফে রয়েছে- যে সব ধনাঢ্য ব্যক্তি দুনিয়ার জমিনের গরীব, অসহায়দের সাহায্য করবে আরশের অধিপতি তাঁকে সাহায্য করবেন। কিয়ামতের ময়দানের আরশের ছায়ার নিচে তাঁকে স্থান দেবেন।

তিনি আমৃত্যু অত্যন্ত সততা ও নিষ্ঠার সাথে আনজুমান ট্রাস্ট’র ফাইন্যান্স সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালন করে যান। এছাড়াও টি ট্রেডার্স এসোসিয়েশন বাংলাদেশ’র সাবেক সেক্রেটারী ও রিয়াজ উদ্দীন বাজার তিনপুলস্থ গোলাম রাসূল ওয়াকফ জামে মসজিদের সাবেক সেক্রেটারী ছিলেন। জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদরাসা সংলগ্ন দায়েম নাজির জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া জামে মসজিদ কমিটির সেক্রেটারী ও কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব আমৃত্যু পালন করেছেন।

১৯৯৯ সালে পবিত্র শবে বরাতের রাতে তাঁর স্ত্রী ইন্তেকাল করেন। হুজুর কিবলা আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ (মু. জি. আ.) ফজরের নামাযের পর নামাযে জানাযায় ইমামতি করেন।
তিনি ১৮ মে ২০২১ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৫ শাওয়াল ১৪৪২ হিজরি ৯১ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন। তাঁর ইনতিকালে দরবারে আলিয়া কাদেরিয়ার সাজ্জাদানশীন হযরতুল আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ (মু.জি.আ.) ও পীরে বাঙ্গাল আল্লামা সাবির শাহ্ (মু.জি.আ.) ও দরবারে সাহেবজাদাগণ তাঁর মাগফিরাত কামনা করে দো’আ ও মুনাজাত করেন। তাঁর দ্বিতীয় সন্তান আলহাজ্ব মুহাম্মদ এনামুল হক বাচ্চু আনজুমান ট্রাস্ট’র ফাইন্যান্স সেক্রেটারী, দায়েম নাজির জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া জামে মসজিদের সেক্রেটারী ও অর্থ-সম্পাদক হিসেবে বর্তমান দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তাঁর দ্বিতীয় ওফাত বার্ষিকীতে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন, মাশায়েখ হযরাতে উসিলায় তাঁর সকল খেদমত কবুল করুন এবং তাকে জান্নাতের আ’লা মকাম দান করুন।

লেখক: সহকারী সম্পাদক- মাসিক তরজুমান, চট্টগ্রাম।

Share:

Leave Your Comment