নজরুল ভাবনায় ঈদ

নজরুল ভাবনায় ঈদ

ইমরান হুসাইন তুষার>

বাংলা সাহিত্য ভূবনে নজরুল চির বিস্ময়কর এক অধ্যায়। কী স্থান পায় নি তাঁর সাহিত্য সম্ভারে? পুথিঁগত বিদ্যার বাহিরেও যে জ্ঞানের বিশাল জগৎ আছে। তা হয় তো নজরুলের আগমন না হলে, বাঙ্গালীর জানাই হতো না। ঐশী দানে পূর্ণভানে নজরুলের সাহিত্যধারা। তিনি ঈদ নিয়ে লিখেছে ডজন খানেক গান, কবিতা। এসব গান-কবিতার অন্তর নিহিত আহবান মুলত ইসলামের শ্বাশত বিধান। এমনি কয়েক’টি গান হল-কৃষকের ঈদ, ঈদ মোবারক, চল ঈদগাহে, ঈদের চাঁদ আর কালজয়ী গান-“ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ” তো আছেই। এসব গানের কবির ভাবনা নিয়ে দু’কলম লিখা।
বাঙ্গালীর কাছে ঈদে আগামী বার্তা মানেই প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী গান-“ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ”। বাঙ্গালী’র গগণে কাজী নজরুলে চাঁদ বৈ অন্য সব বেমানান। তাই তো ১৯৩১ রচনা আর ৩২’এর ফেব্রুয়ারী’তে প্রিয় মরমী গায়ক শিল্পী আববাস উদ্দিনের কণ্ঠে রেকর্ডে দিন হতে আজ শতাব্দী জয়ের পথে। প্রতিবারই মাহে রমজান আসে আমাদের মাঝে আত্মশুদ্ধির পয়গাম নিয়ে। আবার চোখের পলকেই বিদায়ও নেয়। ঈদ পর ঈদ আসে সকলেরই কানে বাজে প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী গান “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ”। দায়বদ্ধতা, উদারতা, ত্যাগ, সেবায় নিজেকে উৎসর্গ মানে হাক্কুল ইবাদার হক আদায়ের আত্মোপলব্ধিময় ঈদের শিক্ষা নিয়ে প্রিয় কবি’র লেখা এ গানের ৮ পঙক্তি’র অন্তর নিহিত দর্শন আমাদের মর্মে গাঁথে নি, কর্মেও অনুপস্থিত। আর তো প্রিয় কবি লিখেন-
“জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ
মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?”
আজ আমরা যখন ঈদের আনন্দে ভাসচ্ছি। আমার গায়ে বাহারী পোষাক। ঘরে সেমাই, কোরমা-পোলাও। একটি বারো কি ভেবে দেখেছি পাশের বাড়ী’র দিন মজুর হতদরিদ্র মানুষ’টির কথা। মোটেও না! যে কৃষক ফসল ফলিয়ে অন্যের মুখে হাসি ফোটায় তারই মুখ থাকে মলিন। তাই তো কবি লিখেন-

রোজা এফতার করেছে কৃষক অশ্রুর-সলিলে হায়,
বেলাল! তোমার কন্ঠে বুঝি গো আজান থামিয়া যায়!
থালা ঘটি বাটি বাঁধা দিয়ে হেরো চলিয়াছে ঈদগাহে,
তির-খাওয়া বুক, ঋণে-বাঁধা-শির, লুটাতে খোদার রাহে।
ঐ যেই, হযরত বেলালের আযানের ধ্বনিতে খোদার আরশ প্রকম্পিত হয়। সেই বেলালের আযান থেমে যাবার উপক্রম অভাবি মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখে। তবুও কৃষক তার হৃদয়ে হাজারও জমাটদ্ধ কষ্ট নিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই ঈদগাহে যায়। সেজদাহ্ অবনত হয়ে শোকর প্রকাশ করে আল্লাহর দরবারে। সে কথাই তুলে ধরেন কবি এখানে।
কথায় আছে, দেশ গড়ে কামলায় আর লুটে খায় আমলায়। সুমিষ্ট শরবতের যখন আমাদের দেশের আমলা আর রাজনৈতিকদের ইফতার পার্টির অতিথিদের গলা ভিজে। ঠিক তখন কৃষকের ইফতার হয় চোখের নোনা জলে। ঈগাহে যেতে যেন ওদের পা থেমে যায়। নামাজের মসছল্লায় ঠাঁয় দাড়িঁয়ে পাওনাদারের দেনার দায়ের খেয়াল ফিরে ফিরে আসে। কবি মজুর চাষার ঈদের চাঁদের কথা বলতে গিয়ে লিখেন-
“আমাদের বাঁকা ছুরি আঁকা দেখো আকাশে ঈদের চাঁদ!
তোমারে নাশিতে চাষার কাস্তে কী রূপ ধরেছে, দেখো,
চাঁদ নয়, ও যে তোমার গলার ফাঁদ! দেখে মনে রেখো!
প্রজারাই রোজ রোজা রাখিয়াছে, আজীবন উপবাসী,
তাহাদেরই তরে এই রহমত , ঈদের চাঁদের হাসি।”
দীর্ঘ ঊনত্রিশ কিংবা ত্রিশ দিনের রোজা ও ঈদের নতুন চাঁদের আগমন আমাদের কাছে আনন্দের। কারণ গদবাধা জীবনধারায় খানিকটা ভিন্নতার ছোঁয়া। কিন্তু মজুর-চাষার কাছে হার রোজই রোজা আর হাতে বাঁকা কাস্তে ঈদের নতুন চাঁদ।
নজরুল লিখেছে গরিবের হিস্যা যাকাত আদায়ের কথা। আজকের সমাজে যাকাতকে ধনীরা মনে করছে জুলুম কিংবা আত্মপ্রকাশের মহোৎসব। তাই তিনি লিলেখন-
“ঈদ্-অল-ফিতর আনিয়াছে তাই নব বিধান,
ওগো সঞ্চয়ী, উদ্বৃত্ত যা করিবে দান,
ক্ষুধার অন্ন হোক তোমার!
ভোগের পিয়ালা উপচায়ে পড়ে তব হাতে,
তৃষ্ণাতুরের হিসসা আছে ও পিয়ালাতে,
দিয়া ভোগ কর, বীর, দেদার”
ইসলাম সাম্য, মৈত্রী ও মানুষে মানুষের ব্যবধানকে ঘুচাতে ধনীর সম্পদে গরিবের হক রেখেছেন। বিনিময়ে ধনীদের সম্পদকে পরিশুদ্ধ করণের সুবর্ণ সুযোগ রেখেছে যাকাত ব্যবস্থায়। আল্লাহর দানকৃত সম্পদের তাঁর বান্দাদের হকের কথা বারংবার জানিয়ে দিয়েছেন। সেই কথা পুনঃরাবৃত্তি করেন কবি।
যক্ষের ধনের ন্যায় আকড়ে থাকা ধনীদের উদ্দেশ্যে নজরুল হুশিয়ারী উচ্চারণ করে লিখেন-
বাঁচিবে না আর বেশিদিন রাক্ষস লোভী বর্বর,
টলেছে খোদার আসন টলেছে, আল্লাহু-আকবর!
সাত আশমান বিদারি আসিছে তাঁহার পূর্ণ ক্রোধ।
জালিমে মারিয়া করিবেন মজলুমের প্রাপ্য শোধ।”
তাঁর এই লিখনী আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় যাকাত প্রদানে অস্বীকৃতি জানানোদের বিরুদ্ধে খলিফাতুল মুসলিমীনের কঠর শাস্তি মুলক ব্যবস্থার কথা।
“ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ” প্রিয় কবির এ গানের পঙক্তিমালা মর্মে ধারণ আর কর্মে প্রতিফলন ঘটাতে যিনি সক্ষম প্রিয় কবি তাকে বলেন- এই দুনিয়ায় দিবা- রাতি ঈদ হবে তোর নিত্য সাথী; তুই যা চাস তাই পাবি হেথায়, আহমদ চান যদি হেসে। আসলেই মু’মিনের ঈদেও সাজ কেমন হওয়া দরকার তা নিয়ে প্রিয় কবি বলেন-
“নাই হল মা বসন ভূষণ এই ঈদে আমার।
আল্লা আমার মাথার মুকুট, রসুল গলার হার।।”
প্রিয় কবি শত বঞ্ছনার মাঝে এমনি ভাবেই ঈদের আনন্দ খুঁজে। এটাই প্রকৃত মুমিনের নিশান। আজ সেই মুসলমান বড়ই দূর্লভ। কবির ও দু’টি আখিঁ কেবলই খুজে ফিরে-
“আল্লাতে যার পূর্ণ ঈমান কোথা সে মুসলমান
কোথা সে আরিফ অভেদ যাহার জীবন মৃত্যু জ্ঞান।।
(যাঁর) মুখে শুনি তৌহিদের কালাম-
ভয়ে মৃত্যুও করিত সালাম।
যাঁর দীন দীন রবে কাঁপিত দুনিয়া জীন পরি ইনসান্।।”
নজরুল রাতের আকাশে ঈদের নতুন চাঁদের নয়; অন্য এক চাঁদ দেখার প্রত্যাশায় ব্যাকুল। তিনি তাই তো বলেন-
“সবাই খুশি ঈদের চাঁদে, আমার কেন পরান কাঁদে,
কখন আমি দেখব আমার ঈদের চাঁদ মোস্তফা (দ.)’কে”।
প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যের গহিনের এমনিভাবে বিরাজ করছে অগুণতি চাঁদ। আল্লাহ পাক আমাদের সবাই’কে নিজেকে বিলিন করার আসমানী তাগিদময় ঈদের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে ঈদের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করার তৌফিক দিন। আমিন। সবাইকে ঈদ মোবারক।

প্রতিষ্ঠাতা প্রধান, বইসই, ঢাকা।

Share:

Leave Your Comment