বিদ’আতের প্রকারসমূহ

বিদ’আতের প্রকারসমূহ

= বিদ’আতের প্রকারসমূহ =

শর্‌’ঈ বিদ’আত অর্থাৎ শরীয়তের দৃষ্টিতে বিদ’আত প্রথমতঃ দু’প্রকারঃ

১. ই’তিক্বাদী (আক্বীদাগত) ২. আমলী (আমলগত)

আক্বীদাগত বিদ’আতই হাদীসে পাকের আলোকে চরম পথভ্রষ্টতা হিসেবে বিবেচ্য। ই’তিক্বাদী বিদ’আত ওই আক্বীদাসমূহকে বলা হয়, যা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র যাহেরী অবস্থানের পরে অর্থাৎ তাঁর তিরোধানের পরেই ইসলামের নামে এ ধর্মের অভ্যন্তরে উদ্ভূত হয়। এ প্রকারের বিদ’আতের অস্তিত্বের প্রমাণে ‘দুররে মুখতার’ গ্রন্থে বলা হয়েছে- وَمُبْتَدِعٌ اَیْ صَاحِبُ بِدْعَۃٍ وَہِیَ اِعْتِقَادُ خِلاَفِ الْمَعْرُوْفِ عَنِ الرَّسُوْلِ

অর্থাৎ (ইমাম হওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, বিদ’আতী ইমামের পিছনে নামায মাকরূহে তাহরীমী।) আর বিদ’আত হলো ওইসব আক্বীদা বা বিশ্বাসের পরিপন্থী আক্বীদা পোষণ করা, যা হুযূর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র যুগ থেকে প্রসিদ্ধ ছিলো. [কিতাবুস সালাত, বাবুল ইমামত]

মিশকাত গ্রন্থের ‘কিতাবুল ঈমান’র এক হাদীসে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- یَکُوْنُ فِیْ اُمِّتِیْ خَسْفٌ وَمَسْخٌ اَوْقَذْفٌ فِیْ اَہْلِ الْقَدْرِ অর্থাৎ আমার উম্মতের মধ্যে ভূমিধ্বস, চেহারা বিকৃতি ও পাথর বর্ষণ (জাতীয় আযাব) হবে ক্বদরিয়া সম্প্রদায়ের উপর।

ফাত্‌ওয়ায়ে রশীদিয়ায় উল্লেখ রয়েছে- جس بدعت میں ایسی شدید وعیدہے وہ بدعت فی العقائد ہے جیساکہ روافض خوارج کی بدعت অর্থাৎ যে বিদ’আত সম্পর্কে এরূপ কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে তা হলো আক্বীদাগত বিদ’আত। যেমন রাফেযী, খারেজীদের বিদ’আত। [১ম খণ্ড, কিতাবুল বিদ’আত, পৃষ্ঠা-৯০]

কাজেই, আক্বীদাগত বিদ’আত’র বিষয়টি স্বীকার্য। সুতরাং ক্বদরিয়া, রাফেযী, খারেজী, মুরজিয়া, গায়রে মুক্বাল্লিদ ইত্যাদি (আহলে হাদীস) আক্বীদাগত বিদ’আতের উদাহরণ। এভাবে পরবর্তীতে উদ্ভূত সকল বাতিল ফির্ক্বাও এ প্রকারভুক্ত।এ প্রকারের প্রত্যেকটি বিদ’আতই নিঃসন্দেহে গোমরাহী ও ভ্রান্তি এবং অনেক ক্ষেত্রে কুফরী ও বে-ঈমানী পর্যন্ত পৌঁছে যায়।

বিদ’আতে আমলী হচ্ছে এমন কাজ, যা হুযূর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র পবিত্র যমানার পরে প্রচলিত হয়েছে। দুনিয়াবী হোক বা দ্বীনি, সাহাবায়ে কেরামের সময়ে হোক কিংবা পরে। শেখ আব্দুল হক্ব মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হিও এটাই বলেছেন।       [আশি’আতুল লুম’আত, বাবুল ই’তিসাম]

বিদ’আতে আমলী আবার দু’প্রকারঃ বিদ’আতে হাসানাহ্‌ ও বিদ’আতে সায়্যিআহ্‌। হাসানাহ বলা হয় ওই সব নতুন কর্মকাণ্ডকে, যা কোন সুন্নাতের পরিপন্থী নহ; বরং দ্বীনের সহায়ক হিসেবে গণ্য হয়। যেমন মিলাদ মাহফিল, ঈদে মিলাদুন্নবী, জশনে জুলুস, খতমে গাউসিয়া শরীফ, সুন্নী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা, ক্বোরআন, কিতাব ইত্যাদি ছাপানো প্রভৃতি।

বিদ’আতে সায়্যিআহ্‌ বলা হয়, যা কোন সুন্নাতের পরিপন্থী, বিরোধী বা উচ্ছেদের কারণ হয়। হযরত শায়খ আব্দুল হক্ব মুহাদ্দিস দেহলভী বলেন- آنچہ موافق اصول وقواعد سنت است وقیاس کردہ شدہ است آں را بدعت حسنہ گونید وآنچہ مخالف آں باشد بدعت ضلالت گویند অর্থাৎ-পরবর্তীতে প্রবর্তিত যে সব কাজ মৌলিক রীতি-নীতি ও সুন্নাতের অনুবর্তী হয় অথবা তার আলোকেই ক্বিয়াস প্রসূত হয় তাকে বিদ’আতে হাসানাহ্‌ বলে। [আশি’আতুল লুম’আত, ১ম খণ্ড: কৃত শায়খে মুহাক্বক্বিক্ব আব্দুল হক্ব মুহাদ্দিস দেলেভী রাহমাতুল্লাহি আালায়হি]

তার পরিপন্থী হলো বিদ’আতে দ্বালালাত, যা হাদীস অনুযায়ী পথভ্রষ্টতা।

বিদ’আতে হাসানাহ্‌ তিন প্রকারের এবং সায়্যিআহ দু’প্রকারের এ প্রসঙ্গে মোল্লা আলী ক্বারী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন-

اَلْبِدْعَۃُ اِمَّا وَاجِبَۃٌ کَتَعَلِّمُ النَّحْوِ وَتَدْوِیْنِ اُصُوْلِ الْفِقْہِ وَاِمَّا مُحَرَّمَۃٌ کَمَذْہَبِ الْجَبَرِیَّۃِ وَاِمَّا مَنْدُوْبَۃٌ کَاِ حْدَاثِ الرَّوَابِطِ وَالْمَدَارِسِ وَکُلِّ اِحْسَانٍ لَّمْ یَعْہَدْ فِی الصَّدْرِ الْاَوَّلِ وَکَالتَّرَاوِیْحِ اَیْ بِالْجَمَآعَۃِ الْعَامَّۃِ وَاِمَّا مَکَرُوْہَۃٌ کَزَخْرَفَۃِ الْمَسَاجِدِ وَاِمَّا مُبَاحَۃٌ کَالْمُصَافَحَۃِ عَقِیْبَ الصُّبْحِ وَالتَّنَوُّعِ بِلَذِیْذِ الْمَاٰکِلَ وَالْمَشَارِبِ

অর্থাৎ বিদ’আত হয়তো ওয়াজিব, যেমন ইলমে নাহ্‌ভ শিক্ষা করা, উসূলে ফিক্বহের বিষয় প্রণয়ন করা অথবা হারাম, যেমন জবরিয়া আক্বীদার উদ্ভব। অথবা মুস্তাহাব, যেমন মুসাফির খানা, মাদরাসা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করা এবং ওইসব নেক প্রয়াস, যা প্রথমে ছিলো না, যেমন সাধারণ মুসল্লীদের জামা’আত সহকারে তারাবীহর নামায আদায় করা। অথবা মাকরূহ বিদ্‌’আত, যেমন মসজিদগুলোকে কারুকার্য খচিত করা। অথবা জায়েয বা মোবাহ্‌, যেমন ফজর নামাযের পর মুসাফাহা করা এবং নানাধরনের খানা-পিনা তৈরী করা ইত্যাদি।

[মিরক্বাত শরহে মিশকাত, কৃত মোল্লা আলী ক্বারী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এবং শামী, ১ফখণ্ড]

উপরোক্ত আলোচনার আলোকে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, বিদ’আত মাত্রই হারাম নয়। যা হারাম অথবা শরীয়তের নীতিমালার পরিপন্থী অবশ্যই তা হারাম এবং হাদীসে পাকে প্রিয় নবীর এরশাদে পাকে كل بدعة ضلالة (অর্থাৎ প্রত্যেক বিদ’আত পথভ্রষ্টতা) দ্বারা সকল সায়্যিআহ বিদ’আতকেই বুঝানো হয়েছে।

এ পর্যায়ে গোমরাহীমূলক বিদ’আতের অপকারিতা সুন্নাতে রসূলের দৃষ্টিতে পর্যালোচনার করা হচ্ছে-

হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বাহ্‌ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- مَنْ اَحْدَثَ فِیْ اَمْرِنَا ہَذَا مَالَیْسَ مِنْہُ فَہُوَ رَدٌّ (متفق علیہ) অর্থাৎ যে আমাদের দ্বীনের মধ্যে এমন কোন বিষয় উদ্ভাবন করে, যা দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত নয় বরং দ্বীনের পরিপন্থী সে (ব্যক্তি বা ণৎর উদ্ভাবিত কাজ) প্রত্যাখ্যাত। [বুখারী ও মুসলিম শরীফের বরাতে মিশকাত পৃষ্ঠা-২৭]

হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত এক হাদীসে আল্লাহ্‌র রাসূল এরশাদ করেন- شَرُّ اْلاُمُوْرِ مُحْدَثَاتُہَا وَکُلُّ بِدْعَۃٍ ضَلاَ لَۃٌ সর্ব নিকৃষ্ট বিষয় হলো (দ্বীনের মধ্যে) নতুন বিষয়ের উদ্ভাবন। আর প্রত্যেক বিদ’আত (যা দ্বীনের পরিপন্থী তা) গোমরাহী। [মিশকাত, বাবুল ই’তিসাম বিল কিতাব ওয়াস্‌ সুন্নাহ ও ইবনে মাজাহ্‌]

হযরত ইরবাদ্ব ইবনে সারিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- اِیَّاکُمْ وَمُحْدَثَات209 الْاُمُوْرِ فَاِنَّ کُلَّ مُحْدَثَۃٍ بِدْعَۃٌ وَکُلُ بِدْعَۃٍ ضَلاَ لَۃٌ

অর্থাৎ তোমরা (দ্বীনের মধ্যে) নব উদ্ভাবন করা থেকে বেঁচে থাকো। দ্বীনের প্রত্যেক নব-উদ্ভাবনই (যা দ্বীন বহির্ভুত তা) বিদ’আত। আর প্রত্যেক বিদ’আত (যা দ্বীন বহির্ভূত তা) গোমরাহী।   [আবূ দাঊদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ]

এ হাদীসের ব্যাখ্যায় হাকীমুল উম্মত মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন- یہاں نئی چیز سے مراد نئے عقیدے ہیں جو اسلام میں حضور کے بعد ایجاد کئے جائیں اسلئے کہ یہاں اسے گمر اہی کہاگیا گمر اہی عقیدہ میں ہوتی ہے অর্থাৎ এখানে নতুন বিষয় বলতে নতুন আক্বীদা বুঝানোই উদ্দেশ্য, যা ইসলামের নামে নবীর পরে উদ্ভাবিত হয়েছে। কারণ এখানে এটাকে গোমরাহী বলা হয়েছে। গোমরাহী সাধারণতঃ আক্বীদার বিষয়েই হয়ে থাকে।         [মিরআত শরহে মিশকাত]

হযরত হাসসান ইবনে সাবিত রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন- مَاابْتَدَعَ قَوْمٌ بِدْعَۃً فِی دِیْنِہِمْ اِلاَّ نَزَعَ اللّٰہُ مِنْ سُنَّتِہِمْ مِثْلَہَا ثُمَّ لَایُعِیْدُہَا اِلَیْہِمْ اِلٰی یَوْمِ الْقِیَامَۃِ (رواہ الدارمی) অর্থাৎ যে সম্প্রদায়ই তাদের দ্বীনে কোন বিদ’আতের প্রচলন করবে, আল্লাহ তা’আলা তার বিনিময়ে দ্বীন থেকে একটি সুন্নাত উঠিয়ে নেবেন। ক্বিয়ামত পর্যন্ত তা আর ফিরায়ে দেবেন না।  [মিশকাত, বাবুল ই’তিসাম বিল কিতাব ওয়াস্‌ সুন্নাহ]

হযরত ইবরাহীম ইবনে মায়সারা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- مَنْ وَقَّرَ صَاحِبَ بِدْعَۃٍ فَقَدْ اَعَانَ عَلٰی ہَدَمِ الْاِسْلَاَمِ অর্থাৎ যে ব্যক্তি কোন বিদ’আতীকে সম্মান করে, সে অবশ্যই দ্বীন’র ধ্বংসযজ্ঞে সহায়তা করলো।                     [প্রাগুত্ত]

উল্লেখ্য যে, এ সকল হাদীস শরীফে দ্বীন বহির্ভূত বা দ্বীনের পরিপন্থী বিদ’আতকে বুঝানো হয়েছে, যা উম্মতের জন্য চরম দূর্ভাগ্য ও অভিশাপ।

বুঝা যাচ্ছে দ্বীন-ধর্ম বেঁচে থাকবে সুন্নাত পালনের মাধ্যমেই। সুন্নাত উঠে যাওয়ার মাধ্যমেই ইসলাম ক্রমশঃ ধরাপৃষ্ঠ থেকে মুছে যাবে। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সুন্নাত পালন ও বিদ’আতে সায়্যিয়াহ্‌ বর্জনের পূর্ণশক্তি দান করুন।

বিদ’আতের প্রকারভেদ

ইমামে রাব্বানী মুজাদ্দিদে আলফে সানী শেখ আহমদ সেরহেন্দি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বিদ’আতের প্রকারভেদকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁর মতে বিদ’আত বলতেই ভ্রষ্ঠতা, কোন ভাল কাজকে বিদ’আত বলা যায় না। বিদ’আত বলতেই যা পূণ্যের আশা রাখে এমন কোন ভাল কাজকে বোঝায় না। বিদ’আতের মধ্যে তিনি কোন সৌন্দর্য, কোন আলোরছটা দেখেন না, অন্ধকার আর কলুষতা ছাড়া সেখানে ভিন্ন কিছু অনুভূত হয় না। তিনি সব ভাল কাজকে সুন্নাতে হাসানার অন্তর্ভুক্ত করেছেন।[মাকতুব নং ১৮৬, দফরত-১, খণ্ড ৩য়, জাহানে ইমামে রাব্বানী থেকে]

সামঞ্জস্য বিধান

বিষয়টি সমাধানে মাক্বামাতে সা’ঈদিয়াতে আল্লামা শেখ মাযহার দেহলভী লিখেছেন-

اَلْبِدْعَۃُ الْحَسَنَۃُ عِنْدَ الْاِمَامِ الرَّبَّانِیِّ قُدِّسَ سِرُّہَ دَاخِلَۃٌ فِی السُّنَّۃِ وَلاَ یُطْلَقُ عَلَیْہَا اِسْمُ الْبِدْعَۃِ بِمَوْجَبِ کُلِّ بِدْعَۃٍ ضَلاَ لَۃٌ وَالنِّزَاعُ لَفْظِیٌ بَیْنَہٗ وَبَیْنَ الْعُلَمَآءِ بِوَجُوْدِ الْحُسْنِ فِی الْبِدْعِ অর্থাৎ বিদ’আতে হাসানাহ্‌ ইমামে রাব্বানীর দৃষ্টিতে সুন্নাতেরই অন্তর্ভুক্ত। তিনি ‘প্রত্যেক বিদ’আত পথভ্রষ্ঠতা’ হাদীসের এ বক্তব্যের ভিত্তিতে এটাতে বিদ’আত শব্দের প্রযোজ্যতাকেই স্বীকার করেন নি। এটা তাঁর এবং অপরাপর ওলামায়ে কেরামের মধ্যে শব্দ চয়নগত মতভিন্নতা ছাড়া আর কিছু নয়। অর্থাৎ ইমামে রাব্বানী ও অন্যান্য ওলামা-ই কেরামের অভিমত এ প্রসঙ্গে এক ও অভিন্ন।[জাহানে ইমাম রাব্বানী (করাচী থেকে মূদ্রিত), পৃষ্ঠা-৩৪৩]