ঘুষদাতা অভিশপ্ত ও গুনাহ্‌গার হবে কিনা

ঘুষদাতা অভিশপ্ত ও গুনাহ্‌গার হবে কিনা

= বাধ্য হয়ে এবং যুল্‌ম থেকে বাঁচার জন্য ঘুষ দিলে ঘুষদাতা অভিশপ্ত ও গুনাহ্‌গার হবে কিনা =

যারা ঘুষ খায় তারা স্বেচ্ছায় ঘুষ খায়. তারা হয়তো অন্যদেরকে ঘুষ দিতে বাধ্য করে, অথবা নিজেরা খায় কিন্তু কাউকে ঘুষ খেতে বাধ্য করে না। এদিকে প্রত্যেকে চায় অতিরিক্ত কোন খরচ না দিয়ে তার কাজটি আদায় করে নিতে। যে সব ক্ষেত্রে ঘুষ দাতা অবৈধভাবে কোন সুবিধা আদায়ের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ঘুষ গ্রহণের জন্য প্রভাবিত করে, সে ক্ষেত্রেও গ্রহীতার ইচ্ছার স্বাধীনতা থাকে। সেলন ইচ্ছা করলে ঘুষের মত পাপ কাজে লিপ্তও হতে পারে; আবার ইচ্ছা করলে বিরতও থাকতে পারে।

কিন্তু যারা ঘুষ দেয় তাদের অধিকাংশ বাধ্য হয়ে ঘুষ দেয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার ন্যায্য প্রাপ্য আদায়ের জন্য অনেকক্ষেত্রে ঘুষ দিতে হয়। অন্যথায় কাজ আদায় হয় না। ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হয়। ঘুষ সম্পর্কে শরীয়তের বিধান হচ্ছে ঘুষ হারাম। যেমন  হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে- ঘুষদাতা ও ঘুষ গ্রহীতা উভয়েই অভিশপ্ত। অন্যত্র বলা হয়েছে, ঘুষদাতা ও ঘুষ গ্রহীতা উভয়েই জাহান্নামী।

এখন প্রশ্ন জাগে যে, যারা অনিচ্ছা এবং ঘৃণা থাকা সত্ত্বেও ন্যায্য প্রাপ্য ও অধিকার আদায়ের জন্য ঘুষ দিতে বাধ্য হয়, তারাও কি অভিশপ্তদের অন্তর্ভূক্ত হবে? এ বিষয়ে ইমামগণ একমত হয়েছেন যে, ঘুষদাতার উপর অভিসম্পাত তখনই পতিত হবে, যখন সে ঘুষ দিয়ে অন্যের ক্ষতি সাধনে লিপ্ত হবে কিংবা অবৈধ ও নিয়মবহির্ভূতভাবে কোন সুযোগ সুবিধা আদায়ের জন্য চেষ্টা করবে কিংবা অন্যের ন্যায্য প্রাপ্যকে নিজের মালিকানায় আনার প্রচেষ্টা চালাবে। কিন্তু সে যদি নিজের কোন ন্যায্য প্রাপ্য আদায়ের জন্য অথবা কারো যুল্‌ম থেকে বাঁচার জন্য হালাল বা ন্যায়সঙ্গত সকল পথে চেষ্টা, সাধনা ও যাচাই করে কোন ফল না পেয়ে শেষ পর্যায়ে নিরুপায় হয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে, বাধ্য হয়ে এবং ঘৃণা সহকারে ঘুষ দেয় তাহলে তার উপর অভিসম্পাত পতিত হবে না এবং তাকে দোষারূপ করাও যাবে না, তবুও সে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করবে।

ঘুষের আভিধানিক অর্থ

‘ঘুষ’-এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘উৎকোচ’। এটি বিশেষ্য বা নামবাচক শব্দ। কখনো কখনো ‘ঘুষ’ শব্দটি বস্তুবাচক বিশেষ্যের, আবার কখনো গুণবাচক বিশেষ্যের রূপ লাভ করে। ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশশ কর্তৃক প্রকাশিত ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’-এ ‘ঘুষ’ বলতে বুঝানো হয়েছে, ‘‘সাহায্য লাভের নিমিত্তে গোপনে প্রদত্ত পুরস্কার, উৎকোচ, অবৈধ পারিতোষিক।’’

বাংলা একাডেমী, ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলা একাডেমী সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান’-এ ‘ঘুষ’ শব্দের অর্থ করা হয়েছে ‘উৎকোচ, অবৈধ সহায়তার জন্য প্রদত্ত গোপন পারিতোষিক।’ কোলকাতা সাহিত্য সংসদ কর্তৃক প্রকাশিত ‘সংসদ বাঙ্গালা অভিধান’-এ ‘ঘুষ’ বলতে বুঝানো হয়েছে, ‘অন্যায় কাজে সাহায্য লাভ করার জন্য গোপনে প্রদত্ত পুরস্কার, উৎকোচ।’ যে ব্যক্তি ঘুষ গ্রহণ করে অথবা ঘুষ খায় তাকে বলা হয় ‘ঘুষখোর’ বা ‘ঘুষ গ্রহীতা’। আর যে ব্যক্তি ঘুষ দেয় বা প্রদান করে তাকে বলা হয় ‘ঘুষদাতা’ বা ‘ঘুষ প্রদানকারী’।

আরবী ভাষায় ‘ঘুষকে বলা হয় رِشْوَةٌ (রিশ্‌ওয়াতুন) বা رَشْوٌ (রাশ্‌ওয়াতুন)। ঘুষ দেওয়া বা লওয়াকে বলা হয় رَشْوٌ (রাশভুন্‌)। যে ব্যক্তি ঘুষ গ্রহণ করে বা খায় তাকে বলা হয়  مُرْتَشِىْ (মুরতাশী)অর্থাৎ- ঘুষখোর, বা ঘুষ গ্রহীতা। আর যে ব্যক্তি ঘুষ দেয় তাকে বলা শহ- رَاشِىْ (রাশী) অর্থাৎ- ঘুষদাতা বা ঘুষ প্রদানকারী। বাংলা ভাষায় ‘ঘুষ’ শব্দটি আরবী ‘রিশওয়াতুন’ বা ‘রাশওয়াতুন’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যহৃত হয়। উর্দূ এবং ফারসীতেও ঘুষকে বলা হয় رشوت (রিশওয়াত)। আর যে ঘুষ খায় তাকে বলা হয় رشوت خور  (রিশওয়াত খোর) অর্থাৎ- ঘুষখোর বা ঘুষগ্রহীতা।

ঘুষের প্রকারভেদ : ঘুষকে প্রধানত: দু’ভাগে ভাগ করা যায়।

যেমন ১. প্রত্যক্ষ ঘুষ এবং পরোক্ষ ঘুষ।

১. প্রত্যক্ষ ঘুষ:  প্রত্যক্ষ ঘুষ বলতে সাধারণতঃ কার্যসম্পাদন-এর বিনিময়ে কাজের মালিক কর্তৃক কার্য সম্পাদনকারীকে কোন কিছু দেয়ার সরাসরি প্রস্তাব করা এবং দেয়া কিংবা কার্য সম্পাদনকারী কর্তৃক কাজের মালিকের নিকট সরাসরি কোন কিছু চাওয়া এবং লওয়াকে বুঝায়।

এ ধরনের ঘুষ নগদ অর্থও হতে পারে কিংবা পণ্য সামগ্রী বা অন্য কিছুও হতে পারে।

নগদ অর্থঃ যেমন- টাকা, ডলার, পাউণ্ড বা অন্য কোন বৈদেশিক মুদ্রা।

পণ্য সামগ্রীঃ যেমন রেডিও, টু-ইনওয়ান, টেলিভিশন, ফ্রিজ, খাট, আলমিরা, পাখা, ফার্নিচার, স্বর্ণালংকার, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি।

অন্য কিছুঃ যেমন বিদেশ ভ্রমণ করা, ভাই, ভাতিজা, ভাগিনার চাকুরী দেয়া, বাড়িতে যাবার জন্য প্রাইভেট গাড়ি চাওয়া, সন্তানদের স্কুল, কলেজে  ভর্তির ব্যবস্থা করে দেয়া, টেলিফোন লাইনের ব্যবস্থা করে দেয়া ইত্যাদির সরাসরি প্রস্তাব করা বা চাওয়া।

২.পরোক্ষ ঘুষঃ কার্য সম্পাদনের বিনিময়ে কার্যের মালিক কর্তৃক যদি ঘুষের সমার্থবোধক কোন শব্দ দ্বারা কার্য সম্পাদনকারীকে কোন কিছু দেয়ার প্রস্তাব করা হয়; কিংবা কার্য সম্পাদনকারী কর্তৃক যদি তৃতীয় কোন ব্যক্তির মাধ্যমে বা কারো নাম ব্যবহার করে কার্যের মালিকের নিকট কোন কিছু চাওয়া হয় তাহলে তা হবে পরোক্ষ ঘুষ। এ ধরনের ঘুষ নগদ অর্থও হতে পারে আবার পণ্য সামগ্রী বা অন্য কিছুও হতে পারে। এ ধরনের ঘুষকে সাধারণতঃ ঘুসের সমার্থবোধক শব্দে ব্যবহার করা হয়।

সমার্থবোধক শব্দ- বখশিশ, খরচপাতি, খুশি করানো, সুদৃষ্টি, সম্মানী, ম্যানেজ, কমিশন, নেগোসিয়েশান, এক্সট্রা পারিশ্রমিক, টোকেন মানি, ক্লিয়ারেন্স ইত্যাদি।

তৃতীয় কোন ব্যক্তিকে উস্থাপন করাঃ যেমন- বলা হয় দেখুন আমি এসব (ঘুষ-টুস) খাইনা কিন্তু উপরে বস্‌ আছেন তো, ওনাকে খুশি করতে (ঘুষ দিতে) হবে; ফাইলটা আমার হাতেই আছে কিন্তু ওনার সাথে আপনি অবসর সময়ে আলাপ করুন। (ঘুষের আলাপ)। ওরা সারাদিন পরিশ্রম করে একটু মিষ্টিমুখ করাতে হবে ইত্যাদি। সুতরাং সরাসরি ঘুষ না চেয়ে অন্য যে কোন উপায়ে নগদ অর্থ, দ্রব্য বা কোন কিছু দ্বারা চাওয়া হলে বা দিলে তা হবে পরোক্ষ ঘুষ। উল্লেখ্য যে, ঘুষের উপাদান, ধরন, প্রকৃতি, সময়, অবস্থা, পাত্র, পদ্ধতি ইত্যাদির বিভিন্নতা ভেদে ঘুষের আরো বিভিন্ন শ্রেণী-বিভাগ রয়েছে। লোক ও পদমর্যাদা ভেদে তথা চেয়ারের ক্ষমতা ভেদে এর পরিমাণ উঠানামা করে ও ধরন বদলায়।