মানুষ ঘুষ কেন খায়?

মানুষ ঘুষ কেন খায়?

= মানুষ ঘুষ কেন খায়? =

ইসলামে ঘুষের আদান-প্রদান সম্পূর্ণরূপে হারাম। কিন্তু এরপরও বর্তমান বিশ্বে বিশেষ করে আমাদের বাংলাদেশে এখন ঘুষ নিত্যদিনের একটি মা’মুলী ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘুষের লেনদেন হারাম ও পাপকাজ হওয়া সত্ত্বেও এক শ্রেণীর মানুষের অন্তরে এর প্রতি তেমন কোন ঘৃণা সৃষ্টি হচ্ছে না। পাপকাজে নেই কোন ভয়ভীতি। কিছু কিছু অসৎ কর্মকর্তা ও কর্মচারী আছে, যারা ঘুষ ছাড়া কোন কাজই করতে চায় না। অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি নির্দ্বিধায় ঘুষ চেয়ে বসে। ‘ঘুষ দিন কাজ নিন’ এ হলো তাদের স্পষ্ট বক্তব্য। শিক্ষা মানুষকে সৎ ও নীতিবান করে। মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা অর্জন করেও তারা কেন ঘুষের মতো আবর্জনা খায়। এ প্রশ্নের জবাব এক কথায় দেয়া সম্ভব নয়। কারণ একক কোন কারণে মানুষ ঘুষ খায় না। ঘুষ খাওয়ার পেছনে রয়েছে বহুবিধ কারণ। নিম্নে ঘুষ খাওয়ার কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হলো-

১. উচ্চাভিলাষী মনোভাবঃ কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারী এমন আছে যাদের রয়েছে উচ্চাভিলাষী মনোভাব। তারা রাতারাতি বড় লোক হতে চায়। শহরের বিভিন্ন নামিদামি স্থানে অট্টালিকা গড়ে তুলতে চায়। তারা ভূলে যায় যে, তারা চাকুরীজীবি, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। তারা স্বপ্ন দেখে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হবার। ফলে উচ্চাভিলাষী মনোভাবের কারণে তারা বেছে নেয় ঘুষ খাওয়ার জঘন পথ; অথচ উচ্চাভিলাষী না হয়ে নিজের থেকে ছোট ও নিম্ন পর্যায়ের মানুষের প্রতি লক্ষ্য রেখে স্বীয় প্রাপ্ত নিঞ্চমাতগুলোর শুকরিয়া আদায়ের প্রতি ইসলামী শরীয়ত উৎসাহিত করেছে।

২. অত্যাধিক লোভ প্রবণতাঃ পৃথিবীতে সেই কেবল সুখী যে অল্পে তুষ্ট। অর্থাৎ যার যা কিছু আছে, তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে পারলে সে সুখী হতে পারে। কিন্তু কতিপয় লোক আছে যারা অল্পে তুষ্ট হতে পারে না।, কারো বাড়ী, গাড়ী, দালান কোটা দেখলেই তার প্রতি লোভ এসে যায়। সেও হতে চায় তার মত গাড়ী ও বাড়ির মালিক। অন্যের সম্পদ দেখে লোভকে সামলাতে না পেরে সে পা বাড়ায় ঘুষ খাওয়া বা উপরি আয়ের দিকে; অথচ লোভের মত ক্ষতিকর লন অভ্যাস পরিত্যাগ করার জন্য ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে।

৩. ধর্মীয় শিক্ষা ও অনুশাসনের অভাবঃ বর্তমান সমাজে যে ঘুষ খায় সে সাধারণত শিক্ষিত এবং পদস্থ কর্মকর্তা বা কর্মচারী। সে প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চ শিক্ষা হয়তো পেয়েছে; কিন্তু যে শিক্ষা মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখার সে শিক্ষা তার হয়তো নেই, নতুবা সে পায়নি। আর পেয়ে থাকলেও হয়তো অনুশাসন নেই। যদি তার মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষা ও অনুশাসন থাকতো তাহলে হয়তো তার হৃদয়ে এ অনুভূতিটুকু আসতো যে, তার প্রতিটি কৃতকর্ম সম্পর্কে একদিন আল্লাহ পাকের দরবারে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জবাবদিহি করতে হবে, পার্থিব বিচারের কাঠগড়ায়ও হয়তো একদিন দাঁড়াতে হবে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সে ঘুষের মত অবৈধ উপার্জন থেকে বিরত থাকতে পারতো। ধর্মীয় শিক্ষা ও অনুশাসনের অভাবে অনেকে ঘুষ খেয়ে থাকে। এজন্য ধর্র্মীয় শিক্ষা অর্জন ও ধর্মীয় অনুশাসন পালনের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জনের প্রতি ইসলাম উৎসাহিত করেছে, তাকীদও দিয়েছে।

৪. ঘুষদাতার প্রলোভনঃ অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারী আছে যারা ঘুষ খায় না; বরং কষ্ট করে সৎভাবে জীবন যাপন করতে চায়। কিন্তু ঘুষ দিয়ে যারা অবৈধ ও নিয়মবহির্ভূতভাবে কাজ সম্পাদন করে নিতে চায়, তারা সংশ্লিষ্ট কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের মোটা অংকের লোভ দেখাতে থাকে। ফলে আস্তে আস্তে ওই সৎ লোকটিও হয়ে যায় অসৎ। ভাবতে থাকে, জ্ঞচাকুরী করেতো জীবনে কিছুই করতে পারলাম না বা পারবো না। ঠিক আছে, একবার না হয় ঘুষ খেইে দেখি।’ এভাবে একদিন, দু’দিন, তিনদিন আস্তে আস্তে ঘুষদাতার প্রলোভনে পড়ে সেও হয়ে যায় আস্ত ঘুষখোর। অথচ যে ব্যক্তি সৎ ও ন্যায়ের পথে চলে তাকে সহযোগিতা করাই প্রকৃত মু’মিনের আদর্শ।

৫. পরিবেশের প্রভাবঃ কোন ভদ্রলোক হয়তো এমন আছেন, যিনি ঘুষ খান না; অথচ তার পার্শ্বের টেবিলের কর্মকর্তা ঘুষ খাচ্ছে, স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করছে। কিন্তু এ ভদ্রলোক যে অফিসে চাকুরী করে তার নাম শুনলেই অনেকেই ভাবে তিনিঐ গঁরগ্ধখার। আর এ ভদ্রলোকও ভাবেন এ অফিসে চাকুরী করে ঘুষ না খেলেও অন্যেরা মনে করে ঘুষ খায়। আর আমি একা না খেয়ে ভাল থাকলে কি হবে, অন্যেরাতো খায়-ই। ফলে আস্তে আস্তে পরিবেশ তার উপর প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। সেও  শুরু করে ঘুষ খেতে। অথচ ইসলাম এ ধরনের পরিবেশে সৎভাবে থাকার দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণের শিক্ষা দেয়।

৬. অভ্যাসঃ ঘুষ খেতে খেতে কারুর মধ্যে তা এমন অভ্যাসে পরিণত হয় যে, ঘুষ না পেলে তাদের আর ভালই লাগে না। কোন দিন অফিসে ঘুষ না পেলে ভাবে, জ্ঞআজ যে কার মুখ দেখে এসেছি, সারাটা দিন একেবারেই নিরামিষ হয়ে আছে।’ এ সময়ে কাউকে পেলে সাধারণত একটি সিগারেট বা এক কাপ চায়ের পয়সার আবদার করতেও লজ্জাবোধ করে না। অথচ বদ অভ্যাসকে বর্জন করে সৎকাজে অভ্যস্থ হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ, ইসলামের শিক্ষা।

৭. আইনের প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন না থাকাঃ বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৬১- ১৬৫ ধারায় ঘুষ খোরদের শাস্তির বিধান উল্লেখ আছে। কিন্তু এর যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নেই। আইন কেবল বইয়ের পাতায় যথাযথভাবে আছে। অপরদিকে যারা আইনকে প্রয়োগ করবে তাদের ব্যাপারেই যদি চাঁদা, টোকেন মানি, মালপানি, সেলামী ইত্যাদি গ্রহণের অভিযোগ উঠে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই অন্যেরা মনে করবে তারা যখন ঘুষ গ্গখয়ে পার পেয়ে যায়, তখন আমাদের খেতে দোষ কি? শুরু হয় ঘুষ খাওয়ার প্রতিযোগিতা। তাই ক্বোরআন-সূন্নাহ্‌র আইন ও প্রকৃত ইসলামী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা আইনের যথাযথ প্রয়োগ করাই সংরক্ষিত জাতি ও সমাজের জন্য কল্যাণকর বৈ-কি।

৮. অধার্মিক প্ররোচনাঃ অনেক সৎস্বামী আছেন যারা হালাল জীবিকার উপর কষ্ট করে জীবন যাপন করতে চান। কিন্তু অধার্মিক স্ত্রীর কারণে স্বামী তার সততা রক্ষা করতে পারেথ না। স্ত্রী তার বান্ধবীর দামী দামী পোশাক পরিচ্ছদ দেখে লোভে পড়ে যায়। স্বামীকে তা ক্রয় করে আনতেও চাপ সৃষ্টি করে। অনেক ক্ষেত্রে স্ত্রী বলেই ফেলে, ‘‘অমুকের হাজব্যান্ড চাকুরী করে যদি এতো কিছু আনতে পারে তুমি পারো না কেন? ও আর তুমি তো একই অফিসে চাকুরী করো। আসলে তুমি ভাল শিক্ষিত ও চালাক হতে পারো নি; হয়েছে বোকা।’’ বেচারা স্বামী ভাবে, ‘‘ঘুষ খাইনা বলে বোকা হয়ে গেলাম।’’ শেষ পর্যন্ত স্ত্রীর প্ররোচনায় সৎ স্বামীটিও হয়ে যায় অসৎ ও ঘুষখোর। একজন স্ত্রী ইচ্ছে করলে তার স্বামীকে আল্লাহ-ওয়ালা বানাতে পারে। আবার ইচ্ছে করলে অসৎ ও ঘুষখোরও বানাতে পারে। এ জন্য সৎ ও নেককার মহিলা শাদী করার প্রতিআ রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তাজ্ঞআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে তাগিদ দিয়েছেন।

৯. নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ঃ এক শ্রেণীর কর্মকর্তা ও কর্মচারী আছে যাদের প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চ ডিগ্রী আছে বটে; কিন্তু নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে। ফলে তারা ঘুষ ছাড়া কোন কাজ করতে রাজি হয় না। সুতরাং নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করার জন্য মহান আল্লাহ তা’আলা দ্বীনি সঠিক জ্ঞানার্জন ও সেটার অনুশীলন এবং সত্যবাদী ও প্রকৃত আউলিয়া-ই কেরামের সঙ্গ লাভ করার নির্দেশ দিয়েছেন।

ঘুষ দেয়ার কারণসমূহ

ঘুষ কেন দেয় এর কারণ অনেক। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রক্তকে পানি করে উপার্জিত অর্থ কেউই কাউকে অনর্থক দিতে চায় না। অর্থ এমন এক জিনিস যার প্রতি লোভের শেষ নেই। যার যত অর্থই থাকুক না কেন তার আরো চাই। অভাবেরও শেষ নেই। অর্থকে কেন্দ্র করে ভাই-এ ভাই-এ ঝগড়া করে, পিতা পুত্রে ঝগড়া হয়, সংসার ভেঙ্গে যায়। পিতার মৃত্যুর পর বোনের অধিকারকে খর্ব করা হয়। তখন এ অর্থই সকল অনর্থের মূল হয়। সুতরাং কেউ কাউকে স্বেচ্ছায় নিজের উপার্জিত অর্থ দিয়ে দেয় না বা দিতেও চায় না। তাই প্রশ্ন জাগে ঘুষ দেয়া ইসলামে, এমনকি সকল ধর্মেই নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও মানুষ কেন ঘুষ দেয়? এর জবাবে বলা যায় যে, মানুষ দু’টি কারণে ঘুষ দিয়ে থাকেঃ

১. অবৈধ সুযোগ সুবিধা লাভের জন্যঃ এক শ্রেণীর লোক যারা রাতারাতি বড় লোক হবার স্বপ্ন দেখে, তারা অবৈধ এবং নিয়ম বহির্ভূতভাবে সুযোগ-সুবিধা লাভের জন্য ঘুষ দিয়ে কাজ আদায় করে। তাদের ভাষা ‘ঘুষ নিন কাজ দিন।’ কেউ যদি ঘুষ খেয়ে অবৈধ কাজ করতে রাজি না হয় তাহলে তাকে হতে হয় নানামুখী ষড়যন্ত্রের শিকার। ঘুষ দেখিয়ে তারা কাজ সম্পাদনকারীকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। কেউই তাদেরকে ঘুষ  দিতে বলে না; বরং তারা স্বেচ্ছায় ঘুষ দিয়ে অবৈধ কাজ করার চেষ্টা করে।

২. বাধ্য হয়ে বা চাপে পড়ে ঘুষ দেয়ঃ অনেক লোক আছেন, যারা ন্যায়ের পথে চলতে চান। তারা কাউকে ঘুষ দিতে রাজি নন। কারো নিকট হতে অবৈধ ও নিয়ম বহির্ভূতভাবে কাজ আদায় করারও চেষ্টা করেন না। তারা চান ন্যায়ের পথে তাদের যতটুকু প্রাপ্য ততটুকই পেতে। ন্যায্য অধিকার যেন কেউ হরণ না করে। কিন্তু কিছু কিছু অসৎ কর্মকর্তা ও কর্মচারী আছে, যারা ঘুষ ছাড়া কোন কাজ করতে রাজি নয়। এমনকি সরাসরি ঘুষ চেয়ে বসে। অন্যথায় তাদের ফাইল আটকে রাখা হয়, ছাড়া হয় না। ঘুষ দিয়ে অন্যরা অবৈধ পন্থায় টেন্ডার নিয়ে যায়। এমতাবস্থায় ন্যায্য প্রাপ্যটুকু পাবার জন্য কেউ কেউ মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঘুষ দিতে বাধ্য হয়।