মি’রাজুন্নবী: অতুলনীয় মু’জিযা

মি’রাজুন্নবী: অতুলনীয় মু’জিযা

মি’রাজুন্নবী: নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম -এর অতুলনীয় মু’জিযা
 আমাদের আক্বা ও মাওলা নবীকুল শিরমনি, রসূলকুল শ্রেষ্ঠ রহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হলেন আপাদমস্তক শরীফ মু’জিযা। আল্লাহ্ পাক জাল্লা শানুহূ তাঁর হাবীবকে সবদিক দিয়ে অতুলনীয় করে সৃষ্টি করেছেন। মি’রাজ শরীফ অর্থাৎ তাঁর ঊর্ধ্বলোকে গমন ও আল্লাহ্ পাকের সাথে আলম-ই লা-মকানে সশরীরে সাক্ষাৎ করে রাতের একটি অতি ক্ষুদ্রাংশে পুনরায় ফিরে আসা এবং তাতে অগণিত হিকমত বা রহস্যের সমাবেশ ঘটা ছিল তাঁরই একটি অনন্য মু’জিযা। এ মু’জিযার বাস্তব অবস্থা ও হিকমত কি- তা তো পূর্ণাঙ্গভাবে জানেন যে মহান রব আপন হাবীবকে মি’রাজ করিয়েছেন, আর তাঁর একান্ত অনুগ্রহক্রমে জানেন যাঁকে এ মু’জিযার ধারক করা হয়েছে, অর্থাৎ খোদ্ নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। তবুও পবিত্র ক্বোরআন মজীদ ও সহীহ হাদীস শরীফ ইত্যাদির আলোকে যতটুকু কিতাবাদিতে বিধৃত হয়েছে তা থেকে কিছুটা সংক্ষেপে আলোচনা করার প্রয়াস পেলাম।
প্রথমে পবিত্র ক্বোরআনে খোদ্ মহান রব তাঁর হাবীবকে মি’রাজ করানোর যে হিকমতপূর্ণ বর্ণনা দিয়েছেন তার সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যাক। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহূ এরশাদ ফরমায়েছেন-
سُبْحٰنَ الَّذِیْ اَسْرٰی بِعَبْدِہٖ لَیْلاً مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ اِلَی الْمَسْجِدِ
الْاَقْصٰی الَّذِیْ بَارَکْنَا حَوْلَہٗ مِنْ اٰیَاتِنَا اِنَّہٗ ہُوَ السَّمِیْعُ الْبَصِیْرُ
উচ্চারণঃ সুবহা-নাল্লাযী- আসরা- বি‘আবদিহী লায়্লাম মিনাল্ মাসজিদিল হারা-মি ইলাল মাসজিদিল আক্বসাল্লাযী- বা-রাক্না- হাওলাহূ- লিনু-রিয়াহূ- মিন্ আ-য়া-তিনা-, ইন্নাহু হুয়াস্ সামী-‘উল্ বাসী-র। [সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত-১]
তরজমা: পবিত্রতা তাঁরই জন্য, যিনি আপন বান্দাকে রাতারাতি নিয়ে গেছেন মসজিদ-ই হারাম থেকে মসজিদ-ই আক্বসা পর্যন্ত; যার আশে-পাশে আমি বরকত রেখেছি, যাতে আমি তাঁকে আপন মহান নিদর্শনসমূহ দেখাই; নিশ্চয় তিনি জানেন ও দেখেন। [তরজমা: কান্যুল ঈমান, বাংলা সংস্করণ]
বস্তুত এ আয়াত শরীফে আল্লাহ্ তা‘আলা হুযূর করীমের মি’রাজের প্রতিটি স্তর ও ধরন এবং হিকমত বা রহস্যের কথা এরশাদ করেছেন। আয়াতের প্রতিটি অংশের সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণেও তা ফুটে ওঠে। সুতরাং দেখুন-
আয়াতের প্রথমাংশে আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন- ‘সুবহা-না ল্লাযী’ (পবিত্রতা ওই সত্তার) এ মহান ঘটনাকে আল্লাহ্ তা‘আলা আপন ‘পবিত্রতা’র ঘোষণা দিয়ে বর্ণনা করেছেন। আর এ কথা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন যে, তিনি আপন মাহবূবকে রাতের একটি ক্ষুদ্রাংশে ঊর্ধ্বলোকে নিয়ে যেতে এবং মি’রাজ করিয়ে ফিরিয়ে আনতে অক্ষম নন। সব ধরনের অক্ষমতা থেকে তিনি সম্পূর্ণ পবিত্র। অতঃপর এরশাদ করেছেন-
‘আসরা- বি‘আবদিহী-’ (যিনি নিয়ে গেছেন আপন বান্দাকে)ঃ এখানে আল্লাহ্ তা‘আলা ‘আসরা’ বলেছেন। কেননা, এ শব্দ থেকে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আর ‘বি‘আবদিহী’র ‘বা’ (অব্যয়) পদটি একথা প্রকাশ করছে যে, এ ভ্রমণ করানোর সময় যিনি ভ্রমণ করাচ্ছেন (অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘আলা) যাকে সফর করাচ্ছেন (অর্থাৎ হুযূর-ই আক্রাম)-এর সাথে সাথে ছিলেন। ‘বা’ অব্যয়টি ‘মুসাহাবাহ্’ বা সঙ্গ বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত। অবশ্য এ ‘সঙ্গে থাকা’ এমন কোন প্রকার-আকার আকৃতি থেকে পবিত্র ছিল, যাকে ইন্দ্রিয়শক্তি অনুধাবন করতে পারে। (অর্থাৎ যেভাবে শোভা পায়)। ‘আব্দ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে সম্বন্ধ পদ হিসেবে, যা ه (সর্বনাম)’র সাথে সম্পৃক্ত। এতে এ কথা সুস্পষ্ট হয় যে, তখন ‘আব্দ’ আপন মা’বূদের দিকে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেছিলেন, আর মা’বূদও তাঁর এ খাস ‘আব্দ বা বন্ধুর দিকে তাঁর পুরস্কার ও সম্মানদান সহকারে মনোনিবেশ করেছিলেন। ‘আবদিহী’ (তাঁর বান্দা) মানে ‘কামিল বান্দা’। আর কামিল বান্দা হলেন হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম। ‘আবদ’ শব্দকে ‘হু’ সর্বনাম অর্থাৎ আল্লাহ্’র দিকে সম্পৃক্ত করায় এই ‘আবদ’র মধ্যে অতুলনীয় বিশেষত্ব এসেছে।
আল্লামা ইক্ববাল শুধু ‘আবদ’ এবং আল্লাহ্’র দিকে সম্বন্ধযুক্ত ‘আবদ’র মধ্যে বিরাট পার্থক্যের কথা উল্লেখ করে বলেছেন-
عبد دیگر عبدہٗ چیزے دگر- ما سراپا  انتظار  او  منتظر
অর্থাৎ ‘বান্দা’ এক জিনিস, ‘আল্লাহ্’র বান্দা’ (আবদুহু) অন্য কিছু। আমরা হলাম ‘বান্দা’, আপাদমস্তক অপেক্ষমান, আর যিনি ‘আবদুহূ’ (আল্লাহ্’র বিশেষ বান্দা বা মাহবূব বান্দা) তিনি হলেন এমন সত্তা, যাঁর জন্য অপেক্ষা করা হয়।
তাছাড়া, ‘আবদ’ শব্দ দ্বারা এদিকে ইঙ্গত করা হয়েছে যে, এ ভ্রমণ ঘুমে, স্বপ্নে বা রূহানীভাবে করানো হয়নি, বরং সশরীরে করানো হয়েছে। কারণ, ‘আবদ’ বলা হয়, ‘দেহ ও রূহ’র সমন্বিত বান্দাকে। শুধু রূহ যেমন ‘আবদ’ নয় রূহবিহীন দেহও তেমনি ‘আবদ’ নয়।
তদুপরি, ‘আব্দ্’র সাথে ‘নূর’ এর সমন্বয়ও ঘটতে পারে। সুতরাং হুযূর আলায়হিস সালাতু ওয়াস্ সালাম এমন ‘আবদ’ যে, তাঁর মধ্যে নূরানিয়াতের বৈশিষ্ট্যও বিদ্যমান। এটা অসম্ভবও নয়; কারণ, পবিত্র কোরআনেই আল্লাহ্ পাক নূরের তৈরি ফিরিশতাদেরকে ‘ইবাদ’ عَبْدُ -عِبَادٌর বহুবচন) বলেছেন। যেমন এরশাদ হচ্ছে قُلْ عِبَادُ مُّکْرَمُوْنَ  (বরং ফিরিশতাগণ হচ্ছে সম্মানিত বান্দা)।
এরশাদ হয়েছে- ‘লায়্লান’ (রাতের একটি ক্ষুদ্রাংশ)ঃ এখানে লক্ষণীয় যে, এ ঊর্ধ্বলোকে ভ্রমণ রাতের বেলায় করানো হয়েছে। আর এ ভ্রমণও করানো হয়েছে আল্লাহ্’র বিশেষ বিশেষ নিদর্শনাবলী দেখানোর জন্য। রাতও বেছে নিলেন ২৭ তারিখের রাত, যে সময়ে চাঁদের আলোও নেই; অথচ কোন কিছু ভালভাবে দেখা যায় দিনের বেলায়। সুতরাং ঘোর অন্ধকার রাতে এ ভ্রমণ করানো থেকে এ কথা সুস্পষ্ট হল যে, হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম চাঁদ ও সূর্যের আলোর মুখাপেক্ষী নন; বরং সমগ্র সৃষ্টি হুযূরের নূরের মুখাপেক্ষী, বরং সৃষ্টি জগতের সমস্ত উজালা ও আলো হুযূরের নূরেরই প্রতিচ্ছবি।
মহান আল্লাহ্ এরশাদ ফরমান- মিনাল মাসজিদিল হারা-মি ইলাল মাসজিদিল আক্বসা- (মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আক্বসা পর্যন্ত)ঃ কোন কোন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে- মি’রাজের প্রারম্ভ হয়েছে, হাতীম-ই কা’বা থেকে, আর কিছু সংখ্যক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে- হুযূর আপন চাচাতো বোন হযরত উম্মে হানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা’র ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। সেখান থেকে কা’বার হাতীমে এসেছিলেন। ‘হাতীম’ মসজিদুল হারামেরই অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং মি’রাজ শরীফের প্রারম্ভ মসজিদুল হারাম থেকেই হয়েছে। মি’রাজের প্রথম সোপান মসজিদ-ই আক্বসা পর্যন্ত (ইলাল মাসজিদিল আক্বসা) তারপর মসজিদে আক্বসা থেকে ‘মালা-ই আ’লা (উর্ধ্বজগত) পর্যন্ত। আর মি’রাজের পরবর্তী সোপানে এর স্পষ্ট বিবরণ এসেছে পবিত্র ক্বোরআনের -সাতাশতম পারার ‘সূরা নাজ্ম’-এ। মসজিদ-ই আক্বসার বৈশিষ্ট্য এরশাদ হয়েছে এ আয়াতাংশে- “আল্লাযী- বা-রাকনা- হাওলাহূ- (ওই মসজিদ-ই আক্বসা, যার চতুর্পাশে আমি বরকত রেখেছি)”। এ মসজিদ সব নবীর কেন্দ্রস্থল। এর চতুর্পাশে আল্লাহ্ পাক সব ধরনের বরকত রেখেছেন। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বরকত ছিল- বাগানগুলো, শাক-সবজি, গাছপালার সজীবতা, পানির ফোয়ারা, ফসলাদি ও বড় বড় ক্ষেতের মাঠ ইত্যাদি। আর রূহানী বরকতরাজি হচ্ছে- ওখানে অবস্থিত অগণিত সম্মানিত নবীগণের নিদর্শনাদি ও মাযার শরীফসমূহ।
মি’রাজের দ্বিতীয় সোপানের ইঙ্গিত রয়েছে এ আয়াতাংশে- “লিনুরিয়াহূ- মিন আ-য়া-তিনা- (তাঁকে আপন নিদর্শনাদি দেখানোর জন্য।)” অর্থাৎ এ উর্ধ্বলোকে ভ্রমণ করানোর অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে এটা। আল্লাহ্’র ঘনিষ্ট সান্নিধ্যে সশরীরে সাক্ষাতের বর্ণনা এসেছে আয়াতের শেষাংশে- “ইন্নাহূ- হুয়াস্ সামী-‘উল বাসীর (নিঃসন্দেহে তিনি শোনেন, দেখেন)”ঃ এখানে ‘তিনি’ দ্বারা ‘আল্লাহ্’ ও ‘রসূল’ উভয়ের কথা বুঝানো যেতে পারে। তখন অর্থ দাঁড়াবে- আল্লাহ্ তো হুযূরের কথা শুনেন ও তাঁকে দেখেন, হুযূরও এ বিশেষ ভ্রমণে বিশেষভাবে আল্লাহ্’র কথা শুনেন, ও সরাসরি তাঁকে দেখেন। অন্য ভাষায়- আল্লাহ্ তো সত্তাগতভাবে সামী’ ও বাসীর, আর আল্লাহ্’র অনুগ্রহক্রমে হুযূরও সামী’ ও বাসীর (শ্রোতা ও দ্রষ্টা)। মোটকথা, আলোচ্য আয়াতে হুযূরের মি’রাজের সব ক’টি স্তরের বর্ণনা এসেছে।
তদুপরি, হুযূরের পবিত্র সত্তায়ও তিনটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান: বাশারী, মালাকী ও হাক্ব্ক্বী (যথাক্রমে মানবীয়, ফিরিশতাসুলভ ও অনন্য বা প্রকৃত)। সুতরাং, মসজিদে হারাম থেকে বায়তুল মুক্বাদ্দাস পর্যন্ত বাশারিয়াতের মি’রাজ, এখান থেকে সিদ্রাতুল মুন্তাহা পর্যন্ত মালাকিয়াতের এবং এখান থেকে ‘লা-মকান’ পর্যন্ত হাক্ব্ক্বী সূরতের মি’রাজ হয়েছে। যেখানে শুধু আল্লাহ্ তা‘আলা ও হুযূরই ছিলেন। সূরা নাজম’সহ অন্যত্রও এ পবিত্র মি’রাজের কথা এরশাদ হয়েছে। বিশুদ্ধ হাদীসসমূহেও এ মহান ভ্রমণের বিস্তারিত বিবরণ এসেছে। সুতরাং এ সবের আলোকে মি’রাজের ধারাবাহিক সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করার প্রয়াস পেলাম-
মি’রাজ শরীফের ঘটনা
হিজরতের প্রায় ৫ বছর পূর্বে রজব শরীফের ২৭তম রাতে মি’রাজের দুলহা হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আপন চাচাতো বোন হযরত উম্মে হানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা’র ঘরে বিশ্রামরত ছিলেন। হযরত জিব্রাঈল পঞ্চাশ হাজার ফিরিশতার জমা‘আত ও জান্নাতী বোরাক্ব নিয়ে হাযির হলেন। হুযূরের বরকতময় চক্ষুদয়ে তখন ঘুম ছিল। হযরত জিব্রাঈল অতি আদবসহকারে হাত বেঁধে দাঁড়ালেন। চিন্তা করছিলেন- যদি আওয়াজ দিয়ে ঘুম ভাঙ্গাই, তবে বে-আদবী হবে। কারণ
ادب گاہیست زیر آسماں از عرش نازک تر-نفس گم کردہ می آید  جنید و بایزید  ایں جا
(আসমানের নিচে আরশ অপেক্ষাও বেশি নাজুক ও স্পর্শকাতর একটি আদবের স্থান রয়েছে। হযরত জুনায়্দ ও বায়েযীদের মত মহান বুযর্গ ব্যক্তিরাও নিঃশ্বাস বন্ধ করেই এ মহান দরবারে হাযির হয়।) সুতরাং মহান রবের নির্দেশ হল ياجِِبْرَآئیْلُ قَبِّلْ قَدَمَیْہِ (হে জিব্রাঈল তাঁর পদযুগলে চুম্বন কর।) হযরত জিব্রাঈল তৎক্ষণাৎ নিজের চক্ষুযুগল ও ওষ্ঠদু’টি হুযূরের বরকতময় পদযুগলে রাখলেন। হুযূরের বরকতময় চক্ষুযুগল খুলল। হযরত জিব্রাঈল আরয করলেন اِنَّ اللّٰہَ  اِشْتَاقَ اِلٰی لِقَآءِ کَ (নিশ্চয় আল্লাহ্ আপনার সাক্ষাতের জন্য আগ্রহ করেছেন)।
দেখুন, যাঁর পদচুম্বন করছেন ফিরিশতাকুল সরদার হযরত জিব্রাঈল আমীন, আর সাক্ষাতের আগ্রহী হলেন কুল কা-ইনাতের মহান স্রষ্টা ও মালিক, এমন রসূলের মর্যাদা যে কত উঁচু তা একটু ভেবে দেখুন।
অতঃপর হুযূরের সামনে হযরত জিব্রাঈল বোরাক্ব পেশ করলেন। বেহেশতের অগণিত বোরাক্বের মধ্যে এ বোরাক্বটি হুযূরের সর্বাপেক্ষা বেশি আশিক্ব এবং নিজের পিঠে আরোহন করিয়ে আল্লাহ্’র হাবীবকে এ ভ্রমণ করানোর প্রতি দারুন আগ্রহী ও অপেক্ষমান ছিল। রাতদিন কান্না করত আল্লাহ্ পাক যেন তাঁকে এ সৌভাগ্য দান করেন। অকৃত্রিম ভালবাসা, নিষ্ঠাপূর্ণ আগ্রহ ও আদবের কারণেই বোরাক্বটির মনোবাঞ্ছা পূরণ হল।
হুযূর বোরাক্বের পিঠে আরোহন করলেন। বোরাক্বটি একটু নেচে ওঠল। হযরত জিব্রাঈল ধমক   দিয়ে বললেন, “হে বোরাক্ব! তুমি জানো কি তোমার পিঠে কে আরোহন করছেন?” বোরাক্ব আতঙ্কিত মনে আরয করল, “আমি বাবুয়ানা করে এমন আচরণ করিনি, বরং আমার সৌভাগ্যের অবস্থা দেখে আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি।”
এখানে উল্লেখ্য, হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বোরাক্বে আরোহনের পূর্বক্ষণে একটু থেমে যান এবং কি যেন চিন্তা করছিলেন। হযরত জিব্রাঈল এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। হুযূর এরশাদ ফরমালেন, “আজ তো আমার উপর আল্লাহ্’র মহা অনুগ্রহ হচ্ছে। রহমত ও নূরের বৃষ্টি হচ্ছে। উর্ধ্বলোকে ভ্রমণের জন্য বোরাক্ব পাঠানো হয়েছে। কিন্তু ক্বিয়ামতের সঙ্কটময় সময়ে, পুলসিরাত্ব পাড়ি দেওয়ার সময় আমার উম্মতের কি অবস্থা হবে- তা ভাবছি।” তখন আল্লাহ্’র পক্ষ থেকে সুসংবাদ এল, “হে মাহবূব! আপনি চিন্তা করবেন না, আমি তাদের জন্য পুলসিরাত্ব পার হবার জন্য এমন ব্যবস্থা করব যে, তারা পার হয়ে যাবে অথচ টেরও পাবে না।” আ’লা হযরত এ সুসংবাদকে ছন্দে বলেছেন-
پل سے گذارو راہ گزر کو خبر نہ ہو- جبریل پر بچھائیں تو پر کو خبرنہ ہو
অর্থাৎ: পুল সেরাত্ব এমনিভাবে পার করিয়ে দিন, যেন পুল অতিক্রমকারীও টের না পায়। জিব্রাঈল পাখা বিছালে পাখাও যেন খবর না পায়।
সুসংবাদ শুনে হুযূর আনন্দিত হলেন। বোরাক্বে আরোহন করলেন। জিব্রাঈল বোরাক্বের ‘রিকাব’ ধরলেন। মীকাঈল ধরলেন লাগাম। ইস্রাফীল যীন স্থির রাখলেন। পঞ্চাশ হাজার ফিরিশতার জুলূসে সালাত ও সালামের রব ধ্বনিত হচ্ছিল। এভাবে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আক্বসার দিকে নূরানী জুলূস রওনা হল। দৃশ্যটি একটু  কল্পনা করুন সেটা কেমন ছিল! আমন্ত্রণকারী নূর, আমন্ত্রিত আরোহীও নূর, আরোহনের বাহনটিও নূর, অভ্যর্থনাকারীরাও নূর! মোটকথা, দুলহাও নূর, বরযাত্রীও নূর। চতুর্দিকে নূরেরই ছড়াছড়ি ছিল।
বোরাক্বও চলল দ্রুতগতিতে। দৃষ্টির দিগন্তে পড়ত সেটার প্রতিটি পরবর্তী কদম। মুহূর্তের মধ্যে এ নূরানী জুলূস বায়তুল মুক্বাদ্দাসে গিয়ে পৌঁছুল। বোরাক্বের গতি রাশিয়া-আমেরিকার তৈরি মিসাইল ও রকেটোর চেয়েও দ্রুতগামী ছিল। কারণ, এ গতি ছিল নূরেরই। তাক্বভিয়াতুল ঈমানের লেখক ইসমাঈল দেহলভী ও তার অনুসারীদের, নবীগণ সম্পর্কে ভুল ধারণা আশা করি এ থেকে ভাঙ্গবে। তারা সম্মানিত নবীগণকে, এমনকি আমাদের নবী, রসূলকুল সরদার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামও তাদের মতো মানুষ মনে করে থাকে। এটা ঈমান বিধবংসী আক্বীদা।
মি’রাজের প্রথম সোপানে, এ নূরানী কাফেলা বায়তুল মুক্বাদ্দাস যাবার সময় পথিমধ্যে মদীনা মুনাওয়ারায় উপনীত হলে হযরত জিব্রাঈল আরয করলেন, এখানে অবতরণ করুন এবং দু’রাক্‘আত নফল নামায পড়–ন। এটাই আপনার হিজরতগাহ্ মদীনা তাইয়্যেবাহ।
তারপর যাত্রাপথে ‘ওয়াদী-ই আয়মান’-এ পৌঁছলেও হযরত জিব্রাঈল সেটার পরিচয় করালেন- এটা ওই উপত্যাকা, যেখানে হযরত মূসা আলায়হিস্ সালামকে আল্লাহ্ পাক তাঁর সাথে সরাসরি কথা বলার সৌভাগ্য দান করেছেন। পথিমধ্যে একটি লাল রঙের টিলা অতিক্রম করার সময় দেখা গেল- হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম তাঁর মাযার শরীফে দাঁড়িয়ে নামায পড়ছেন।
এ থেকে নবীগণের ওফাতোত্তর হায়াত বা জীবিত থাকার মাসআলাও সুস্পষ্ট হয়।
বায়তুল মুক্বাদ্দাসে হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম থেকে আরম্ভ করে হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম পর্যন্ত সমস্ত নবী ও রসূল কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সবাই অপেক্ষমান। জায়নামায তখনো খালি ছিল। অতঃপর নবীকুল সর্দার সেটার উপর তাশরীফ নিয়ে গেলেন। হযরত জিব্রাঈল ‘সাখরা’য় আযান বললেন।  সুবহানাল্লাহ্, যে নামাযের মুআয্যিন ফিরিশতাদের সরদার আর ইমাম হলেন সমস্ত নবী ও রসূলদের সরদার, মুক্বতাদী হলেন- হযরত আদম, হযরত নূহ, হযরত ইব্রাহীম, হযরত মূসা ও হযরত ঈসা আলায়হিমুস্ সালামসহ সমস্ত নবী, ওই নামাযের শান কিরূপ হতে পারে! হুযূর-ই আক্রাম সবাইকে নামায পড়ালেন।
এর মাধ্যমে প্রমাণিত হল- আমাদের আক্বা ও মাওলা সমস্ত নবী ও রসূলের পরে দুনিয়ায় তাশরীফ আনলেও তাঁর মর্যাদা সবার চেয়ে বেশি, সৃষ্টির মধ্যে মর্যাদায় তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ।
মসজিদ-ই আক্বসা থেকে এবার উর্ধ্বলোকের দিকে সফর আরম্ভ হল। হুযূর এরশাদ ফরমান ثُمَّ عُرِجَ بِیْ  (অতঃপর আমাকে উপরের দিকে নিয়ে যাওয়া হল।) বোরাক্ব ও ফিরিশতাদের ওই জুলূস তখন আসমানের দিকে, রওনা হল। সালাত ও সালাম জারি ছিল। চোখের পলকে তাঁরা প্রথম আসমানে এসে পৌঁছলেন। হযরত জিব্রাঈল আসমানের দরজায় সঙ্কেত দিলেন। দারোয়ান আরয করল, “কে?” বললেন, “জিব্রাঈল।” দারওয়ান বলল, “আপনার সাথে কে?” জিব্রাঈল বললেন, “মুহাম্মদ।”(সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)। দারোয়ান বলল, “স্বাগতম! তাঁর জন্যই এ দরজা খোলা হবে।” প্রথম আসমানে হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম হুযূরকে স্বাগত জানালেন। একইভাবে দ্বিতীয় আসমানে আরোহন করলেন। এখানে হযরত ইয়াহ্য়া ও হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম স্বাগত জানালেন। তৃতীয় আসমানে আসলে সেখানে হযরত ইয়ূসুফ আলায়হিস্ সালাম-এর সাথে সাক্ষাৎ হল। চুতর্থ আসমানে পৌঁছলে সেখানে হযরত ইদ্রীস আলায়হিস্ সালাম স্বাগত জানালেন। পঞ্চম আসমানে হযরত হারূন আলায়হিস সালাম, ষষ্ঠ আসমানে হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম এবং সপ্তম আসমানে হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম’র সাথে সাক্ষাৎ হল। তাঁরা সবাই হুযূরকে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। এভাবে তাঁরা ‘সিদরাতুল মুন্তাহা’ পর্যন্ত পৌঁছুলেন। এখানে ফিরিশতাকুল সরদার হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম আরয করলেন,
اگریک سرموئے بر تر پرم-فروغ  تجلّی  بسو زد  پرم
অর্থাৎ: এখান থেকে এক চুল পরিমাণও যদি সামনে অগ্রসর হই, তবে আল্লাহ্ তা‘আলার নূররাশি ও জ্যোতিরাশি আমার পাখাগুলো জ্বালিয়ে ছাই করে ছাড়বে। এ পর্যন্তই আমার ক্ষমতা। কিন্তু হুযূর আরো সামনে যাচ্ছেন।
বিদায়ের প্রাক্কালে হুযূর হযরত জিব্রাঈলের উদ্দেশে বললেন, “জিব্রাঈল! তুমি আমার প্রপিতা হযরত খলীলুল্লাহ্ (আলায়হিস্ সালাম)কে বলেছিলে, ‘আমাকে বলুন, আমি কি সাহায্য করতে পারি! আমি ওখানে যেতে পারি, যেখানে কেউ যেতে পারে না।’ জিব্রাঈল, আজ দেখ! আমি ওখানে যাচ্ছি যেখানে তুমিও যেতে পারছ না। তোমার কোন পয়গাম থাকলে বলতে পার; আমি তা আল্লাহ্’র দরবারে আরয করে মঞ্জুর করিয়ে আনব।” হযরত জিব্রাঈল আরয করলেন, “আমি চাই আপনার উম্মতকে আমার পাখায় আরোহন করিয়ে পুলসেরাত্ব পার করাবো।” সুতরাং তা মঞ্জুর হল। ক্বিয়ামতে মু’মিনদের পুলসেরাত্ব পার হবার দৃশ্যও হবে বিরল ধরনের। হযরত জিব্রাঈল পাখা বিছাবেন আর হুযূর বলতে থাকবেন  رَبِّ سَلِّمْ اُمَّتِیْ رَبِّ سَلِّمْ اُمَّتِ (হে আল্লাহ্! আমার উম্মতকে নিরাপদে পার করে দাও, হে আল্লাহ্ আমার উম্মতকে নিরাপদে পার করে দাও)
এরপর হুযূর সিদরাতুল মুন্তাহা অতিক্রম করে যাচ্ছেন। হযরত জিব্রাঈল ও বোরাক্ব এখানেই রয়ে গেল। ‘মা‘আরিজুন্ নুবূয়াত’-এ এর পরবর্তী (মি’রাজের তৃতীয় সোপান) ভ্রমণের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এভাবেই-
অতঃপর হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- আমি একাকী রওনা হলাম। ৭০ হাজার নূরানী পর্দা অতিক্রম করলাম। প্রত্যেক পর্দার পুরুত্ব ছিল পাঁচশ বছরের রাস্তা। আর প্রতি দু’টি পর্দার মধ্যভাগের দূরত্বও ছিল পাঁচশ’ বছরের রাস্তা।
এক বর্ণনায় আছে, হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম’র যানবাহন বোরাক্ব এখানে এসে থেমে গেল। তখন সবুজ রঙের রফরফ প্রকাশ পেয়েছিল, যার আলো সূর্যের আলোর মত ছিল। তিনি ওই রফরফে আরোহন করে এগুচ্ছিলেন। এভাবে আরশের নিকট গিয়ে পৌঁছুলেন।
‘মাওয়া-হিবে লাদুন্নিয়া’র ৩৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে- হুযূর যখন আরশের নিকটে পৌঁছলেন, তখন আরশ তাঁর দামান ধরল, আর হুযূরও আরশের উপর আরোহন করলেন। আ’লা হযরত এর বর্ণনা ছন্দে দিয়েছেন-
وہی لامکان کا مکیں ہوئے  –  سرعرش تخت نشین ہوئے
وہ نبی ہے جس کے ہیں یہ مکاں  –  وہ خدا ہے جس کا مکاں نہیں
অর্থাৎ: তিনি লা-মকানে গিয়ে অবস্থান করেছেন, আরশের উপর তখ্ত-নশীন হয়েছেন। ইনি হলেন এমন নবী, যাঁর এই শান! উনি হলেন ওই খোদা, যিনি স্থান থেকে পবিত্র।
সামনে পর্দার পর পর্দা-ই দেখতে পান। সমস্ত পর্দা তুলে নেওয়া হল। শেষ পর্যন্ত একটা স্থান আসল যেখানে-
سراغ اَیْنَ و متیٰ کہاں تھا نشان کیف واِلٰی کہاں تھا-نہ کوئی
راہی نہ کوئی ساتھی نہ سنگ منزل نہ مرحلے تھے
অর্থাৎ: ‘কোথায়’ ও ‘কখন’-এর অস্তিত্ব ছিল না, ‘কেমন’ ও ‘কোন দিকে’-এর চিহ্নও ছিল না। না ছিল কোন পথিক, না ছিল কোন সাথী। না ছিল গন্তব্যের পাথর (চিহ্ন), না ছিল মাইল ফলক।
তারপর সাক্ষাতের জন্য সাদর আহ্বান আসল- ثُمَّ دَنٰی فَتَدَلّٰی فَکَانَ قَابَ قَوْسَیْنِ اَوْ اَدْنٰی
(তারপর ওই জ্যোতি নিকটবর্তী হল। অতঃপর খুব নেমে আসল। অতঃপর ওই জ্যোতি ও এ মাহবূবের মধ্যে দু’হাতের ব্যবধান রইল; বরং তদপেক্ষাও কম। [৫৩: ৮-৯]
তখন অতি মুহাব্বতপূর্ণ আহ্বান আসল  اُدْنُ مِنِّیْ (নিকটে আসুন)। হুযূর  دَنٰ (নিকটবর্তী হলেন)’র মক্বাম থেকে অগ্রসর হলেন।  فَتَدَلّٰىএর মক্বামে পৌঁছলেন। সেখান থেকে অগ্রসর হয়ে  قَابَ قَوْسَیْنِ-এর স্তরে উপনীত হলেন। তারপর وْاَدْنٰی (আরো নিকটে)’র মর্যাদায় উন্নীত হলেন। সাক্ষাৎ হল।
মিশকাত শরীফের ৬৮ পৃষ্ঠায় আছে। হযরত আবদুর রাহমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন-
قَالَ رَسُوْلُ اللّٰہِ صَلَّی اللّٰہُ عَلَیْہِ وَسَلَّمَ رَأَیْتُ رَبِّیْ فِیْ اَحْسَنِ صُوْرۃٍ فَوَضَعَ کَفَّہٗ
بَیْنَ کَتِفَیَّ فَوَجَدْتُّ بَرْدَھَا بَیْنَ ثَدِیَیَّ فَعَلِمْتُ مَا فِی السَّمٰوَاتِ وَالْاَرْضِ   (ملحضًا)
অর্থাৎ: রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান, আমি আমার রবকে (অতুলনীয়) সুন্দর আকৃতিতে দেখেছি। অতঃপর তিনি আমার উভয় স্কন্ধের মধ্যভাগে আপন কুদরতের হাত রাখলেন। এর ফলে আমি আমার বক্ষে ঠাণ্ডা অনুভব করেছি এবং যমীন ও আসমানের প্রত্যেক কিছু (সম্পর্কে) জানতে পেরেছি।
উল্লেখ্য, হুযূর-ই পাক মি’রাজের রাতে আল্লাহকে তাঁর যাহেরী চোখেই দেখেছেন। এ যাহেরী দীদারের বিষয়টি প্রায় সব ইমামের নিকট স্বীকৃত। ‘মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়া’র ৩৮ পৃষ্ঠায় বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা বলেছেন, আল্লাহ্ তা‘আলা হযরত ইব্রাহীমকে ‘খুল্লাৎ’ (খলীল হবার মর্যাদা), হযরত মূসাকে ‘সরাসরি কথা বলা’র এবং হুযূর মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হিস্ সালাম’কে ‘দীদার’ (সাক্ষাৎ) দ্বারা ধন্য করেছেন।
আল্লামা ইসমাঈল হাক্বক্বী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর তাফসীর-ই রূহুল বয়ান’র ১ম খণ্ডের ৫৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “এটা কীভাবে সম্ভব হতে পারে যে, এক সম্মানিত সত্তা আরেক সম্মানিতকে নিজের নিকট দাওয়াত দিয়ে আনবেন, বন্ধু বন্ধুকে দাওয়াত দেবেন আর নিজে গোপন করবেন! চেহারাটুকুওু দেখাবেন্ না?” শায়খ আবদুল হক্ব মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হিও একই ধরনের যুক্তি-প্রমাণ পেশ করেছেন।
প্রকৃতপক্ষে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ্ পাকের সাথে দীদার সাক্ষাৎ করেছেন। কেমন ছিল এ দীদার?
موسٰی زہوش رفت بیک جلوہئ صفات-تو  عین  ذات  می  نگرمی  د ر تبسّمی
অর্থাৎ আল্লাহ্’র সিফাতের নূরের একটি মাত্র ঝলক দেখে হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম হুঁশ হারিয়ে ফেলেন। আর হে হাবীব! সাল্লাল্লাহু আলায়কা ওয়াসাল্লাম আপনি আল্লাহ্’র সত্তা মুবারকই দেখেছেন হাসিমুখে।
আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান বেরলভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন-
اورکوئی  غیب کیا تم سے نہاں  ہو بھلا- جب نہ خداہی چھپاتم پہ کروڑوں درود
অর্থাৎ: হে আল্লাহ্’র হাবীব! যখন খোদ্ খোদা তা‘আলা আপনার নিকট গোপন থাকেননি, তখন এমন কোন্ জিনিস আছে, যা আপনার নিকট থেকে অদৃশ্য থাকতে পারে?
আমরা উম্মতের জন্য আনন্দের বিষয় হচ্ছে আল্লাহ্ পাকের সাক্ষাতের এমন সময় আমাদের আক্বা ও মাওলা আপন উম্মতের কথা স্মরণ করেছেন। আল্লাহ্ পাকও আপন হাবীবকে প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন যে, রোজ ক্বিয়ামতে হুযূরের সুপারিশ কবূল করবেন এবং তাঁর উম্মতকে ক্ষমা করবেন।
আরো লক্ষ্যণীয় যে, এ মহান রাতে এ ঘনিষ্ট সাক্ষাতে মহান দাতা রব্বুল আলামীন যা চেয়েছিলেন তা দিয়েছেন। আর মহান গ্রহীতা তাঁর হাবীবও ওই অনুগ্রহ গ্রহণ করেছেন। কি দিয়েছেন, আর কি নিয়েছেন তা মহান দাতা ও গ্রহীতাই জানেন।
এর চেয়ে বড় নি’মাত আর কি হতে পারে যে, মহান রব তাঁর হাবীবকে আপন দীদার দিয়ে ধন্য করেছেন। এখানে আমাদের আরো খুশীর ব্যাপার যে, আমাদের জন্যও মি’রাজ দিয়েছেন। তা’ হচ্ছে পাঁচ ওয়াক্বত নামাযের তোহ্ফা। হুযূর এরশাদ ফরমাচ্ছেন, اَلصَّلوٰۃُ مِعْرَاجُ الْمُؤْمِنِیْنَ (নামায মু’মিনদের জন্য মি’রাজ)।
শায়খ আবদুল হক্ব মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর ‘মাদারিজুন্ নুবূয়াত’-এ লিখেছেন- আল্লাহ্ তা‘আলা শবে মি’রাজে হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালামকে তিন ধরনের জ্ঞান দান করেছেন- ১. ওই জ্ঞান, যার সম্পর্কে এরশাদ করেছেন, “এটা আপনার জন্য খাস। আপনি ব্যতীত আর কেউ ওই জ্ঞানের ভার সহ্য করতে পারবে না।” ২. ওই জ্ঞান, যে সম্পর্কে হুযূরকে ইখতিয়ার দিয়েছেন। তিনি যাকে উপযুক্ত মনে করেন, যতটুকু চাইবেন দান করতে পারবেন এবং ৩. ওই জ্ঞান, যা সমস্ত সৃষ্টির জন্য ব্যাপক করেছেন। এ তৃতীয় ধরনের জ্ঞানের অবস্থা এ হল যে, -জীবনের এমন কোন শাখা নেই, যে সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞানগত সমাধান হুযূর দেননি। এতে অর্থনীতি, সমাজনীতি এবং ইবাদাত, আক্বাইদ বা বিশ্বাস সম্পর্কিত প্রতিটি বিষয়ে হুযূরের সুস্পষ্ট বাণী ও নির্ভুল দিকনির্দেশনা মওজূদ রয়েছে।
এ পবিত্র মি’রাজ রজনীতে তিনটি তোহফারও বিনিময় হয়েছে। মি’রাজে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম ৩টি তোহফা পেশ করেন। ওইগুলো হচ্ছে-
১. 1. اَلتَّحِیَّاتُ لِلّٰہِ  2. وَالصَّلَوَاتُ, 3. وَالطَّیِّبَاتُ (যথাক্রমে সমস্ত মৌখিক প্রশংসা, সমস্ত দৈহিক ইবাদত এবং সমস্ত আর্থিক ইবাদত)। তারপর আল্লাহ্ পাকও তিনটি তোহফা দিলেন-
১. 1. اَلسَّلَامُ عَلَیْکَ اَیُّھَا النَّبِیّ, 2. وَرَحْمَۃُ اللّٰہ  3. وَبَرَکَاتُہٗ (যথাক্রমে, হে নবী! আপনার উপর সালাম, আল্লাহ্’র রহমত এবং তাঁর বরকতসমূহ)। হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম ও এ সালাম, রহমত ও বরকত (যথাক্রমে শান্তি, দয়া ও কল্যাণ)-এ আপন উম্মতদেরও শামিল করে আরয করলেন-
اَلسَّلَامُ عَلَیْنَا وَعَلٰی عِبَادِ اللّٰہِ الصّٰلِحِیْنَ
(বরং শান্তি বর্ষিত হোক আমাদের উপর এবং আল্লাহ্’র নেক্কার বান্দাদের উপর) তারপর ঊর্ধ্ব জগতের ফিরিশতাগণ না’রা লাগালো-
اَشْھَدُ اَنْ لَآاِلٰہَ اِلَّا اللّٰہُ وَاَشْھَدُ اَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُہٗ وَرَسُوْلہٗ
উল্লেখ্য, এটাকে নামাযের তাশাহ্হুদ বানিয়ে আল্লাহ্ ও তাঁর হাবীব আমাদেরকে এর বরকত লাভের ব্যবস্থা করেছেন।
উল্লেখ্য, প্রিয় মুস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্’র দীদার ছাড়াও সিদ্রাতুল মুন্তাহা, র্আশ, র্কুসী, লাওহ, ক্বালাম, জান্নাত ও দোযখ ইত্যাদি আশ্চর্যজনক বিষয়াদি পরিদর্শন করেছেন, যে গুলো হচ্ছে ‘আল্ আয়াতুল কুবরা’ বা বড় বড় নিদর্শন। তিনি জান্নাতের দারোগা হযরত রিদ্বওয়ান এবং দোযখের দারোগা হযরত মালিকের সাথেও সাক্ষাৎ করেছেন। জান্নাতের নি’মাতরাজি ও জাহান্নামের শাস্তির দৃশ্যাবলীও দেখেছেন।
জাহান্নামে দেখেছেন নারীদের সংখ্যা পুরুষদের চেয়ে বেশি। অন্যান্য জঘন্য অপরাধীদেরকেও আযাবে লিপ্ত দেখেছেন। যেমন- একটি জনগোষ্ঠীকে দেখেছেন, ফিরিশতাগণ বড় বড় পাথর দিয়ে তাদের মাথায় আঘাত করে সেগুলো ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলছেন। তারপর তাদের মাথাগুলো আবার ঠিক হয়ে যাচ্ছে। হযরত জিব্রাঈল আমীন বর্ণনা করছেন- এরা ওই সব লোক, যাদের মাথায় ফরয নামায ভারী মনে হচ্ছিল। তাই তারা নামায পড়ত না।
একটি দল কাঁটা বিশিষ্ট ঘাস ও যাক্কুম ফল খাচ্ছিল। ওইগুলো তাদের কন্ঠে আটকে পড়ছিল। এরা ছিল ওই সব লোক, যারা যাকাত দিত না।
আরেকটি দলকে দেখেছেন, কাঁচি দিয়ে ফিরিশতাগণ তাদের জিহ্বা ও ওষ্ঠগুলো বারবার কাটছিলেন। হযরত জিব্রাঈল বললেন, এরা হচ্ছে خُطَبَآءُ الْفِتْنَ (অর্থাৎ ওই সব মুফাসসির-বক্তা, যাদের ওয়ায-বক্তৃতায় মানুষ পথভ্রষ্ট হত, ফিৎনা-ফ্যাসাদে লিপ্ত হত)।
আরেকটা দলকে দেখলেন, যাদের পেটগুলো বড় বড় গম্বুজের মত, ওইগুলো বিষাক্ত সাপে ভর্তি ছিল। তারা যখন ওঠে দাঁড়াতে চাইত, তখন পতিত হত। হযরত জিব্রাঈল বললেন, এরা হচ্ছে اَکَلَۃُ الرِّبَا (সুদখোর)। [যারক্বানী: ৬ষ্ঠ খণ্ড: ৪২ পৃষ্ঠা ও সিহাহ্ সিত্তাহ্]
অনুরূপ, হুযূর যখন জান্নাত পরিদর্শন করলেন, তখন আপন কিছু বিশেষ গোলামকে জান্নাতে দেখতে পেলেন। তিনি আপন কোন কোন উম্মতের জান্নাতী মহলগুলোও প্রত্যক্ষ করেছেন। হযরত বিলাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’কে হুযূরের আগে আগে দূতের ন্যায় চলতে দেখেছেন, হযরত আবূ ত্বাল্হা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র স্ত্রী হযরত রুমায়্সাকে তাঁর মহলে জান্নাতের নি’মাতরাজি উপভোগ করতে দেখেছেন। তা’ছাড়া হুযূর তাঁর অন্যান্য গোলামদের জান্নাতী মহলগুলোর সাথে সাথে হযরত ওমর ফারূক্ব-ই আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র বিশেষ মহলও দেখতে পান। মোটকথা, এ সব বড় বড় নিদর্শন দেখানোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে পবিত্র ক্বোরআনে- لِنُرِیَہٗ مِنْ اٰیٰتِنَ অর্থাৎ তাঁকে বড় বড় নিদর্শনসমূহ দেখানোর জন্যই এ মি’রাজ তথা ঊর্ধ্বলোক ভ্রমণের আয়োজন।
বিশুদ্ধ বর্ণনায় এসেছে যে, মি’রাজে আল্লাহ্’র সাথে হুযূরের সাক্ষাতে সালাম ও জবাবের পর-
تَکلَّمَ مَعَہٗ تسْعِیْنَ اَلفَ حِکَایَۃٍ اَسْرَارًا وَاخبَارا وَّاَحْکَامًا
অর্থাৎ: আল্লাহ্ পাক মি’রাজের দুলহা (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া ‘আলা- আ-লিহী ওয়া আসহাবিহী ওয়া বারাকা ওয়া সালাম)-এর সাথে নব্বই হাজার ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ওই গুলোর মধ্যে ছিল রহস্যাদি, কিছু সংবাদ আর কিছু আহকাম বা বিধানাবলী। [তাফসীর-ই আহমদী, ৩৩০পৃষ্ঠা]
সূরা ‘নাজম’-এ আল্লাহ্ তা‘আলা এ দিকে ইঙ্গিত করে এরশাদ করেছেন-  فَاَوْحٰی اِلٰی عَبْدِہٖ مَآاَوْحٰی (অতঃপর তিনি আপন বন্ধুকে ওহী করেছেন, যা ওহী করার ছিল) অর্থাৎ একান্ত সাক্ষাতে কথা বলেছেন, যা বলার ছিল। এ ইঙ্গিতকে কিছুটা খোলাসা করে ‘তাফসীর-ই আহমদী’র ২২৯পৃষ্ঠায় একটি বর্ণনার অবতারণা করা হয়েছে-
قَدْ اَوْحَی اللّٰہُ یَامُحَمَّدًا اَنَاوَاَنْتَ وَمَاسِوٰی ذٰلِکَ خَلْقُتۃ لِاَجْلِکَ
অর্থাৎ: “নিশ্চয় মহান আল্লাহ্ ওহী করেছেন- হে আমার অতি প্রশংসিত বন্ধু! আমি ও আপনি। আর এতদ্ব্যতীত   যা কিছু আমি সৃষ্টি করেছি সবই আপনার জন্য।”
এর জবাবে আরশের মেহমান আরয করলেন-
یَارَبِّ اَنَا وَاَنْتَ  وَمَا سِوٰی ذَلِکَ تَرَکْتُہٗ لِاَجْلِکَ
(হে আমার রব! আমি ও আপনি। আর এতদ্ব্যতীত যতকিছু আছে আমি আপনার জন্য ত্যাগ করেছি।)
এভাবে হুযূরের বক্ষ মুবারক এ রাতে জ্ঞানের ভাণ্ডার এবং আল্লাহ্’র মা’রিফাতের মহাসমুদ্র হয়ে গেছে। মহান আল্লাহ্ সমগ্র সৃষ্টির জ্ঞান হুযূরকে দান করে সৃষ্টির মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি জ্ঞানী (اَعْلَمُ الْْخَلْق) করে দিয়েছেন।
মি’রাজ শরীফ থেকে ওই রাতের একটি ক্ষুদ্রাংশেই পুণরায় ফিরে আসলেন আল্লাহ্’র হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। আল্লামা আলূসী তাঁর তাফসীর-ই রূহুল মা‘আনীর ১৫শ খণ্ডের ১২ পৃষ্ঠায়, আল্লামা ইসমাঈল হক্বক্বী হানাফী তাঁর তাফসীর-ই রূহুল বয়ানের ২য় খণ্ডের ৪০৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- যখন সাইয়্যিদে আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ফিরে আসলেন, তখনো ঘরের দরজার শিকল নড়ছিল, বিছানাও গরম ছিল এবং যাওয়ার সময় যে ওযূ করেছিলেন সেটার পানিও গড়াচ্ছিল। এক উর্দু কবি এ চিত্রটি তাঁর ছন্দে এভাবে বিধৃত করেছেন-
زنجیر بھی ہلتی رہی بستر بھی رہا گرم-سر عرش گئے اور آئے محمد  ﷺ
(তিনি যখন ফিরে আসলেন, তখন দরজার শিকলটিও নড়ছিল, বিছানাও গরম ছিল, এত স্বল্প সময়ে হুযূর মুহাম্মদ আলায়হিস্ সালাম র্আশের উপরে গিয়েছেন আর ফিরেও এসেছেন।)
হুযূরের ঊর্ধ্বজগতে যাওয়াতো স্বাভাবিক। হুযূর নূর, আল্লাহ্’র সর্বাধিক প্রিয় হাবীব। তাঁকে র্আশের উপর নিয়ে গিয়ে সমগ্র সৃষ্টিকে তাঁর কদম শরীফের নিচে রেখে দুনিয়াবাসীকে এটাই দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে যে,
بعد از خدا بزرگ توئی قصّۂ مختصر
(আল্লাহ্’র পর হে আল্লাহ্’র হাবীব! আপনারই মর্যাদা, এটাই সংক্ষিপ্ত তথা চূড়ান্ত কথা) ইত্যাদি তাঁরই জন্য শোভা পায়। কিন্তু ওই নূরুন্নবী আল্লাহ্’র পক্ষ থেকে উম্মতের জন্য অগণিত তোহফা নিয়ে আসাই হচ্ছে আশ্চর্যজনক ও আমাদের জন্য বড়ই সৌভাগ্যের।
হুযূর ফিরে এসে ওই ঘটনার কথা জানালেন। তারপর সত্যায়নের পালা। হুযূর সর্বপ্রথম হযরত উম্মে হানীকে বললেন। তিনি বললেন, “আপনি এ ঘটনা ব্যাপকভাবে প্রকাশ করবেন্ না, লোকেরা অস্বীকার করবে।” কিন্তু হুযূর এরশাদ ফরমালেন, “আমি সত্য কথা প্রকাশ করতে কখনো কুন্ঠাবোধ করতে পারি না। কেউ তা সত্য বলে মেনে নিক, কিংবা মেনে না নিক।” আবূ জাহ্ল এ ঘটনা শুনা মাত্র হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব  রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র নিকট ছুটে গেল। বলল, “তুমি কি শুনেছ- মুহাম্মদ কি বলছে? এ কথাকি কখনো মেনে নেওয়া যেতে পারে যে, এত স্বল্প সময়ে বায়তুল মুক্বাদ্দাস ও আসমানগুলো পরিভ্রমণ করে এসেছেন।” হযরত আবূ বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন, لَئِنْ قَالَ لَصَدَقَ (যদি তিনি বলে থাকেন তবে তিনি অবশ্যই সত্য বলেছেন।) তাঁর পবিত্র মুখে কখনো মিথ্যা আসতে পারে না।” এ সত্যায়নের জন্য তিনি ‘সিদ্দীক্ব’ হয়ে গেলেন।
কবি বলেন- عقل قربان کن بہ پیش مصطفٰے (নিজের বিবেক-বুদ্ধিকে মুস্তফা’র সামনে উৎসর্গ কর।) সমস্ত সাহাবীও এ ঘটনা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে নিয়েছেন। কিন্তু কাফিরগণ তা নিয়ে হৈ চৈ শুরু করে দিল। এখন তাদের যাচাই-বাছাই’র পালা।
সুতরাং আবূ জাহ্ল হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম’কে বলল, “আপনি কি এ কথা সমগ্র সম্প্রদায়ের সামনে বলতে প্রস্তুত আছেন?” হুযূর এরশাদ ফরমালেন, “নিশ্চয়।” আবূ জাহল কাফিরদের ডেকে একত্রিত করল। হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পূর্ণ ঘটনা শুনালেন। তারা তালি বাজালো, উপহাস করল। এক কাফির বলল, “আজ পর্যন্ত আপনি তো বায়্তুল মুক্বাদ্দাস যাননি। বলুন তো সেটার স্তম্ভ ও দরজা ক’টি?” তাৎক্ষনিকভাবে হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস সালাম বায়তুল মুক্বাদ্দাসকে হুযূরের সামনে হাযির করলেন, আর হুযূর স্তম্ভ ও দরজার সংখ্যা ইত্যাদি দেখে দেখে বলে দিলেন। কাফিরগণ বলল, “হয়তো কারো থেকে শুনে মুখস্থ করে নিয়েছেন। কোন নতুন প্রমাণ উপস্থাপন করুন।”
এক কাফির বলল, “আমাদের ব্যবসায়িক কাফেলাগুলো আসছে। আপনি কি তাদের কাউকে পথিমধ্যে দেখতে পেয়েছেন?”
হুযূর এরশাদ ফরমালেন, “হ্যাঁ, তিনটি কাফেলা দেখেছি। প্রথম কাফেলাকে দেখেছি ‘রাওহা’ নামক স্থানে। এ কাফেলা আগামী বুধবার সূর্যাস্ত নাগাদ এখানে পৌঁছে যাবে। আমি দেখেছি তাদের একটি উট হারিয়ে গিয়েছিল। আর তারা তা তালাশ করছিল। তারা খুব বিমর্ষ ছিল। আমি তাদেরকে আওয়ায দিলাম। বললাম, অমুক জায়গায় উটটি আছে। “তারা আশ্চর্যান্বিত হয়েছে, এখানে ‘মুহাম্মদ’র (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) আওয়াজ কোত্থেকে?
দ্বিতীয় কাফেলাকে দেখেছি ‘যী-মারওয়া’য়। ওই কাফেলা আগামী বুধবার নাগাদ এখানে পৌঁছে যাবে। তাদের দু’জন লোক উটের উপর আরোহনরত ছিল। যখন তাদের পাশ দিয়ে আমার বোরাক্ব সবেগে যাচ্ছিল তখন উটটি ভয় পেয়ে গিয়েছিল এবং উভয় আরোহীকে নিচে ফেলে দিয়েছিল।
তৃতীয় কাফেলাকে ‘তান‘ঈম’-এ দেখেছি। ও কাফেলার অগ্রভাগে সারি সারি উট চলছিল। এক উষ্ট্রারোহীর ঠাণ্ডা অনুভূত হচ্ছিল। তখন সে আপন ক্রীতদাসের নিকট কম্বল চাচ্ছিল। এ কাফেলা নিকটে এসে গেছে। সূর্য উদয়ের সাথে সাথে এখানে পৌঁছে যাবে।”
সুতরাং সৃষ্টিকুল সরদার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম যেমনি বলেছেন তেমনি হয়েছে। হুযূরের বর্ণনানুযায়ী যথাসময়ে কাফেলাগুলো এসে পৌঁছেছে। কাফিরগণ কাফেলাগুলোকে ওইসব নিদর্শন জিজ্ঞেস করেছে। হুযূর যা যা বলেছেন সবই তারা সত্য বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। এরপর অনেক কাফির ইসলাম গ্রহণ করেছে।
পরিশেষে, এ কথা সুস্পষ্ট হল যে, রসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র মি’রাজ শরীফ হচ্ছে একটি অসাধারণ মু’জিযা। এটা একদিকে আল্লাহ্ পাকের অসীম ক্ষমতার প্রমাণ বহন করে। অপরদিকে সৃষ্টিকুল সরদার মহানবীর মহান মর্যাদা প্রকাশ পায় এ অলৌকিক ঘটনায়। হুযূর যে সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহ্’র সর্বাধিক প্রিয়, সর্বাধিক জ্ঞানী, সর্বাধিক ক্ষমতার অধিকারী, আল্লাহ্’র প্রধানতম প্রতিনিধি এবং সশরীর অসাধারণ নূর, সর্বোপরি উম্মতের প্রতি অসাধারণ দয়া পরবশ ইত্যাদি তা বিশেষভাবে প্রমাণিত হয় মি’রাজ শরীফের অলৌকিক ঘটনায়। আল্লাহ্ পাকের বিশেষ ব্যবস্থাপনায় এ মি’রাজ বা অলৌকিক ভ্রমণ করানোর মধ্যে অগণিত হিকমত বা রহস্য নিহিত রয়েছে।
আসুন, আমরা হুযূরের মি’রাজ শরীফের ঘটনার প্রতিটি দিক নিয়ে সম্যক জ্ঞান অর্জন করে গভীরভাবে চিন্তা করি প্রতিটি বিষয় নিয়ে, কাজে লাগাই আমাদের মধ্যে খোদাপ্রদত্ত বিবেককে। তখন বুঝতে পারব আমরা কতই ধন্য এ মহান রসূলের উম্মত হতে পেরে। নবীর মহামর্যাদা ও অতুলনীয়তা অনুধাবনে আমরা আরো বেশি ধন্য হব।  এ জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি তাদেরকেও যারা নবী পাককে তাদের মত মানুষ মনে করে, যারা হুযূরের নূরানিয়্যাতকে অস্বীকার করে, যারা নিজেদের মুসলমান দাবী করে কাফিরদের সূরে কথা বলে নবীর শানে বেআদবী করে। আল্লাহ্ পাক সবাইকে সত্য অনুধাবন করার শক্তি দিন, আমাদেরকেও ধন্য করুন ওই সব নি’মাত থেকে কিছু দান করে, যা’ তাঁর হাবীবের মাধ্যমে ওই রাতে উম্মতের জন্য দান করেছেন। আ-মী-ন।
[সূত্র. গাউসিয়া তারবিয়াতি নেসাব, পৃ. ৩৯০-৪০৪পৃ.]