মন্দ চরিত্র

মন্দ চরিত্র

মানুষ আশরাফুল মাখলুক্বাত তথা সৃষ্টির সেরা। এই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জিত হয় اَخْلاَقِ حَسَنَه  তথা চারিত্রিক গুণের মাধ্যমে। সৎ চরিত্র দ্বারা যেমন মানুষ সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে, তেমনি অসৎ চরিত্র দ্বারা সে জীবজন্তুর চেয়েও নিকৃষ্ট হয়ে যায়। মন্দ চরিত্রের লোককে কেউ পছন্দ করে না। এমনকি অতি আপনজনও তাকে ঘৃণা করে। ফলে মন্দ কাজগুলো চিহ্নিত করে সম্পূর্ণ পরিহার করা একান্ত প্রয়োজন। আর এ মন্দকাজগুলো হচ্ছে হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, পরনিন্দা, অহংকার, মিথ্যা, রিয়া, রাগ, তোষামোদ, গালি-গালাজ, মদ, ব্যভিচার, জূয়া ইত্যাদি। এসব মন্দ কাজের খারাপ পরিণতি সম্পর্কে ক্বোরআন-হাদীসে বিশদ বর্ণনা রয়েছে এবং ওইগুলো পরিত্যাগ করার কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিছু মন্দ কাজের পরিচিতি ও পরিণতি সম্পর্কে ক্বোরআন-হাদীসের আলোকে নিম্নে আলোচনার প্রয়াস পাচ্ছিঃ
হিংসা-বিদ্বেষ
আরবীতে হিংসা-বিদ্বেষকে ‘হাসাদ’ বলে। حسد শব্দের অর্থ হলো কারো নি’মাত ও সুখ সাচ্ছন্দ্য দেখে মনে মনে জ্বলে ওঠা ও তার অবসান কামনা করা। ইমাম নাওয়াভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, অন্যের প্রাপ্ত নি’মাতের বিনাশ কামনা করাই হল হাসাদ। [রিয়াদ্বুস্ সালেহীন, পৃষ্ঠা- ৫৯১]
এ হিংসা হারাম ও মহাপাপ। শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, আসমানে সর্বপ্রথম সংঘটিত গুনাহ- হিংসা, যা অভিশপ্ত শয়তান থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
হযরত আদম আলায়হিস্‌ সালাম-এর বিরুদ্ধে, আর পৃথিবীতেও সর্বপ্রথম গুনাহ-হিংসা, যা আদম আলায়হিস্‌ সালাম-এর পুত্র হাবীলের বিরুদ্ধে ক্বাবিল থেকে প্রকাশিত হয়েছে।         [তাফসীরে আযীযী, পৃষ্ঠা- ২৯৭]
এই হিংসার কারণেই তাঁর ভাইয়েরা হযরত ইয়ূসুফ আলায়হিস্‌ সালামকে স্বীয় পিতা ইয়াক্বুব আলায়হিস্‌ সালাম থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন। ইহুদী, নাসারা দ্বীন-ইসলামকে অস্বীকার করেছে হিংসার কারণে। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
وَدَّّ کَثِیْرٌ مِّنْ اَہْلِ الْکِتَابِ لَوْ یَرُدُّ وْنَکُمْ مِنْ بَعْدِ اِیْمَانِکُمْ کُفَّارًا حسدًا
অর্থাৎঃ আহ্‌লে কিতাবের অনেকেই হিংসা বশতঃ চায় যে, মুসলমান হওয়ার পরও তোমাদেরকে কোন রকমে কাফির বানিয়ে দেবে।  [সূরা বাক্বারা, আয়াত- ৪৩]
হিংসা এমন এক মারাত্মক ব্যাধি, যার কোন ঔষধ নেই, চিকিৎসা নেই। হিংসুক নিজেই হিংসার আগুনে জ্বলে থাকে। হিংসার আগুন অপরকে পোড়াতেও পারে, নাও পারে, কিন্তু সে আগুনে হিংসুক নিজে জ্বলবে- এতে কোন সন্দেহ নেই। হিংসুকের কোন ইবাদত আল্লাহর দরবারে ক্ববূল তো দূরের কথা; পৌঁছবেও না। কেননা হিংসা হিংসুকের যাবতীয় ইবাদত নষ্ট করে দেয়।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু তাজ্ঞআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
اِیَّاکُمْ وَالْحَسَدَ فَاِنَّ الْحَسَدَ یَأْکُلُ الْحَسَنَاتِ کَمَا  تَأْکُلُ النَّارُ الْحَطَبَ
অর্থাৎঃ তোমরা হিংসা-বিদ্বেষ থেকে বেঁচে থাকো, কেননা হিংসা মানুষের সৎকর্মসমূহকে খেয়ে (নষ্ট করে) ফেলে, যেমনিভাবে আগুন শুকনো লাকড়িকে জ্বালিয়ে ছাই করে দেয়। [আবু দাঊদ শরীফ]
অন্যত্র নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لَاتَبَاغَضُوْا وَلَا تَحَاسَدُوْا وَلَا تَدَابَرُوْا وَکُوْنُوْا عِبَادَ اللّٰہِ اِخْوَانًا وَلَا یَحِلُّ لِمُسْلِمٍ اَنْ یَّہْجُرَ اَخَاہُ فَوْقَ ثَلاَثِہِ اَیَّامٍ
অর্থাৎঃ তোমরা পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করো না। পরস্পরের প্রতি মুখ ফিরিয়ে রেখো না, বরং আল্লাহর বান্দা হিসেবে পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাও। আর কোন মুসলমানের পক্ষে অন্য মুসলমান ভাইয়ের প্রতি তিনদিনের বেশী সময় পর্যন্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে রাখা জায়েয নয়।   [বুখারী ও মুসলিম শরীফ]
নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হিংসা-বিদ্বেষকে দ্বীন মুণ্ডনকারী মারাত্মক ব্যাধি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে-
ذُبَّ اِلَیْکُمْ دَآءُ الْاُمَمِ قَبْلَکُمُ الْحَسَدُ وَالْبَغْضَآءُ ہِیَ الْحَالِقَۃُ لاَ اقول تُحَلِّقُ الشَّعْرَ لٰکِنْ تُحَلِّقُ الدِّیْنَ
অর্থাৎঃ পূর্ববর্তী উম্মতের ব্যাধি তোমাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে; তা হল হিংসা-বিদ্বেষ। এটা মুণ্ডনকারী ব্যাধি। (নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন) আমি চুল মুণ্ডনকারী বলছি না বরং দ্বীন মুণ্ডনকারী।[মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা- ৪২৮]
ইমাম গাযালী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, হযরত মূসা আলায়হিস্‌ সালাম একদা এক ব্যক্তিকে আরশে আ’যমের ছায়ায় দেখে আল্লাহর দরবারে আরয করলেন, হে আল্লাহ! এ ভাগ্যবান ব্যক্তি কে? আল্লাহ উত্তর দিলেন তিনটি আমল দ্বারা সে নৈকট্য অর্জন করেছেঃ ১. সে কখনো কারো প্রতিহিংসা করেনি। ২. সে কোন দিন পিতা-মাতার অবাধ্য হয়নি এবং ৩. সে কোন দিন চোগলখোরী করেনি। [ইহ্‌ইয়াউল উলূম]
হিংসা এমন এক ভয়ঙ্কর ব্যাধি যে, অজ্ঞ লোক তো বটেই, বড় বড় সাধক দরবেশকেও কাবু করে নেয়। এমনকি তাদেরকে দুনিয়াতে সর্বনাশ করে পরকালে জাহান্নামে পৌঁছিয়ে দেয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ছয় প্রকারের লোক ছয়টি কারণে জাহান্নামে প্রবেশ করবেঃ আরবগণ স্বজনপ্রীতির কারণে, আমীর-উমারার দল নিপীড়ন-নির্যাতনের কারণে, ব্যবসায়ীগণ খেয়ানতের কারণে, পল্লীবাসীরা মূর্খতার কারণে এবং পীর ও আলিমগণ হিংসার কারণে। [মিনহাজুল আবেদীন, বাংলা, পৃষ্ঠা- ১১৬]
ইমাম গাযালী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, হিংসা সাধারণত পাঁচটি অনিষ্ট করেঃ
১. পূণ্য বিনষ্ট করে।
২. পাপ ও নাফরমানীর প্রেরণা যোগায়।
৩. অহেতুক হয়রানী ও দুশ্চিন্তার উদ্ভব ঘটায়, অধিকন্তু পাপ বৃদ্ধি করে।
৪. হিংসার প্রভাবে হিংসুটের হৃদয় দৃষ্টিহীন হয়ে যায় ও
৫. অবমাননা ও লাঞ্ছনার অভিশাপ ডেকে আনে।   [প্রাগুক্ত]
হিংসুক উভয় জগতে ক্ষতিগ্রস্ত। হিংসুকের হিংসার কারণে হিংসাকৃত ব্যক্তির নি’মাত বন্ধ হবে না বরং বাড়বে। ফলে যত নি’মাত বাড়বে তত হিংসুকের অন্তরের জ্বলনও বেড়ে যাবে। হিংসার আগুন অন্যকে জ্বালাবে কিনা সন্দেহ থাকে; কিন্তু হিংসুককে জ্বালাবে এতে কোন সন্দেহ নেই। কারো নি’মাত দেখে হিংসা হওয়া মানে আল্লাহর বন্টনে নারায হওয়া।
ইমাম গাযালী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, হযরত যাকারিয়া আলায়হিস্‌ সালাম এর বাণী- আল্লাহ তা’আলা বলেন, আমার বান্দার প্রতি প্রদত্ত নি’মাত দেখে হিংসা করা মানে আমার বন্টনে নারায হওয়া।[খুৎবাতে গাযালী, পৃষ্ঠা- ১০২]
আল্লাহর কাজে নারায হওয়া কুফ্‌রী। আর পরকালের ক্ষতি হল দুনিয়ায় হিংসার কারণে তার সব আমল নষ্ট হয়ে যাবে; ফলে ক্বিয়ামত দিবসে আমল শূন্য অবস্থায় উঠবে। অথবা হিংসুকের আমল হিংসাকৃত ব্যক্তির আমল নামায় লিখা হবে, ফলে হিংসুককে আমল বিহীন অবস্থায় জাহান্নামে যেতে হবে।
অতএব, হিংসা সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য। তবে ঈর্ষা জায়েয। ঈর্ষাও এ অর্থে যে, নি’মাতের অধিকারী ব্যক্তির নি’মাত ধ্বংস কামনা না করে নিজেই অনুরূপ ব্যক্তির নি’মাত লাভের প্রত্যাশা করা। যেমন কারো ধন-দৌলত, জ্ঞান, গরিমা, তাক্ওয়া-পরহেয্‌গারী দেখে ওদের মত নিজের জন্য আল্লাহর কাছে তা প্রার্থনা করা। এটা মন্দ নয়; বরং উত্তম।
যেমন হাদীস শরীফে আছে- যারা নবীও নন, শহীদও নন; কিন্তু ক্বিয়ামতের দিন তাদের মর্যাদা দেখে নবীগণ ও শহীদগণ আল্লাহর কাছে ঈর্ষা করবেন।   [মিশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা-৪২৬]
তাই হিংসা পরিত্যাগ করে ঈর্ষা গ্রহণ করে দুনিয়া-আখেরাতের সফলতা অর্জনে সদা সচেষ্টা থাকা উচিত।

[গাউসিয়া তারবিয়াতী নেসাব, পৃ. ৪৫৭]

গাউসিয়া তারবিয়াতী নেসাব