নারী জাতির উত্তম আদর্শের নমুনা হযরত ফাতেমাতুয্ যাহরা 

নারী জাতির উত্তম আদর্শের নমুনা হযরত ফাতেমাতুয্ যাহরা 

শেখ মুহাম্মদ ইব্রাহীম

হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা জমাদিউস্ সানী মাসের ২০তারিখ, সকালে মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র পবিত্র ঘর আলোকিত করে হযরত খাদীজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা-এর গর্ভে পৃথিবীর বুকে আবির্ভুত হন। হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা-এর জন্মগ্রহণের পর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম খুবই আনন্দিত হন এবং আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করেন হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা-এর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা ভাবনা করে।

মক্কার কুরাইশরা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দাম্পত্য জীবনকে সহজভাবে মেনে নেয়নি, তারা সবসময় শত্রুতাভাব পোষণ করতো। এর মধ্যে আল্লাহর হুকুমে একে একে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পুত্র সন্তানেরা মারা গেলে কাফির-মুশরিকরা রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে ঠাট্টা করতে থাকে। তাদের নেতা আস ইবনে ওয়ায়েল রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ‘আবতার’ অর্থাৎ নির্বংশ বলে গালি দিয়ে বলতো, আরে মুহাম্মদের তো কোন পুত্র সন্তান নেই, সে মারা গেলে তার নাম নেয়ার মতো তো কেউ আর থাকবে না।’’
এই অর্বাচীন কথাবার্তায় তিনি খুবই মনে কষ্ট পেতেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সূরা কাওসার নাযিল হয়। তাতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়। ‘‘আমি অবশ্যই আপনাকে কাউসার দান করেছি। সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন এবং কুরবানী করুন। নিশ্চয়ই আপনার প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারীই তো নির্বংশ।’’ ওই সূরাতেই নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সান্তনা দেন। তিনি অনুধাবন করতে সক্ষম হন, মহান আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর এ কষ্ট দূর করার জন্য যে অমূল্য নি’মাত তাঁকে দান করেন, তিনি হলেন আদরের নয়নমনি হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা। এরই পরিপ্রেক্ষিতেই পবিত্র ক্বোরআনের সূরা কাওসার নাযিল হয়। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ভাগ্যবতী শিশুকন্যা জন্মগ্রহণ করার পরই তাঁর পবিত্র নাম রেখেছিলেন ফাতিমা। ফাতিমা ছাড়াও তাঁর গুণবাচক নাম সিদ্দিক্বা, যাকিয়্যাহ, রাবিয়্যা, মারযিয়্যা, মুবাশ্শিরা, মুহাদ্দিসাহ্, সাইয়্যেদা, জাহরা, বতুল ইত্যাদি। এসব গুণবাচক নামগুলো অর্থসহ ছিল যা তাঁর পুত-পবিত্র চরিত্রের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। যেমন সিদ্দিকা (বিশ্বাসী), যাকিয়্যাহ্ (সতী সাধ্বী, কঠোর ত্যাগ সাধনার মাধ্যমে আত্মা ও দেহ-মনকে পবিত্র রাখতেন), মারযিয়্যাহ্ (আল্লাহর মর্জির উপর নির্ভরশীল ও অনুগ্রহ কামনাকারী) সুবারিয়্যাহ্ (শুভত্রী), মুহাদ্দিসাহ্ (জ্ঞানী-বিশারদ) সাইয়্যেদা (শ্রেষ্ঠ এবং সর্দার) জাহরা বতুল (পার্থিব সুখ বর্জনকারী)।
সবচেয়ে প্রসিদ্ধ উপাধি হলো ‘যাহ্রা’। তাই তিনি হযরত ফাতিমাতুয্ যাহ্রা নামে সমধিক পরিচিত। তিনি অবশ্য অতুলনীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে শ্রদ্ধার সাথে অনেক নামে ও উপাধিতে ভূষিত ছিলেন। যেমন পরবর্তীতে তিনি ‘খাতুনে জান্নাত’ অর্থাৎ বেহেশতের রমনীদের সর্দার এবং ‘নবী নন্দিনী’ হিসেবে বিভূষিত ছিলেন।

হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা-এর শৈশবকাল
শৈশবকাল হতেই হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা আরাম আয়েশ পরিত্যাগ করে অনাড়ম্বর জীবন-যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। পার্থিব জগতের ভোগ-বিলাসের প্রতি তাঁর কোন আগ্রহ ছিল না, তিনি পরকালের পাথেয় সংগ্রহে সর্বদা ব্যস্ত থাকতেন। তাই বলে সাংসারিক গৃহস্থালী কর্মে উদাসীন ছিলেন না, স্বহস্তে কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে পারিবারিক কাজ-কর্ম সুচারুরূপে সামাল দিতেন। কাপড়-চোপড়, দামী পোষাক-পরিচ্ছেদের প্রতি বাল্যকাল থেকেই তাঁর অনীহাভাব প্রকাশ পেতো। অতি সাধারণ সহজ-সরলভাবে তাঁর বাল্যকাল গড়ে উঠেছিল। তিনি পাড়া-প্রতিবেশী সমবয়সী ছেলে-মেয়ের সাথে কোন ধরনের হাসি-ঠাট্টা, কৌতুকের সাথে জড়িত হতেন না, এসব কিছুকে এড়িয়ে চলতেন।
ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর দু’কন্যা হযরত আসমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা ও হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা, দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর কন্যা হযরত হাফসা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা এবং হযরত জুবাইর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর কন্যা হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা সহ অনেকেই ছিলেন হযরত ফাতিমাতুয্ যাহ্রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা-এর শৈশবকালের সাথী।

তিনি শৈশব কাল থেকেই অযথা বাইরে ঘুরাফিরা পছন্দ করতেন না। মাতা জীবিত থাকালীন তিনি গৃহে মাতার পরম সাহচর্যে থাকতে অধিক পছন্দ করতেন। কেননা অনুপম চরিত্রের অধিকারী মায়ের চাল-চলন, কথা-বার্তা, আদেশ-উপদেশ অনুকরণ করে তাঁর মতো জীবন গঠন করার ইচ্ছা শৈশবকাল হতেই তাঁর মধ্যে জাগ্রত ছিল। তাঁর অদম্য ইচ্ছাশক্তির প্রভাবে জ্ঞানে-গুণে, আদর্শে ও চরিত্রে সকল নারীদের শীর্ষে হযরত ফাতেমাতুয্ যাহ্রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা-এর নাম স্থান পেয়েছে। শৈশবে মাতা খাদীজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহাকে হারিয়ে তিনি পিতৃস্নেহে লালিত-পালিত হচ্ছিলেন। পিতা তাঁকে মায়ের আদর, স্নেহ-মমতা দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন। মায়ের অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা পিতা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর একান্ত সান্নিধ্যে এসে তাঁর খিদমতে নিজেকে সপে দেন- যাঁর খিদমতের বিনিময়ে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে সমগ্র নারী জাতির শীর্ষ আসনে সমাসীন করেন।

মাতা হযরত খাদীজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-এর ইন্তিকাল
হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা বাল্যকালেই তাঁর মাতা উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদীজা (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা)কে হারান। বাল্যকালেই তিনি মাতার আদর-স্নেহ-মমতা থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। হযরত খাদীজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা তাঁকে খুব বেশী আদর স্নেহ করতেন। সযতেœ লালন-পালন করেছেন। হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহাও মাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। তাই মায়ের কথা মনে পড়তেই কান্না ভেজা কন্ঠে পিতাকে বললেন, মায়ের কথা মনে পড়লে তাঁর কিছুই ভালো লাগে না।

হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা তখন আবদারের সুরে পিতা প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে বললেন, আপনি ফিরিশতা জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালামকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, পরপারে আমার মাতা কেমন আছেন? মাতৃহারা আকুল মেয়ে ফাতিমার কথা শুনে তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হলেন। আদরের দুলালীকে আবেগ জড়ানো কন্ঠে স্নেহের সুরে শান্তনা দিয়ে বললেন, ‘‘হে ফাতিমা! তোমার মায়ের মতো মা পৃথিবীতে ক’জন আছে, তুমি তা কি একবারও ভেবে দেখেছো? আমার দৃঢ় বিশ্বাস, রাহমানুর রাহীম আল্লাহ্ তা‘আলা বেহেশতের মধ্যে তোমার মাকে শান্তিতে রেখেছেন।’’ তুমি তাঁর জন্য কোন চিন্তা করবে না। বরং সব সময় তাঁর মাগফিরাতের জন্য আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করবে।

হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার শিক্ষা লাভ
প্রত্যেক শিশু মাতা-পিতার মায়া-মমতার স্নেহের ছায়াতলে থেকে যে শিক্ষা লাভ করে তা হলো ভবিষ্যত জীবনে গড়ে উঠার মূল ভিত্তি। শৈশবকাল গৃহের মধ্যে পিতা-মাতার পরম সান্নিধ্যে থেকে আচার-আচরণ, চাল-চলন, আদব-কায়দা, স্বভাব-চরিত্রের যে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে তা সুপ্ত কোমলমতী হৃদয়ে স্থান করে নেয়। হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা-এর শৈশবে সুন্দরভাবে গড়ে ওঠার এই সৌভাগ্য হয়েছিলো।
মহান রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রিয় হাবীবকে সর্বজ্ঞানে জানী করে তোলেন। তাওহীদের মহান বাণীসমূহ তাঁর হৃদয়ে গ্রথিত করে দেন। এই মহান তাওহীদের বাণীসমূহ সময় ও সুযোগ পেলে সন্তান-সন্তুতি, স্ত্রী-পরিবার পরিজনকে শুনাতেন সত্য ও ন্যায়ের প্রতি তাঁদের আকৃষ্ট ও মনযোগী করার জন্য। হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা পিতার স্নেহ-ছায়ায় ও মাতার আদরে থেকে ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহ শিক্ষালাভ করে একজন আদর্শময়ী নারী হিসেবে গড়ে ওঠে ছিলেন। আল্লাহর মহান কৃপায় হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা প্রখর মেধা ও প্রচুর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি দ্বীনের সকল বিষয়ে প্রয়োজনীয় সকল তারবিয়াতের শিক্ষা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।
প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আদরের দুলালীকে স্বীয় আমল আখলাক অনুযায়ী সার্বিক শিক্ষা দিয়ে বিশ্বের মহিলাদের মধ্যে সর্বযুগের সর্বোত্তম আদর্শের নমুনা হিসেবে গড়ে তুলেছেন।

বিবাহের পয়গাম বা প্রস্তাব
হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা-এর রূপ-গুণ, নম্রতা-ভদ্রতা, আচার-ব্যবহার, স্বভাব-চরিত্র, কথাবার্তা, শালীনতা, পরোপকারীতা, ইবাদত-বন্দেগী, তাক্বওয়া, সুতীক্ষè প্রজ্ঞা, কর্মোদ্দীপনা সব রকমের মহত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সুনাম তখনকার সবার জানা ছিল। যার কারণেই অনেকেই নবী দুলালী হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহাকে জীবন সঙ্গীনী হিবেবে পাওয়ার জন্য আগ্রহভরে নবীজির দরবারে উপস্থিত হয়ে তাঁর কাছে সশ্রদ্ধভাবে বিয়ের প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে সর্বপ্রথম হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তারপর হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু প্রস্তাব পেশ করলে তাঁদের আবেদনে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কোন প্রকার সাড়া দেননি।

পরিশেষে, আল্লাহ্র ইচ্ছায় শেরে খোদা হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে তাঁর বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু আবেদন করার সাথে সাথে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, বিবাহের মোহরানা আদায় করার মতো তোমার সামর্থ্য আছে কি? তখন হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বললেন, একটি ঘোড়া ও একটি বর্ম ছাড়া আর কিছুই নেই। হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র সাহসিকতার পরিচয় পেয়ে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, যুদ্ধের জন্য অবশ্যই ঘোড়া দরকার বিধায় তুমি বর্মটি বিক্রি করে মোহরানা আদায় করতে পারো। এরপর অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু আদবের সাথে সেখান থেকে ক্ষণিকের বিদায় নিলেন। এতে সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যেরূপ যোগ্যতা সম্পন্ন পাত্রের আকাঙ্খা করেছিলেন রাহমানুর রাহীম আল্লাহ্ তা‘আলা সেরূপ যোগ্যতম পাত্র তাঁর প্রিয়তমা কন্যার জন্যে মিলিয়ে দিয়েছিলেন।

ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার সাথে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর শুভ বিবাহ্
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ অনুযায়ী হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু স্বীয় বিবাহের মোহরানা আদায়ের জন্য নিজ ব্যবহৃত যুদ্ধের লৌহ বর্মটি বিক্রির প্রচেষ্টা চালালেন। যথাযথ খরিদদারের সন্ধান না মিলায় বর্মটি নিয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে উপস্থিত হলেন। ওই মুহুর্তে ওখানে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত উসমানগণি রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সহ আরো অনেক সাহাবী উপস্থিত ছিলেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উপস্থিত সাহাবীদের মধ্যে ঘোষণা দিলেন, কেউ কি আছো যে উপযুক্ত মূল্য দিয়ে (হযরত) আলী এর বর্ম ক্রয় করবে। সাথে সাথে হযরত উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু দাঁড়িয়ে বললেন যে, আমি ৪৮০ দিরহাম মূল্য দিয়ে বর্মটি ক্রয় করতে আগ্রহী। হযরত উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর কথানুযায়ী বর্মটি তাঁর হাতে দিলেন এবং ৪৮০ দিরহাম তাঁর কাছ থেকে নিয়ে নিলেন। এদিকে পলকের মধ্যে হযরত উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু অত্যন্ত খুশী মনে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে বর্মটি ফেরত দিলেন আল্লাহ্র রাস্তায় যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য। এই মহানুভব দৃশ্য দেখে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম খুশী হয়ে হযরত উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে প্রাণভরে দো‘আ করলেন।

হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার মহান চরিত্র ও আচার-ব্যবহার
হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা অত্যন্ত পুত-পবিত্র, সর্বগুণে গুণান্বিত ও সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর গৃহে হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা লালিত-পালিত হওয়ায় তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছিল অতি সংযমী মনোভাব, দানশীলতা, অল্পে তুষ্টি, ইবাদত-বন্দেগী এবং অন্যান্য মহত গুণাবলী। হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহাকে আল্লাহ্ তা‘আলা নারী জাতির উত্তম আদর্শ হিসেবে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সান্নিধ্যে তাঁর চরিত্রকে উন্নতির উচ্চ শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা সংসার জীবনে স্বামীর প্রতি খুবই শ্রদ্ধা পোষণ করতেন এবং স্বামীর সেবাযতেœ কার্পণ্য করেননি। শত অভাব-অনটন, দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করে স্বীয় আদর্শ ও চরিত্রকে বিসর্জন দিয়ে সুখের পথ খুঁজেননি। তিনি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শে অটল ছিলেন। কোন অবস্থাতেই স্বামীর কাছে অহেতুক কোন আবদার করেননি। ভোগ-বিলাস, আরাম-আয়েশের প্রতি তাঁর কোন খেয়ালই ছিল না। নিঃস্ব অবস্থায় থেকে সহায় সম্বল সবকিছু গরীব, দুঃখী অভাবীদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন।

স্বামীর সংসারের কার্য সম্পাদন
সংসার জীবনে স্বামীর সংসারে হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা-এর অভাব-অনটন, দুঃখ-কষ্ট লেগেই ছিল। তাছাড়া সাংসারিক নানা গৃহস্থালীর কাজ তাঁকে নিজ হাতে সমাধা করতে হতো। বিশ্ব নবীর কন্যা বলে গর্ব করে কোন সময় সাংসারিক কাজের প্রতি অনীহা প্রকাশ করতেন না। হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা ও হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু দাম্পত্য জীবনের বুঝাপড়া হিসেবে স্বামী বাইরের কাজে এবং স্ত্রী ঘরের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তখনকার দিনে পারিবারিক কাজ সমাধা করা খুবই কষ্টকর ও কঠিন ছিল। এত কষ্টের মধ্যে হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা-এর পবিত্র চেহেরায় মলিনতার ছাপ পরিলক্ষিত হতো না। ঘরের সকল কাজ তিনি আনন্দের সাথে সমাপন করতেন।

সংসারিক কাজের চাপে অতিষ্ঠ হয়ে হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা-এর মাধ্যমে দয়াল নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে গণীমতের সম্পদ থেকে একজন বাঁদী তাঁর কাজের সাহায্যের জন্য দেয়ার অনুরোধ করলেন। হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার নিকট হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা-এর আবেগ জড়িত কন্ঠের অনুরোধের কথা শুনে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রিয় কন্যার গৃহে গিয়ে মেয়ের দুঃখ-কষ্টের শান্তনা দিয়ে বললেন, ‘‘হে ফাতিমা! তুমি আমার কাছে গোলাম বাঁদীর দরখাস্ত করেছ। কিন্তু যে পর্যন্ত মদীনাবাসীর প্রতিটি ঘরে গোলাম বাঁদী না থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আদরের দুলালী কলিজার টুকরা হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার গৃহে গোলাম বাঁদী থাকবে না। এটা আমার পছন্দ নয় তোমাকে এভাবে সাহায্য করা।’’ তিনি আরো বললেন, হে ফাতিমা! মনে রাখবে আল্লাহ্র কাছে প্রত্যেকেই তাঁর নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। এতে হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার মনে দুঃখ নিলেন না বরং নিজের অহেতুক আবদারের জন্যে অনুশোচনা করলেন।
হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা সংসারের সকল কাজ-কর্ম নিজ হাতে করতেন এবং কোন সময় স্বামীকে ঘূর্ণাক্ষরে বলেননি তাঁর একার পক্ষে সংসারের এত কাজ সমাধা করা সম্ভব নয়। সংসারের কাজ-কর্ম সেরে সন্তান-সন্ততির দেখাশুনা, রক্ষণাবেক্ষণ এবং স্বামীর সেবা-যত্ন করতেন।

মহান নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যতবারই হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার গৃহে গমন করতেন তখন তিনি কাজে ব্যস্ত থাকতেন। কাজের এ ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে প্রিয় কন্যাকে নানা মূল্যবান উপদেশ দিতেন। কন্যাকে কাছে ডেকে তাঁর পাশে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, ‘‘হে মা, স্ত্রীলোক স্বামীর ঘরের সন্তান-সন্ততির রক্ষণাবেক্ষণকারী হিসেবে তাঁকে জবাবদিহি করতে হবে, একথা স্মরণ রেখে দাম্পত্য জীবনের দিনগুলো অতিবাহিত করবে।’’ স্ত্রীলোক স্বামীর ঘর সংসার ও সন্তান-সন্ততির একান্ত নেগাহবান। প্রত্যেক স্ত্রীর স্বামীর ঘরের দু’টি গুরু দায়িত্ব হলো স্বামীর ঘরের দায়িত্ব এবং সন্তান-সন্ততির দায়িত্ব। এক কথায় পরিবারের সকল কিছুর রক্ষণাবেক্ষণের দায়-দায়িত্ব এবং ঘরের সকল সঠিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব স্ত্রীর উপর ন্যাস্ত, স্ত্রী হলো গৃহের কত্রী।

ওফাত
বিশুদ্ধ বর্ণনা মতে নবী নন্দিনী হযরত ফাতেমাতুয্ যাহ্রা ৩ রমজানুল মোবারক ১১ হিজরী ওফাত বরণ করেন। নবী নন্দিনী হযরত ফাতেমাতুয্ যাহ্রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার গোটা জীবন সমগ্র নারী জাতির জন্য সর্বোত্তম আদর্শের নমুনা। আল্লাহ্ পাক নারী জাতিকে তাঁর আদর্শ অনুসরণের তাওফিক দান করুন। আ-মী-ন।

লেখক: পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম।

Share:

Leave Your Comment