ইসলামে আযান প্রবর্তনের ইতিবৃত্ত ও শিয়া সম্প্রদায়ের আযান বিকৃতি

ইসলামে আযান প্রবর্তনের ইতিবৃত্ত ও শিয়া সম্প্রদায়ের আযান বিকৃতি

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান

আযান (اذان) ইসলামের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। মুসলিম উম্মাহ্ ইসলামের মহান নবী হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এরই পবিত্র যাহেরী জীবদ্দশায় তাঁরই অনুমোদনক্রমে এ আযান লাভ করে ধন্য হয়েছে। মুসলিম সমাজে প্রচলিত আযানই ইসলামের একেবারে প্রথম যুগ থেকে ধ্বনিত হয়ে আসছে। সুতরাং ওই আযানের অভ্যন্তরে কোন বাক্য কিংবা শব্দের পরিবর্তন কিংবা পরিবর্ধনের কোন সুযোগ নেই। তবু কেউ যদি আযান পরিবর্তনের মতো গর্হিত কাজ করে, তবে তা হবে সম্পূর্ণ অ-ইসলামী। এ নিবন্ধে প্রথমে ইসলামে ‘আযান’ প্রবর্তনের সঠিক ইতিবৃত্ত, তারপর কারা এ আযান পরিবর্তনের দুঃসাহস দেখিয়ে আসছে সে সম্পর্কে আলোচনা করার প্রয়াস পাবো। শারেহে মুসলিম শরীফ আল্লামা গোলাম রাসূল সা‘ঈদী আলায়হির রাহমাহ্ কৃত শরহে মুসলিম শরীফে এবং অতি নির্ভরযোগ্য অন্যান্য কিতাবে ‘আযান’ সম্পর্কে সপ্রমাণ আলোচনা করা হয়েছে।

আযান (اذان) শব্দের আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ
‘আযান’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ঘোষণা দেওয়া এবং ব্যাপকভাবে জানিয়ে দেওয়া। মহান রব এরশাদ ফরমাচ্ছেন- اَذَانٌ مِّنَ اللهِ وَرَسُوْلِه (তরজমা: আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে ঘোষণা। ৯:৩, কানযুল ঈমান) আরো এরশাদ ফরমান- فَاَذَّنَ مُؤَذِّنٌ بَيْنَهُمْ (তরজমা: একজন ঘোষণাকারী তাদের মধ্যে ঘোষণা করলো। ৭:৪৪, কান্যুল ঈমান)। শরীয়তের পরিভাষায়, বিশেষ শব্দাবলী দ্বারা নামাযের জন্য ঘোষণা দেওয়ার নাম হচ্ছে ‘আযান’।

আযানের ইতিবৃত্ত
হযরত জিব্রাঈল আমীন মি’রাজের রাতে বায়তুল মুক্বাদ্দাসে সর্বপ্রথম আযান দিয়েছেন যখন হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সকল নবী আলায়হিমুস্ সালামকে নামায পড়িয়েছেন। মুসলমানদের মধ্যে হিজরতের পর প্রথম হিজরী সনে আযান আরম্ভ হয়েছে।
[মিরআত শরহে মিশকাত: ১ম খণ্ড ও দুররে মুখতার]

হিজরতের পর আযানের প্রচলন
হিজরতের পর নামায সম্পর্কে জানিয়ে দেওয়ার কোন নিয়ম ছিলো না। আন্দাজ করে মুসলমানগণ মসজিদে একত্রিত হয়ে যেতেন এবং জমা‘আতে সামিল হতেন। যখন মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলো, তখন সাহাবীগণ নামায সম্পর্কে জানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করার কথা ভাবলেন। কেউ কেউ প্রস্তাব দিলেন, নামাযের সময় আগুন জ্বালানো হোক, এর উপর আপত্তি হলো। কারণ এটা ইহুদীদের প্রথা। কেউ কেউ বললেন, ‘ঘন্টা বাজানো হোক।’ এর উপরও আপত্তি হলো। কারণ, এটা খ্রিস্টানদের প্রথা। তারা তাদের উপাসনার সময় হলে ঘন্টা বাজায়। ইসলামী ঘোষণা (আযান) স্বতন্ত্র হওয়া চাই। স্মর্তব্য যে, কিছু কিছু ইহুদী তাদের উপাসনার সময় হলে শিঙ্গা কিংবা বিউগল বাজাতো আর কেউ কেউ আগুন জ্বালাতো। [মিরআত শরহে মিশকাত]
মুসলিম শরীফের ৭৪১ নং হাদীসে বর্ণিত যে, হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু প্রস্তাব দিলেন একজন লোককে নিয়োগ করা হোক, যে নামাযের সময় লোকজনকে উচ্চস্বরে নামাযের জন্য ডাকবে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামও তখন হযরত বেলালকে ডেকে বললেন, ‘ওঠো! লোকজনকে নামাযের জন্য ডাকো!’

শরীয়তের বিধিবদ্ধ আযান
এ হাদীস শরীফের ব্যাখ্যায় বর্ণনা করা হয় যে, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পারস্পরিক পরামর্শ করা চাই। বস্তুত: সাহাবা-ই কেরাম হলেন, ইসলামের রূহ। তাঁরা ইসলামের চাহিদাগুলো সম্পর্কে ওয়াকিফ্হাল ছিলেন। তাঁরা মনে করতেন যে, ইসলাম একটি বিশ্বব্যাপী ধর্ম। এর রুক্ন (মৌলিক বিধান)গুলো সম্পন্ন করার জন্য একটি মজবুত নীতিমালা থাকা চাই।
সুতরাং নামাযগুলো সম্পন্ন করার জন্যও শরীয়তে নির্দ্ধারিত সময় বর্ণিত হয়েছে। ফলে একটি নির্দিষ্ট সময়ে সব মুসলমান নামায সম্পন্ন করেন। এতে উম্মত একটি সময়ে সমবেতও হয়। এতে ঐক্যও কায়েম থাকে। একারণে নির্দ্ধারিত সময়গুলোতে সমবেত হবার একটি সংকেত বা আলামত ঠিক করার জন্যও তাঁরা চিন্তা-ভাবনা ও পারস্পরিক পরামর্শ করলেন।
হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইহুদী ও খ্রিস্টানদের পদ্ধতিকে অপছন্দ করতেন। ইসলামও নিজেদের জন্য স্বতন্ত্র নিয়ম চায়। ইসলাম অন্য ধর্মের অনুসারী নয়; বরং অন্য সব ধর্মকে রহিত (মানসূখ) কারী। এটা একটা পূর্ণাঙ্গ দ্বীন। ইসলাম যেভাবে ইবাদতের ক্ষেত্রে কারো অনুসারী নয় বরং ইসলাম অন্য সব ধর্মের মধ্যে স্বতন্ত্র্য বা পৃথক মর্যাদা ও মহিমায় মহিয়ান। এর দাবী হচ্ছে ইসলাম তার তামাদ্দুন বা কৃষ্টি ও সামাজিকতা এবং সংস্কৃতিতেও স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী হওয়া। তাই সেটা অন্য কোন সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির অনুসরণ করবে না। বিশেষ করে ইহুদী ও খ্রিস্টানদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রথাগুলো থেকে একেবারে আলাদা থাকবে।
হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তখন যা বলেছিলেন- নামাযের সময় একজন লোকের মাধ্যমে অন্য লোকজনকে ডাকা হোক সেটা আযানের প্রসিদ্ধ ধরণ ছিলোনা। এটা দ্বারা নিছক আহ্বান ও দাওয়াত দেওয়াই উদ্দেশ্য ছিলো তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ওই পরামর্শ পছন্দ করেছিলেন। এতে হযরত ওমর রাদ্বিযাল্লাহু তা‘আলা আনহুর অভিমত প্রদানের দক্ষতার পক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়।
পরে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে যায়দ স্বপ্নে এক ফেরেশতাকে আযানের কলেমা (বাক্য)গুলো বলতে শুনেছেন। ইমাম তিরমিযী তাঁর সনদ সহকারে বর্ণনা করেছেন- হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে যায়দ বলেন, একদিন ভোরে আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র দরবারে উপস্থিত হলাম। তখন আমি আমার দেখা স্বপ্ন বর্ণনা করলাম। রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘তুমি বেলালের সাথে দাঁড়িয়ে তাকে স্বপ্নে শ্রুত কলেমাগুলো বলে দাও! তারপর সে এ কলেমা (বাক্য)গুলো সহকারে আযান দেবে। কেননা, তার কন্ঠস্বর তোমাদের কন্ঠস্বরের চেয়ে উঁচু।’’ যখন ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু আযানের আওয়াজ শুনলেন, তখন তিনি দৌঁড়ে আসলেন। আর আরয করলেন, ‘‘এয়া রসূলাল্লাহ্! ওই মহান সত্তার শপথ, যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন। আমিও স্বপ্নে এ কলেমাগুলোই শুনেছি।’’ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘‘আল্লাহ্ তা‘আলারই শোকর! এবং তিনিই প্রশংসার উপযোগী।’’ [ইমাম আবূ ঈসা মুহাম্মদ ইবনে ঈসা তিরমিযী, ওফাত২৭৯ হিজরী, জামে তিরমিযী: পৃষ্ঠা-১৫, নূর মুহাম্মদ কর্তৃক মুদ্রিত, আসাহ্হুল মাত্বাবি; করাচী]

‘আযান’ শরীয়তের বিধিবদ্ধ হবার ভিত্তি নিছক হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে যায়দ অথবা হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমার স্বপ্নের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। কেননা, সাহাবীদের স্বপ্ন ওহী নয়, তাঁরা শারে’ বা শরীয়তের প্রবর্তক নন; বরং আযান শরীয়তে বিধিবদ্ধ হওয়া রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ওই হুকুম বা নির্দেশে সম্পন্ন হয়েছে, যা তিনি হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে যায়দকে দিয়েছিলেন। তাতে তিনি এরশাদ করেছেন, ‘‘এ কলেমা বা বাক্যগুলো বেলালকে শিখিয়ে দাও, যাতে সে আযান দেয়।’’ যদি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হুকুম না দিতেন, তবে হাজারো সাহাবা-ই কেরামও যদি ওই কলেমাগুলো স্বপ্নে শুনে নিতেন, তবুও আযান ওইসব স্বপ্ন দ্বারা মাশরূ’ (শরীয়তে বিধিবিদ্ধ) হতো না।
আল্লামা যারক্বনী লিখেছেন, হতে পারে এ স্বপ্নের সাথে সাথে নবী-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর ওহীও নাযিল করা হয়েছিলো। এও হতে পারে যে, নবী-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ স্বপ্নের দাবী অনুসারে আযান দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ নির্দেশ স্থায়ীভাবে কার্যকর হয়েছিলো। [আল্লামা মুহাম্মদ আবদুল বাক্বী যারক্বানী (ওফাত-১১২২হি.) শরহে মুআত্তা, ইমাম মালিক: ১ম খণ্ড, পৃ. ১২২, মাত্ববা‘আতুল খায়রিয়া, মিশরে মুদ্রিত]
তাছাড়া, এতেও সন্দেহ নেই যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আযানের কলেমাগুলো সম্পর্কে জানতেন। কেননা, শায়খ আবদুল হক্ব মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি লিখেছেন, হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম শবে মি’রাজে ফেরেশতা থেকে আযানের কলেমাগুলো শুনেছিলেন। আর একথা গবেষণা (তাহক্বীক্ব) দ্বারা প্রমাণিতও। [আশি’‘আতুল লুম‘আত: ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা- ৩০৬]
আল্লামা জালাল উদ্দীন খাওয়ারেযমী লিখেছেন, আবূ জাফর মুহাম্মদ ইবনে আলী বর্ণনা করেছেন, মি’রাজ রাত্রিতে যখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মসজিদে আক্বসায় পৌঁছেছিলেন, তখন হযরত জিব্রাঈল আযান দিলেন। আর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সমস্ত নবী আলায়হিমুস্ সালাম এবং ফেরেশতাদের নিয়ে নামায পড়েছিলেন। [কিফায়া ‘আলা হামেশে ফাতহিল ক্বদীর: ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২১, মুসনাদে বায্যার: ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা- ১৪৬-১৪৭]
সাহাবীর মুখে আযান জারী করানোর মধ্যে হিকমত এ ছিলো যে, নবী-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আযান সপ্ত আসমানের উপর শুনেছিলেন। বস্তুত: এটা ওহীর চেয়েও বেশী মজবুত মাধ্যম ছিলো। তারপর যখন আযান শরীয়তে বিধিবদ্ধ হওয়া নামায ফরয হবার পরে হয়ে গেলো, আর আল্লাহ্ তা‘আলা হুযূর-ই আকরামকে আযানের খবর দেয়ার ইচ্ছা করলেন, তখন একজন সাহাবী স্বপ্নে দেখলেন আর তিনি তা হুযূর-ই আকরামের দরবারে বর্ণনা করলেন। বস্তুত এ স্বপ্নের আযান ওই আযানের অনুরূপ ছিলো, যা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম শুনেছিলেন। এজন্য তিনি বলেছিলেন, ‘‘নিশ্চয় এ স্বপ্ন সত্য।’’ তখন তাঁর একথাও জ্ঞাত হয়ে গেলো যে, আসমানে আযান শুনানোতে আল্লাহ্ তা‘আলার উদ্দেশ্য এ ছিলো যে, যমীনেও তা সুন্নাত হয়ে যাবে।
আর এটা আরো মজবুত হলো হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর স্বপ্ন দ্বারা। কেননা, হযরত ওমরের মুখ মুবারক থেকে হক্ব (সত্য) জারী হয়।
তাছাড়া, সাহাবীর মুখে আযানের শব্দগুলো জারী করে, সেগুলোকে নবী-ই আকরাম সত্যায়ন করা এবং ওই শব্দগুলো দ্বারা আযান দেওয়ানোর মধ্যে হুযূর-ই আকরামের অধিকতর শান বা মর্যাদার প্রমাণ মিলে।

সপ্ত আসমানের উপর আযান শোনার বর্ণনা
যদি একথা বলা হয় যে, নবী-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সাত আসমানের উপর আযান শোনানো হয়েছে- এটা কার রেওয়ায়ত? তবে আমরা বলবো, এ হাদীস শরীফকে ইমাম আবূ বকর বায্যার তাঁর মুসনাদে হযরত আলী ইবনে আবী তালিব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন, যখন আল্লাহ্ তা‘আলা আপন রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে আযান সম্পর্কে জ্ঞান দানের ইচ্ছা করলেন, তখন হযরত জিব্রাঈল তাঁর নিকট বোরাক্ব নিয়ে আসলেন। তিনি তাতে আরোহন করে ওই হিজাব পর্যন্ত পৌঁছলেন, যা আল্লাহ্ তা‘আলার অতি নিকটে। ওই সময় এক ফেরেশতা ওই হিজাব (পর্দা) থেকে বের হলেন। হুযূর-ই আকরাম বললেন, ‘‘ইনি কে?’’ হযরত জিব্রাঈল বললেন, তিনি আল্লাহ্ তা‘আলার সৃষ্টির মধ্যে সর্বাপেক্ষা নৈকট্যধন্য ফেরেশতা। আর আমি যখন সৃষ্টি হয়েছি, তখন থেকে এ পর্যন্ত সময় সীমার মধ্যে এর পূর্বে তাঁকে দেখিনি। ওই ফেরেশতা বললেন, ‘‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার।’’ তখন হিজাবের আড়াল থেকে আওয়াজ আসলো, ‘‘আমার বান্দা সত্য বলেছে। আমি আকবার (আমি সবচেয়ে বড়), আমি আকবার (আমি সব চেয়ে বড়)।’’ তারপর ওই ফেরেশতা বললেন, ‘‘আশ্হাদু আল্ লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ্।’’ তখন হিজাবের আড়াল থেকে আওয়াজ আসলো, ‘‘আমার বান্দা সত্য বলেছে। আমি আল্লাহ্। আমি ব্যতীত অন্য কেউ ইবাদতের উপযুক্ত নয়। তারপর ফেরেশতা বললেন, ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রসূলুল্লাহ্!’ তখন হিজাবের পেছন থেকে আওয়াজ আসলো, ‘‘আমার বান্দা সত্য বলেছে। আমি মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-কে রাসূল করেছি।’’ তারপর ফেরেশতা বললেন, ‘‘হাইয়্যা ‘আলাস্ সোয়ালাহ্’ (অতঃপর) ‘‘হাইয়্যা ‘আলাল ফালাহ্।’’ তারপর ফেরেশতা বললেন, ‘‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার।’’ তখন হিজাবের আড়াল থেকে আওয়াজ আসলো, ‘‘আমার বান্দা সত্য বলেছে। আমি আকবার (আমি সব চেয়ে বড়)। তারপর তিনি (ফেরেশতা) বললেন, লা-ইলা-হা ইলল্লা-হ্।’’ তখন হিজাবের পেছন থেকে আওয়াজ আসলো, আমার বান্দা সত্য বলেছে। আমি ইলাহ্, আমি ব্যতীত কোন ইলাহ্-নেই।’’ তারপর ফেরেশতা হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে হাতে ধরে এগিয়ে দিলেন। আর তিনি আসমানবাসীদেরকে নামায পড়িয়েছেন। তাঁদের মধ্যে হযরত আদম ও হযরত নূহ্ (আলায়হিমাস্ সালাম)ও ছিলেন। আর জা’ফর মুহাম্মদ ইবনে আলী বলেছেন, ওই দিন আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে (হুযূর-ই আকরাম) সমস্ত আসমান ও যমীন বাসীদের উপর ফযীলত (শ্রেষ্ঠত্ব) দিয়েছেন।’’ আল্লামা সুহায়লী বলেছেন, আমার মতে এ হাদীস ‘সহীহ’। কারণ, মি’রাজ শরীফের অন্যান্য হাদীস শরীফ এর সমর্থন করছে। ওইগুলোতে একথাও রয়েছে যে, আল্লাহ্ তা‘আলার নামাযকে যমীনের উপর ফরয করা উদ্দেশ্য ছিলো। আর সেটা ফরয হবার বর্ণনা আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর সাক্ষাতে করেছেন। তদুপরি এ হাদীস শরীফে নামাযের ঘোষণা অর্থাৎ আযানের বর্ণনা রয়েছে,যার জ্ঞান পবিত্র হেরমের (হিজাব)-এর পেছন থেকে দেওয়া হয়েছে।
এ থেকে আযানের উৎস-প্রমাণ সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে জানা গেলো। আল্লাহ্ তা‘আলা ও তাঁর রসূল-ই আকরাম প্রদত্ত এ আযানের শব্দাবলীও অকাট্যভাবে প্রমাণিত হলো। ইসলামের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ওই আযানই সর্বত্র ধ্বনিত হয়ে আসছে। আলহামদু লিল্লাহ! মুসলিম সমাজে ওই আযান এখনো অবিকৃত অবস্থায় আছে। কিন্তু এ ওহীলব্ধ আযানের মধ্যে সম্পূর্ণ মনগড়াভাবে পরিবর্দ্ধন ও পরিবর্তনের দুঃসাহস দেখালো পথভ্রষ্ট দল শিয়া সম্প্রদায়। তারা আযানের মধ্যে যেসব বাক্য বর্দ্ধিত করলো, সেগুলো সম্পর্কেও একটু আলোচনা করা যাক।
প্রথমত: তারা মনগড়াভাবে আযানকে বিকৃত করে শরীয়তের দৃষ্টিতে অমার্জনীয় অপরাধ করেছে। কারণ, ওহীলব্ধ আযানের মধ্যে মনগড়া বাক্য বা শব্দ বর্দ্ধিত করার কোন সুযোগ নেই।
দ্বিতীয়ত: তাদের বর্দ্ধিত বাক্যগুলোর অর্থ যাই হোক না কেন, কিন্তু তাতে তাঁদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানা দরকার। ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্’র পর তারা আযানে বলে থাকে ‘আশহাদু আন্না আলিয়্যাঁও ওয়ালিয়ুল্লাহ্।’ অর্থাৎ ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, হযরত আলী আল্লাহর ওলী।’ অর্থাৎ তাদের মতে হযরত আলী কাররামাল্লাহু তা‘আলা ওয়াজহাহু যেই বেলায়তের অধিকারী, ওই ‘বেলায়ত’ সম্পর্কে যা জানা গেলো তাতো অতি জঘন্য ও ঈমান বিধ্বংসী। কারণ, তাদের মতে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বেলায়ত-এর স্তর এত ঊর্ধ্বে যে, সেখানে নাকি কোন নবী-ই মুরসালও পৌঁছতে পারেন না। প্রকারান্তরে তারা বলতে চায় যে, হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকেও শ্রেষ্ঠ। (নাঊযুবিল্লাহ্!) [শিয়াদের রচিত সূরা বেলায়তের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য ‘শিয়া-সুন্নী বিরোধ]
শিয়াদের ফির্ক্বাহ্-ই গুরাবিয়াহ্র (কাক ফির্ক্বা) আক্বীদা হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলা ‘নুবূয়ত’ প্রেরণ করেছিলেন হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র নিকট, কিন্তু হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম ভুল করে ওহী নিয়ে গেছেন হুযূর-ই আকরাম হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট। এর কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছে- দু’টি কাকের মধ্যে যেমন পার্থক্য করা কঠিন, তেমনি হযরত জিব্রাঈল হুযূর-ই আকরাম (আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম) ও হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র মধ্যে পার্থক্য করতে পারেননি। সুম্মা না‘ঊযুবিল্লাহ্ িমিন হা-উলা-ইশ্ শায়াত্বীন।
[তা-ঈদে আহলে সুন্নাহ্, কৃত হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী আলায়হির রাহমাহ্]
শিয়ারা আযানে এরপর বলে- ‘আশহাদু আন্না আলিয়্যান খালীফাতুল্লাহ’ (অর্থাৎ হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু আল্লাহ্র খলীফা)। তারা হাইয়্যা‘আলাস্ সালাহ’-এর পর বলে- ‘হাইয়্যা ‘আলা খায়রিল ‘আমাল’ (সর্বাধিক উত্তম কাজের দিকে এসো।’
উল্লেখ্য, এ ‘খালীফাতুল্লাহ্’ ও ‘খায়রিল ‘আমাল’-এর ব্যাখ্যা শিয়াদের থেকে জেনে নিন, তখন বুঝা যাবে তারা এর কত জঘণ্য ও ঈমান-বিধ্বংসী ব্যাখ্যা দেয়! আল্লাহরই পানাহ্!
আযানের মধ্যে ‘শাহে বেলায়ত’ মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে ‘আল্লাহর ওলী’ ও ‘আল্লাহর খালীফা’ বলে মনগড়াভাবে ঘোষণা দেওয়ার উদ্দেশ্য কি? তারা কোন্ খায়রিল ‘আমালের দিকে ডাকছেন? শিয়া মতবাদ ও তাদের জঘন্য কাজগুলো নয় তো?
বস্তুত: শুধু আযান নয়, এ শিয়া সম্প্রদায় ইসলামের বহু সঠিক আক্বীদা ও অনুশাসনে মারাত্মক পরিবর্তন/বিকৃতি সাধন করেছে ও করে যাচ্ছে। তাদের কোন কোন গোমরাহী কুফর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। তাই আ’লা হযরত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুসহ প্রখ্যাত ইমামগণ তাদের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন। এসব কারণে তাদের থেকে দূরে থাকা এবং তাদের ভ্রান্ত আক্বীদাগুলোর বর্জন ও খণ্ডনে সব সময় সোচ্ছার থাকা অপরিহার্য। আল্লাহ্ তাওফীক্ব দিন। আ-মী-ন।

লেখক: মহাপরিচালক, আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম বাংলাদেশ।

Share:

Leave Your Comment