প্রথম খলীফা সায়্যিদুনা সিদ্দীক্ব-ই আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু

প্রথম খলীফা সায়্যিদুনা সিদ্দীক্ব-ই আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু

মাওলানা মুহাম্মদ আবুল হাশেম

بِسۡمِ اللّٰهِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِيْمِ
قَالَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ‌لَا ‌يَنْبَغِيْ ‌لِقَوْمٍ فِيْهِمْ أَبُوْ بَكْرٍ أَنْ يَؤُمَّهُمْ غَيْرُهُ.
“রাসূলুল্লাহ্  ইরশাদ করেন: যে সম্প্রদায়ের মধ্যে আবূ বকর থাকেন, তাদের জন্য উপযুক্ত নয় যে, তাদের ইমামতি আবূ বকর ছাড়া অপর কেউ করবে।”

এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর মুসলিম উম্মাহ্র ইমামতি (চাই তা ‘ইমামত-ই সুগরা’ তথা নামায হোক, কিংবা ‘ইমামত-ই কোবরা’ তথা খিলাফত-ই নবভী হোক) হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর-ই হক্ব (অধিকার)। এ হাদীস দ্বারা অন্যসব মাসআলা ও সুক্ষ্মরহস্য ছাড়াও প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর এ উম্মতের মধ্যে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর মর্যাদা, ইমামতের অধিকার এবং খিলাফত সাব্যস্ত হয়।

 আফদ্বালিয়ত-ই সিদ্দীক্ব-ই আকবর
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সর্বসম্মত আক্বীদা হচ্ছে, এ উম্মতের মধ্যে হুযূর সায়্যিদুল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র পর সর্বাধিক উত্তম ও উন্নত মর্যাদার অধিকারী হলেন- হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু। হযরত আলী মুরতাদ্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর পবিত্র সন্তান হযরত মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
قُلْتُ لِأَبِيْ: أَيُّ النَّاسِ خَيْرٌ بَعْدَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ قَالَ: أَبُوْ بَكْرٍ.

“আমি আমার পরম সম্মানিত পিতাকে জিজ্ঞেস করলাম: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র পর সর্বাধিক উত্তম কে? তিনি ইরশাদ করেন: হযরত আবূ বকর।”
হযরত আলী মুরতাদ্বা কাররামাল্লাহু তা‘আলা ওয়াজহাহুল কারীম হযরত আমীর মু‘আবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর নামে প্রেরিত একটি পত্রে হযরত আবূ বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সম্পর্কে লিখেন:
وكان افضلهم فى الاسلام كما زعمت، وانصحهم لله ولرسوله، الخليفة الصديق وخليفة الخليفة الفاروق، ولعمرى ان مكانهما فى الاسلام لعظيم، وان المصاب بهما لجرح فى الاسلام شديد، يرحمهما الله وجزاهما باحسن ما عملا.
“তিনি (হযরত আবূ বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু) ইসলামের সকল লোকের মধ্যে সর্বোত্তম ছিলেন। যেমনটি আপনার রায়। আর তাদের মধ্য থেকে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের সাথে সর্বাধিক নিষ্ঠাবান ছিলেন, খলীফা সিদ্দীক্ব এবং খলীফার খলীফা ফারূক্ব, আমার জীবনের শপথ, তাঁদের মর্যাদা ইসলামে অনেক বড় এবং তাঁদের ওফাতের ঘটনায় ইসলামের প্রচ- আঘাত হয়েছে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁরা উভয়ের প্রতি রহমত নাযিল করুন এবং তাঁদেরকে তাঁদের উত্তম আমলসমূহের প্রতিদান দান করুন।” (এ চিঠি অন্যসব শিয়া আলিম শরহে নাহযুল বালাগাত-এর মধ্যে উল্লেখ করেছেন।)

ইসলামে সিদ্দীক্বে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ‘আফদ্বালিয়ত’ (শ্রেষ্ঠত্ব)-এর আক্বীদা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, হযরত ওমর ফারূক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু একবার মিম্বরের উপর তাশরীফ নিয়ে গেছেন এবং ইরশাদ করেন:
এ উম্মতের মধ্যে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র পর হযরত আবূ বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ‘আফদ্বালুন্ নাস’ (সর্বাধিক উত্তম ব্যক্তি)। যদি কোন ব্যক্তি সেটার বিপরীতে কথা বলবে, তাহলে সে অপবাদদাতা এবং তাকে সেই শাস্তি দেয়া যাবে, যা অপবাদদাতার জন্য শরী‘আত নির্দারণ করে রেখেছে

আফদ্বালিয়াত-ই সিদ্দীক্ব-ই আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর উপর শীর্ষস্থানীয় সাহাবীগণ এবং আহলে বায়তে নবভীর ইজমা’ (ঐক্যমত) হয়েছে। এমনকি ওলামা-ই কালাম লিখেছেন যে, আহলে সুন্নাত হওয়ার আলামত হচ্ছে, (تفضيل الشيخين) তথা হযরত আবূ বকর ও ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমাকে সকল সাহাবী ও আহলে বায়ত থেকে ‘আফদ্বল’ (শ্রেষ্ঠ) জ্ঞান করা। ওইসব শর‘ঈ দলীলের ভিত্তিতে ইমামে আহলে সুন্নাত মাওলানা শাহ আহমদ রেযা খান ফাদ্বিল বেরলভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এবং অন্যসব শীর্ষস্থানীয় ওলামা-ই আহলে সুন্নাত এ আক্বীদার বিরোধীদের গোমরাহ এবং বদ মাযহাবী আখ্যা দিয়েছেন।

 ইমামতের মাসআলা
ইমামত-এর অর্থ হচ্ছে, প্রধান, পরিচালক হওয়া, আদর্শ হওয়া, নামায পড়ানো ইত্যাদি। শরী‘আতে ইমামত দু’ প্রকার। ১. ইমামত-ই সুগরা: তথা নামাযের ইমামতি; ২. ইমামত-ই কোবরা: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র খিলাফত ও প্রতিনিধিত্ব। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র পর এ দু’ ইমামতি হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর জন্য সাব্যস্ত এবং তিনি ওই দু’ ইমামতের সর্বাধিক হক্বদার (উপযুক্ত)।

 ইমামত-ই সুগরা
ইমামত-ই সুগরা তথা নামাযের ইমামতি। হুযূর নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম স্বীয় ওফাতের কিছুদিন পূর্বে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে নামাযের ইমামতির দায়িত্ব সোপর্দ করেন। উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে বর্ণিত, যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র অসুস্থতা তীব্র আকার ধারন করলো এং হযরত বিলাল রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নামাযের ব্যাপারে অবহিত করতে হাযির হন, তখন তিনি (হুযূর করীম) ইরশাদ করেন: مُرُوْا اَبَا بَكْرٍ اَنْ يُّصَلِّىَ بِالنَّاسِ. “আবূ বকরকে বলো যেন তিনি লোকদের ইমামতি করেন।”
হযরত আয়েশা বলেন, আমি আরয করলাম: ইয়া রাসূলাল্লাহ্! হযরত আবূ বকর নরম অন্তরের মানুষ, যখন তিনি আপনার মুসল্লায় দ-ায়মান হবেন, তখন তিনি লোকদেরকে (ক্বিরাআত) শুনাতে পারবেন না। অর্থাৎ কান্না করবেন, কতই না ভালো হত যে, আপনি হযরত ওমরকে এ নির্দেশ দিবেন। অতঃপর নবী করীম পুনরায় নির্দেশ দিলেন: مُرُوْا اَبَا بَكْرٍ اَنْ يُّصَلِّىَ بِالنَّاسِ. “আবূ বকরকে বলো যেন তিনি লোকদের ইমামতি করেন।”
এটা তো সহীহ বুখারীর বর্ণনা এবং জামে’ তিরমিযীর রেওয়ায়ত ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে ইরশাদ-ই নবভী ছিল- যে সম্প্রদায়ের মধ্যে আবূ বকর থাকেন, তাদের জন্য সমীচীন নয় যে, তাদের ইমামতি আবূ বকর ব্যতীত অপর কেউ করবে।”
নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মদীনা মুনাওয়ারায় শীর্ষস্থানীয় সাহাবীগণ, আহলে বায়ত-এর উপস্থিতিতে এ ইরশাদ করেন। অতএব, হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র শেষ অসুস্থতায় সতের (১৭) নামাযের ইমামতি করেন এবং সকল সাহাবী ও আহলে বায়ত হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ইক্বতিদাতে নামায আদায় করেন।

 ইমামত-ই কোবরা তথা খিলাফত-ই নবভী
এ ইমামত দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র সাধারণ প্রতিনিধিত্ব। আর ইমাম হচ্ছেন তিনি, যার কাছে মুসলমানদের দ্বীন ও দুনিয়ার যাবতীয় বিষয়ে মোহাম্মদী শরী‘আত মোতাবেক সাধারণ ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার থাকবে এবং (অবাধ্যধ্যতা ব্যতিরেকে) তার আনুগত্য করা মুসলমানদের উপর আবশ্যক হবে। আহলে সুন্নাতের মতে, ইমামের জন্য মুসলমান, বিবেকবান, প্রাপ্তবয়স্ক, স্বাধীন, ক্ষমতাসম্পন্ন এবং কুরাইশী হওয়া শর্ত। হাশেমী, আলভী এবং মা’সূম হওয়া জরুরী নয়।

 ইমামত ও খিলাফত-ই সায়্যিদুনা সিদ্দীক্ব-ই আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু
হুযূর নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কোন ব্যক্তিকে স্পষ্ট শব্দাবলি দ্বারা নিজ খলীফা ও প্রতিনিধি নির্ধারণ করেন নি, তবে নিশ্চয় স্বীয় ওফাতের কিছুদিন পূর্বে হযরত আবূ বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে বারবার তাগিদ সহকারে ইমামতির মুসল্লায় দাঁড় করিয়েছেন এবং হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর খিলাফত ও স্থলাভিষিক্ত হওয়ার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন।
 হযরত যুবাইর ইবনে মুত‘ইম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, এক রমনী নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র সাথে কোন এক বিষয়ে কথা বলেছেন, তখন তিনি (হুযূর করীম) তাকে দ্বিতীয়বার হাযির হওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি আরয করলেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ্! যদি আমি আসি এবং আপনাকে না পাই, তাহলে? সম্ভবত: তার উদ্দেশ্য ছিল মৃত্যু। তখন তিনি (নবী করীম) ইরশাদ করেন: فان لم تجدينى فاتى ابا بكر.
“যদি আমাকে না পাও, তাহলে আবূ বকরের নিকটে আসবে।”
 হযরত হোযাইফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: আমি বলতে পারবো না যে, আমার জীবন আর কত রয়েছে: فاقتدوا بالذين من بعدى واشار الى ابى بكر و عمر. “আমার পরবর্তীগণ (ইঙ্গিত করে বলেন) আবূ বকর ও ওমরের অনুসরণ করবে।”

 হযরত আয়েশা সিদ্দীক্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম অসুস্থতার সময়ে ইরশাদ করেন: তোমার পিতা আবূ বকর এবং তোমার ভাইকে ডাকো, যাতে আমি লিখে দেই। কেননা আমার আশংকা যে, কোন প্রত্যাশী প্রত্যাশা করবে কিংবা কোন বক্তা বলবে ‘আমি’; কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলা এবং মুসলমানগণ আবূ বকরকে ছাড়া অপর কাউকে মানবে না।

 সিদ্দীক্ব-ই আকবরের খিলাফত সম্পর্কে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ফয়সালা
সীরাতে হালাবিয়া এবং অন্যসব গ্রন্থে রয়েছে, হযরত আলী মুরতাদ্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ইরশাদ হচ্ছে-
والنبي صلى الله عليه وسلم لم يمت فجأة بل مكث في مرضه أياما وليالي يأتيه المؤذن فيؤذنه بالصلاة فيأمر أبا بكر فيصلي بالناس وهو يرى مكاني، فلما مات رسول الله صلى الله عليه وسلم اخترنا لدنيانا من رضيه النبي صلى الله عليه وسلم لديننا فبايعناه.

“নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হঠাৎ ওফাতবরণ করেন নি, বরং কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন। তাঁকে নামাযের বিষয়ে অবহিত করা হত, তিনি নির্দেশ দিতেন যেন আবূ বকর লোকদের ইমামতি করেন। এমতাবস্থায় নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমার মর্তবা ও মর্যাদা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। অতঃপর যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বিসাল ফরমালেন, তখন আমরা দুনিয়াবী বিষয়ের জন্য ওই ব্যক্তিকে চয়ন করে নিলাম, যাকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাদের দ্বীন (নামাযের ইমামতি)’র জন্য পছন্দ করে গেছেন। সুতরাং আমরা তাঁর হাতে বায়‘আত গ্রহণ করলাম।”

 খিলাফত-ই সিদ্দীক্বীর উপর সাহাবীগণের ইজমা’ (ঐক্যমত)
হযরত আবূ বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর খিলাফতের বিষয়ে সকল সাহাবী ও আহলে বায়তের ইজমা’ (ঐক্যমত) প্রতিষ্ঠিত। সর্বসাধারণ মুসলমানেরাও হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর হাতে আমীর হিসেবে মেনে নিয়ে বায়‘আত গ্রহণ করেছেন। প্রসিদ্ধ মুফাস্সির, মুহাক্কিক্ব এবং ইতিহাসবিদ হাফিয ইবনে কাসীর দামেশ্ক্বী লিখেছেন: وَقَدِ اتَّفَقَ الصَّحَابَةُ رَضِيَ اللّٰهُ عَنْهُمْ عَلٰى بَيْعَةِ الصِّدِّيْقِ فِيْ ذٰلِكَ الْوَقْتِ حَتَّى عَلِيَّ بْنَ أَبِيْ طَالِبٍ وَالزُّبَيْرَ بْنَ الْعَوَّامِ رضى الله عنهما،

“নিশ্চয় সম্মানিত সাহাবীগণ, হযরত আলী মুরতাদ্বা ও হযরত যুবাইর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমসহ সকলে ওই সময় হযরত সিদ্দীক্ব-ই আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বায়‘আত-এর উপর একমত ছিলেন।

অনুরূপ বিষয়ের বর্ণনা সুনানে কোবরা লিল্ বায়হাক্বী, কানযুল উম্মাল, মুসনাদে ইমাম আহমদ, মুস্তাদ্রাক হাকেম প্রভৃতি হাদীসের কিতাবে বিদ্যমান রয়েছে। শিয়া সম্প্রদায়ের গ্রন্থাদি দ্বারাও হযরত আলী মুরতাদ্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর হযরত সিদ্দীক্ব-ই আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বায়‘আত গ্রহণ করা প্রমাণিত। যেমন: শরহে নাহজুল বালাগাহ্ হাদীদী, প্রথম খ-, পৃ. ১৫৪, মুদ্রণ: বৈরূত-এ রয়েছে: قال على والزبير ما غضبنا الا فى المشورة وانا لنرى ابا بكر احق الناس بها انه صاحب الغار وانا لنعرف له سنة…. وامره رسول الله صلى الله تعالى عليه وسلم بالصلوة وهو حي وكان افصلهم.
“হযরত আলী এবং হযরত যুবাইর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা বলেন: আমাদের অসন্তুষ্টি তো ছিল পরামর্শ করণের মধ্যে ছিল। অথচ আমাদের রায় ছিল যে, হযরত আবূ বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু খিলাফতের সর্বাধিক হক্বদার, তিনি গুহার সাথী এবং তাঁর মর্যাদা সম্পর্কে আমরা অবগত। আর রাসূলুল্লাহ্  যখন যাহিরী (দৃশ্য) জীবনে ছিলেন, তখন তিনি হযরত আবূ বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে নামাযের ইমামতির নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং হযরত আবূ বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু মুসলমানদের মধ্যে সর্বাধিক মর্যাদাবান।”
আর ইতিহাসবিদগণের ইজমা’ (ঐক্যমত) হয়েছে যে, হযরত আলী মুরতাদ্বাসহ সকল সাহাবী ও আহলে বায়ত ‘খোলাফা-ই সালাসাহ্’ তথা প্রথম তিন খলীফা (হযরত সিদ্দীক্ব-ই আকবর, হযরত ফারূক্ব-ই আ’যম, হযরত ওসমান যুন নূরাইন) রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমের হাতে বায়‘আত গ্রহণ করেছেন।

 সাহাবা-ই কিরামের ইজমা’ রায় অস্বীকার করা কুফরী
ইজমা’-ই উম্মত-এর সবচেয়ে সুদৃঢ় স্তর হচ্ছে সাহাবা-ই কিরামের ‘ইজমা’-ই মানসূস’। ‘ইজমা’-ই মানসূস’ হচ্ছে, কোন মাসআলার ব্যাপারে সকল সাহাবী নিজ নিজ রায় প্রকাশ করে দেয়া এবং কেউই মতবিরোধ না করা। এ প্রকারের ইজমা’ অস্বীকারকারী কাফির। ওলামা-ই উসূলে ফিক্হ লিখেছেন: যেমনিভাবে ক্বোরআনের আয়াত অস্বীকার করা কুফরি, অনুরূপ সাহাবা-ই কিরামের ইজমা’-ই মানসূস অস্বীকার করাও কুফরি। (প্রসিদ্ধ উসূলের গ্রন্থাবলি দ্রষ্টব্য)

যেহেতু হযরত সিদ্দীক্ব-ই আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর খিলাফতের উপর ‘ইজমা’-ই সাহাবা মানসূস’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সুতরাং ইসলামের ফক্বীহগণ খিলাফত-ই সিদ্দীক্ব-এর অস্বীকারকারীদের কাফির বলে আখ্যা দিয়েছেন। যেমন: ফাতাওয়া-ই আলমগীরীতে রয়েছে,
مَنْ اَنْكَرَ اِمَامَةَ اَبِىْ بَكْر الصديق رضى الله تعالى عنهم فهو كافر.
“যে ব্যক্তি হযরত আবূ বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ইমামতকে অস্বীকার করবে, সে কাফির।”
এরপর লিখেছেন, “তার বিধান মুরতাদ কাফিরদের অনুরূপ।”

শিয়া সম্প্রদায় তাদের আজানে হযরত আলী মুরতাদ্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ব্যাপারে ‘خليفته بلا فصل’ অর্থাৎ হযরত আলী মুরতাদ্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র ‘খলীফা বিলা- ফাস্ল’ (তথা কোন ব্যবধান ছাড়াই প্রথম খলীফা) পড়ে থাকে। শিয়ারা আজানে এ কলেমাগুলো বলে ‘খোলাফা-ই সালাসাহ্’ (তথা তিন খলীফা)’র খিলাফতকে অস্বীকার করে। আর নিশ্চয় এর দ্বারা কুফরি সাব্যস্ত হয়।

আশ্চর্যের বিষয় যে, দৈনিক পাঁচ ওয়াক্তে এ কুফরি কলেমাগুলো বলার পরও ওই লোকদেরকে মুসলমান বলা হচ্ছে। আল্লাহ্ তা‘আলা মুসলমানদেরকে তাদের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করুন এবং সলফে সালেহীন-এর আক্বীদা-বিশ্বাসের উপর সুদৃঢ় থাকার তাওফীক্ব দান করুন।
আ-মীন, বিহুরমাতি সায়্যিদিল মুরসালীন। 

টিকা:
তিরমিযী, আস্ সুনান, হা/ ৩৬৭৩
বোখারী, আস্ সহীহ, হা/ ৩৬৭১
শরহে নানীযুল বালাগাহ্ লি ইবনে মায়শাম বাহরানী, পৃ. ৪৮৬, খ– ৩, মুদ্রণ: ইরান
তারীখুল খুলাফা, সুয়ূত্বী, ইবনে আসাকির
ফাতাওয়া-ই রযভিয়্যাহ্, ফাতাওয়া-ই আলমগীরী, বাহারে শরী‘আত, ১ম খ-, বাব-১১
সহীহ বোখারী, হা/ ৩৩৮৪
তিরমিযী, আস্ সুনান, হা/ ৩৬৭৩
সহীহ বোখারী, হা/ ৭৩৬০; সহীহ মুসলিম, হা/ ২৩৮৬; তিরমিযী, হা/ ৩৬৭৬
তিরমিযী, হা/ ৩৬৬৩, ইবনে মাজাহ্, হা/ ৮০
সহীহ মুসলিম,
আস্ সীরাতুল হালাবিয়া, খ–৩, পৃ. ৫১৩
আল্ বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খ–৬, পৃ. ৩০১
ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী, খ–২, পৃ. ২৬৪

লেখক: পরিচালক, আনজুমান রিসার্চ সেন্টার ও খতীব, নওয়াব ওয়ালী বেগ খাঁ জামে মসজিদ, চকবাজার, চট্টগ্রাম

Share:

Leave Your Comment