তুরস্কে মিলাদুন্নবী সপ্তাহ- মুহাম্মদ শাফাআতুজ্জামান নাঈম

তুরস্কে মিলাদুন্নবী সপ্তাহ- মুহাম্মদ শাফাআতুজ্জামান নাঈম

তুরস্কে মিলাদুন্নবী সপ্তাহ নবী প্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত –

মুহাম্মদ শাফাআতুজ্জামান নাঈম

===

মানবতার মুক্তিদাতা, বিশ্ব শান্তির অগ্রদূত, রাহমাতুল্লিল আলামীন বিশ্বনবী মুহাম্মদ মুস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর শুভাগমন বিশ্ববাসীর জন্য বড়ই নেয়ামত। তাই তার শুভাগমনের দিন ও সময়কাল, মোবারক জীবনীর উপর আলোচনা, আনন্দ উদযাপন, আল্লাহর শোকরিয়া আদায় পৃথিবীর দেশে দেশে ভিন্ন ভিন্ন আংগিকে উদযাপিত হয়।

তারই ধারাবাহিতায় তুরস্কেও প্রিয় নবিজীর ভালবাসায় সপ্তাহব্যাপী এক ব্যতিক্রমধর্মী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।ঘরে ঘরে নেমে আসে আনন্দ উৎসব। এশিয়া-ইউরোপ দুই মহাদেশের সংযোগস্থল, গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক অবস্থানে অবস্থিত তুরস্ক বিশ্ব সভ্যতার ধারক ও উসমানী খেলাফতের জন্যে বিশ্বব্যাপী প্রসিদ্ধ ও নন্দিত একটি রাষ্ট্র। বিশ্ব মুসলিম সভ্যতার অসংখ্য নিদর্শন তুরস্কের ঐতিহাসিক নগরী ইস্তাম্বুল, রাজধানী আনকারা,আল্লামা রুমির শহর কোনিয়া, বুরসা, এদিরনে সহ অনেক শহরে বিদ্যমান। বিশেষত হিজরতের দিন মদিনা মোনাওয়ারায় প্রিয় নবিজী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের মেজবান, জলিলুল কদর সাহাবি হযরত আবু আইয়ুব আল আনসারি রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর পবিত্র মাজার ইস্তাম্বুলকে আলোকিত করেছে বহুগুণে। হানাফি মাজহাবের অনুসারী তার্কি জাতির হৃদয়ে নবীপ্রেম, সাহাবা আজমাইনের প্রতি অগাধ ভালবাসা, আলেম ওলামা, পীর মাশায়েখগণের প্রতি অতীব শ্র্রদ্ধা প্রশংসনীয়। যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো নবিজী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের শুভাগমনের মাসে ‘মিলাদুন্নবী সপ্তাহ’ উদযাপন।

আজকের আধুনিক তুরস্কের কয়েক যুগ পূর্বের ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই- উসমানী খেলাফতের পতন ও গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র হওয়ার পর দুর্ভাগ্যবশত কয়েক যুগ তার্কি জাতির জন্য দীন চর্চা একপ্রকার নিষিদ্ধ থাকলেও তারা হৃদয়ের মণিকোঠায় দীনের সে প্রেমকে লালন করেছেন। গোপনে দীন আকড়ে ধরেছিলেন। অবশেষে পৃথিবির অমোঘ নিয়মানুযায়ী জুলুম অত্যাচারের অবসান হলে আল্লাহ পাক তাদের জন্য দীন চর্চার দুয়ার নতুন ভাবে খুলে দিলেন। দীনের মৌলিক বিষয়ে কারো সাথে আপোষ না করতে তারা বদ্বপরিকর। ছোটখাটো বিষয় কিংবা শাখা মাসআলা নিয়ে তর্কবিতর্ক করাকেও তারা পাশ কাটিয়ে চলেন। সেক্ষেত্রে প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার এশার আজানের আগে সালাত সালাম পড়াকে তারা একপ্রকার আবেগ দিয়ে উপভোগ করে থাকেন। প্রসঙ্গত: আজকের আধুনিক তুরস্কে তার্কি জাতি দীনের কিছু বিষয়কে রসমে পরিণত করে নিয়েছেন। যা হাদিসে রাসূল দিয়ে প্রমাণিত আমল, তাই প্রশংসনীয়ও বটে। যেমন -ফরজ নামাজের পূর্বে সুন্নাত আদায় (সুন্নতে মুয়াক্কদা -গায়রে মুয়াক্কাদা বলে উপেক্ষা না করা), সালাম ফিরানোর পরপর আস্তাগফিরুল্লাহ ও দোয়া পড়া,সালাত সালাম পড়া, নামাজের পর আয়াতুল কুরসি পাঠ, তাসবিহাত আদায় (৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ, ৩৩/৩৪ বার আল্লাহু আকবর), ফযর ও মাগরিবের নামাজের পর সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াত পাঠ,এশার নামাজের পর সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পাঠ,ইমাম সাহেব মুক্তাদিদের দিকে ফিরে বসে সম্মিলিত ভাবে দোয়া-মোনাজাত করা, মসজিদ থেকে বের হওয়ার পূর্বে একবার সূরা ফাতিহা পড়া প্রভৃতি।

তুরস্কে প্রতি বছর প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের শুভাগমনের শুভক্ষণকে স্মরণ করে সমগ্র দেশজুড়ে সপ্তাহব্যাপী বিশাল আয়োজনের ব্যবস্থা করা হয়। (মিলাদুন্নবী সপ্তাহ) নামের এ আয়োজন ধর্ম মন্ত্রনালয়ের অধীনে ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়।

বলাবাহুল্য,তুরস্কের সমস্ত জুমা মসজিদ সরকারী খরচে পরিচালিত হয়। খতিব, ইমাম, মুয়াজ্জিন, আলোচকগণ সরকারি চাকুরিজিবি হিসেবে রাষ্ট্রের সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে থাকেন। প্রতি বছর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে সমস্ত মসজিদে শিশু-কিশোরদের জন্য সহিহ কোরআন ও ইসলাম শিক্ষার আয়োজন করা হয়। ইমাম- মুয়াজ্জিন সহ আরো কয়েকজন শিক্ষককে রাষ্ট্র এ জন্য সম্মানী প্রধান করে থাকে।

‘‘মিলাদুন্নবী সপ্তাহ’’ নামে প্রতি মসজিদে সপ্তাহব্যাপী নারী-পুরুষের জন্য পৃথক পৃথক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ‘‘পবিত্র মিলাদুন্নবি সপ্তাহ সফল হোক’’, ‘‘আসুন, আমরা একতাবদ্ধ থাকি’’ প্রভৃতি লেখা সমৃদ্ধ ব্যানার, ফেস্টুন সর্বত্র পরিলক্ষিত হয়।

মসজিদ ভিত্তিক আলোচনা সভার পাশাপাশি জনবহুল শহর গুলিতে বিভিন্ন অডিটোরিয়াম, কনভেনশন হল, কমিউনিটি সেন্টারে নবিজি সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের মোবারক জীবনীর উপর সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এর আয়োজন করা হয়। প্রতিটি অনুষ্ঠানে নারী পুরুষের উপস্থিতি লক্ষণীয়। সেমিনার হলগুলি বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বেষ্টিত থাকে। প্রত্যেক মেহমান বা শ্রুতাকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে অভিনন্দন জানিয়ে ফুল, নবীজীর বাণী সমৃদ্ধ ষ্টীকার, বই উপহার দেওয়া হয়। অনুষ্ঠান শেষে এক প্রকার হালুয়া জাতীয় মিষ্টান্ন, খেজুর, জুস প্রভৃতি আপ্যায়নের ব্যবস্থাও থাকে।

প্রতিটি অনুষ্ঠান স্বল্প-দৈর্ঘ হয়। যাতে শ্রুতার বিরক্তি না ঘটে সেদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখা হয়। এ লক্ষ্যে আলোচক পূর্ব থেকে সময় ও বিষয় নির্ধারণ করে সারগর্ভ আলোচনা উপস্থাপন করে থাকেন।আলোচনার শুরুতে কোরআন তিলাওয়াত, হামদ-নাতে মুস্তফাও পরিবেশিত হয়।আলোচনায় বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের শরিয়া ফ্যাকাল্টির ডীন, বিভাগীয় প্রধান, বড় আলেমগণ অংশ গ্রহন করেন এবং আলোচনা সাজানো গুছানো, সংক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। আলোচনার শেষে শ্রুতাদের জন্য উন্মুক্ত প্রশ্নোত্তর এর ব্যবস্থাও থাকে। পূর্ব থেকে নির্ধারিত তালিকা করে ইশতেহার প্রচার করা হয়। কখন, কোথায়, কোন আলোচক, কি বিষয়ে আলোচনা করবেন তাও তাতে সন্নিবেশিত থাকে। সর্বশেষ অনুষ্ঠানটি বিশাল সমারোহে সমাবেশের রূপে প্রসিদ্ধ নগরির বিখ্যাত স্টেডিয়াম বা খোলা মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন স্থান থেকে সমাবেশে যোগদানের লক্ষ্যে গাড়ির ব্যবস্থাও করা হয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র, সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, দাতব্য সংস্থা, সামাজিক সংগঠনের ভূমিকাও লক্ষণীয়। এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন প্রেসিডেন্ট, প্রধান মন্ত্রী সহ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সুধিসমাজ।বিভিন্ন মিডিয়ায় সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। সর্বশেষ আলোচনা ও দোয়া পরিচালনা করেন দায়িত্ব পালনকারী ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর গর্ভনর। যিনি খবই প্রসিদ্ধ, দক্ষ আলেম, হাফেজ, ডক্টর, প্রফেসর পর্যায়ের হয়ে থাকেন।বিভিন্ন দেশের লোকজন ও শিক্ষার্থীদেরকেও স্বস্ব দেশের পতাকা নিয়ে এ বিশাল অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে দেখা যায়। সব মিলিয়ে সপ্তাহব্যাপী উদযাপিত আনন্দঘন পরিবেশ সর্ব বৃহৎ এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আরো বেশি পূর্ণতা লাভ করে। বাস, ট্রাম ও রেল স্টেশনে পথচারীদের মাঝে এক জাতিয় খাবার (যাকে তার্কি ভাষায় ‘কান্দিল সিমিত’ বলা হয়) পরিবেশন করতেও দেখা যায়।

‘মিলাদুন্নবী সপ্তাহ’ উদযাপন তার্কি জাতির পক্ষ থেকে প্রিয় নবিজী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভালবাসার উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত। যা নিয়ে জায়েজ-নাজায়েজ, শিরক-বিদআত প্রভৃতি ফতুয়ার পিছনে না ছুটে বরঞ্চ সর্বত্র নবীজী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের ভালবাসা ছড়িয়ে দিতে তারা আপ্রাণ চেষ্টা চালান। নবীজী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামে সুমহান আদর্শে জাতি উজ্জীবিত হোক, তার ‘খুলুকে আজীম’ মানুষ চর্চা করুক এ থাকে তাদের প্রচেষ্টা।

বিশ্বায়নের এ যুগে আকাশ সংস্কৃতির করাল গ্রাস সহ নানা ষড়যন্ত্রে সমগ্র মুসলিম মিল্লাত যখন বিপদ গ্রস্থ তেমনি সময়ে নতুন প্রজন্ম সহ জাতিকে দীনের পথে, নবিজী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের অনুকরণীয় আদর্শের দিকে আহবান করে এমন আয়োজন সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। এমন আয়োজন বড্ড প্রয়োজনও বটে। কারণ বিশ্বব্যাপী শান্তির একমাত্র পথ ও মত হল বিশ্বে শান্তির আধার হয়ে শুভাগমনকারী প্রিয় নবিজী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের অনুপম আদর্শ।

মহান আল্লাহ আমাদেরকেও নবীজী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের ভালবাসা দান করুন, তারই অনুসরণে আমাদের জীবন গড়ার তাওফিক দান করুন।…. আমিন।

লেখক : এম.এ (শেষ বর্ষ), ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্তাম্বুল, তুরস্ক।