ঈদে মীলাদুন্নবী ও সীরাতুন্নবী (1)

ঈদে মীলাদুন্নবী ও সীরাতুন্নবী (1)

ঈদে মীলাদুন্নবী ও সীরাতুন্নবী [সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম] উদ্যাপনের বাস্তবতা –

           মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান =

।। এক।।

পবিত্র  ক্বোরআনের আলোকে ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনের দলীল

মানুষ যখন কোন নি’মাত ও রহমতপ্রাপ্ত হয়, তখন তজ্জন্য আনন্দোৎসব করা তার স্বভাবজাত কাজ। আল্লাহর নির্দেশও তাই।

(১)

যেমন পবিত্র ক্বোরআনে এরশাদ হচ্ছে- قُلْ بِفَضْلِ اللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَٰلِكَ فَلْيَفْرَحُوا هُوَ خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُونَ (৫৮)

তরজমা: (হে হাবীব) আপনি বলুন! আল্লাহরই অনুগ্রহ ও তাঁর দয়া; এবং সেটারই উপর তাদের আনন্দ প্রকাশ করা উচিত। তা তাদের সমস্ত ধন-দৌলত অপেক্ষা শ্রেয়।

[সূরা ইয়ূনস, আয়াত-৫৮, তরজমা: কানযুল ঈমান বাংলা সংস্করণ]

উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম জালাল উদ্দীন সুয়ূতী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর তাফসীর গ্রন্থ ‘আদ্ দুররুল মনসূর’-এ উল্লেখ করেছেনঃ

اَخْرَجَ اَبُوْ الشَّيْخِ عَنْ اِبْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا فِى الْايَةِ قَالَ فَضْلُ اللهِ اَلْعِلْمُ وَرَحْمَتُه النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْه وَسَلَّمَ قَالَ اللهُ تَعَالى وَمَآ اَرْسَلَنكَ اِلاَّ رَحْمَةً لِّلْعلَمِيْنَ ـ [سُوْرَةُ الْاَنْبِيَاءِ] وكذا قال الالوسى فى روح المعانى (الجزء ـ ১০: صـ ১৪১) وابو السعود فِى تفسيره والامام الرازى فى التفسير الكبير الجزء ১৭ـ الصفحة ১২৩ : (والدّرُّ المَنْثُوْرُ للسُّيُوْطِىْ ـ الجزء ـ৪ : صـ ৩৬৭)

অর্থাৎ হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা এ আয়াতের তাফসীরে বলেন, ‘‘এখানে ‘আল্লাহর অনুগ্রহ’ فَضْلُ الله)) দ্বারা ‘ইলমে দ্বীন’ বুঝানো হয়েছে আর ‘রহমত’ ( رَحْمَة) দ্বারা বুঝানো হয়েছে ‘নবী করীম সরকারে দু’ আলম নূরে মুজাস্সাম আমাদের প্রিয় আক্বা হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর কথা। যেমন, আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ ফরমান, ‘‘হে হাবীব! আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্ব-জগতের প্রতি ‘রহমত’ করেই প্রেরণ করেছি।’’  [সূরা আম্বিয়া: আয়াত-১০৭]

ইমাম আলূসী তাঁর ‘রূহুল মা‘আনী’: ১০ম খন্ড: পৃষ্ঠা ১৪১-এ, আবুস্ সা‘ঊদ তাঁর তাফসীর গ্রন্থে এবং ইমাম রাযী তাঁর ‘তাফসীর-ই কবীর’: খন্ড ১৭, পৃ. ১৩২-এ অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। [ইমাম সুয়ূত্বী কৃত ‘তাফসীর-ই আদ্দুররুল মানসূর’ ৪র্থ খন্ড, পৃ. ৩৬৭]

তাছাড়া, আল্লামা শাওকানী তাঁর রচিত ‘তাফসীরে ফাতহুল ‘ক্বাদীর’-এ লিখেছেনঃ

رُوِىَ عَنِ الْحَسَنِ والضحّاكِ وَمُجَاهِدٍ وَقَتَادَةَ اَنَّ فَضْلَ اللهِ الْاِيْمَانُ وَرَحْمَتُهُ الْقُرْانُ وَالْاَوْلى حَمْلُ الْفَضْلُ وَالرَّحْمَةِ عَلى الْعُمُوْمِ [ تفسير فتح القدير للشكوكانى : الجزء ـ২ـ صـ ৪৫৪]

অর্থাৎঃ হযরত হাসান বসরী, হযরত দ্বাহ্হাক্ব, হযরত মুজাহিদ ও হযরত ক্বাতাদাহ্ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, উপরোক্ত আয়াতে করীমায় ‘আল্লাহর অনুগ্রহ’ ‘মানে ‘ঈমান’ এবং ‘তাঁর রহমত’ মানে ‘ক্বোরআন’। তবে, উত্তম হচ্ছে ‘অনুগ্রহ’ ও ‘রহমত’ (শব্দ দু’টি)-কে ব্যাপকার্থে ব্যবহার করা।

[আল্লামা শাওকানী কৃত. ‘তাফসীর-ই ফাত্হুল ক্বদীর’ : ২য় খন্ড: ৪৫৪পৃ.]

অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘আলার কোন অনুগ্রহ ও নি’মাত পেয়ে প্রাপ্ত ব্যক্তি খুশী উদ্যাপন করতে পারবে। আর আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর সর্বাধিক বড় অনুগ্রহ, রহমত ও নিমাত।

সুতরাং তাঁর মীলাদ শরীফের খুশী উদযাপনও তদনুরূপ হওয়া চাই।

( ২)

মহান আল্লাহ পৃথিবী পৃষ্ঠে হুযূর আক্রাম প্রিয় রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আগমনকে মানব জাতির জন্য বড় ইহসান (অনুগ্রহ) হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এরশাদ হচ্ছেঃ

لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِنْ أَنْفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ (سورة ال عمران : الاية ১২৪)

তরজমা: নিশ্চয় আল্লাহর মহান অনুগ্রহ হয়েছে মুসলমানদের উপর যে, তাদের মধ্যে তাদেরই মধ্য থেকে তিনি একজন রসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের উপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করেন তিনি, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দান করেন; আর তারা এর পূর্বে স্পষ্ট গোমরাহীতে ছিলো। [সূরা আল-ই ইমরান: আয়াত-১৬৪, তরজমা: কানযুল ঈমান বাংলা সংস্করণ]

এ আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের প্রিয় রসূলের শুভাগমনকে মু’মিনদের জন্য ‘বিশেষ অনুগ্রহ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। পূর্ববর্তী আয়াতে আল্লাহর যে কোন নি’মাত ও অনুগ্রহ পেয়ে তা নিয়ে খুশী উদযাপন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং পার্থিব সাধারণ নি’মাত বা অনুগ্রহ লাভ করার দরুন যদি ঈদ বা খুশি প্রকাশ করা যেতে পারে, তবে সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ অর্থাৎ মহান রসূলের শুভাগমনের মুহূর্ত, মাস, দিন ও কালকে স্মরণ করে (শরীয়তসম্মত উপায়ে) আনন্দোৎসব করা যে উত্তম কাজ তা’তে সন্দেহের অবকাশ নেই।

তদুপরি, সূরা আল-ই ইমরানের উপরোক্ত আয়াতে করীমায় মহান রব্বুল আলামীন রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীর বুকে শুভাগমনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছেন। এটাই তো ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনের অন্যতম কর্মসূচি হয়ে থাকে।

(৩)

পবিত্র ক্বোরআনে আরো এরশাদ হচ্ছেঃ

وَمَآ اَرْسَلْنكَ اِلاَّ رَحْمَةَ لِلْعلَمِيْنَ (سورة الانبياء : الاية ১০৭)

তরজুমা: এবং আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্ব-জগতের জন্য রহমত করেই প্রেরণ করেছি।

[সূরা আম্বিয়া: আয়াত-১০৭। তরজমা: কানযুল ঈমান বাংলা সংস্করণ]

এ পবিত্র আয়াতে মহান আল্লাহ্ প্রিয় নবীর ‘ইরসাল’ তথা তাঁকে পৃথিবীর বুকে প্রেরণের কথা উল্লেখ করেছেন এবং তাঁকে ‘রহমাতুল্লিল আলামীন’ বলে আখ্যায়িত করে তাঁর বরকতময় সত্তার বিবরণ দিয়েছেন। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন-

اِنَّه عَلَيْهِ السَّلاَمُ كَانَ رَحْمَةً فِىْ الدِّيْنِ وَفِى الدُّنْيَا ـ اَمَّا فِى الدِّيْنِ فَلِاَنَّه عَلَيْهِ السَّلاَمُ بُعِثَ وَالنَّاسُ فِى جَاهِلِيَّةٍ وَضَلاَلَةٍ الخـ ….

[التفسير الكيير للامام فخر الرزازى ـ الجزء ২২ ـ صـ ২৩০]

অর্থাৎ তিনি (নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) দ্বীন ও দুনিয়া-উভয় ক্ষেত্রে ‘রহমত’। দ্বীনের ব্যাপারে হুযূর সাহিবে লাওলাক রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ‘রহমত’ হওয়ার কারণ হচ্ছে- তাঁর শুভাগমন এমন সময়ে হয়েছিলো যখন মানবজাতি জাহেলিয়াতের গোমরাহীর মধ্যে নিমজ্জিত ছিলো।

(তাঁরই মাধ্যমে বিশ্ববাসী হিদায়ত লাভ করে ধন্য হয়েছে।) আর পৃথিবীতে তিনি ‘রহমত’ এ জন্য যে, তাঁরই আগমন ও শুভ পদার্পণে গোটা অশান্ত পৃথিবী শান্তির ছোঁয়া লাভ করে ধন্য হয়েছে।’’      [ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী কৃত তাফসীর-ই কবীর: ২২তম খন্ড: পৃ-২৩০]