আমাদের আদর্শ প্রিয় নবী – জসিম উদ্দীন মাহমুদ

আমাদের আদর্শ প্রিয় নবী – জসিম উদ্দীন মাহমুদ

আমাদের আদর্শ প্রিয় নবী –
জসিম উদ্দীন মাহমুদ

===

আল্লাহ তায়ালার প্রিয় হাবীব হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আগমনে বিশ্বমানব লাভ করেছে অনুপম কল্যাণময় পথের দিশা, মানবিক মূল্যবোধ ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নিরূপনের ক্ষমতা। তাঁর অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব, অতুলনীয় সততা, ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ, আল্লাহর প্রতি পরম আস্থা ও নির্ভরতা, সৃষ্টি জগতের প্রতি অগাধ প্রেম ও ভালোবাসা, সৌভ্রাতৃত্ববোধ ও সাম্যনীতি তথা সর্বোত্তম জীবন ব্যবস্থা উপস্থাপনে তিনি বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ মহামানব হিসেবে দেশ-কাল-জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকলের নিকট মহিমান্বিত মর্যাদায় অভিষিক্ত ও অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তাঁর প্রচারিত দ্বীন ‘ইসলাম’ সর্বকালের সকল মানুষের একমাত্র মুক্তির পাথেয়। তাঁর অনুপম শিক্ষা ও আদর্শ দিতে পারে মানবতার মুক্তি।

মীলাদে মুস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম
পবিত্র ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছর আমাদের ঈমান ও নবীপ্রেমে নিয়ে আসে এক নবতর সজীবতা। হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত এই মুবারক উৎসব যেন মহান আল্লাহর সবচেয়ে বড় নেয়ামতের বিনম্র কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের আরবী ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার প্রিয় নবীর শুভাগমন ছিল বিশ্বের সকল মানুষের মুক্তির ওসিলা। অসত্যের অন্ধকার থেকে মহাসত্যের নূরানী উদ্ভাস। দুনিয়া ও আখেরাতের মঙ্গলের বার্তা নিয়ে তিনি এসেছিলেন। তাই মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, “প্রকৃতই আল্লাহ মুমিনদের বড় উপকার করেছেন। যখন তিনি তাদেরই মধ্য হতে প্রেরণ করেছেন এক মহান রাসূল। যে তাঁর আয়াতসমূহ তাঁদের নিকট তিলাওয়াত করে, তাদেরকে পরিশোধন করে এবং তাদেরকে কিতাব ও বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়। যদিও তারা পূর্বে বিভ্রান্তিতেই ছিল।”[৩:১৬৪]

এই অনুগ্রহ ও বরকত পেয়ে আমরা কী করব, তাও মহান আল্লাহ বলে দিয়েছেন : “বলুন, আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর করুণা লাভ করে তোমরা অবশ্যই আনন্দ-উৎসব করবে।”

আল্লাহর হাবীবের প্রতি লাখো সালাম
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মহান আল্লাহর সর্বাপেক্ষা প্রিয় বন্ধু। মহান আল্লাহ সর্বদা তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে রহমতের মাধ্যমে প্রিয়তম করেন। তাঁর প্রতি স্বয়ং আল্লাহ সালাত প্রেরণ করেন। তাঁর ফেরেশতাগণও সালাত প্রেরণ করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালার পবিত্র বাণী, “নিশ্চয়ই আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি সালাত প্রেরণ করেন, ওহে যারা ঈমান এনেছ, তোমরাও তাঁর উপর সালাত প্রেরণ কর এবং বিশেষভাবে সালাম দাও।” [সূরা আল-আযাব, আয়াত : ৫৬] হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন : “যে ব্যক্তি আমার উপর একবার সালাত (দরূদ শরীফ) পড়ে আল্লাহ তার উপর দশটি রহমত নাযিল করেন।”
[মুসলিম, সাহীহ, ২/৩২৭, আবু দাউদ, সুনান,২/১১৯, তিরমিযী, জামি, ২/৩০৫, হাদিস ৪৪৬]

সারা জাহানের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক
আল-কুরআন ও হাদীস ভিত্তিক ইসলামী শিক্ষা হলো মুসলমানদের মৌলিক শিক্ষা। তাছাড়া এর শাখা উৎসমূল হিসাবে ইজমা ও কিয়াসকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই শিক্ষাকে ওহী নিঃসৃত শিক্ষা নামেও অভিহিত করা হয়েছে। এই শিক্ষার আদর্শ শিক্ষক ছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম শিক্ষকতাসহ একজন মু’মিন-মুসলিমের জীবনের সর্বক্ষেত্রে অনুকরণীয় উত্তম আদর্শ হিসেবে পরিগণিত। মহান আল্লাহ বলেন : “তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসুলুল্লাহ এর মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে। [আল-কুরআন, ৩৩:২১]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে একজন উঁচুমানের শিক্ষক আখ্যা দিয়ে মহান আল্লাহ মু’মিনদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ ও করুণার কথা উল্লেখ করে বলেন : আল্লাহ মু’মিনদের প্রতি অবশ্যই অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের নিজেদের মধ্য হতে তাদের নিকট রাসুল প্রেরণ করেছেন, যে তাঁর আয়াতসমূহ তাদের নিকট পাঠ (তিলাওয়াত) করে, তাদেরকে পরিশোধন করে এবং কিতাব (মহাগ্রন্থ আল-কুরআন) শিক্ষা দেয়।”  [আল-কুরআন, ৩:১৬৪]

নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দাওয়াত
আল্লাহ তায়ালার মনোনীত ধর্ম পবিত্র ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন নবী রাসূলগণ। নবী রাসূল শব্দ দু’টির মধেই যে প্রচারের উদ্দেশ্যটি নিহিত তা আল-কুরআনের বিভিন্ন আয়াত থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়। যেমন : ‘‘রসূলগণকে (প্রেরণ করেছি) সুসংবাদদাতা ও সাবধানকারী করে, যাতে রসূলগণের পরে আল্লাহর নিকট মানুষের কোন অভিযোগের অবকাশ না থাকে এবং আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’’ [সুরা নিসা ৪:১৬৫]

প্রচার বা দাওয়াতি দায়িত্ব পালনটা একটা দুরূহ ব্যাপার। যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে স্ব-স্ব সম্প্রদায়ের প্রচণ্ড বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছেন। আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে একখানা আয়াতে তাঁর মিশনের বর্ণনা এসেছে এভাবে : “হে নবী আমি আপনাকে সাক্ষ্য প্রদানকারী সুসংবাদদাতা, গাফেলদেরকে সতর্ককারী এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁরই দিকে আহ্বানকারী এবং একটি প্রদীপ্ত প্রদীপরূপে প্রেরণ করেছি।” [আহযাব, ৩৩:৪৫-৪৬]

নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সে দায়িত্ব কীভাবে পালন করবেন, তার দিকনির্দেশনাও আল্লাহ তায়ালা নিজে দিয়েছেন: “আল্লাহর পথে লোকজনকে আহ্বান করবে প্রজ্ঞা (হিকমত) পূর্ণ পন্থায় এবং সুন্দর উপদেশবাণীর সাহায্যে।” [নাহাল ১৬:১২৫]

দ্বীনি শিক্ষা গ্রহণ করা ফরয
মানব জীবনের অধ্যায় হলো দুটি। ইহলৌকিক অধ্যায় ও পরলৌকিক অধ্যায়। একজন মানুষকে তখনই সফল বলা যেতে পারে যখন সে নিজ জীবনের এই উভয় অধ্যায়ে সফলতা অর্জন করে। জীবনের উভয় অধ্যায়ের সফলতা সম্পর্কে দিক-নির্দেশনা চূড়ান্ত ও নিশ্চিতভাবে দেয় একমাত্র ইলমে ওহী। এ জন্য প্রতিটি মুসলমানের জন্য দীনি শিক্ষা গ্রহণকে ফরয বলে ঘোষণা করছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন : “দীনি শিক্ষা অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম (নর-নারী)’র জন্য ফরয।”

অনুপম চরিত্রে প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম
পৃথিবীতে অনেক মহামানব তাঁদের চারিত্রিক গুণাবলী, মতবাদ ও আদর্শের কারণে মানব জাতির নিকট স্মরণীয় হয়ে আছেন। কিন্তু গুণাবলী ও মতবাদ তাঁদের নিজস্ব চিন্তা থেকে উদ্ভব হয়ে থাকে। ফলে তাঁদের গুণাবলী মানব সমাজে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বা গ্রহণযোগ্যতা লাভ করতে পারে না। এমনকি কালক্রমে মানুষের মনোজগৎ থেকে এগুলোর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। পক্ষান্তরে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-কে আল্লাহ পাক এরূপ অনুপম চরিত্র মাধুর্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, যাতে মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর যুগ থেকে কিয়ামত পর্যন্ত আগত জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পৃথিবীর যে কোন মানুষ তাঁর অনুপম চারিত্রিক মাধুর্য গ্রহণ করে ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ লাভ করতে সক্ষম হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন : “নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর রাসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ।” [সুরা আহযাব : আয়াত ২১] অপর আয়াতে আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন : “এবং নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের উপর অধিষ্ঠিত।”
[সুরা কালাম : আয়াত ৪]

আল্লামা শেখ সাদী (রহ.) লিখেছেন :
বালাগাল উলা বিকামালিহি
কাশাফাদ্ দুজা বিজামালিহি
হাসুনাত জামীউ খিসালিহি
সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি।
অনুবাদ :
আরোহন করেছেন তিনি পূর্ণতার সর্ব শীর্ষে
তাঁর সৌন্দর্যে সমস্ত অন্ধকার আলোকিত হয়েছে
অপূর্ব চরিত্র তাঁর অনুপম সৌন্দর্যে মণ্ডিত,
সালাম তাঁকে, সালাম তাঁর পরিবারবর্গকে।

নবীজির আদর্শে জীবনের নিরাপত্তা
ইসলাম পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। এটি শান্তি ও নিরাপত্তার ধর্ম। জীবনের নিরাপত্তা তথা স্বাভাবিক জীবন ও মৃত্যুর গ্যারান্টি মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম তথা রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ মানুষকে জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছে। তাই ইসলাম হত্যাকাণ্ডকে হারাম ঘোষণ করেছে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : “যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে নৈরাজ্য সৃষ্টির কারণ ব্যতীত কাউকে হত্যা করে, সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করে আর যে ব্যক্তি কারো জীবন রক্ষা করে, সে যেন সকল মানুষের জীবন রক্ষা করে।” [সুরা মায়িদা : ৩২] এভাবে ইসলাম দিয়েছে সম্পদ, মান-মর্যাদা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, বসবাস, খাবার, ব্যক্তি স্বাধীনতা, ইনসাফ বা ন্যায়বিচারসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে সঠিক নিরাপত্তা।

স্বাস্থ্য-শিক্ষায় প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম
দৈহিক সুস্থতা আল্লাহ তায়ালার একটি নিয়ামত। এর প্রতি উদাসীন হওয়া যাবে না। ইসলাম সুস্থ জীবন কামনা করে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন : “তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে নিক্ষেপ করোনা”।
[সুরা বাকারা : ১৯৫]

পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা আল্লাহ খুব পছন্দ করেন। ইরশাদ হয়েছে : আল্লাহ তওবাকারীকে ভালোবাসেন এবং যারা পবিত্র থাকেন তাদেরকেও।

বেকার সমস্যা সমাধানে মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম
নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজে কাজ করে বেকার লোকদেরকে কাজের প্রতি উৎসাহ প্রদান করতেন। বেকার ও অলস জীবনের প্রতি নিরুৎসাহিত করতেন। তিনি বলেছেন, অকর্মন্য অলস ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার অপছন্দনীয় এবং উপার্জনকারী কর্মঠ ব্যক্তি রাব্বুল আলামীনের পছন্দনীয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, “সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ খোঁজ কর।”  [সূরা জুমুয়া : ১০]

এছাড়া মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম দানের প্রতি উৎসাহিত করে বেকার সমস্যা দূরীকরণে ভূমিকা পালন করেন। মহান রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন, “তারা আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে কি তারা ব্যয় করবে? আপনি বলুন, নিজের প্রয়োজনের পরে যা থাকবে তা ব্যয় করবে। এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য নিদর্শনাবলী সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন যাতে তোমরা চিন্তা করতে পার। [সুরা বাকারা : ২১৯]

শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর
ইসলামের আবির্ভাব মুহূর্তে ও তার আগের বিশ্বের মানবসমাজে বিরাজমান ছিল চরম বৈষম্য। সুদ, ঘুষ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, হত্যাকাণ্ড প্রভৃতি অবাধে চলতো। তখনকার সামাজিক অনাচার ও অশান্তির অন্যতম কারণ ছিল অর্থনৈতিক বড় রকম পার্থক্য। এই অশান্ত সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম । তাঁর শান্তি প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ ও পদ্ধতি ছিল অনন্য। যুদ্ধ-বিগ্রহ, কলহ-বিবাদ, রক্তপাত, অরাজকতা ইত্যাদি দূরীভূত করে মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির ভিত্তিতে তিনি একটি অনুপম আদর্শ কল্যাণমূলক সমাজ গড়তে সক্ষম হন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন : “তোমরা ছিলে পরস্পর শত্র“, অতঃপর তিনি তোমাদের মধ্যে প্রীতি স্থাপন করে দিলেন আর তোমরা হয়ে গেলে পরস্পর ভাই ভাই।”[সূরা আলে ইমরান, আয়াত :১০৩]

দুর্নীতির মূলোৎপাটন
রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এসেছেন দুর্নীতির মূলোৎপাটন ও সুনীতির প্রচলন ঘটিয়ে মানুষকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছিয়ে দিতে। দুর্নীতি ও অসদুপায়ে অর্জিত ধন সম্পদ এবং বেঈমান সন্তান সন্ততি মহান আল্লাহর সম্মুখে কোনই কাজে আসবেনা। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন, “তোমাদের ধন সম্পদ ও সন্তান সন্ততি এমন কিছু নয় যা তোমাদেরকে আমার নিকটবর্তী করবে। তবে যারা ঈমান এনে সৎকর্ম করে তারাই তাদের কর্মের বহুগুণ পুরস্কার পাবে আর তারা প্রসাদে নিরাপদ থাকবে। [৩৪ : ৩৭]

নীতিসম্মত কর্মে উৎসাহ প্রদানে মহান আল্লাহ বলেন : “নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়নতা, সদাচরণ ও আত্মীয় সজনকে দান করার নির্দেশ দেন এবং তিনি নিষেধ করেন অশ্লীলতা, অপকর্ম ও সীমালংঘন, তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন যাতে তোমরা শিক্ষা গহণ কর।” [১৬ :৯০]

সামাজিক বন্ধন
সামাজিক বন্ধনের গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন : “মুমিনরা তো পরস্পর ভাই ভাই। অতএব তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করবে এবং আল্লাহকে ভয় করবে, যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হও।” [সূরা আল হুজরাত, আয়াত : ১০]

“হযরত নুমান ইবনে বশীর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মুমিনরা এক দেহের ন্যায়, যদি তার চোখ ব্যথিত হয় তাহলে সমস্ত শরীর ব্যথিত হয়। যদি মাথা ব্যথিত হয় সমস্ত শরীর ব্যথিত হয়।” [মুসলিম শরীফ]

শরীয়তের আলোকে নারীদের মর্যাদা
শরীয়ত আইনের দৃষ্টিতে সকল নাগরিক সমান। নাগরিকদের মৌলিক মর্যাদা ও অধিকার সমান। এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র, শেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ পার্থক্য করা হবে না। তবে শিক্ষা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী যার যতটুকু প্রাপ্য তাকে ততটুকু মর্যাদা, অধিকার, সামাজিক সুযোগ, রাষ্ট্রীয় সুবিধা ও কর্মের সুযোগ দেওয়ার বিধান রয়েছে। প্রাসঙ্গিকভাবে আমরা মহান আল্লাহর বাণী সামনে রাখতে পারি। “হে মানব জাতি! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর তিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গীনীকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের থেকে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন।” [আল-কুরআন : ৪-১০] মহান আল্লাহ আরো বলেন, আমি পুরুষ নারী কারো কৃতকর্মের প্রতিফল বিনষ্ট করি না।” [আল-কুরআন, ০৩ : ১৯৫]

প্রতিহিংসা পরিহার
হিংসার প্রতিক্রিয়ায় যা সংঘটিত হয় তাকে প্রতিহিংসা বলে। প্রতিহিংসা মানব চরিত্রে এক মারাত্মক ব্যাধি যা মানব মর্যাদাকে চরমভাবে ক্ষুণœ করে এবং মানুষকে মনুষ্যত্বের স্তর থেকে পশুত্বের স্তরে নামিয়ে দেয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হিংসা পরিহারের নির্দেশ দিয়ে বলেন, “তোমরা হিংসা পরিহার কর, কেননা হিংসা পুণ্যসমূহকে খেয়ে ফেলে, যেমন আগুন শুকনো লাকড়িকে খেয়ে ফেলে।” [আবু দাউদ]

অন্য হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমরা পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ করো না, পরস্পর সম্পর্ক ছিন্ন করো না একে অন্যের পিছনে লেগো না এবং আল্লাহর বান্দা সকলে ভাই ভাই হয়ে যাও।” [বুখারী, মুসলিম]

শ্রমিক-মালিক সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম
শ্রমিক শ্রেণী পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসেবে শ্রমজীবীদের সকল সমস্যার সঠিক ও ন্যায়ানুগ সমাধানের সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা তাতে রয়েছে। ইসলাম এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের ধারণা দেয় যাতে শ্রমিক ও নিয়োগকর্তার সম্পর্ক হবে সৌহার্দ্যপূর্ণ। যেখানে থাকবে না জুলুম-শোষণ, থাকবে না দুর্বলকে নিষ্পেষিত করার মত ঘৃণ্য প্রবণতা। ইসলাম শেখায় এরাও মানুষ, এদেরও বাঁচার অধিকার আছে। এরা তোমাদের ভাই। হে মালিক পক্ষ! তুমিতো আরাম কেদারায় বসে জীবিকা অর্জন করছ আর সে? সে তো মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জীবন ঘানি টেনে নিয়ে চলেছে। তোমার উচিত, তোমার প্রতি আল্লাহ তায়ালা যে অনুগ্রহ করেছেন তাঁর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তার যথার্থ পাওনা তাকে বুঝিয়ে দেয়া। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “সাবধান! মজুরের শরীরের ঘাম শুকাবার পূবেই তার মজুরি মিটিয়ে দাও।”[তিরমিযী]

ন্যায় বিচার
ইসলাম হচ্ছে কিয়ামত পর্যন্ত আগত অনাগত সকল মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। তাই ইসলামে মানব জাতির প্রয়োজনের বিষয়টি বিবেচনা করে সমাজে পরিপূর্ণ শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্যে যুগে যুগে মহান আল্লাহ তায়ালা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার নির্দেশ সম্বলিত আইন ও বিধান দিয়ে নবী রাসূলদের প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ বলেন : “নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছি স্পষ্ট প্রমাণসহ এবং তাদের সাথে দিয়েছে কিতাব ও ন্যায় নীতি, যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে।” [সূরা হাদিদ : ২৫]

প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, “ কিয়ামতের দিন সাত প্রকারের লোক আরশের ছায়ার নিচে অবস্থান করবে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ন্যায়পরায়ন শাসক। [বুখারী ও মুসলিম]

শিশু-কিশোরদের সাথে ব্যবহার
বিশ্বজগতের অনুপম, অনুসরণীয় ও সুমহান আদর্শ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। মহান আল্লাহ তাঁর সুমহান চরিত্রের সনদ দিয়েছেন এভাবে, ‘নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত’। [সূরা কলম : ৪]

রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, “আমি উন্নত চরিত্রের পূর্ণতা দানের জন্যই প্রেরিত হয়েছি।” তিনি ছোটদের স্নেহ ও বড়দের সম্মান করার উপর গুরুত্বারোপ করেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, “যে ছোটদের স্নেহ করে না এবং বড়দের সম্মান করে না, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।” নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেছেন, “তোমরা সন্তানদের (শিশুদের) স্নেহ কর, তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার কর এবং সদাচরণ ও শিষ্টাচার শিক্ষা দাও।” [তিরমিযী]

মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শের একনিষ্ঠ অনুসরণ ও প্রচার-প্রসারে যদি আমরা নিরলসভাবে সমবেত উদ্যোগে কাজ করে যাই, তবে আশা করা যায়, বিভ্রান্তির বেড়াজাল ছিন্ন করে ‘সিরাজাম মুনিরা’র আলোকচ্ছটা অচিরেই বিশ্বকে উদ্ভাসিত করবে।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ অনুসরণ, অনুকরণ, প্রচার ও প্রসারের তওফীক দিন। আমিন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কর্মকর্তা- আনজুমানে রহমতুল্লিল আলামীন ট্রাস্ট, চট্টগ্রাম।