আনসার ও মুহাজিরগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন রচনায় প্রিয় নবীজির অনুপম দৃষ্টান্ত

আনসার ও মুহাজিরগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন রচনায় প্রিয় নবীজির অনুপম দৃষ্টান্ত

আনসার ও মুহাজিরগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন
রচনায় প্রিয় নবীজির অনুপম দৃষ্টান্ত

সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী

ইসলামে ভ্রাতৃত্বের গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামের অন্যতম বৈশিষ্ট হলো, মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠা করা। মুমিনদের পরষ্পর বিবাদ-বিসংবাদ দূর করে তাদের মাঝে ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠা করা ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুণ। মুমিনদের পরষ্পর ভ্রাতৃত্ববোধ যত দৃঢ় ও মজবুত হবে ততই তাদের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি বিরাজ করবে। ভ্রাতৃত্বের এই বন্ধন ইসলামি সমাজের মূল ভিত্তি। এই ভ্রাতৃত্বে যখন ফাটল ধরবে, তখন ইসলামি সমাজ আপন স্বকীয়তা হারাবে।
তাই ইসলাম মুমিনদের পরষ্পর বিবাদে লিপ্ত হওয়াকে অত্যন্ত খারাপ মনে করে। তাদের মাঝে যখনই কোনো বিবাদ-বিসংবাদ সৃষ্টি হয়, তৎক্ষণাত তা নিরসনের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে নির্দেশ দেয়। এ প্রসঙ্গে কোরআনে বলা হয়েছে,
وَإِن طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا ۖ فَإِن بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَىٰ فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّىٰ تَفِيءَ إِلَىٰ أَمْرِ اللَّهِ ۚ فَإِن فَاءَتْ فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوا ۖ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ (الحجرات ৯-১০)
“যদি মুমিনদের দুই দল যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তবে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবে। অতঃপর যদি তাদের একদল অপর দলের উপর চড়াও হয়, তবে তোমরা আক্রমণকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে; যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। যদি ফিরে আসে, তবে তোমরা তাদের মধ্যে ন্যায়ানুগ পন্থায় মীমাংসা করে দেবে এবং ইনসাফ করবে। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদেরকে পছন্দ করেন। মুমিনরা তো পরস্পর ভাই-ভাই। অতএব, তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করবে এবং আল্লাহকে ভয় কর-যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও।” [সূরা হুজুরাত, আয়াত: ৯-১০] ইসলাম অত্যাচার-অনাচার, হানাহানি এবং অশুভ আচরণ থেকে মানুষকে শুদ্ধতার দিকে ধাবিত করে। আবদ্ধ করে একে-অপরকে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে, সৃষ্টি করে আদর্শে নিবেদিত, ধর্মানুরাগী, খোদাভীরু, সংযমী ও মিথ্যার সঙ্গে আপসহীন একটি সুন্দর মানবসমাজ। নৈতিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত করার মাধ্যমে মানুষের মনে সততার বিকাশ ঘটায়।

ভ্রাতৃত্ব
আরবীতে أُخُوَّةٌ শব্দের অর্থ ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব ইত্যাদি। পরস্পরের মধ্যে হৃদ্যতা, আন্তরিকতা, সম্প্রীতি, বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্যপূর্ণ নিবিড় সম্পর্ককে ভ্রাতৃত্ব বলা হয়। ইসলাম শান্তির ধর্ম, আর শান্তির অন্যতম নিয়ামক হ’ল ভ্রাতৃত্ব। আর ইসলামে ভ্রাতৃত্বের মূল উৎস হ’ল তাওহীদ ও রিসালত। সুতরাং সবাই সবার সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে থাকবে এটাই মূলত তাওহীদ ও রিসালতের অন্তর্নিহিত দাবী। রক্তের ভ্রাতৃত্বের চেয়ে দ্বীনি ভ্রাতৃত্ব বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
রাসুল সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও সহানুভূতির ক্ষেত্রে মুমিনদের দৃষ্টান্ত এক দেহের ন্যায়, যার একটি অঙ্গ অসুস্থ হলে গোটা দেহ জ¦র ও অনিদ্রায় আক্রান্ত হয়।
[সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০১১; সহীহ মুসলিম, হদীস ২৫৮৬] অন্য হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, الْمُؤْمنُ للْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ يَشدُّ بعْضُهُ بَعْضًا “মুমিনগণ পরস্পর প্রাচীরের ন্যায়, যার একটি গাথুনি অপরটিকে আকড়ে থাকে।
[বুখারী: ৩/১২৯. হা-২৪৪৬। মুসলিম:৪/১৯৯৯. হা-২৫৮৫] পারষ্পরিক বিরোধ নিষ্পত্তির মূল সূত্র হলো ভ্রাতৃত্ব বন্ধন। ভ্রাতৃত্বের এই সূত্রই মূলত মুমিনের জীবনের চালিকা শক্তি। তাই এই শক্তিকে সচল রাখতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন الْمُؤْمِنُ مِرْآةُ الْمُؤْمِنِ، وَالْمُؤْمِنُ أَخُو الْمُؤْمِنِ، يَكُفّ عَلَيْهِ ضَيْعَتَهُ، وَيَحُوطُهُ مِنْ وَرَائِهِ.“মুমিন মুমিনের জন্য আয়না। মুমিন মুমিনের ভাই। সে তার আমানত সংরক্ষণ করে এবং তার অনুপস্থিতিতে তাকে হেফাযত করে।
[সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯১৮] এই সম্প্রীতি ও সহযোগিতার নির্দেশ তাকওয়া ও কল্যাণের পথে, ন্যায় ও বৈধ কাজে। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে ,وَتَعَاوَنُوْا عَلَی الْبِرِّ وَالتَّقْوٰی وَلَا تَعَاوَنُوْا عَلَی الْاِثْمِ وَ الْعُدْوَان “তোমরা তাকওয়া ও ন্যায় কাজে পরস্পরে সহযোগিতা করো। পাপাচার ও অন্যায় কাজে সহযোগিতা করো না।” [সূরা মায়েদা: ০২] অতএব ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা হল, তাকওয়া ও কল্যাণের কাজে মুসলমানগণ পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। নিজেদের মাঝে প্রীতি ও সৌহার্দ্য বজায় রাখবে এবং অন্যায়ের পক্ষাবলম্বন ও সহযোগিতা থেকে বিরত থাকবে। প্রকৃত প্রস্তাবে ইসলাম পরস্পরের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং কল্যাণকর কর্মে একে-অপরকে সহায়তা করাকে কর্তব্য হিসেবে ধার্য করেছে।
মক্কা মুকাররমা থেকে মদীনা মুনাওয়ারায় হিজরত করে চলে আসা মুসলমানদের মুহাজির এবং মদীনায় তাঁদের সহায়তাকারী মুসলমানদের আনসার বলা হয়। আমাদের প্রিয় নবীজি ছিলেন পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববন্ধন সৃষ্টিতে সফলকাম এক মহান ব্যক্তিত্ব। তিনি আরব সমাজ থেকে সব ধরনের হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি, জুলুম, অত্যাচার ও নির্যাতনের অবসান ঘটিয়ে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে সবাইকে আবদ্ধ করেন। বিশ্ববাসীকে উপহার দেন এক আদর্শ সমাজ।
মহান আল্লাহর নির্দেশক্রমে ইসলাম প্রচার-প্রসারের নিমিত্তে মক্কা থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীরা মদিনায় হিজরত করেন। সেখানে পৌঁছে সাহাবিরা নানাবিধ সমস্যাÑ বিশেষ করে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যার সম্মুখীন হন। কেননা মুহাজিররা তাঁদের পরিবার-পরিজন এবং অধিকাংশ সহায়-সম্পদ মক্কায় ফেলে রেখে মদিনায় চলে আসেন। মদিনার অর্থনীতি কৃষি ও হস্তশিল্পের ওপর নির্ভরশীল ছিল। মুহাজিররা ব্যবসা-বাণিজ্যে দক্ষ হলেও কৃষি ও হস্তশিল্পে তেমন পারদর্শী ছিলেন না। তদুপরি ব্যবসার জন্য প্রয়োজন মূলধনের। এ মূলধনের অভাবে কোরাইশরা নতুন সমাজ মদিনায় সহজে নিজস্ব জীবিকার উপায় অবলম্বনে সক্ষম হচ্ছিলেন না।
অন্যদিকে নবগঠিত ইসলামী রাষ্ট্র তাদের জীবিকার নির্বাহের সুযোগ সৃষ্টিতে হিমশিম খাচ্ছিল। কেননা মদিনার নবসমাজের সঙ্গে মুহাজিরদের সম্পর্কের শুভসূচনা হয়েছিল মাত্র। মুহাজিররা মক্কায় পরিবার-পরিজন ও বন্ধুবান্ধব রেখে চলে আসেন এবং তাদের সঙ্গে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এর ফলে একদিকে যেমন মুহাজির সম্প্রদায় একাকিত্ববোধ করেন, অন্যদিকে মাতৃভূমি মক্কার জন্য ব্যাকুলতা অনুভব করেন।
এ অবস্থায় মুহাজিরদের প্রতি সজাগ দৃষ্টি নিক্ষেপ করা এবং চরম আতিথেয়তা প্রদর্শন করা অতীব জরুরি হয়ে পড়ে মদিনাবাসী আনসারদের ওপর। আনসাররা নিঃসংকোচে তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। আনসাররা ত্যাগ ও নিঃস্বার্থ মেহমানদারির মাধ্যমে এমন এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা।
মদিনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আনাস ইবন মালিকের গৃহে আনসার ও মুহাজিরদের মাঝে ভ্রাতৃত্ব কায়েম করেন। নব্বই জন সাহাবী তাঁর ঘরে একত্রিত হন; অর্ধেক আনসার আর বাকী অর্ধেক মুহাজির। তাঁদের সম্পর্ক বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এতই নিবিড় ছিল, একজন মারা গেলে তার সম্পত্তিতে অপরজন অংশ পেত। অথচ তার সাথে রক্তের কোন সম্পর্ক ছিল না।
তারপর যখন আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন, তখন উত্তরাধিকার শুধুমাত্র রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়দের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مِنۢ بَعۡدُ وَهَاجَرُواْ وَجَٰهَدُواْ مَعَكُمۡ فَأُوْلَٰٓئِكَ مِنكُمۡۚ وَأُوْلُواْ ٱلۡأَرۡحَامِ بَعۡضُهُمۡ أَوۡلَىٰ بِبَعۡضٖ فِي كِتَٰبِ ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمُ
“আর যারা পরে ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং তোমাদের সাথে জিহাদ করেছে, তারা তোমাদের অন্তর্ভুক্ত, আর আত্মীয়-স্বজনরা একে অপরের তুলনায় অগ্রগণ্য, আল্লাহর কিতাবে। নিশ্চয় আল্লাহ প্রতিটি বিষয়ে মহাজ্ঞানী”। [সুরা আল-আনফাল, আয়াত: ৭৫] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের মধ্যে যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেন, তা শুধু কাগজের লেখা বা মুখের কথা ছিল না, বরং তাঁদের মধ্যে যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেছিল তা ছিল তাদের অন্তরের গাঁথা একটি চিরন্তণ বন্ধন, তা ছিল তাঁদের জান মালের সাথে একাকার ও অভিন্ন। তাঁদের কথা ও কাজে ছিল একটি চিরন্তন ও স্থায়ী সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ। বিপদে-আপদে তাঁরা ছিলেন একে অপরের হিতাকাক্সক্ষী ও সহযোগী।
পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের এক অনুপম দৃষ্টান্ত হলো মদিনাবাসী আনসার হযরত সাদ ইবনে রাবী’ এবং মক্কাবাসী মুহাজির হযরত আবদুুর রহমান ইবনে আউফ এর মধ্যকার ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। সহীহ বুখারীতে এ বিষয়ে একটি উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত বর্ণনা করা হয়:
“আব্দুর রহমান ইবন আওফ রাদিয়াল্লাহু আনহু ও সা‘দ ইবন রবি’ রাদিয়াল্লাহু আনহু উভয়ের মাঝে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুসম্পর্ক কায়েম ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করেন। তখন সা’দ রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর সাথীকে বললেন, আনসারীরা জানে আমি সম্পদের দিক দিয়ে তাদের চেয়ে অধিক সম্পদের অধিকারি। সুতরাং তুমি আমার যাবতীয় সম্পদকে তোমার মধ্যে ও আমার মধ্যে দুই ভাগ করে নাও; অর্ধেক তোমার আর বাকী অর্ধেক আমার। আর আমার দু’টি স্ত্রী আছে তাদের মধ্যে তোমার নিকট যাকে পছন্দ হয়, তার নাম বল, আমি তাকে তালাক দিয়ে দিব তারপর যখন তার ইদ্দত শেষ হয়ে যাবে, তখন তুমি তাকে বিবাহ করবে। এসব কথা শোনে হযরত আব্দুর রহমান তাঁর সাথীকে বললেন, আল্লাহ তা‘আলা তোমার পরিবার ও জান-মালের মধ্যে বরকত দান করুন। তোমাদের বাজার কোথায়? তারা বনী কায়নুকা নামক বাজারের সন্ধান দিলে সেখান থেকে তিনি সামান্য পনীর ও ঘি নিয়ে ফিরে আসেন। তারপর তাঁরা দুপুরের খাওয়ার খান। এরপর তিনি একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসেন, তাঁর দেহে লাল রং এর আলামত পরিলক্ষিত দেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেন, তোমার কী অবস্থা? উত্তরে তিনি বললেন, আমি একজন আনসারী নারীকে বিবাহ করেছি। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, এ বিষয়ে তুমি কী খরচ করেছ? বললেন, একটি খেজুরের আটি পরিমাণ স্বর্ণ। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেন, তুমি ওলিমা খাওয়াও! যদি না পার তাহলে কমপক্ষে একটি ছাগল হলেও খাওয়াও”। [বুখারী: হা-৩৭৮০] আনসারদের দয়া, মহানুভবতা ও উদারতা এতই মহৎ ছিল, তাঁরা নিজেদের খেজুর বৃক্ষগুলো মুহাজির ভাইদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেয়ার জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। যদিও তাঁদের জীবন-জীবিকার একমাত্র মাধ্যম ছিল খেজুর। মদিনাবাসী আনসারদের এরূপ মহৎ আচরণ ও মহানুভবতায় মুহাজিররা অত্যন্ত খুশি হন এবং খোলামনে আনসারদের এ উদারতার ভূয়সী প্রশংসা করেন।
হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, আনসার সাহাবীগণ নবীজীর নিকট এ বলে আবেদন পেশ করলেন, আমাদের খেজুর বাগানগুলো মুহাজির ভাই ও আমাদের মাঝে সমানভাবে বণ্টন করে দিন। নবীজী তাদের এ প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন। তাই আনসারগণ মুহাজিরগণকে বললেন, তোমরা শুধু আমাদেরকে চাষাবাদের কাজে সাহায্য করবে আর আমরা তোমাদেরকে ফসলের ভাগ দিব। অবশেষে তারা সকলেই এই প্রস্তাবে সম্মত হলেন। [সহীহ বুখারী, হাদীস ২৩২৫,২৭১৯] এ থেকে সহজে অনুমান করা যায়, আনাসারগণ কিভাবে আন্তরিকতা ও আগ্রহের সঙ্গে আগ বেড়ে মুহাজির-ভাইদের জন্য সহমর্মিতা ও সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করেছিলেন এবং কতটুকু মহববত, খুলুসিয়াত ও আত্মত্যাগের নজির দেখিয়েছিলেন। অধিকন্তু, মুহাজিরগণও তাঁদের আনসার-ভাইদের প্রতি কতটুকু শ্রদ্ধাশীল, সহমর্মী ও আত্মসচেতন ছিলেন, তাও এ ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়ে যায়। আনসারগণের আত্মত্যাগের সুযোগ তাঁরা গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু সুযোগের অপব্যবহার কখনোই করেননি। তাঁদের ভেঙে-যাওয়া জীবনধারাকে ন্যূনতম প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে সচল করে তোলার জন্য যতটুকু গ্রহণ করার প্রয়োজন ছিলো, তাঁরা ঠিক ততটুকুই গ্রহণ করেছিলেন। এ প্রসঙ্গটি সম্পর্কে সত্য কথা এবং এর গৃঢ় রহস্য সম্পর্কে বলতে গেলে এ কথা অবশ্যই বলতে হয় যে, এ ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের ভিত্তি ছিল অভাবিত ও অপূর্ব।
মদিনাবাসী মুসলিমদের ত্যাগ ও উদারতা সত্ত্বেও আইনের মাধ্যমে মুহাজিরদের সুন্দর জীবনযাপনের নিশ্চয়তা দেয়ার জন্য বিধান প্রণয়ণের প্রয়োজন থেকেই যায়। বিশেষ করে মুহাজিরদের গৌরব ও মর্যাদার স্বাভাবিক দাবি ছিল যে, তাঁদের সমস্যা এমনভাবে সমাধান করা হোক যাতে তাঁরা সে আনসারদের ওপর নির্ভরশীল এ কথা তাঁদের ভাবতে না হয়। যে কারণে ভ্রাতৃত্বের বিধান প্রণীত হয়েছিল।
মূল কথা হলো, মদিনায় যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করা হয়েছিল তা আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে। পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের বিধান প্রণয়নের ফলে ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ দুই ব্যক্তির মাঝে সাহায্য-সহযোগিতার মতো বিশেষ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং উভয়ের মধ্যে সৌহার্দপূর্ণ মনোভাব গড়ে ওঠে।
বলাবাহুল্য, এ সহযোগিতা কোনো নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল না; জীবনের সার্বিক সমস্যা সমাধানের জন্য সব ধরনের বস্তুগত সাহায্য ও সহযোগিতার সর্বব্যাপী ব্যবস্থা ছিল, যদিও সেটা ছিল সাহায্য দান বা পরিচর্যা করা, উপদেশ প্রদান, পারস্পরিক মেহমানদারী ও ভালোবাসা ইত্যাদি। মুহাজির ও আনসারদের মাঝে এমন উচ্চতর ভ্রাতৃত্বের বন্ধন রচনা হয়েছিল, যার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। মদিনাবাসী মুসলিমরা মক্কাবাসী মুহাজির ভাইদের জন্য ত্যাগের বিশেষ সুযোগ পেয়ে এতই আনন্দিত হয়েছিলেন যা বর্ণনাতীত। বিভিন্ন রেওয়ায়াতে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের বিধানের প্রতি তাঁদের গভীর আস্থা এবং তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে তাঁদের ত্যাগের অবিস্মরণীয় চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
عَنْ أَنَسٍ ، قَالَ : ” قَالَ الْمُهَاجِرُونَ : يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا رَأَيْنَا مِثْلَ قَوْمٍ قَدِمْنَا عَلَيْهِمْ أَحْسَنَ مُوَاسَاةً فِي قَلِيلٍ ، وَلا أَحْسَنَ بَذْلا مِنْ كَثِيرٍ ، لَقَدْ كَفَوْنَا الْمَئُونَةَ ، وَأَشْرَكُونَا بِالْمَهْنَأِ ، لَقَدْ خَشِينَا أَنْ يَذْهَبُوا بِالأَجْرِ كُلِّهِ ، فَقَالَ : لا ، مَا أَثْنَيْتُمْ ، وَدَعَوْتُمُ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ لَهُمْ ” .
হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, মুহাজিরগণ নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! যে ভাইদের নিকট আমরা আশ্রয় গ্রহণ করেছি তাদের চেয়ে উত্তম মানুষ আর দেখিনি। তারা সামান্য বিষয়েও আমাদের প্রতি সহানুভূতি দেখায় এবং আমাদের জন্য প্রচুর সম্পদ বিসর্জন দেয়। আমরা শুধু তাদের বাগান ও জমির কাজে সহযোগিতা করি। এতেই তারা আমাদেরকে ফসলের সমান ভাগ দেয়। আমরা আশংকা করছি, তারাই (আখেরাতের) সমস্ত প্রতিদান নিয়ে যাবে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না। যতক্ষণ তোমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে এবং তাদের জন্য দুআ করবে। (তোমরাও প্রতিদান পাবে।) [মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৩০৭৫; সুনানে নাসাঈ,  আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লায়লা ১৮১] গভীর ভ্রাতৃত্ব ও পারস্পরিক স্বার্থ ত্যাগের এ অপূর্ব দৃশ্য দেখে যে কেউ বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়বেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমরা অন্য কোনো জাতির ইতিহাসে কখনও এমন ঘটনার নজির দেখতে পাইনি। তাঁদের এই অনুপম ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্বকে অটুট ও স্থায়ী করার লক্ষ্যে নবীজি যে ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন, বিশ্ব-ইতিহাসে তা এক উজ্জ্বল ও স্বতন্ত্রতম অধ্যায়। নবীজি মুসলিমগণের মধ্যে অপূর্ব এক ভ্রাতৃত্ব-বন্ধন প্রতিষ্ঠিত করলেন;‘মুহাজির-আনসার ভ্রাতৃত্ব’ নামে যা অভিহিত।
যখন বনূ নুযীর গোত্রের ধনসম্পদ মুসলিমবাহিনীর হস্তগত হলো তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইখতিয়ার দেওয়া হলো সেসব ধনসম্পদ মুসলিমদের মাঝে বণ্টন করে দেওয়ার। সে সময় মুহাজিরগণ ছিলেন একেবারে নিঃস্ব। তাঁদের না ছিল নিজস্ব কোন ঘর-বাড়ি এবং না ছিল কোনো বিষয়-সম্পত্তি। তাঁরা আনসারগণের গৃহে বাস করতেন এবং তাঁদেরই বিষয়-সম্পত্তিতে মেহনত মজদুরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এই সম্পদ হস্তগত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসারগণের দলপতি হযরত সাবেত ইবনে কায়স রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে ডেকে বললেন, তুমি আনসারগণকে আমার কাছে ডেকে আনো। হযরত সাবেত আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার নিজের গোত্র ‘খাযরাজ’ এর আনসারগণকে ডাকব, নাকি সব আনসারকে ডাকব? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, সবাইকে ডাকতে হবে। অতঃপর তিনি আনসারগণের এক সম্মেলনে ভাষণ দিলেন। হামদ-সালাতের পর তিনি মদীনার আনসারগণের অনেক অনেক প্রশংসা করে বললেন: ‘আপনারা আপনাদের মুহাজির ভাইদের সাথে যে সদয় আচরণ করেছেন, নিঃসন্দেহে তা অনন্য সাধারণ উদারতা-সাহসিকতা-বড় হিম্মতের কাজ। অতঃপর তিনি বললেন, মহান আল্লাহ তা’আলা বনূ নযীরের ধনসম্পদ আপনাদের হস্তগত করে দিয়েছেন।
যদি আপনারা চান, তবে আমি এই সম্পদ মুহাজির ও আনসার সবার মধ্যে বণ্টন করে দেব এবং মুহাজিরগণ পূর্বের ন্যায় আপনাদের গৃহেই বসবাস করবে। পক্ষান্তরে আপনারা চাইলে, আমি এই সম্পদ কেবল গৃহহীন ও সহায়-সম্বলহীন মুহাজিরগণের মধ্যেই বণ্টন করে দেব এবং এরপর তারা আপনাদের গৃহ ত্যাগ করে আলাদা নিজেদের গৃহ নির্মাণ করে নিবেন।এই ভাষণ শুনে আনসারগণের দুইজন প্রধান দলপতি হযরত সা’দ ইবনে ওবাদা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত সা’দ ইবনে মুয়ায রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু দ›ডায়মান হলেন এবং আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের অভিমত এই যে, এই ধনসম্পদ আপনি সম্পূর্ণই কেবল মুহাজির ভাইদের মধ্যে বণ্টন করে দিন এবং তাঁরা এরপরও পূর্বের ন্যায় আমাদের গৃহে বসবাস করুন। দলপতিদ্বয়ের এই অভিমত শুনে উপস্থিত আনসারগণ সমস্বরে বলে উঠলেন, আমরা এই সিদ্ধান্তে সম্মত এবং আনন্দিত।
তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল আনসার এবং তাঁদের সন্তানগণকে মনভরে দোয়া করলেন। হস্তগত ধনসম্পদ বণ্টন করে দিলেন মুহাজিরগণের মধ্যে। আনসারগণের মধ্যে মাত্র দুই ব্যক্তি হযরত সহল ইবনে হানীফ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত আবূ দুজানা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে অত্যধিক অভাবগ্রস্ততার কারণে কিছু সম্পদ দিলেন এবং গোত্র-দলপতি হযরত সা’দ ইবনে মুয়ায রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে ‘ইবনে আবী হাকীকের’ একটি বিখ্যাত তরবারি প্রদান করলেন।
পরবর্তীতে যখন মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম দ্বীপ-রাষ্ট্র ‘বাহরাইন’ বিজিত হল, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রাপ্ত ধনসম্পদ সম্পূর্ণই আনসারগণের মধ্যে বিলিবণ্টন করে দিতে চাইলেন; কিন্তু তখনও আনসারগণ তাতে রাজী হলেননা। বরং বললেন, আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত কিছুই গ্রহণ করব না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের মুহাজির ভাইগণকেও এই ধনসম্পদ থেকে অংশ না দেওয়া হয়।
হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে এক বর্ণনায় এসেছে, (বাহরাইন বিজিত হওয়ার পর) নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমস্ত যুদ্ধলব্ধ সম্পদ আনসার সাহাবীদের নামে লিখে দিতে চাইলেন। তারা এ প্রস্তাবে অসম্মতি জ্ঞাপন করলেন। আর আবেদন জানালেন, আমাদেরকে যে পরিমাণ সম্পদ দেয়া হবে মুহাজির ভাইদেরও যেন সেই পরিমাণই দেয়া হয়। তখন রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যদি তোমরা (মুহাজিরদেরকে রেখে কোনো কিছু) নিতে সম্মত না হও তাহলে ধৈর্যধারণ করতে থাকো হাউযে কাউসারের নিকট আমার সাথে তোমাদের সাক্ষাৎ হওয়া পর্যন্ত। কেননা, ভবিষ্যতে বিভিন্ন বিষয়ে তোমাদের উপর অন্যদেরকে প্রাধান্য দেয়া হবে। [সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৭৯৪, ২৩৭৬, ২৩৭৭] সুবহানাল্লাহ! নিঃসন্দেহে এ তো ভ্রাতৃত্ব-বন্ধনের অনন্য প্রকাশ! তাঁদের পরার্থপরতার এ গুণটি পছন্দ করে আল্লাহ পাক কুরআনে কারীমে ইরশাদ করেন:
وَالَّذِينَ تَبَوَّءُوا الدَّارَ وَالْإِيمَانَ مِن قَبْلِهِمْ يُحِبُّونَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلَا يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمْ حَاجَةً مِّمَّا أُوتُوا وَيُؤْثِرُونَ عَلَىٰ أَنفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ ۚ وَمَن يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
(আর তাদের জন্যেও)। মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে যারা এ নগরীতে বসবাস করেছে এবং ঈমান এনেছে এবং মুহাজিরদেরকে যা দেওয়া হয়েছে সে জন্যে তারা অন্তরে আকাক্সক্ষা পোষণ করে না। আর তারা ওদেরকে নিজেদের উপর অগ্রাধিকার দেয়-নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও অন্তরের কার্পণ্য থেকে যাদেরকে মুক্ত রাখা হয়েছে, তারাই সফলকাম। [সূরা হাশর, আয়াত:৯] আল্লাহ তা’আলা আরো ইরশাদ করেন:
وَالَّذِينَ عَقَدَتْ أَيْمَانُكُمْ فَآتُوهُمْ نَصِيبَهُمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدًا
এবং যাদের সঙ্গে তোমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছ, তোমরা তাদেরকে তাদের অংশ দান করবে। নিশ্চয় আল্লাহ সর্ব বিষয়ে দ্রষ্টা। [সূরা নিসা, আয়াত:৩৩] আল্লাহ পাক জান্নাতের বিশেষ কিছু নি’মাত উল্লেখ পূর্বক এসকল নে’মতের অধিকারীগণের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ইরশাদ করেন:
ویُطْعِمُوْنَ الطَّعَامَ عَلٰی حُبِّهٖ مِسْكِیْنًا وَّ یَتِیْمًا وَّاَسِیْرًا اِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللهِ لَا نُرِیْدُ مِنْكُمْ جَزَآءً وَّ لَا شُكُوْرًا (তারাই এসকল নি’মাত লাভ করবে যারা…) এবং যারা মিসকীন, এতীম ও বন্দিদেরকে খাবার দান করে তার প্রতি (নিজেদের) আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও। (আর বলে) আমরা তো তোমাদেরকে খাওয়াই কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। তোমাদের থেকে আমরা কোনো প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতা কামনা করি না। [সূরা দাহর বা ইনসান, আয়াত:৮-৯] অন্য এক আয়াতে সৎকর্ম ও পুণ্যের বর্ণনা দেয়া হয়েছে এভাবে-
وَ لٰكِنَّ الْبِرَّ مَنْ اٰمَنَ بِاللهِ وَ الْیَوْمِ الْاٰخِرِ وَ الْمَلٰٓىِٕكَةِ وَ الْكِتٰبِ وَ النَّبِیّٖنَ وَ اٰتَی الْمَالَ عَلٰی حُبِّهٖ ذَوِی الْقُرْبٰی وَ الْیَتٰمٰی وَ الْمَسٰكِیْنَ وَ ابْنَ السَّبِیْلِ وَ السَّآىِٕلِیْنَ وَ فِی الرِّقَابِ.
বরং পুণ্য তো হল, মানুষ ঈমান রাখবে আল্লাহ, শেষ দিন, ফেরেশতা, (আল্লাহর) কিতাব আর নবীগণের প্রতি এবং (নিজ) সম্পদের প্রতি ভালবাসা থাকা সত্ত্বেও তা দান করবে আত্মীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন মুসাফির ও সওয়ালকারীদেরকে এবং দাসমুক্তিতে। [সূরা বাকারা: ১৭৭] ‘মুহাজির-আনসার ভ্রাতৃত্ব’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মূর্খতার যুগের বংশীয় সম্পর্কের অনুচিত ও ভ্রান্ত ইমারতটি ভেঙে পড়ে। আত্মীয়তা বা অনাত্মীয়তার সম্পর্কের ভিত্তিমূল হিসেবে স্থাপিত হয় ইসলাম। মানুষে মানুষে বংশ, বর্ণ ও দেশের সম্পর্ক মুছে যায়। উঁচু, নিচু ও মানবত্বের মাপকাঠি নির্ধারিত হয় তাকওয়া। নবীজির প্রতিষ্ঠিত এই ভ্রাতৃত্ব-বন্ধন শুধুমাত্র দফা বা মূলনীতিসর্বসস্ব কোনো ঘোষণা বা পদক্ষেপ ছিলো না; বরং তিনি এই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে কার্যকরী প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। মানব-ইতিহাসে রচিত হয় এক অভূতপূর্ব ভালোবাসার দৃষ্টান্ত। নবীজির পরিকল্পিত ও প্রতিষ্ঠিত এ নবতর জীবনধারা শুধু সালাম-মোসাফাহায় সীমাবদ্ধ ছিলো না, এর বুনিয়াদ ছিলো রক্ত ও ধন-সম্পদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সমবেদনা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মিশ্রণে এ ছিলো এক অনন্য জীবন।
আরবদের মধ্যে যুগ যুগ ধরে যে গোত্রীয় দ্বন্দ্ব ছিল তা দূর করা ও বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার পথে খুবই সহায়ক হয়েছিল এই চুক্তি। আমাদের সমাজে মুমিনগণ আজ শতধা বিভক্ত। তারা আজ অতি নগন্য বিষয়ে পারষ্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত। বিরাজমান দ্বন্দ্ব জাতির জন্য যে অত্যন্ত অশনি সংকেত, সেটা আশা করি কারো বুঝতে বাকি নেই। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুক, আ-মী-ন।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক- সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, খতীব- মুসাফির খানা জামে মসজিদ।