স্বাগতম ৪৬ তম জসনে জুলুস

স্বাগতম ৪৬ তম জসনে জুলুস

স্বাগতম ৪৬ তম জসনে জুলুস

মোছাহেব উদ্দীন বখতিয়ার

বর্তমান বিশ্ব ইসলামি সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণীয় এবং জনপ্রিয় সংযোজন হল জসনে জুলুস। সাধারণত এর অর্থ বর্ণাঢ্য শোভা যাত্রা বা মিছিল বোঝানো হলেও, বর্তমানে এটি অধিকতর প্রাসঙ্গিকতা পেয়েছে “জসনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম” হিসেবে। এটি এখন মিলাদুন্নবীর শোভাযাত্রা বোঝায় বিশ্বব্যাপি। পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উদযাপন বর্তমানে এক বর্নাঢ্য রুপ পেয়েছে এ জসনে জুলুসের সৌন্দর্য ও প্রভাবে। ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, আজ হতে চৌদ্দশ বছর আগে সমগ্র সৃষ্টির রহমত নবী মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মক্কা শরিফ থেকে হিজরত করে মদিনায় পৌঁছেন সেদিন এই শ্রেষ্ঠ অতিথির আগমন সংবাদে মদিনার উপকন্ঠে এসে জড়ো হয়েছিলেন মদিনার সকল বয়সী নারী-পুরুষেরা। তাঁরা তাঁদের প্রিয়তম এ অতিথি নবীজি কে নিয়ে কাসিদা গাইতে গাইতে বর্নাঢ্য শোভাযাত্রা বা জসনে জুলুস সহকারে শহরের অভ্যন্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার এ ধরাপৃষ্ঠে নবীজির শুভাগমন অর্থাৎ মীলাদের সময়ে মা আমেনার ঘরে এসেছিল অসংখ্য ফেরেস্তা ও জান্নাতি রমনীদের নূরানি মিছিল। ৮ম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং নবী পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ও লক্ষাধিক সাহাবায়ে কেরামের মিছিল। ধর্মীয় শোভাযাত্রার এ সব ঐতিহ্যকে ধারন করেই প্রবর্তিত হলো নবীজির শুভ আগমন বা মীলাদ উপলক্ষে জসনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বিশাল এবং আকর্ষণীয় যে জসনে জুলুসটি সমগ্র বিশ্ববাসীর দৃষ্ট আকর্ষণ করেছে সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা হতে প্রতিবছর ১২ রবিউল আউয়াল যে জসনে জুলুসটি বের হয়ে আসছে। আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট’র ব্যবস্হাপনায় আয়োজিত চট্টগ্রামের এ জসনে জুলুসে লোক সমাগম হয় অন্তত চল্লিশ লক্ষ। এ উপলক্ষে ১২ রবিউল আউয়াল সমগ্র চট্টগ্রাম শহরে ওঠে সাজ সাজ রব। চট্টগ্রামের এ জসনে জুলুস শুরু হয় ১৯৭৪ সনে, রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র ৩৯ তম অধ:স্তন বংশধর, মাতৃগর্ভের অলী,দরবারে আলিয়া কাদেরিয়া সিরিকোট শরিফের তৎকালিন সাজ্জাদানশীন, আল্লামা হাফেজ সৈয়্যদ মুহম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির নির্দেশ ও রূপরেখা অনুসরনে। সেদিন ১৯৭৪ এর ১২ রবিউল আউয়াল (১৩৯৪ হিজরি) সকালে আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আলহাজ নূর মুহম্মদ আল কাদেরীর নেতৃত্বে কোরবানিগঞ্জস্থ বলুয়ারদিঘীপাড় খানকাহ্ এ কাদেরিয়া সৈয়্যদিয়া তৈয়্যবিয়া হতে শুরু হয়ে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক সমূহ প্রদক্ষিণ করে ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা ময়দানে এসে ওয়াজ, মিলাদ ও মুনাজাতের মাধ্যমে শেষ হয়েছিল জুলুসটি। ১৯৭৬- ১৯৮৬ পর্যন্ত এর নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং এর প্রতিষ্ঠাতা রূপকার গাউসে জামান তৈয়্যব শাহ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি। ১৯৮৭ হতে অন্তত ৩২ বার এর নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁরই শাহজাদা এবং সাজ্জাদানশীন, রাহনুমায়ে শরিয়ত ও তরিকত, আল্লামা সৈয়্যদ মুহম্মদ তাহের শাহ্ (মু.জি.আ)। ১৯৭৪ সনে শুরু হওয়া মাত্র কয়েক হাজারের এ জসনে জুলুস বর্তমানে চল্লিশ লাখ মানুষের জনশ্রোতে রূপ নিয়েছে এই মহান আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব আল্লামা তাহের শাহ’র নেতৃত্বে। ধারনা করা যায়, এই জসনে জুলুসটিই বর্তমান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ এবং এটিই বিশ্বের অপরাপর জুলুসের মূল প্রেরণা। সে হিসেবে এর প্রতিষ্ঠাতা রূপকার, ইসলামের মহান সংস্কারক, আল্লামা সৈয়্যদ মুহম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি হলেন বিশ্ব জসনে জুলুসের প্রকৃত স্বপ্নদ্রষ্টা এবং রূপকার। বিচ্ছিন্নভাবে অনাড়ম্বরভাবে পৃথিবীর অন্য কোথাও জসনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আয়োজন এর আগে হলেও হতে পারে। হয়তো সেগুলোর খবর বিশ্ববাসীর কাছে সময়মত এসে পৌঁছায়নি, বা ঐ সব আয়োজন মুসলমানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। সে হিসেবে শুরুতেই প্রথমে সমগ্র বাংলাদেশে, এবং পরবর্তিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রেরণার কারণ হবার সৌভাগ্য অর্জন করেছে চট্টগ্রামের এই বিশাল আয়োজনটি। তাই বলা যায়, এটিই বিশ্ব জসনে জুলুসের প্রেরণাদানকারী প্রথম জুলুস, এবং এর রূপকার আল্লামা তৈয়্যব শাহ্ হলেন এর প্রতিষ্ঠাতা প্রাণপুরুষ। যেভাবে বলা যায় যে, ভারত বর্ষে ইসলামের সূচনা ৭১২ খ্রিস্টাব্দে আরবদের সিন্ধু বিজয় বা আরো আগের পীর দরবেশদের মাধ্যমে শুরু হলেও তাঁদের হিন্দুস্তানে ইসলামের সূচনাকারী বলা যায়, আর প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় খাজা গরীব নওয়াজ মঈনুদ্দিন চিশতি রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিকে যিনি এসেছিলেন আরো পাঁচশত বছর পরে। কারণ, তাঁর হাতে ইসলামের জোয়ার এসেছিল এ উপমহাদেশে। ১৩৯৪ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল থেকে চট্টগ্রামে এর শুরু ধরে এবার ১৪৪০ হিজরির ১২ রবিউল আউয়ালের জসনে জুলুস হবে ৪৬ তম আয়োজন। ইনশাল্লাহ্, এবারও নেতৃত্বে থাকবেন রাহনুমায়ে শরিয়ত ও ত্বরিকত, আওলাদে রাসুল, আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ (মাজিআ)। দাবি ওঠেছে, এ জসনে জুলুসকে বিশ্ব ঐতিহ্য (ড়িৎষফ যবৎরঃধমব) হিসেবে স্বীকৃতি দেবার। ইনশাল্লাহ্, এ দাবি একদিন প্রতিষ্ঠিত হবে, এই প্রত্যাশা করি। সবাইকে সকল ঈদের সেরা ঈদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।

ইনশাল্লাহ্, ৫০ তম জসনে জুলুস পালিত হবে ১৪৪৪ হিজরির ১২ রবিউল আউয়ালে। সেদিন হয়ত এই জুলুসে অংশ গ্রহনকারির সংখ্যা অর্ধকোটি ছাড়িয়ে যাবে। তার আগেই যেন চট্টগ্রামের এই জুলুস জাতিসংঘের টহবংপড় কর্তৃক ডড়ৎষফ যবৎরঃধমব হিসেবে স্বীকৃতি পাবে, যদি আমরা এটি আদায় করতে যথাযথ প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হই। তবে, এই জুলুস যে ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের ঐতিহ্য এবং ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিষ্কলুষ সংস্কৃতির জায়গা দখল করেছ তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। চট্টগ্রামের মানুষ এক রবিউল আউয়াল যেতে না যেতে পরের বছরের জুলুস নিয়ে ভাবতে শুরু করে। বাংলাদেশ ও বিশ্বের এই প্রধান জুলুসটি চট্টগ্রামের মানুষের উপর এতটা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে যে, এখন একে উপেক্ষা করা যায়না। যদি কেউ চট্টগ্রামের সত্যাশ্রয়ী ইতিহাস -ঐতিহ্য লিখতে যায়, তবে তাকে অবশ্যই জসনে জুলুসকে এতে গুরুত্বসহ উপস্থাপন করতে হবে। শুধু চট্টগ্রাম শহর কেন্দ্রিক এই জুলুসটি নয়, এখন এর অনুসরনে মফস্বল, গ্রাম-গঞ্জ নির্বিশেষে চট্টগ্রামের সর্বত্র সমগ্র রবিউল আউয়াল মাসব্যাপী যতগুলো জুলুস বের করা হয় এর সংখ্যাও হাজারের বেশি হতে পারে। অর্থাৎ জসনে জুলুস আর চট্টগ্রাম যেন একাকার হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। একই সাথে, যে বিষয়টি আজ দিনের আলোর মত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, তা হল, এখন এমন কোন মহল্লা বা গ্রাম এখানে পাওয়া যাবেনা যেখানে এলাকাবাসী সম্মিলিত হয়ে, বা কোন না কোন সংগঠন-সংস্থার নামে ঈদে মীলাদুন্নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাহফিল আয়োজন করছেনা। মীলাদের এই জোয়ারটা কিন্তু জসনে জুলুসেরই দান। আর, পক্ষান্তরে এটি যে, গাউসে জামান, মুজাদ্দিদে মিল্লাত, আল্লামা তৈয়্যব শাহ্ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির মহান সংস্কারের প্রভাব তা অনস্বীকার্য। আজ আমাদের স্মরণে আনা দরকার যে, স্বাধীনতাত্তোর কালের সুন্নিয়ত বিরোধি চক্রান্তগুলোর মধ্যে একটি ছিল হঠাৎ করে পরিকল্পিতভাবে ‘সীরাতুন্নবী’ আয়োজন করা, এবং এসব সীরাত মাহফিল থেকে মীলাদের বৈধতা নিয়ে বক্তব্য রাখা। হঠাৎ করে মুসলিম সমাজের উপর নেমে আসা এই বিতর্ক যখন সর্বত্র রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেবার উপক্রম ঠিক সেই সময়েই ১৯৭৪ সন (১৩৯৪ হিজরি) সনে আনজুমান ট্রাস্ট’র উপর মুজাদ্দেদী নির্দেশ আসে হুজুর কেবলা তৈয়্যব শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলায়হির পক্ষ থেকে, এই জুলুস আয়োজনের। দেখতে না দেখতে জুলুস শুরু হয়ে গেল। বিরোধিদের বিরোধিতা আরো বাড়ল। এমনকি মীলাদের পক্ষের যারা, তারাও শুরু করল এই নতুন কর্মসূচি নিয়ে বক্র উক্তি ও সমালোচনা। কিন্তু আল্লাহর মেহেরবানি যে, শেষ পর্যন্ত তারাও ফিরে আসল জুলুসে। এখন প্রায় সব সুন্নি দরবার, সংগঠন-সংস্থা আয়োজন করছে জসনে জুলুস। আজ সমগ্র বাংলাদেশে জসনে জুলুস রবিউল আউয়াল সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে জোড়া লেগে গেছে। এখানেই হুজুর কেবলা তৈয়্যব শাহ রহমাতুল্লাহি আলায়হি’র সফলতা। তিনি চিরস্মরণীয়। তিনি আমাদের প্রাত:স্মরণীয় পথপ্রদর্শক। জসনে জুলুস দখল করুক সমগ্র বিশ্ব। এটি হোক বিশ্ব মুসলিমের ঐক্য-সংহতি ও শক্তির প্রতীক।

লেখক: যুগ্ম মহাসিচব- গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় পরিষদ।