প্রিয়তম নবী কেমন ছিলেন

প্রিয়তম নবী কেমন ছিলেন

প্রিয়তম নবী কেমন ছিলেন

 * গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির * 

মহান আল্লাহ পাকের প্রিয় হাবীব হুজুর সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লা-এর আগমন বিশ^ জগতের জন্য অনুপম কল্যাণকর, পথের দিশা, মানবিক মূল্যবোধ ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী, তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, অতুলনীয় সততা, ভারসাম্য পূর্ণ আচরণ, সৃষ্টি জগতের প্রতি অগাধ প্রেম-ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও সাম্যনীতি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ। দেশ-কাল, জাতি-ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সকলের কাছে মহিমান্বিত ও মর্যাদাপূর্ণ। তাঁর অনুপম শিক্ষা ও আদর্শ বর্তমান ঘুণেধরা সমাজকে দিতে পারে মুক্তির গ্যারান্টি।
তিনি কেমন ছিলেন, কেমন ছিল তাঁর পাক-বদনের দীপ্তি, কিভাবে তিনি কথা বলতেন, চলাফেরা করতেন, কেমন করে কাটত তাঁর দৈনন্দিন জীবন, পরিবার-পরিজনের একান্ত সান্নিধ্যে তাঁর আচরণই বা কেমন ছিল-এই প্রশ্নগুলো এবং এ সম্পর্কে জানার আগ্রহ নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের যে কোন ভক্তজনের অন্তরে জাগ্রত হওয়া একান্তই স্বাভাবিক।
মানুষের ইতিহাসে একমাত্র মহানবী সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লা-ই এমন একজন অনন্য ব্যক্তি, যাঁর জীবনের প্রতিটি মুহুর্তের আচার-আচরণ, প্রতিটি কথা, এমনকি প্রতিটি অভিব্যক্তি অত্যন্ত বিশ^স্ত বর্ণনার মাধ্যমে হুবহু এঁকে রাখা হয়েছে। বর্ণনাকারিগণ নবী করিম সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লা এর আদর্শ এবং আচার-আচরণের সংগে সংগে তাঁর চেহারা মুবারক এবং বাহ্যিক অবয়বেরও নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে গেছেন। এ সমস্ত বর্ণনা হাদীসের কিতাসমূহে ‘আখলাক্ব’ ও ‘শামায়িল’ অধ্যায়ে সযতেœ সংযোজিত হয়েছে।
বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী এবং মুসনদে আহমদ ইবনে হাম্বল কিতাবের ‘আখলাক্ব’ ও ‘শামায়িল’ সম্পর্কিত বর্ণনাগুলো একত্রিত করলে দেখা যায়, মহানবী সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লা-এর পবিত্র অবয়ব ছিল অপূর্ব। আকৃতি ছিল মধ্যম, বর্ণ দুধে-আলতায়, ললাট ছিল প্রশস্ত, মাথা বড়, গ্রীবা উন্নত, চঞ্চর মত নাসিকা, পটলচেরা চোখ এবং ভ্রƒজোড়া একত্রে সন্নিবেশিত। ডাগর দুটো চোখের মণি ছিল গাঢ় কৃষ্ণবর্ণের। সুগঠিত ভরাট চোয়াল এবং উপরে নিচে সামান্য লম্বাকৃতির মুখমন্ডলে ঘনকৃষ্ণ বর্ণের শ্মশ্রুরাজি শোভা পায়। ওষ্ঠ জোড়া ছিল গোলাপ পাপড়ির মত। হঠাৎ দেখলে মনে হত, যেন দু’ঠোঁটে খুব যতেœর সাথে এক পোঁচ গোলাবী রঙ বুলিয়ে রাখা হয়েছে। তার মধ্যে সুগঠিত দাঁতের পাটি মুক্তোর ন্যায় জ¦লজ¦ল করত। মাথার চুল ছিল সামান্য ভাঁজসম্বলিত ও ঘন কৃষ্ণবর্ণ। শেষ বিদায়ের সময় কয়েকটা মাত্র চুল মোবারকে এবং শ্মশ্রুতে সামান্য পাক ধরেছিল। দুচোখের ভ্রু ছিল অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ। বক্ষদেশ ছিল প্রশস্ত এবং ছাতির মধ্যস্তল হতে নাভীমূল পর্যন্ত হালকা রেশমের মত চুলের রেখা প্রলম্বিত ছিল। দু’বাহু ছিল মাংসল, সুগঠিত এবং সাধারণ মানুষের তুলনায় একটু বেশী লম্বা, জানু পর্যন্ত প্রলম্বিত। মসৃণ ত্বকবিশিষ্ট শরীরের কোথাও মেদের বাহুল্য দৃষ্টিগোচর হত না। পায়ের গোছা ছিল সুগঠিত এবং পাতা সামান্য বাঁকানো।
হেঁটে যাবার সময় সোজাভাবে সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে চলতেন; দেখলে মনে হত, যেন অপেক্ষাকৃত উঁচু ভূমি হতে নীচের দিকে নেমে আসছেন। বিশুদ্ধ বর্ণনায় দেখা যায়, খর রৌদ্রের মধ্যে হেঁটে গেলেও তাঁর শরীরের কোন ছায়া হতো না। অতুলনীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ন্যায় তাঁর বাহ্যিক অবয়বও ব্যক্তিত্বপূর্ণ এবং আকর্ষণীয় ছিল যে, দর্শকমাত্রই অভিভূত হয়ে পড়ত। অনেক লোক শুধুমাত্র একবার এই অতুলনীয় চেহারা মোবারকের দর্শন করেই আত্মহারা হয়েছেন। মদীনার বিশিষ্ট ইহুদী সর্দার আবদুল্লাহ ইবনে সালাম মহানবীর পবিত্র চেহারা দেখেই বলে উঠেছিলেন, ‘‘আল্লাহরই শপথ! এ চেহারা কোন কপট মিথ্যাবাদীর হতে পারে না।’’ [বুখারী] জাবির ইবনে সামুরা নামের জনৈক সাহাবীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তাঁর চেহারা কি খোলা তরবারির মত ঝলমল করত? তিনি জবাব দিয়েছিলেন ‘না, পূর্ণ চাঁদের মতো চমকাত। আমি মেঘের লেশচিহ্নহীন এক পূর্ণিমার রাতে একবার পূর্ণ চাঁদের দিকে আর একবার রসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চেহারা মোবারকের দিকে চেয়ে দেখছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল, তাঁর পবিত্র চেহারার তুলনায় আকাশের পূর্ণচন্দ্র যেন অনেকটা দীপ্তিহীন’। [শামায়িলে তিরমিযী] সাহাবীগণের মধ্যে হযরত আব্বাস, হযরত আবু বকর, হযরত হাসান, হযরত ‘কাব ইবনে যুহাইর, হযরত ‘আয়েশা প্রমুখ শতাধিক সাহাবী কাব্যকথার মাধ্যমে হুযুর পাকের চেহারার বর্ণনা দিয়েছেন। এসমস্ত আবেগময় কাব্যকথার উপরে ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে না’তে রসূল সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুবিশাল কাব্যভান্ডার গড়ে উঠেছে। এ সমস্ত না’তিয়া কালামে হুযুর পাকের পবিত্র চেহারা ও আচার-আচরণের ছবি এমনি জীবন্ত হয়ে রয়েছে যে, ভাবুক পাঠকমাত্রই তা পাঠ করে অভিভূত হয়ে পড়েন। না’তে রসূলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপকার আল্লামা জামীর ভাষায় সেই বর্ণনাঃ
‘ইয়া সাহিবাল জামালি ইয়া সাইয়্যিদাল বাশার,
মিন-ওয়াজহিকাল মুনীরি লাক্বাদ নুওভিরাল ক্বমার
লা-য়ুমকিনুস সানাউ কামা কানা হাক্কুহু-
বা’দ আয খোদা বুযুর্গ তুয়ী ক্বিসসা মুখতাসার।’
অর্থাৎঃ ‘হে জ্যোতির্ময়, হে মানবশ্রেষ্ঠ, তোমার পূতপবিত্র চেহারার দীপ্তি থেকেই চাঁদ আলোকপ্রাপ্ত হয়েছে।’
‘যেমন প্রশংসা তোমার হওয়া উচিত, তেমনটি সম্ভব নয়। সংক্ষিপ্ত কথা হলো-খোদার পরেই তুমি মহীয়ান, গরীয়ান।’
সাধারণ কথাবার্তা ছিল অত্যন্ত মধুর; কোন কারণে বিরক্ত হলেও নূরানী মুখাকৃতিতে বা আওয়াজের মধ্যে তা প্রকাশ পেত না। ক্রোধের উদ্রেক হলে শুধুমাত্র চেহারা মুবারকের বর্ণ লাল হয়ে যেত।
লোকজনের সাথে কথাবার্তা বলার সময় সুস্পষ্ট উচ্চারণে বলে যেতেন, উপদেশ দেওয়ার সময় অপ্রাসঙ্গিক কোন কথা বলতেন না। প্রতিটি বিষয় আলাদা আলাদাভাবে অত্যন্ত স্পষ্ট উচ্চারণে বলে যেতেন। সুস্পষ্ট ও হৃদয়গ্রাহী ছিল তাঁর বাচনভংগী, শ্রোতামাত্রই তা সহজে অনুধাবন করতে ও সহজে স্মরণ রাখতে পারত। আওয়াজ ছিল গুরুগম্ভীর। কথার মধ্যে এমন একটা আকর্ষণ ছিল যে, একবার কানে গেলে তা মর্মমুলে গিয়ে প্রবেশ করত। ক্বোরআন পাঠ করার সময় আওয়াজ হয়ে উঠত আবেগময়, বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্য রেখে আওয়াজ ওঠানামা করত। সাহাবী হযরত হিন্দ বর্ণনা করেছেন, ‘রসুল-ই-করীমকে দেখলে মনে হত সব সময় যেন তিনি কোন গভীর চিন্তায় আছেন! অপ্রয়োজনীয় কোন কথা তাঁর পবিত্র মুখ দিয়ে কখনো বের হতে কেউ শোনেনি। কথা বার্তার মধ্যে এমন একটি আকর্ষণ ছিল যে, কেউ সে কথার মধ্য হতে মনযোগ অন্যদিকে সরিয়ে নিতে পারত না।’
মহানবীর বাগ্মিতা ছিল অপূর্ব। নুবূওয়াতের কথা সর্বপ্রথম ঘোষণা করার সময় মক্কায় আবু-ক্বুবাইস পর্বতশীর্ষে দাঁড়িয়ে তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন তার মধ্যেই এমন এক অপূর্ব আবেদন সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল, যার ফলে অনেকের অলক্ষ্যেই অন্তরের গভীরে ইসলামের সত্যতা সম্পর্কে একটা শ্রদ্ধাবনত মনোভংগি গড়ে উঠেছিল। পরবর্তী যুগে ইসলাম গ্রহণ করার পর তাঁরা সেই প্রভাবের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। ক্বোরআন পাকের অপরূপ সুরলহরীর পর বাগ্মিতা ছিল ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে মহানবীর অন্যতম সেরা হাতিয়ার। তাঁর বক্তৃতা একবার যে শুনেছে, তার অন্তরেই বিপ্লবাত্মক পরিবর্তনের সূচনা হয়ে গেছে।
বক্তৃতা করার সময় মাঝে মাঝে ডান হাত উপরে তুলে আঙুল দ্বারা ইশারা করতেন। কোন আশ্চর্যজনক বিষয় বোঝানোর সময় কখনও কখনও হাতের তালু ঘুরিয়ে নিতেন। আনন্দ প্রকাশ পেলে দৃষ্টি অবনত করে ফেলতেন। অন্যথায় সাধারণত কথা বার্তা বলার সময় দৃষ্টি উপরে থাকত। কোন বিষয় ব্যাখ্যা করার সময় মনে হত, যেন ছবি এঁকে তিনি শ্রোতাদের সামনে তুলে ধরছেন। তাঁর মুখে বেহেশত ও দোযখের বর্ণনা শোনার সময় মনে হত, তিনি যেন তা দেখে দেখে বলছেন।
সব সময় হাসিমুখে থাকতেন, সংগী-সাথীদের সংগে সাক্ষাত হওয়া মাত্র হাসিমুখে অভ্যর্থনা করতেন; কিন্তু জীবনে কোনদিন তাঁকে কেউ অট্টহাসি হাসতে দেখেনি। প্রবল হাসির উদ্রেক হলে কখনও কখনও বিদ্যুৎচমকের মত এক ফালি দাঁতের ঔজ্জ্বল্য ফুটে বের হত। সাহাবী জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্ বর্ণনা করেন ঃ জীবনে যতবার আমি রসূল-ই-পাকের সাথে সাক্ষাত করেছি, প্রতিবারই তিনি আমাকে হাসিমুখে সম্ভাষণ করেছেন। অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে আমার কথা শুনেছেন। কারও মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কথা বলতেন না-একজনের বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে শেষ হওয়ার পর নিজের মন্তব্য প্রকাশ করতেন।
চেহারা মোবারকের মধ্যে এমন একটা জ্যোতি ছিল যে, কেউ কোনদিন তাঁর চোখে চোখে চেয়েছে এমন বর্ণনা পাওয়া যায় না।
ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, এমন কি শিশুদের সাথেও অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে কথা বলতেন। সকল শ্রেণীর লোকের মর্যাদা প্রদান করতেন। প্রত্যেক আগন্তুকের সাথে অত্যন্ত আবেগের সাথে মুসাফাহা করতেন। কিছুদিন বিরতির পর সাক্ষাত হলে বুকে বুক লাগাতেন, ললাট চুম্বন করতেন। যে কোন লোক কথা বলতে এলে আগ্রহভরে তা শুনতেন। সাহাবাগণের মধ্যে এমন একটি সাধারণ ধারণা ছিল যে, রসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম বোধ হয় তাঁকেই সবচেয়ে বেশী ভালবাসেন। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে যখন তিনি মদীনায় কর্তব্য পালনরত তখনো মাঠের রাখাল ছেলে পর্যন্ত মনে করত, মহানবী সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে তার এমন ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব রয়েছে যে, তার যে কোন আবদার তিনি রক্ষা করবেন। ফলে মরুচারী অমার্জিত স্বভাবের বেদুঈনরাও সময়ে-অসময়ে সম্ভব-অসম্ভব নানা প্রকার আবদারের উপদ্রব নিয়ে হাযির হত। কিন্তু তিনি কখনো কারো প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেছেন এমন ঘটনা কেউ বর্ণনা করতেন পারেনি।
পথে হেঁটে যেতে প্রথম তিনি সালাম দিতেন। ছোট ছোট বাচ্চাকে ডেকেও কৌশল বার্তা জিজ্ঞেস করতেন-তাদের খেলাধুলা, ছাগল-ছানা, পালিত পাখির ছানা সম্পর্কেও জিজ্ঞাসাবাদ করতে ভুলতেন না। শিশুরাও তাদের আবদারের কথা অকপটে তাঁর কাছে বর্ণনা করত। অবসর পেলেই তিনি বের হতেন। অলিতে-গলিতে এমন কি ক্ষেত-খামার এবং পশু পালনের চারণক্ষেত্রে পর্যন্ত গিয়ে সবার সাথে প্রাণখোলা আলাপ করতেন। সকল শ্রেণীর মানুষের সমস্যা ও হাসি-কান্নার সাথে আন্তরিকভাবে শরীক হওয়ার চেষ্টা করতেন।
পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা ছিল মজ্জাগত। সুগন্ধি ব্যবহার ছিল নিয়মিত অভ্যাস। নোংরামী বা অপরিচ্ছন্নতাকে বড় বেশী ঘৃণা করতেন। যেখানে সেখানে থুথু ফেলতে দেখলে অনেক সময় নিজ হাতে তা পরিস্কার এবং কঠোর ভাষায় এরূপ বদভ্যাস ত্যাগ করার জন্য তাগিদ দিতেন। কাঁচা পেঁয়াজ, রসুন, মূলা ইত্যাদির কটু গন্ধ পর্যন্ত সহ্য করতে পারতেন না। কেউ যেন এ সমস্ত জিনিস খাওয়ার পরই মসজিদে না আসে, সে কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন।
দিনরাত্রের তিনভাগের একভাগ সময় ইবাদত-বন্দেগীর জন্য, একভাগ পরিবার-পরিজন ও গৃহকর্মের মধ্যে এবং একভাগ নিঃস্ব দুস্থজনদের সেবায় ব্যয় করতেন। কোন জরুরী অবস্থা দেখা না দিলে সাধারণত এ অভ্যাসের ব্যতিক্রম হত না।
রাতের অর্ধপ্রহর পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠতেন। ওযুর পানি ও মিসওয়াক হাতের কাছেই রাখা থাকত। প্রথমে ভালভাবে মিসওয়াক করতেন। গভীর রাতে শয়নের বিছানাই হত তাঁর সালাতের মুসল্লা। জীবনের কোন সময় এ নিয়মের ব্যতিক্রম হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং কোন কোন সময় এশার পর নামমাত্র সামান্য কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে ফজর পর্যন্ত শুধু সালাত এবং কান্নাকাটি করে কাটিয়েছেন, এরূপ বর্ণনার অভাব নেই।
মহানবীর বাসস্থান ছিল মসজিদে নববীর পাশে ছয় হাত চওড়া এবং আট হাত লম্বা কয়েকটি কুটীর। এগুলোতে খেজুর পাতার ছাউনি ছিল। রোদ-বৃষ্টি থেকে পুরাপুরিভাবে আত্মরক্ষার মত ব্যবস্থা এ সমস্ত কুটিরে ছিল না। বিদেশী মেহমান এবং কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের সাথে বসে আলাপ-আলোচনা করার জন্য সাহাবীগণ মসজিদে নববীর সামনে আর একটি কুটির তৈরী করে দিয়েছেলেন। সেই কয়েকটি শুকনো চামড়ার আসন ছাড়া আর কোন আসবাব ছিল না।
গোটা আরবের উপর আধিপত্য বিস্তৃত হওয়ার পর সাহাবীগণ মহানবীর জীবনযাত্রার মান কিছুটা উন্নত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন অবস্থাতেই এরূপ করার অনুমতি প্রদান করেন নি। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বক্তব্য ছিলঃ দুনিয়ার আরাম আয়েশের সাথে আমার সম্পর্ক থাকতে পারে না। আমি একজন মুসাফির বৈ অন্য কিছু নই। একজন পথচারী যেমন ছায়াদার কোন গাছের নীচে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম গ্রহণ করে, মানুষের জীবনটুকুও ঠিক তদ্রুপ। মানুষ এখানে আরাম করার জন্য আসেনি-এসেছে কঠোর কর্তব্য সমাধা করে অনন্ত জীবনের সাফল্যজনক শান্তি পেতে।
নবী-ই-করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের সালাত শেষে সাথীদের দিকে ফিরে বসতেন এবং জিজ্ঞেস করতেন, কোন রোগী আছে কি, যাকে দেখতে যাওয়া দরকার বা কোন জানাযা আছে কি? যদি এরূপ কিছু থাকত বলে জানতে পারতেন, তবে সাথে সাথে বিহিত ব্যবস্থা করতে বের হয়ে যেতেন।
তিনি মাটিতে বসতেন এবং মাটিতে বসেই আহার করতেন। অধিকাংশ সময় মাটিতেই শুয়ে বিশ্রাম গ্রহণ করতেন। গরীব অসহায়দের অসুখ-বিসুখে নিজে গিয়ে সেবা-শুশ্রুষা করতেন। নিজ হাতে তাদের কাজ করে দিতেন। কখনো কাউকে তুচ্ছ জ্ঞান করতেন না। অসহায় গরীবদের জানাযায় বিশেষভাবে শরীক হতেন।
গরীব-সর্বহারা ভুখা-নাঙ্গা লোকদের মধ্যে চলে যেতেন এবং সাধ্যমত তাদের সাহায্য সহায়তা করতেন। তাদের দা’ওয়াত কবুল করতেন, তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। প্রয়োজনে নিজ কাঁধে তাদের বোঝাও বহন করতেন। সকল প্রকার কল্যাণকর কাজে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন।
সঙ্গীদের কাউকে কোথাও শাসনকার্যের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করার সময় বিশেষভাবে নির্দেশ দিতেন, যেন ছিন্নমূল অসহায় শ্রেণীর প্রতি সর্বাধিক মনোযোগ দেওয়া হয়। তাঁরা যেন সাধারণ মানুষের সাথে ভালভাবে কথা বলেন। সকলের সুখ-সুবিধার প্রতি যেন বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা হয়, দীন-ধর্মের কথা সহজভাবে পেশ করা হয়। ধর্মের অনুশাসন গুলো যেন এমনভাবে প্রয়োগ করা হয় যাতে স্বাভাবিকভাবেই এগুলোর প্রতি লোকের সশ্রদ্ধ আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। শরীয়তের কোন নির্দেশকে যেন তারা বিপজ্জনক মনে না করে।
জ্ঞানী-গুণী ও চরিত্রবানদের বিশেষ মর্যাদা দিতেন। মানী লোকদের মান-মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। আপনজনদের ভালবাসতেন এবং সাধ্যমত তাদের আশা-আকাঙ্খা পূরণ করতে চেষ্টা করতেন। আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে কে ভাল কে মন্দ সেদিক লক্ষ্য না করে প্রয়োজন মত সবাইকে সাহায্য-সহায়তা করতেন। সঙ্গী-সাথীদের সঙ্গে সাক্ষাতকারের সময় প্রথমে নিজে সালাম করতেন এবং আবেগ ভরে তাদের সাথে হাত মিলাতেন।
জিহাদের নির্দেশ প্রদান করার সময় নিজেই প্রথম প্রস্তুতি নিয়ে বের হয়ে পড়তেন। যুদ্ধের ময়দানে নিজে সবার আগে এবং শত্রুর সর্বাপেক্ষা নিকটবর্তী তিনিই থাকতেন। (ওয়াসায়েলুল উসুল ইলা শামায়েলির রসূল)

সহ্য ও ক্ষমা
বিরোধীদের সকল অত্যাচার-নির্যাতনের মুখে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ধৈর্য ও সহ্য ছিল সীমাহীন। যারা কষ্ট দিত তাদের তিনি ক্ষমা করতেন। যারা তাঁর ক্ষতি করত, তাদের প্রতি মহৎ ঔদার্যের মাধ্যমে প্রতিদান দিতেন। যারা তাঁকে বঞ্চিত করত তিনি তাদেরকেও দান করতেন। যারা যুলুম করতো তাদেরকেও ক্ষমা করতেন-অবশ্য যদি তা আল্লাহর বিধান লংঘনের ব্যাপার না হত। তিনি নিজের পক্ষ থেকে কখনো কারো উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। নিজ হাতে কোন মানুষ এমন কি কোন জীবজন্তুকে পর্যন্ত আঘাত করেননি-অবশ্য জিহাদের কথা স্বতন্ত্র। [শামায়েলে তিরমিজী] হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা বর্ণনা করেন যে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিহাদের ময়দান ছাড়া নিজের হাতে কখনো কোন মানুষ বা জীবজন্তুকে আঘাত করেন নি। স্ত্রী, পরিবার-পরিজন কিংবা খাদেম-চাকর কারো উপর তিনি কোন সময় হাত তোলেন নি। তিনি আরো বলেনঃ হুযুর সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি কখনো নিজের তরফ থেকে কারো যুলুমের বদলা নিতে দেখি নি। অবশ্য কেউ আল্লাহ্র কোন বিধান লংঘন করলে হুযুরের চাইতে বেশী রাগান্বিত হতেও আমি কাউকে দেখি নি। [শামায়েলে তিরমিযী]

অকৃত্রিম সরলতা
হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে বাড়ী বাড়ী গিয়ে রোগীদের সেবা করতেন। কারো মৃত্যু হলে জানাযায় শরীক হতেন। গাধায় আরোহণ করেও তিনি চলাফেরা করতেন। ক্রীতদাসদের দা’ওয়াত কবুল করতেও তাঁর দ্বিধা ছিল না। [শামায়েলে তিরমিযী] তিনি নিজ হাতে ছাগল দোহন করতেন। পরনের কাপড়ে নিজ হাতে তালি দিতেন। প্রয়োজনে নিজ হাতে জামা সেলাই করতেন। নিজের গৃহস্থালির কাজ নিজেই সমাধা করতেন। [ইবনে সা’আদ] তিনি খাদেম-চাকরদের সাথে বসে খানা খেতেন। তাদের সাথেই আটা গুলতেন। বাজার থেকে সওদাপাতি নিজেই বহন করে আনতেন। তিনি সর্বাপেক্ষা বড় অনুগ্রহকারী, ন্যায়বিচারক, সচ্চরিত্র এবং সত্যভাষী ছিলেন।
[মাদারেজুন্ নুবূওয়াত]

বিনয়-নম্রতা
তিনি বিনয়ী ও নম্র স্বভাবের ছিলেন। কাউকে কোনদিন গালি দেন নি, শক্ত কথা বলেননি, অভিশাপও দেন নি।
কাফিরদের সাথেও তিনি অত্যন্ত হাসিমুখে কথা বলতেন। কেউ কোন বে-আদবী করলেও তা সহ্য করতেন। ঘরে থাকার সময় নিজ হাতে ঘর-গৃহস্থালির কাজকর্ম করতেন। চাদর এমনভাবে পরতেন যে, হাত-পাও ঢেকে থাকতো। কখনো তাঁকে অত্যধিক ক্রোধান্বিত হতে দেখা যায় নি।
সহচরগণের কারো প্রতি অন্তরে কোন বিরূপ মনোভাব গোপন করে রাখতেন না। তাঁর চোখেও কখনো খেয়ানত করতো না-অন্তরের খেয়ানতের তো কোন প্রশ্নই আসে না।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের বদভ্যাসের মধ্যে মিথ্যাকে সর্বাপেক্ষা গোনাহ মনে করতেন।
[বায়হাক্বী, ইবনে সা’আদ]

আখিরাতের চিন্তা
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দুনিয়ায় নিজেকে একজন পথচারী মুসাফির বলে গণ্য করতেন। তিনি বলেনঃ দুনিয়াতে এমনভাবে বাস করবে, যেন তুমি এখানে পরদেশী মুসাফির অথবা একজন সাধারণ পথচারী।
[নশরুততীব]

দানশীলতা
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট যাকাত বা অন্য কোন খাতে টাকা পয়সা এলে যে পর্যন্ত তা হকদারদের মধ্যে সম্পূর্ণ বন্টিত হয়ে না যেত ততক্ষণ ঘরে যেতেন না। [নশরুততীব] কখনো অভাবগ্রস্থ লোক এলে নিজের ক্ষুধাতৃষ্ণা ভুলে যেতেন এবং নিজের খাবারটুকু পর্যন্ত তাদের হাতে তুলে দিতেন। তাঁর দান ছিল বিচিত্র ধরনের। কখনো কাউকে কোন জিনিস ডেকে দিয়ে দিতেন। উপহার রূপে অন্যকে দান করতেন। অনেক সময় পোশাক-পরিচ্ছদ ক্রয় করে মূল্য পরিশোধ করার পর বিক্রেতাকেই তা ব্যবহার করতে দিতেন। অনেক সময় কারো কাছ থেকে কিছু নিয়ে তাকে এর অনেক বেশী পরিমাণে ফিরিয়ে দিতেন। কোন কিছু ক্রয় করে সে বস্তুর মূল্যের চাইতে অনেক গুণ বেশী পরিশোধ করতেন। কারো নিকট থেকে কোন হাদিয়া গ্রহণ করে তাকে অনেক বেশী দিয়ে দিতেন। [মাদারেজুন নুবূওয়াত] সাহাবী হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন, কেউ কিছু চাইলে হুযুর সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো তাকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিতেন না। যদি তাৎক্ষণিক সময়ে হাতে কিছুই না থাকতো, তবে অন্য সময় এসে তা নিয়ে যাওয়ার জন্য বলে দিতেন। অগত্যা প্রত্যাশীকে শান্ত¦না দিতেন। তার জন্য দো’য়া করতেন,যেন আল্লাহতা’য়ালা তার অভাব দূর করে দেন।[শামায়েলে তিরমিযী]

দৈনন্দিন জীবনের আচরণ
রসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বভাবগতভাবেই ছিলেন অত্যন্ত উদার ও মহৎ। তাঁর বদান্যতা ছিল তুলনাহীন। জীবনে কখনো তিনি কোন সাহায্যপ্রার্থীকে না’ বলেন নি। কিছু হাতের কাছে থাকলে তৎক্ষণাৎ দিয়ে দিতেন। না থাকলে ন¤্রভাবে বুঝিয়ে বলতেন। অন্য সময় এসে নিয়ে যেতে বলে দিতেন।
[ইবনে সা’আদ] তিনি ছিলেন যথার্থ অর্থেই সত্যভাষী। সহজ সরলভাবে কথা বলতেন। সংগী-সহচরগণের প্রতি তাঁর মমত্ব ছিল অপরিসীম। সবসময় তাদের সুবিধা-অসুবিধার দিকে লক্ষ্য রাখতেন। সময় সময় তাদের ভাল-মন্দ সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতেন। রাতে বাইরে যেতে হলে সাবধানে উঠতেন, আস্তে জুতা পরতেন ও খুব সাবধানে দরজা খুলে বের হয়ে আসতেন, যেন ঘরে নিদ্রিতদের নিদ্রায় কোন ব্যাঘাত না ঘটে। [যাদুল মা’আদ] কেউ তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে এলে তিনি নিজের হাতের মধ্যে তার হাত নিয়ে হাসিমুখে কথা বলতেন যেন অল্পক্ষণের মধ্যে তার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে আসে।
[ইবনে সা’আদ] যদি এমন কোন লোক আসতো, যার নাম তাঁর পছন্দ নয়, তবে তার সুন্দর কোন নাম রেখে দিতেন। [ইবনে সা’আদ] কেউ যদি হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট অভাবগ্রস্তদের মধ্যে বন্টন করার উদ্দেশ্যে যাকাত-সদক্বার মাল নিয়ে হাযির হত, তবে তিনি সে ব্যক্তির জন্য দো’য়া করতেন; বলতেনঃ আল্লাহ ‘অমুকে’র প্রতি রহম কর।
[মুসনদে আহমদ] হুযুর সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম কারো বাড়ী গেলে দরজা বরাবর গিয়ে দাঁড়াতেন না এবং বাড়ীর লোকজনকে তাঁর আগমনের খবর জানানোর উদ্দেশ্যে তিনবার ‘আসসালামু ‘আলাইকুম’ উচ্চারণ করতেন।
[আবু দাউদ, যাদুল মা’আদ] রাতের বেলায় কারো বাড়ী গেলে এমন আওয়াজে সালাম বলতেন, যেন জাগ্রতরা সালামের আওয়াজ শুনতে পায়, নিদ্রিতরা যেন জেগে না ওঠ। [যাদুল মা’আদ] পথ চলতে মাটির দিকে দৃষ্টি অবনত করে চলতেন। লোকজন নিয়ে কোথাও যাওয়ার সময় তিনি সকলের পেছনে থাকতেন। তবে যারা সামনে পড়তো, তাদেরকে সর্ব প্রথম সালাম তিনিই দিতেন। অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বসতেন। গরীব-মিসকীনদের মত বসে খানা খেতেন। মেহমানগণের যতœ নিজ হাতে করতেন। [যাদুল্ মা’আদ] রসূল-ই-মকবুল সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিকাংশ সময় চুপচাপ থাকতেন। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতেন না। কোন কিছু বলার সময় এমনভাবে গুছিয়ে বলতেন যেন শ্রোতামাত্রই সহজে বুঝতে পারে। কোন প্রসঙ্গে এতটুকু লম্বা করতেন না যেন লোক বিরক্ত বোধ করে অথবা এমন সংক্ষেপেও করতেন না যেন প্রসঙ্গে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কোন কাজে বা কথায় কঠোরতা অবলম্বন করতেন না। বিনয় পছন্দ করতেন। কোন আগন্তুকের প্রতিই অসৌজন্য প্রকাশ করতেন না। কারো কথা কেটে বলতেন না। শরীয়তের খেলাফ কোন প্রসঙ্গ আলোচিত হলে তা থামিয়ে দিতেন অথবা সেখান থেকে উঠে অন্যত্র চলে যেতেন। আল্লাহর সকল নি’য়ামতেরই অসাধারণ ক’দর করতেন। [নশ্রুততীব] কোন জিনিস ভেঙ্গে গেলে কিংবা কোন কাজ নষ্ট হলে বিরক্তি প্রকাশ করতেন না। তবে দ্বীনের ব্যাপারে কোন ক্ষতি হতে দেখলে খুব বেশী রাগান্বিত হতেন। [নশ্রুততীব্] হুযুর সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন বিনয়ী ছিলেন যে, উম্মতকে তাকিদ করতেন যেন তাঁর প্রতি কেউ অস্বাভাবিক গুণাবলী আরোপ না করে। [যাদুল্ মা’আদ] সাহাবাগণ সাক্ষাৎ করতে এলে হাসিমুখে মুসাফাহা করতেন। তাঁদের জন্য দো’য়া করতেন। [নাসায়ী] এমন কোন লোককে যদি ডাকতে হত যার নাম স্মরণে নেই বা জানা নেই, তবে হে আল্লাহর বান্দা’ বলে ডাকতেন। [ইবনুস্ সুন্নী] পথ চলতে ডানে-বামে তাকাতেন না। [হাকিম, ইবনে সা’আদ] নবী করীম সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবার সাথেই সদ্ব্যবহার করতেন। কারো সাথে এমন ব্যবহার করতেন না, যাতে তার মনে ভয় সৃষ্টি হতে পারে। এমন কি অত্যাচারী যালিমদের সাথেও হাসিমুখে কথা বলতেন। তাঁর প্রতিটি কাজেই পরিপূর্ণ শৃংখলার ছাপ ফুটে উঠতো। উঠতে বসতে আল্লাহকে স্মরণ করতেন। কোন মজলিসে গেলে যে কোন এক স্থানে বসে পড়তেন। একাধিক লোকের সাথে কথা বলতে হলে পর্যায়ক্রমে সবার দিকে ফিরে কথা বলতেন। [নশ্রুততীব্] হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা বলেন, উত্তম চরিত্রের দিক দিয়ে হুযুর সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাইতে অগ্রগামী আর কেউ কোনদিন ছিলেন না, হতেও পারেন না। যে কেউ এসে ডাক দিলে এমন কি ঘরে কেউ সম্বোধন করে কিছু বললে সাথে সাথে ‘লাব্বাইক-হাযির আছি বলে জবাব দিতেন। [যাদুল মা’আদ] নফল ইবাদত সাধারণত লোকচক্ষুর আড়ালে করতেন, যেন উম্মতের ওপর তা কঠিন বোঝায় পরিণত না হয়।
[যাদুল মা’আদ] কোন একটা নেক কাজ একবার শুরু করলে তা আর ছাড়তেন না, একাধারে করতে থাকতেন। [আবু দাউদ] নবীজী ক্রোধের সঞ্চার হলে বসে পড়তেন। যদি বসা থাকতেন, তবে শুয়ে পড়তেন যেন ক্রোধ ঠান্ডা হয়ে যায়।
[যাদুল মা’আদ] হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা বর্ণনা করেন যে, নবী-ই-করীম সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম খানাপিনা এবং ওযুর জন্য ডান হাত এবং ইস্তেঞ্জা ও এ ধরনের অন্যান্য কাজের জন্য বাম হাত ব্যবহার করতেন।
[আবু দাউদ] সাহাবীগণের মধ্যে কেউ সাক্ষাত করতে এসে যতক্ষণ বসে থাকতেন, হুযুর সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম ততক্ষণ তাঁর সংগ ছেড়ে উঠতেন না। কেউ হাত মিলাতে চাইলে সংগে সংগে হাত বাড়িয়ে দিতেন এবং যতক্ষণ সে ব্যক্তি হাত সরিয়ে না নিতো, ততক্ষণ তিনি নিজে হাত সরাতেন না। [ইবনে সা’আদ] এক বর্ণনায় দেখা যায়, কারো সাথে সামনাসামনি কথা বলার পর যতক্ষণ সে ব্যক্তি তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে না নিতো, ততক্ষণ তিনি তার দিক থেকে মুখ ফেরাতেন না। কেউ কানে কানে কিছু বলতে চাইলে তার দিকে কান পেতে রাখতেন যতক্ষণ কথা শেষ না হত, ততক্ষণ কান সরাতেন না। [ইবনে সা’আদ] হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছোটদের মধ্যে গেলেও তাদের সালাম দিতেন। [যাদুল্ মা’আদ] হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন, কোন লোক হঠাৎ হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে এসে পড়লে প্রথমে ঘাবড়ে যেত। তবে আলাপ-পরিচয় হওয়ার পর তাঁকে অন্তর দিয়ে ভালবেসে ফেলতো। আমি তাঁর মতো এত সুপুরুষ এবং সর্বগুণে গুণান্বিত ব্যক্তি তাঁর আগে বা পরে আর কখনো দেখিনি।
[নশরুততীব] কারো সম্পর্কে খারাপ কিছু শুনলে এবং সংশোধনের উদ্দেশ্য হলে এরূপ বলতেন না যে, অমুক লোকের এ অবস্থা কেন হল? বরং বলতেন যে, লোকদের কি হলো যে, তারা এরূপ করছে! [শামায়েলে তিরমিযী] তাঁর জবান থেকে সচরাচর শুধু সেসব কথাই বের হতো, যাতে সওয়াব পাওয়া যায়। কোন পড়শীর সাথে দেখা হলে তার ভাল-মন্দ জিজ্ঞেস করতেন। পরিচিত জনদের প্রত্যেকেরই এরূপ ধারণা হত যে, বোধ হয় হুযুর সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকেই সর্বাধিক মহব্বত করেন। কেউ কোন কথা বলতে এলে যতক্ষণ সে নিজের থেকে উঠে না যেত, ততক্ষণ তিনি বসে থাকতেন।
[নশরুততীব] হযরত আবূ হোরায়রা বর্ণনা করেন, হুযুর সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো বেশী চিন্তিত হলে আকাশের দিকে মুখ তুলে বলতেনঃ সুবহানাল্লাহিল্ ‘আযীম। দো’য়া করার সময় বেশী আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লে বলতেনঃ ইয়া হাইয়্যূ ইয়া কাইয়্যুম। [তিরমিযী] অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে যে, বেশী চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়লে দাড়িতে ঘন ঘন হাত বুলাতেন। কখনো কখনো দাড়ির মধ্যে অঙ্গুলি প্রবেশ করিয়ে নিতেন। মুখে বলতেনঃ হাসবিয়াল্লাহু ওয়া নি’মাল ওয়াকীল।

লেখক: কলামিষ্ট, সাংবাদিক, চেয়ারম্যান- গাউছিয়া ইসলামিক মিশন,