ইমাম আহমদ রেযা ও তাঁর তরিকত দর্শন- মুহাম্মদ নেজাম উদ্দীন

ইমাম আহমদ রেযা ও তাঁর তরিকত দর্শন- মুহাম্মদ নেজাম উদ্দীন

ইমাম আহমদ রেযা ও তাঁর তরিকত দর্শন
মুহাম্মদ নেজাম উদ্দীন

============

আত্মারূপ তরিকত (সূফীতত্ত্ব) আর দেহরূপ শরিয়ত, এ দু’য়ের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও প্রয়োজনীয়তা মুসলিম মানসে অপরিসীম। এ জন্য একজন প্রকৃত তাসাউফপন্থী (সূফী)-এর জীবনে শরিয়ত, তরিক্বত ও মারিফাত সমভাবে ক্রিয়াশীল। প্রকৃত মু’মিন ও প্রকৃত তাসাউফপন্থী (সূফী)তে তাই কোন পার্থক্য নেই। প্রকৃত সূফী মুসলমানই মুসলিম- সমাজে মু’মিন বা প্রকৃত মুসলমান বা কামিল ওলী-আল্লাহরূপে পরিচিত। এ সম্পর্কে হযরত ইমাম মালিক রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন-‘যে ব্যক্তি শুধু ফিক্বহ (শরিয়ত) মানে ও পালন করে অথচ তাসাউফ অস্বীকার করে সে ব্যক্তি ফাসিক। পক্ষান্তরে যে শুধু তাসাউফ মানে ও পালন করে আর ফিক্হ (শরিয়ত) অস্বীকার করে সে জিন্দিক। আর যে উভয়টিকে মেনে চলে সেই প্রকৃত মু’মিন।’ [আলী ক্বারী, মিরকাত, কিতাবুল ইলম, ৩য় অনু ২/১৯০]

তাই তাসাউফ (তরিকত)-এর প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে জড়িত আছে কুরআন-হাদিসের অমর বাণীসমূহ। বস্তুত তাসাউফ হচ্ছে কুরআন- হাদীসের মগজ ও ইসলামের আত্মা। ফলে মুসলিম সমাজে তাসাউফ এক সুপ্রতিষ্ঠিত সত্যে পরিণত হয়। কিন্তু এক সময়ে তাসাউফের নামে ভণ্ডামীর চিত্র পরিদৃষ্ট হয়। ফলে এক শ্রেণীর ওলামা ও ইসলামী চিন্তাবিদ যথার্থ তাসাউফকেও সংশয়ের চোখে দেখতে শুরু করলেন।

তাসাউফ (তরিকত) থেকে ইসলামী চিন্তাবিদদের সন্দেহ নিরসনে এবং তাসাউফ বা তরিকতের প্রকৃত স্বরূপ ও ব্যাখ্যা জনসম্মুখে তুলে ধরার মহৎ মানসে হিজরী চতুর্দশ শতাব্দিতে যে সব মহান মনীষী নিরন্তন গবেষণা করে যান তাঁদের মধ্যে আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (১২৭২-১৩৪০হিজরী) অন্যতম। তিনি যেমন শরিয়তের ইমাম (পথপ্রদর্শন), তেমনে তাসাউফ (তরিক্বত)-এর ইমামও। বর্তমান বিশ্বের সকল প্রসিদ্ধ তরীকার খিলাফত ও ইজাযত তাঁর অর্জন ছিলো। ফলে তাসাউফ শাস্ত্রের যাবতীয় পরিভাষা এবং এগুলোর বিধিপ্রয়োগ ও কার্যকরণ সম্পর্কেও তিনি সম্যক ওয়াকিবহাল ছিলেন। তিনি শুধু পীর-মুরিদীর মাধ্যমে ইলমে তাসাউফ চর্চায় নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন নি, বরং কতেক রিপুতাড়িত মুর্র্খ সূফী কর্তৃক তাসাউফ চর্চার নামে সৃষ্ট যাবতীয় কুপ্রথা ও ভুল ধারণার সংশোধন ও তাসাউফকে সুশৃঙ্খল নিয়মে ফিরিয়ে আনতে নিয়মিত কলম যুদ্ধও চালিয়ে যান।
ইলমে তাসাউফের দার্শনিক ব্যাখ্যায় তাঁর ঐতিহাসিক ফাতাওয়া গ্রন্থ ছাড়াও তিনি নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ পুস্তকগুলো রচনা করেন। যেমন-
১. কাশফু হাকাইক ওয়া আসরার ওয়া দাকাইক।
২. বাওয়ারিক তালূহু মিন হাকীকাতির রূহ।
৩. আত্ তালাত্তুফ বি জাওয়াবি মাসাঈলিত তাসাউফ।
৪. মাকালু উরাফা বি-ইযাযি শরয়ী ওয়া উলামা
৫. নাকাউস সুলাফা ফী আহকামিল বায়আতি ওয়াল খিলাফা
৬. আল্ ইয়াকুতাতুল ওয়াসিতাহ্ ফী- কালবি আকদির রাবিতা।
ইমাম আহমদ রেযার উপরিউক্ত রচনালীর আলোকে তাঁর তাসাউফ বা তরীকত দর্শনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক নিম্নে আলোচনা করা গেলো।

শরিয়ত ও তরিকত
শরিয়তের বিধি-বিধানকে উপেক্ষা করে যারা নিজেদেরকে সূফী বা তরিকতপন্থী বলে বেড়ায় তাদের স্বরূপ উন্মোচনে রচনা করেন ‘মাকালু উরাফা….’ গ্রন্থটি। তিনি এ গ্রন্থে শরিয়ত ও তরিকতের নিগূঢ় রহস্য তুলে ধরেন। তাঁর মতে, ‘শরিয়ত হচ্ছে-তাসাউফের পথ-পরিক্রমায় প্রারম্ভিক স্তর। শরিয়ত সূফীর আধ্যাত্মিক পথ-পর্যটনের প্রথম ও অপরিহার্য অংশ। শরীয়তের যথার্থ চর্চা ও অনুশীলন ছাড়া মারিফাত (খোদা-পরিচিতি- যা একজন সূফীর পরম লক্ষ্য) অর্জন অসম্ভব; শরিয়ত তাসাউফের পথে উন্নতি ও সফলতা লাভের একমাত্র চাবিকাঠি।’ শরিয়ত ও তরিকতের সঠিক স্বরূপ তুলে ধরতে গিয়ে তিনি লিখেছেন-
এক. এ কথা বলা যে, শরিয়ত হচ্ছে, ‘কিছু সংখ্যক বিধি-বিধান, ফরয, ওয়াজিব, হালাল ও হারামের নাম,’ নিছক অন্ধপনাই, বরং শরিয়ত হচ্ছে- সমস্ত বিধি-বিধান। দেহ ও প্রাণ, রূহ ও হৃদয় এবং সমস্ত উলূম-ই ইলাহিয়্যাহ এবং অপরিসীম জ্ঞান-বিজ্ঞানেরই ধারক। তন্মধ্যে এক টুকরার নাম হচ্ছে তরিকত ও মারিফাত। …সমস্ত হাকিকীতকে পবিত্র শরিয়তের উপর পেশ করা ফরয। যদি তা শরীয়ত অনুযায়ী হয়, তবে গ্রহণযোগ্য, অন্যথায় পরিত্যাজ্য ও ঘৃণিত। সুতরাং নিশ্চিত ও অকাট্য কথা হচ্ছে- শরিয়তই মূল বিষয় ও মূল ভিত্তি। [মাকালু- উরাফা…… (উর্দু) পৃ-২, রেযা একাডেমী, ভারত]

দুই. ইলমে তরিকত (তাসাউফ) চর্চার মাধ্যমে একজন সূফীর হৃদয়ে যা কিছু উদ্ঘাটিত হয়, তা শরিয়তের উপর আমল করারই ফলমাত্র। নতুবা শরিয়তের অনুসরণ ব্যতীত গোপনীয় তথ্য উদ্ঘাটন (কাশফ অর্জন) তো পাদরী, যোগী এবং সন্নাসীদেরও হয়ে থাকে। কিন্তু শরিয়তবিহীন কাশফ সাধন উক্ত সাধকদেরকে জাহান্নাম ও কঠিন শাস্তির দিকে নিয়ে যায়। [পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-৫] তিন. শরিয়ত হলো মূল আর তরিকত হলো এর শাখা। শরিয়ত ঝর্ণার উৎসমূল আর তরিকত এ থেকে সৃষ্ট সাগর। শরিয়ত থেকে তরীকতকে পৃথক করা অসম্ভব ও সুকঠিন। শরিয়তের উপর তরিকত নির্ভরশীল। শরিয়ত হল সবকিছুর মূল ও মাপকাঠি। শরিয়ত হল এমন মহা সড়ক যা আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। এটা বাদ দিয়ে মানুষ যে পথ অবলম্বন করে তা আল্লাহর পথ থেকে যোজন দূর। শরিয়তকে পাশ কাটিয়ে তরিকত চর্চা অবৈজ্ঞানিক ও অসম্ভব। শরিয়তের অনুসরণ ব্যতীত সমস্ত পথ-প্রকৃতার্থে রহিত ও ভ্রষ্ট। [পূর্বোক্ত, পৃ.-৫] চার. শরিয়তের প্রয়োজন একেকজন মুসলমানের প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসে, প্রতি পলকে। প্রতিটি মুহূর্তে আমৃত্যুই; আর তরিকতে যারা পা রাখে তাদের জন্য আরো বেশী প্রয়োজন। বস্তুত রাস্তা যতোই সরু ও বন্ধুর হয়, পথপ্রদর্শকেরও ততবেশী প্রয়োজন হয়। [পূর্বোক্ত, পৃ.৮]

প্রকৃত সূফীর পরিচয়
একজন প্রকৃত সুফীর স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘সূফী’ হচ্ছে ওই ব্যক্তি যে আপন প্রবৃত্তিকে শরিয়তের অনুসারী করে; ওই ব্যক্তি নয়, যে প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে শরিয়ত ছেড়ে দেয়। শরিয়ত হচ্ছে খাদ্য আর তরিকত হচ্ছে শক্তি। যখন আহার বর্জন করা হয়, তখন শক্তি আপসে বিদায় নেয়।’ [ই’তিকাদুল আহবাব, ইদারা-ই ইশাআতে রেযা, বেরিলী, পৃ.-২৭]

ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি একজন প্রকৃত সূফীর জন্য শরিয়তের জ্ঞানে জ্ঞানী হওয়াকে অপরিহার্য বলে জানেন। তিনি বিখ্যাত সূফীদের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন।

‘আউলিয়া-ই কেরাম বলেন, মূর্খ সূফী শয়তানের খোরাক।… ইলমবিহীন সাধনাকারীদেরকে শয়তান আঙ্গুল দ্বারা নাচায়, মুখে লাগাম ও নাকে রশি লাগিয়ে যেদিকে ইচ্ছা টেনে বেড়ায়। (আর অজ্ঞতার দরুন) তারা মনে করে ভাল কাজ করছে।’… ইমাম গাযালী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন, যে ব্যক্তি প্রথমে শরিয়তের ইলম শিক্ষা করে তাসাউফে কদম রাখলো, সে সফলকাম হয়েছে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ইলম অর্জন করার পূর্বে সূফী হতে চেয়েছে, সে নিজেকে ধ্বংসের মধ্যে ফেলেছে।’ [ইরশাদাত-ই আ’লা হযরত (বাংলা), আনজুমান, চট্টগ্রাম, পৃ-৬৮]

একজন প্রকৃতি মু’মিন-মুসলমানের জন্য শরীয়তের প্রতিটি বিধি-বিধান মেনে চলা অপরিহার্য। কিন্তু একজন প্রকৃতি সূফীকে শরিয়তের বিন্দু বির্ষগের প্রতিও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয়। কারণ, আল্লাহ-রসূলের নৈকট্য যার যতো বেশী হাসিল হবে, শরিয়তের বিধানাবলী ততো বেশী তার জন্য কঠিন হয়ে যায়। তাই বলা হয়ে থাকে, ‘সাধারণ নেক্কার বান্দাদের সৎকার্যাদি, নৈকট্যধন্য বান্দাদের জন্য গুনাহর সামিল’। এ প্রসঙ্গে ইমাম আহমদ রেযা বিখ্যাত সূফীসাধক হযরত বায়েজিদ বোস্তামী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি-এর উক্তি উদ্ধৃতি করে বলেন, ‘একদিন হযরত বায়েজিদ বোস্তামী, ওমর বোস্তামীর পিতাকে বললেন, চলুন ওই ব্যক্তির নিকট যাই, যে নিজেকে ওলী বলে প্রকাশ করেছেন এবং পরহিযগার বলে মানুষের নিকট আকর্ষণীয় ব্যক্তিরূপে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। তাঁরা তার নিকট গিয়ে দেখলেন, ঘটনাচক্রে তিনি কেবলার দিকে থুথু ফেলেছেন। তা দেখে হযরত বায়েজিদ বোস্তামী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাকে সালাম না করেই ফিরে এলেন এবং বললেন, ওই ব্যক্তি শরীয়তের একটি আদব রক্ষার ব্যাপারে যখন বিশ্বস্ত হতে পারলো না, সে কী করে আল্লাহর রহস্যাদির ব্যাপারে বিশ্বস্ত হতে পারে।’ [মাকালু-ই উরাফা (উর্দু), পৃ.-১৮]

হযরত বায়েজিদ বোস্তামী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি আরো বললেন, ‘কোন ব্যক্তিকে হাওয়ায় উড়তে বা চারজানু হয়ে হাওয়ায় বসার কারামত দেখে ধোঁকায় পতিত হয়ো না, যতক্ষণ না ফরয, ওয়াজিব, মাকরূহ, হারাম এবং শরিয়তের সীমারেখা ও আদব রক্ষার ব্যাপারে তার অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত না হও।’ [পূর্বোক্ত, পৃ.-১৮]

সূফীদের স্তর বিন্যাস
‘মিরআতুল আসরার’ গ্রন্থপ্রণেতা হযরত আবদুর রহমান চিশতীর মতে সূফীদের ৭টি স্তর রয়েছে। যেমন- ১. তালিবীন, ২. মুরীদীন, ৩. সালিকীন, ৪. সা’য়িরীন ৫. তা’য়িরীন, ৬. ওয়াসিলীন ৭. কুতুবে এরশাদ। [মিরআতুল আসরার, আদবী দুনিয়া, ভারত, পৃ.-৪৯]

ইমাম আহমদ রেযা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সূফীদেরকে প্রথমত ৪টি স্তরে ভাগ করেছেন। যেমন- ১. সালেহীন, ২. সালিকীন, ৩. ফানীয়্যিন, ৪. ওয়াসিলীন। শেষোক্ত ‘ওয়াসিলীন’ কে তিনি দশটি স্তরে ভাগ করেছেন- যেমন- ১. নুজাবা, ২. নুকাবা, ৩. আবদাল, ৪. বুদালা, ৫. আওতাদ, ৬. আমামাইন ৭. গাউস, ৮. সিদ্দীক ৯. নবী ১০. রসূল। তাঁদের মধ্যে প্রথম তিন স্তরের লোকেরা ‘সায়ির ইলাল্লাহ্’ অর্থাৎ আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়ার মর্যাদায় গিয়ে পৌঁছেন আর বাকীরা হচ্ছেন ‘সায়ির ফিল্লাহ্’ অর্থাৎ আল্লাহতেই বিলীনের মর্যাদায় উপনীত। [মালফুযাত-ই আ’লা হযরত, ৪র্থ খণ্ড, পৃ.-২২]

সূফীর চরিত্র ও স্বভাব
ইলমে তাসাউফ অন্তরের বিশুদ্ধতা ও পবিত্রতার উপর সমধিক গুরুত্বারোপ করে থাকে। ব্যক্তিগত জীবনকে কলুষমুক্ত করে সুন্দর ও মনোরম জীবন গড়ে তোলতে তাসাউফের সাধনা সন্দেহাতীতভাবে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে তরীকতপন্থীকে বিশেষ কতগুলো জিনিষ পরিবর্জন ও অর্জনের মাধ্যমে জাহিরী ও বাতিনী উভয় জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনে অগ্রসর হয়।
একজন প্রকৃত সূফীর জাহিরী জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনে ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ৪০টি দোষ পরিহার করার প্রতি নির্দেশ করেন। ওই ৪০টি দোষ হচ্ছে-
১. রিয়া (লোক দেখানো ইবাদত/মনোভাব) ২. ওজব (খোদ-পসন্দী) ৩.হাসদ (হিংসা) ৪. কিনা (দ্বেষ) ৫. তাকাব্বুর (অহংকার) ৬. হুব্বে মাদাহ্ (স্বীয় প্রশংসার মোহ্) ৭. হুব্বে জাহ্ (বিলাস মোহ) ৮. মহব্বতে দুনিয়া (পার্থিব মোহ) ৯.তলবে শুহরাত (যশ-খ্যাতির মোহ) ১০.তা’যীম-ই উমারা (ধনাঢ্য ও নেতৃস্থায়ী লোককে সম্মান দেখানো) ১১. তাহকীরে মাসাকীন (গরীব-দরিদ্রের প্রতি ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যভাব) ১২. ইত্তেবা-ই শাহ্ওয়াত (কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ) ১৩. মদাহিনাত (খোশমোদ বা তোষামোদ করা) ১৪. কুফরানে নি’মাত (নিয়ামতের কুফরী) ১৫. হিরস (লোভ-লালসা) ১৬. বুখল (কৃপনতা) ১৭. তোল-ই আমল (বেশী কামনা) ১৮. সূউ-ই যান (মন্দ ধারনা) ১৯. এনাদ-ই হক্ব (সত্য হতে বিমুখ) ২০. এসরার-ই বাতিল (অসত্যের অবতারণা) ২১. মকর (প্রতারণা) ২২. উযর (আপত্তি) ২৩. খিয়ানত (আত্মসাৎ করা) ২৪. গাফলাত (অলসতা) ২৫. কাসওয়াত (পাষণ্ডতা) ২৬. তাম‘আ (লোভ) ২৭. তামাল্লুক (চাটুকারিতা) ২৮. ই’তিমাদ-ই খাল্ক (সৃষ্টির উপর ভরসা) ২৯. নিসয়ান-ই খালিক (স্রষ্টাকে ভুলে যাওয়া) ৩০. নিসয়ান-ই মাওত (মৃত্যুর কথা ভুলে যাওয়া) ৩১. জুরআত আলাল্লাহ্ (আল্লাহর প্রতি দুঃসাসিকতা) ৩২. নিফাক (কপটতা) ৩৩. ইত্তিবা-ই শয়তান (শয়তানের অনুসরণ) ৩৪. বন্দিগীয়ে নাফস্ (কুপ্রবৃত্তির দাসত্ব) ৩৫. রাগবত-ই বতালত (বেহুদাপনার প্রতি আসক্তি) ৩৬. কারাহাত-ই আমল (মন্দ কাজের প্রতি ঝোঁক প্রবণতা) ৩৭.ক্বিল্লাত-ই খাশয়াত (খোদাভীতির অপ্রতুলতা) ৩৮. জয‘আ (অধৈর্য্য হওয়া) ৩৯. ’আদমে খুশু (বিনয়- নম্রতার অভাব) এবং ৪০. গযব লিন নাফস্ ওয়া তাসাহুন ফিল্লাহ্ (নাফসের কারণে নারাজ হওয়া, এবং আল্লাহর প্রতি উদাসীনতা।
[বায়আত ও খিলাফতের বিধান, (বাংলা), পৃ.৫৩-৫৪]

উপরিউক্ত দোষগুলো পরিহার করার সাথে সাথে অন্তর ও শরীর উভয়ের উপর যতো খোদায়ী বিধান কার্যকর সবই মেনে চলার মাধ্যমে একজন মুসলমান ইহকালীন ও পরকালীন সফলতার দরজায় গিয়ে উপনীত হতে পারে। এ পর্যন্ত এসে একজন মুসলমান সূফীদের প্রথম স্তর ‘তালিবীন’ বা ‘সালিহীন’-এর মর্যাদায় পৌঁছে মাত্র। এটা সুফী সাধনার প্রারম্ভিক স্তর। এটাকে ‘ফালা-ই তাক্ওয়া’ বলা হয়। এ ‘তাকওয়া’ অবলম্বন করা সাধারণত প্রত্যেক মুসলমানদের উপর ফরযে আইন (অবশ্যই করণীয়)।
‘ফালাহ-ই তাক্ওয়া’ অর্জনের স্তর পর্যন্ত তরিকতের প্রচলিত নির্দিষ্ট পীর-মুরশিদের হাতে বায়আতের প্রয়োজন নেই। বরং এ ক্ষেত্রে আল্লাহ, রাসূলের বিধি-বিধান অনুসরণ করার জন্য শরিয়তের ইমামগণের কারো আনুগত্য (তাক্বলীদ) করাই যথেষ্ট। তাঁরা এ ক্ষেত্রে ‘মুরশিদ-ই আম’ হিসেবে বিবেচিত হবে। এ প্রকার মুকাল্লিদ মুসলমানের (ইমাম চতুষ্টয়ের কোন এক জনের অনুসারী) তরীকতের প্রচলিত বায়আত না থাকলে তাকে ‘যার পীর নেই তার পীর শয়তান’- এ বিধানে অন্তর্ভুক্ত করা নিছক বাড়াবাড়ি। সীমালঙ্গন এবং তরিকত সম্পর্কে অজ্ঞতার নামান্তর। কিন্তু ইমাম চতুষ্টয়ের কারো একজনের ‘তাক্বলীদ’ কে স্বীকার না করে কেউ যদি নিজ খেয়াল-খুশী মতো শরিয়তের উপর আমল করতে চায় নিঃসন্দেহে সে পীরহীন। আর পীরহীন ব্যক্তি শয়তানের শিষ্য। সূফীদের উক্তি- ‘যার পীর নেই তার পীর শয়তান’- এ সব গায়রে মুকল্লিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। কারণ ‘মুরশিদ-ই ’আম’-এর আনুগত্য তার কাঁধে নেই।

আর আল্লাহর সাথে মিলনই হচ্ছে সুফী জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনে একজন সূফীকে সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। সূফীর এ যাত্রাপথ কুসুমাস্তীর্ণ ও সুগম নয় বরং যেমনি কন্টকাকীর্ণ ও দুর্গম, তেমনি দীর্ঘ। এটা হচ্ছে ‘ফালাহ-ই ইহসান’ অর্জনের স্তর। তাই এ পথে একাকী চলা নিরাপদ নয় বিধায় একজন কামিল মুরশিদের দীক্ষা গ্রহণ প্রয়োজন পড়ে। এ প্রসঙ্গে ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন,

তরিকতের এ পথ-পরিক্রমায় এমন অনেক সুক্ষ্ম ও দুর্গমপথ রয়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত এ পথের উঁচু-নীচু সবকিছু সম্পর্কে অবগত কামিল ও অভিজ্ঞ পথপ্রদর্শক পথ দেখিয়ে না দেবে ততক্ষণ পর্যন্ত এ পথ দিয়ে পাড়ি দেওয়া সম্ভব নয়। তরিকত বিষয়ক গ্রন্থাদি অধ্যয়ন এবং এই মতে অনুশীলন এখানে কোন কাজ দেবে না।… আল্লাহর একান্ত নৈকট্যলাভের যে অগণিত পথ রয়েছে ওই প্রত্যেক পথের দুর্গমতা, সূক্ষ্মতা ও অবতরণস্থল ভিন্ন ভিন্ন, যা না নিজে বুঝতে পারবে, না তাসাউফগ্রন্থ বলে দেবে। সে সাথে ঐ পুরাতন শত্র“, প্রতারক, অভিশপ্ত ইবলীশ তো সর্বদা লেগেই আছে। যদি সাহায্যকারী সাথে না থাকে, তবে আল্লাহ্ ভাল জানেন কোন গর্তে পতিত করে, কোন ঘাটে ধ্বংস করে বসে। তখন সুলূক (সাধনা) তো দূরে, (আল্লাহ্ না করুক) ঈমান পর্যন্ত হাত ছাড়া হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। অনেক তরিকতের সাধকদের বেলায় এ রকম ঘটনা ঘতে দেখা গেছে।’ [পূর্বোক্ত, পৃ.-৭৩-৭৪] তাসাউফ বা তরিকতের এই অনুশীলন আল্লাহ তা‘আলার সর্বোচ্চ সান্নিধ্য ও মর্যাদা অর্জনের জন্য করা হয়ে থাকে। এটা হচ্ছে ‘ফালা-ই ইহসান’। ‘ফালাহ-ই তাক্ওয়া’র অর্জনের মতো এটা কারো জন্য ফরয নয়। কারণ আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কষ্ট দেন না। তাই আল্লাহর ওলীগণও লোকদেরকে এ পথে সার্বজনীন দাওয়াত দেন নি। আবার এ পথের অনেক অভিযাত্রীকে এ ব্যাপারে অযোগ্য পেয়ে মাঝ পথ থেকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।

বায়আত কি?
‘মুরশিদ-ই ‘আম’-এর আনুগত্যের পাশাপাশি তরিকতের প্রচলিত বায়আতের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক পথে অগ্রসর হওয়া সূফী তরিকার অন্যতম লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনে প্রকৃত সালিক (তরীকত পথের যাত্রী) -এর জন্য পীর-মুরশিদ নির্বাচন করা এক সুকঠিন ব্যাপার। কারণ, বর্তমানে পীর হওয়াকে অনেকে লাভজনক ব্যবসা মনে করে থাকে। ফলে যোগ্যতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ না হয়ে অনেকেই পূর্বপুরুষদের বুযুর্গীর সুবাদে নিজেকে শুধুমাত্র বংশীয় ধারায় ‘পীর-মুরশিদ’ ‘রাহবার’ ইত্যাদি সেজে তরিকত ও তাসাউফের পথকে কলুষিত করে তুলেছে। তাই ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বায়াআতের অর্থ, বায়আতের প্রকারভেদ ও কোন প্রকার বায়আতের জন্য কোন ধরনের পীর-মুরশিদ আবশ্যক এবং তাদের যোগ্যতার মানদণ্ড কি? -এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন-‘বায়আত মানে পরিপূর্ণভাবে বিক্রি করা। অনেকে বায়আতকে রসম বা প্রথানুসারে করে থাকে, বায়আতের অর্থ জানে না। বায়আত বলে, হযরত ইয়াহয়া মুনীরী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির এক মুরীদ নদীতে ডুবে যাচ্ছিলো। হযরত খাযির আলাইহিস্ সালাম আত্মপ্রকাশ করলেন। আর বললেন, তোমার হাত আমাকে দাও! আমি তোমাকে পানি থেকে বের করে আনবো। মুরিদ আরজ করলো, এ হাত আমি হযরত ইয়াহয়া মুনীরীকে দিয়ে রেখেছি। এখন অন্য কাউকে দেবো না। তখন হযরত খাযির অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আর হযরত ইয়াহয়া মুনীরী আত্মপ্রকাশ করলেন এবং তাকে ডুবে যাওয়া থেকে উদ্ধার করলেন।
[ইরশাদাত-ই আ’লা হযরত, পৃ.৫৯, ও মালফুযাত ২য় খণ্ড, পৃ. ৪১]

বায়আত, পীর-মুরশিদের প্রকারভেদ ও পীরের যোগ্যতা
উল্লেখ্য যে, বায়আত দু’প্রকার। ১. বায়আত-ই বরকত ২. বায়আত-ই ইরাদত। বায়আতের এ প্রকারদ্বয়ের উপর আলোচনা করতে গিয়ে ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন-
এক. ‘বায়আত-ই বরকত’ হচ্ছে- শুধু বরকত হাসিলের জন্য সিলসিলায় দাখিল হয়ে যাওয়া। আজকাল সাধারণভাবে এ বায়আতই হচ্ছে। তাও ভাল নিয়্যতে হতে হবে। অনেকে পার্থিব কোন ফাসিদ উদ্দেশ্যে বায়আত হয়ে থাকে তা আলোচনার বাইরে।… এ বায়আত গ্রহণ করাও অনর্থক নয় বরং ইহলোক ও পরলোকে এটাও অনেক উপকারে আসবে। আল্লাহর প্রিয়-বান্দাদের গোলামদের দপ্তরে নাম লিপিবদ্ধ হওয়া, তাঁদের সিলসিলার সাথে মিলিত হয়ে যাওয়া মূলত সৌভাগ্যই। (ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এখানে এ বায়আতের ৩টি বিশেষ উপকারের কথা উল্লেখ করেছেন। বিস্তারিত জানতে ‘বায়আত ও খিলাফতের বিধান’ বঙ্গানুবাদ পুস্তকটি পাঠ করুন।)
এ প্রকার বায়আতের জন্য পীরকে ‘শায়খ-ই ইত্তিসাল’ হতে হবে। আর ‘শায়খ-ই ইত্তিসাল’ হচ্ছেন এমন পীর যার হাতে বায়আত করলে মুরীদের সম্পর্ক পরম্পরা হুযূর পুরনূর সায়্যিদুল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত গিয়ে মিলিত হয়। আর এ প্রকার পীরের মধ্যে নিম্নোক্ত চারটি বৈশিষ্ট্য থাকা অপরিহার্য। অন্যথায় বায়আত করা না-জায়েয হবে। যেমন-

১. তরিকতের শায়খের সিলসিলা পরম্পরা সঠিক পন্থায় হুযূর আকদাস সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছা, মাঝখানে কেউ বাদ না পড়া।
২. তরিকতের শায়খ সুন্নী ও বিশুদ্ধ আক্বিদাধারী হওয়া।
৩. আলিম হওয়া। কমপক্ষে এতটুকু ইলম থাকা জারুরি যে, কারো সাহায্য ছাড়াই নিজের জরুরি সামাইল কিতাব থেকে নিজেই বের করতে পারেন।
৪. পীর ফাসিক-ই মু’লান (প্রকাশ্য ফাসিক) না হওয়া।
[বায়আত ও খিলাফতের বিধান, পৃ. ৫৮]

দুই.‘বায়আত-ই ইরাদত’ হচ্ছে নিজের ইচ্ছা ও ইখতিয়ার থেকে পুরোপুরিভাবে বের হয়ে শায়খ ও মুরশিদ, হাদী-ই বরাহক ও আল্লাহর প্রকৃত ওলীর হাতে একেবারে সোপর্দ করে দেওয়া। তাঁর কাছে জীবিত হয়েও মৃত্যের মতো থাকা। এটা হচ্ছে সালিক বান্দাদের বায়আত। এটাই মাশাইখ ও মুরশিদের উদ্দেশ্য ও কাম্য। এ ধরনের বায়আত সালিককে আল্লাহ তা‘আলা পর্যন্ত পৌঁছায়। [পূর্বোক্ত, পৃ.-৬৩]

এ প্রকার বায়আতের জন্য পীরকে ‘শায়খ-ই ইসাল’-এর মর্যাদায় উত্তীর্ণ হতে হবে। আর ‘শায়খ-ই ইসাল’ হচ্ছেন এমন পীর, যিনি ‘শায়খ-ই ইত্তিসাল’-এর যাবতীয় বৈশিষ্ঠ্যের ধারক হওয়ার সাথে সাথে নফসের ক্ষতিকর বস্তু, শয়তানের প্রতারণা, কামনা-বাসনার ফাঁদ সম্পর্কে জ্ঞাত হবেন। মুরিদকে তরীকতের প্রশিক্ষণ দিতে জানেন এবং নিজ মুরিদদের প্রতি এমন স্নেহপরায়ণ যে তাকে তার দোষত্র“টি ধরিয়ে দেন এবং সংশোধনের পন্থা বাতলিয়ে দেন। আর তরিকতের পথ-পরিক্রমায় যতো অসুবিধার সৃষ্টি হয় তা’ মীমাংসা করে দেন। তিনি শুধু না ‘সালিক’, না শুধু ‘মাজযূব’।….শুধুমাত্র ‘সালিক’ বা শুধুমাত্র ‘মাজযূব’-এরা উভয় ‘শায়খ-ই ইসালা’ হতে পারেন না। কারণ প্রথমজন (সালিক) তো স্বয়ং এখন (তরিকতের) পথে রয়েছেন আর অন্যজন (মাজযূব) মুরীদকে প্রশিক্ষণ দিতে অক্ষম। বরং এ প্রকার পীরকে হয় ‘মাজযূব-ই সালিক’ হতে হবে, না হয়, ‘সালিক-ই মাজযূব’ হতে হবে। উভয়ের মধ্যে প্রথমজনই উত্তম। [প্রর্বোক্ত পৃ.৬০]

ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, ‘ফালাহ-ই ইহসান’-এর মর্যাদা অর্জন করাই তরিকতের চরম ও পরম লক্ষ। এ ফালাহ- (কল্যাণ) অর্জনের মাধ্যমেই ‘সালিক’ আল্লাহ ও তাঁর রসূলের একান্ত সান্নিধ্য লাভ করে থাকে। তাই ‘ফালাহ-ই ইহসান’ এর মর্যাদা লাভের জন্য শায়খ-ই ইসালের শিষ্যত্ব গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন। আর তাঁর হাতে বায়আত-ই ইরাদতই করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বায়আত-ই বরকত যথেষ্ট নয়। এ প্রসঙ্গে ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি লিখেছেন যে, ‘তরিকতের সূক্ষ্ম পথে (ইহসানের পথে) ‘মুরশিদ-ই খাস’ এর হাতে ‘বায়আত-ই ইরাদত’ গ্রহণ করা কদম রাখলে ওই সালিকের বিপদগামী হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। এ ক্ষেত্রে ‘শায়খ-ই ইত্তিসাল’ কোন কাজ দেবে না। বরং ‘শায়খ-ই ইসাল’-এর হাতে ‘বায়আত-ই এরাদত’ করতে হবে। হ্যাঁ আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ যদি তার প্রতি হয় তবে তরিকতের সব বিপদ হতে মুক্তি পাবে। তখন তার পীর স্বয়ং রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। (তবে এটা এমন দূর্লভ বিষয় যার উপর সাবর্জনীন বিধান বর্তায় না।)[পূর্বোক্ত, পৃ.৮৭]

কাশ্ফ (অতিন্দ্রীয় অনুভূতি)
তরিকত দর্শনে ‘কাশ্ফ’ বা অতিন্দ্রীয় অনুভূতি হচ্ছে এক ধরনের অন্তর্দৃষ্টি, যার সাহায্যে সাধক ভূত-ভবিষ্যত জগতের দৃশ্য, অদৃশ, আত্মা, আল্লাহর জাত ও সিফাতকে জানতে প্রয়াস পান। অনেক তরিকতপন্থী সূফীর নিকট তরিকতপন্থী সূফীর নিকট কাশফ্লব্ধ জ্ঞানই প্রকৃত জ্ঞান। কিন্তু ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’ প্রসিদ্ধি তরীকতের ইমামদের উক্তি উদ্ধৃতিপূর্বক লিখেছেন-‘আল্লাহর ইলমের মধ্যে ওলীর কাশ্ফ ওই ইলমকে অতিক্রম করতে পারে না। যা আল্লাহর নবী কিতাব ও ওহী ধারা দান করেছে। এ স্থানে হযরত জুনাইদ বোগদাদী বলেন, আমাদের সূফীদের ইলম (হাল ও কাশ্ফ) আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাত দ্বারা আবদ্ধ।…. যে কাশফের স্বপক্ষে কিতাবুল্লাহ্ ও সুন্নাতে রসূল সাক্ষ্য না দেয়, তা কোন বস্তুই নয়।…. সুতরাং ওলীর ইলম কিতাবুল্লাহ্ ও সুন্নাতে রাসূলের বাইরে যাবে না। আর যদি সামান্যও বের হয়ে যায় তবে বুঝতে হবে যে, এটা ইলমও নয়, কাশ্ফও নয়। বরং চিন্তা-ভাবনা করলে দেখা যাবে যে, সেটি নিছক মূর্খতাই।
[মাকালু- উরাফা, পৃ.২৫]

আল্লাহ্ তা‘আলা শয়তানকে এমন ক্ষমা দিয়েছেন, সে কাশফের অধিকারী ব্যক্তিকে গোলক ধাঁধায় পতিত করে। ফলে ঐ কাশফের দাবীদার সেটাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে বলে ধারণা করে। এটার উপর আমল করে নিজে যেমন পথভ্রষ্ট হয় এবং অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করে দেয়। এ জন্য তরিকতের ইমামগণ কাশ্ফ দ্বারা অর্জিত ইলমের উপর আমল করার পূর্বে তা কিতাবুল্লাহ্ ও সুন্নাতে রাসূলের মাপকাঠিতে যাচাই করে নেন। যদি তা কিতাবুল্লাহ্ ও সুন্নাতে রাসূলের অনুরূপ হয় তবে আমলযোগ্য, নতুবা ওটার উপর আমল করা হারাম।

সামা
আল্লাহর প্রেমমূলক সঙ্গীতকে ‘সামা’ বলে অবিহিত করা হয়। ‘হামদ’ (আল্লাহর স্তুতি), না’ত (হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র প্রশস্তি), গযল (আল্লাহ্র প্রেমমূলক গান), মুরশিদী (পীর-মুরশিদের প্রশংসামূলক সঙ্গীত), মারিফাতী (তত্ত্বমূলক গান), আধ্যাত্মিক সঙ্গীত, দেশপ্রেমমূলক সঙ্গীত প্রভৃতিকে ‘সামা’ বা বিশুদ্ধ সঙ্গীতের পর্যায়ভুক্ত করা হয়ে থাকে। উপরিউক্ত সামাসমূহ শুনা মুবাহ্ (বৈধ)। এ ছাড়া পৃথিবীর সর্বপ্রকার গানবাদ্য হারাম। সামা বা আধ্যাত্মিক সঙ্গীত দ্বারা সূফীগণ নিজ অন্তরে আধ্যাত্মিক অনুতূতিকে জাগিয়ে তোলে এবং আল্লাহর ধ্যানে নিবিষ্ট হন। সামা এর শ্রবণকারীকে আধ্যাত্মিক রাজ্যে টেনে নিয়ে যায় এবং মুহূর্তে সাধকের মনে আধ্যাত্মিক ভাব জাগিয়ে তোলে। ‘সামা’ প্রকৃত শ্রবণকারীকে ‘জজবার’ (ভাবন্মোদনা) পর্যায়ে নিয়ে যায়। তাই চিশতীয়া ও মৌলবীয়া তরীকার সূফীগণ কিছু শর্ত সাপেক্ষে ‘সামা’ শ্রবণকে বৈধ বলে মত দিয়েছেন। ইমাম আহমদ রেযা রাহমাহতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিও কিছু শর্তসাপেক্ষে ‘সামা’-এর বৈধতার উপর মত প্রদান করেছেন। তিনি হযরত মাহবুবে ইলাহী নিযামুদ্দীন আউলিয়ার উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন যে, ‘সামা’ বৈধ হওয়ার জন্য নিম্নোক্ত শর্তগুলো অপরিহার্য।
১. যিনি ‘সামা’ বলবেন, তিনি পূর্ণবয়স্ক পুরুষ হতে হবে। মহিলা বা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে হলে চলবে না।
২. ‘সামা’ আল্লাহ-রাসূলের মহব্বত বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে হতে হবে। অর্থাৎ সামা শ্রবণকারী আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল হতে পারবে না।
৩. যা ‘সামা’ হিসেবে আবৃত্তি করা হবে তা মন্দ, অযথা উপহাসমুক্ত হতে হবে।
৪. সামার অনুষ্ঠান বাদ্যযন্ত্র মুক্ত হতে হবে।
উপরিউক্ত শর্তের ভিত্তিতে ‘সামা’ হালাল বলে সাব্যস্ত হবে।’ [মাকালু-ই উরাফা, পৃ.-৩৮]
সুতরাং সূফী-ই কিরামের উদ্ভাবিত ‘সামা- মাহফিল’-এর সাথে আজকের যুগের সামা বা কাউয়ালীর দূরতমও সম্পর্ক নেই। ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বাদ্যযন্ত্র সহকারে, ‘সামা’ বা কাউয়ালী করা সম্পর্কে বলেন,
শুধু কাউয়ালী করা জায়েয আছে। আর বাদ্যযন্ত্র হারাম। এ ব্যাপারে চিশ্তীয়া তরিকতপন্থীদের মধ্যে বেশী বাড়াবাড়ি দেখা যায়। অথচ হযরত সুলতানুল মাশায়েখ মাহবূবে ইলাহী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ‘ফাওয়ায়েদুল ফুয়াদ শরীফে’ বলেছেন, বাদ্যযন্ত্র হারাম। হযরত শরফুল মিল্লাত ওয়াদ দীন ইয়াহিয়া মুনীরী বাদ্যযন্ত্রকে ব্যাভিচারের সাথে তুলনা করেছেন।’ [আহকামে শরীয়ত (বাংলা), পৃ.১৪৮]
আমাদের দেশে ওরসের নামে আজ যেভাবে বাদ্য-বাজনা, নাচ-গান, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা চলছে তা যেমন গর্হিত কাজ তেমনি দ্বীন-ইসলামের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রুপের শামিল।
এ মাসআলার বিষয়ে ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বে-আমল মিথ্যুক সূফীদের স্বরূপ উম্মোচন করতেও দ্বিধা করেন নি। তিনি লিখেছেন-
‘কোন কোন মূর্খ, মন্দ ধরনের মাতালা, আধা মোল্লা, প্রবৃত্তি পূজারী কিংবা ভণ্ড সূফী এ ব্যাপারে তৎপর যে, তারা সহীহ্, মরফূ ও মুহকাম হাদীস শরীফের মোকাবেলায় কোন কোন দুর্বল কিস্সা কিংবা সন্দেহপূর্ণ ঘটনা অথবা অস্পষ্ট অর্থবোধক বিষয়াদি পেশ করে থাকে। তাদের এতটুকু বিবেক নেই কিংবা স্বেচ্ছাই বিবেকহীন সেজে বসে। বস্তুত সহীহর সামনে দুর্বল, সন্দেহমুক্ত-এর সামনে সন্দেহযুক্ত, ‘মুহকাম’-এর সামনে ‘মুতাশাবিহ’ কে পরিহার করা ওয়াজিব। ….আহা! যদি তারা গুনাহকে গুনাহ্ বলে জানতো! স্বীকার করতো! এ হঠকারিতা আরো জঘন্য যে, উচ্চাভিলাষকেও লালন করবে, অপবাদও প্রতিহত করবে! নিজের জন্য হারামকে হালাল বানাবে। শুধু তা নয়, বরং আল্লাহর পানাহ্! এর অপবাদ আল্লাহর মাহবূব বান্দাগণ ও চিশতিয়া তরীকাত শীর্ষস্থানীয় বুযুর্গগণের উপর আরোপ করে; না আল্লাহকে ভয় করে, না বান্দাদের সামনে লজ্জাবোধ করে।…..
অথচ খোদ্ হুযূর মাহবূবে ইলাহীর খলিফা মাওলানা ফখরুদ্দীন যারাভী খোদ হুযূরের নির্দেশে সামা’র মাসআলায় একটি পুস্তক ‘কাশ্ফুল কানা আন উসূলিস্ সামা’ লিখেছেন। তাতে পরিস্কারভাবে লিখেছেন- ‘আমাদের মাশাই-ই কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম-এর সামা ওই বাদ্যযন্ত্রের অপবাদ থেকে পবিত্র। তাতো নিছক কাওয়ালের আওয়াজ মাত্র ওইসব শ্লোক সহকারে সেগুলো আল্লাহর শিল্পকর্ম সম্পর্কে খবর দেয়।’
আল্লাহর ওয়াস্তে ইনসাফ করুন! খান্দানে চিশতীয়ার ওই মহান ইমামের এ এরশাদ গ্রহণযোগ্য হবে, না আজ-কালকার ওই সবলোকের ভিত্তিহীন অপবাদ ও প্রকাশ্য ফ্যাসাদ।’ [আহকামে শরীয়ত ১মখণ্ড, পৃ.৬১]

নির্জনবাস
জীবনবিচ্ছিন্ন, সংসারত্যাগী সন্ন্যাস জীবন, প্রায়শই নির্জনস্থানে জীবনবর্জিত হয়ে ধ্যানমগ্ন হওয়াকে অনেকেই ‘তাসাউফ বা তরিকতচর্চা’ বলে। এরূপ তরিকতচর্চা ইসলাম অনুমোদন করে না। ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিও ওই তাসাউফ চর্চার ঘোর বিরোধী। মানবজীবনের সার্থক ও পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনে পার্থিব- অপার্থিব, দৈহিক ও আধ্যাত্মিক উভয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। তাই তাঁর মতে, দীনের প্রচারকার্য ছেড়ে দিয়ে নির্জনে আধ্যাত্ম-সাধনা আলেমদের জন্য অনুচিত নিঃস্বার্থে, সৎ নিয়্যাতে দ্বীনের প্রচার-প্রসারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করে যাওয়া হচ্ছে- সবচেয়ে বড় মুজাহিদা। এ প্রসঙ্গে তিনি ইমাম আবূ ইসহাক ইসফেরানী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলাহি’র ঘটনা উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘ইমাম আবূ ইসহাক যখন দেখলেন তাঁর দেশে বাতিলপন্থীরা মানুষের মাঝে বিদআতের বিষপাষ্প ছড়াচ্ছে, আর অন্যদিন ওই যুগের বিশিষ্ট আলিমগণ সংসার ত্যাগ করে নির্জনে ইবাদত-বন্দিগীতে মশগুল। তিনি তাদেরকে গিয়ে বললেন,  হে শুষ্ক তৃণভোজীগণ! তোমরা এখানে নির্জনে ইবাদতে ব্যস্ত আর অন্যদিকে উম্মতে মুহাম্মাদী (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) ফিতনায় নিমজ্জিত।’
তারা জবাবে বললেন, হে ইমাম! ওটা আপনারই দায়িত্ব। আমাদের দ্বারা তা হবে না। তখন তিনি তাদের থেকে ফিরে এসে বিদআতীর মোকাবেলায় আত্মনিয়োগ করলেন।’ [মালফূয, ১মখণ্ড, পৃ. ৮] ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র মতে তাঁর এ প্রচেষ্টা লক্ষ নির্জন সাধনা থেকে উত্তম।
সুতরাং তরিকত (তাসাউফ) সম্পর্কিত ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র চিন্তা-চেতনা সম্পূর্ণ শরিয়তের অনুবর্তনকারী এবং শরিয়তের হেফাজতকারী। শরিয়তের বিরোধী কোন কথা-বার্তা ও আমল তাঁর থেকে কল্পনাই করা যায় না। তাই সুন্নী উলামা, পীর-মাশায়েখ, বক্তাদের উচিত তরিকত সম্পর্কিত ’আলা হযরত ইমাম আহমদ রেযার চিন্তা-চেতনা এবং শিক্ষাকে সমাজের সর্বস্তরে ছাড়িয়ে দেওয়া। তরিকতের নামে শরিয়তকে উপেক্ষা করে যারা সুন্নীয়তের অঙ্গনকে কলুষিত করছে, জনসম্মুখে তাদের স্বরূপ উন্মোচন করা আজ সময়ের দাবি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সুন্নী দাবীদার কিছু আলেম, পীর ও ওয়ায়েজ সত্যকে পাশ কাটিয়ে অসত্যের পক্ষে সাফাই গেয়ে যাচ্ছেন। তাই সত্যপন্থীদের উচিত, সাহকিতার সাথে তরিকতের নামে সৃষ্ট যাবতীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। শরিয়ত ও তরিকতের সঠিক স্বরূপ তুলে ধরা। এ ক্ষেত্রে ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র জীবন ও তাঁর রচনাবলী আমাদের সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে সক্ষম। আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদেরকে সরল-সঠিক পথের দিশা দান করুক। আমিন!

সহায়ক পুস্তক: ইমাম আহমদ রেযা : 

মাকালু উরাফা বি-ইযাযি শরঈ ওয়া উলামা, (উর্দু) রেযা একাডেমী, মুম্বাই, ভারত, ১৪১৮ হিজরী।
বায়আত ও খিলাফতের বিধান, (অনুবাদ, মুহাম্মদ নেজাম উদ্দীন,) সনজরী পাবলিকেশন, চট্টগ্রাম, ২০১০।
আহকামে শরীযত (মাওলানা মুহাম্মদ ইছমাইল অনূদিত) লিলি প্রকাশনা, চট্টগ্রাম, ২০১০।
ফাতাওয়া-ই আফ্রিকা (মাওলানা ইসমাইল অনূদিত) চট্টগ্রাম-২০০৭।
মোস্তফা রেযা খাঁন :আল্ মালফুয (মালফুযাত-ই আ’লা হযরত) মাকতাবা-ই কাদিরীয়াহ্: ইউপি, ভারত, ২০০৫।
আব্দুল মুবীন নূ’মানী : ইরশাদাত-ই ’আলা হযরত (মাওলানা আব্দুল মান্নান অনূদিত) আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট, চট্টগ্রাম, ২০০৮।
ফকীর আবদুর রশীদ :সূফীদর্শন, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন, ঢাকা, ১৯৮০।
মোল্লা আলী ক্বারী :মিরকাতুল মাফাতীহ্, (২য় খণ্ড)
মাকতাবা-ই এমদাদীয়া, মূলতান, পাকিস্তান।
আবদুর রহমান চিশতী :মিরআতুল আসরার, আদবী দুনিয়া, মাটিয়া মহল, দিল্লী, ২০০৫।
মুহাম্মদ নেজাম উদ্দীন:ইমাম আহমদ রেযা’র সংস্কর ও চিন্তাধারা, ইমাম আহমদ রেযা কমপ্লেক্স, ভৈরব, ২০১০।
কামরুল হাসান বসতভী মিসহাবী:আফকার-ই রেযা : রেযভী কিতাব ঘর, দিল্লী, ১৯৯২।
বদরুদ্দীন আহমদ কাদেরী:সাওয়ানিহ-ই আ’লা হযরত কাদিরী মিশন, বেরেলী, ১৯৯৭।