আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা : তাঁর সমাজ সংস্কারের নানা পর্ব -মুহাম্মদ নেজাম উদ্দীন

আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা : তাঁর সমাজ সংস্কারের নানা পর্ব -মুহাম্মদ নেজাম উদ্দীন

লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা : তাঁর সমাজ সংস্কারের নানা পর্ব
মুহাম্মদ নেজাম উদ্দীন

===========

বর্তমান ফিত্না-ফ্যাসাদের যুগে আ’লা হযরত ইমামে আহমদ রেযা বেরলভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি -এর চিন্তা-চেতনা ও দর্শন আপন-পর সকলের নিকট এতই সুষ্পষ্ট যে, যা আলোচনা-পর্যালোচনার অবকাশ রাখে না। পক্ষপাতহীন সততা ও ন্যায়পরায়ণতার সাথে সাল্ফে সালেহীন বা পূর্বসূরিদের আক্বীদাহ ও মতবাদ অধ্যয়নকারী এটা স্বীকার না করে পারবে না যে, আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি অতীত ও বর্তমানের মধ্যে একজন বড় সংযোগকারী হিসেবে স্বীয় যুগে আবির্ভূত হয়েছেন এবং আপন খোদাপ্রদত্ত জ্ঞান এবং কলমযুদ্ধের দ্বারা তিনি ধর্মদ্রোহীতা ও ধর্মবিমুখতার সকল শক্তি ও সব ধরনের প্রচেষ্টাকে ধুলিসাৎ করে দেন। আর চিহ্নিত করেছেন ওই সব অপশক্তিকে যারা আমাদের চিন্তা-বোধ, বিশ্বাস ও কাজ-কর্মের সম্পর্ককে আমাদের পবিত্র অতীত থেকে ছিন্ন করতে চেয়েছিলো।

বস্তুত এটা সংস্কার ও সংশোধনের এক মহান পদবী, যে মর্যাদায় একজন মুজাদ্দিদ (সংস্কারক) অধিষ্ঠিত হন। তিনি কোন নতুন মযহাব বা মতবাদের ভিত্তি স্থাপন করেননি বরং ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শকে যুগের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সঠিক ও সংশোধনের মাধ্যমে লোকদের সামনে পেশ করেন, যা পুরুষানুক্রমভাবে আমাদের পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। তিনি অতীত বুযর্গদের চিন্তা-দর্শন থেকে সরে গিয়ে নতুন মতাদর্শ প্রতিষ্ঠিত করে অতীত থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করেন নি বরং অতীতের শরীয়তসম্মত প্রতিটি কর্মপন্থাকে গ্রহণ করে যুগের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে নতুনভাবে সমাধান দেন। তিনি বলেন ‘আমরা পূর্বসূরি বুযর্গদের উত্তরাধিকারী। তাই অতীত বুযর্গদের নিকট যা কিছু আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি, এর সবই গ্রহণ করতে হবে। যদি কিছু গ্রহণ আর কিছু বর্জন করার নীতি অবলম্বন করি, তবে এমন সময়ও আসবে যখন সব বর্জন করে বসবো, তারপরও নিজেকে মুসলমান বলে মনে রাখবো। তাছাড়া কোন কিছুকে ছোট মনে করাও অনুচিত। বরং এটা চিন্তা করা উচিত যে, এটাও আমাদের পূর্ববর্তী বুযর্গদের থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। কারণ, যে আজ ছোট কিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে, হয়তো সে পরে অতীতের বড় কিছু নিয়ে বাড়াবাড়িতে মেতে উঠবে। তাই কুরআনে নিয়ামত-প্রাপ্তদের অর্থাৎ নবী, ছিদ্দিক্ব ও সালেহীনদের অনুসরণ করতে বলা হচ্ছে। এতদ্ব্যতীত সমস্ত পথই ভ্রান্ত।’ এজন্য আপনি যখনই আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা বেরলভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি-এর যে কোন রচনা হাতে নেবেন, এক সংস্কারধর্মী চিন্তা চেতনা তাঁর প্রতিটি রচনায় ভেসে উঠবে। তিনি যে কোন বিষয়েই কলম ধরেছেন উহার ধারাবাহিক বিন্যাস এভাবে যে, প্রথমে কুরআনের উদ্ধৃতি, পরে হাদীসের, অতঃপর সাহাবী, তাবেঈ ও তাবে-তাবেঈন, আইম্মায়ে মুজতাহীদিন এবং উম্মতে মুহাম্মদীর প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের অভিমত ব্যক্ত করতেন। তাঁর রচনার এ ধারা-বিবরণী থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, শরীয়ত প্রবর্তকের উদ্দেশ্য জানার জন্য অতীতের প্রতিটি স্তরের নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিবর্গের সাথে সম্পৃক্ততা একান্ত প্রয়োজন। যদি তাদের সাথে সম্পৃক্ততার কোথাও ত্র“টি দেখা দেয় তবে ঈমান ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সমূহ বিপদের আশংকা থাকতে পারে। বাস্তবতার আলোকে যদি আপনি ধর্মীয় বিষয়াদির ক্ষেত্রে মতপার্থক্যের কারণ পর্যালোচনা করেন, তবে দেখবেন যে, যারা একদিন অতীত বুযর্গদের মতাদর্শ থেকে সরে দাঁড়ায়, কিছুদিন পর তারা ‘তাক্বলীদ’ করাকে এ বলে উড়িয়ে দেয় যে, তারাও তো আমাদের মতো সাধারণ উম্মত। দ্বীনের বিধি-বিধানে তাদের চিন্তাপ্রসূত ইজতিহাদে বিশ্বাস ও অনুসরণ করা কী প্রয়োজন রাখে? আমাদেরও তো আল্লাহ চিন্তা-গবেষণার শক্তি দিয়েছে। আমরা সরাসরি হাদীস থেকে মাসআলা উদ্ভাবন করবো। হাদীসই আমাদের জন্য যথেষ্ট। ইমাম- মুজতাহিদদের অভিমত মানার প্রয়োজন নেই। তাঁদের মতামত ভুল-ত্র“টিতে পরিপূর্ণ।

এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর এ দল থেকে দ্বিতীয় অন্য একটি দলের জন্ম হলো। তারা বলতে আরম্ভ করলো যে, প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ্ বিধানদাতা। নবীগণ বাহকমাত্র। দ্বীন সম্পর্কে আল্লাহর যাবতীয় পথনির্দেশনা কুরআনের মাধ্যমে আমাদের সম্মুখে উপস্থিত আছে। কুরআন আমাদের জন্য যথেষ্ট। হাদীসের প্রয়োজন নেই। হাদীস নানা ভুল-ত্র“টিতে পরিপূর্ণ। মুসলমানদের চিন্তা-চেতনার পতন এবং বিভেদ সৃষ্টির একমাত্র মাধ্যম হাদীস। এভাবে ‘‘বুযর্গদের রসম’’ বলে যারা ইসলামের ছোট ছোট বিষয়গুলোকেও অস্বীকার করে বসলো, দেখা গেলো তারা একদিন ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকেও অস্বীকার করে বসলো। এসব নব্য ফিত্নাগুলোকে যদি প্রথমেই মাটিতে দাফন করে দেয়া যেতো, তবে আজকে আমাদেরকে এ দুর্দিনের সম্মুখীন হতে হতো না।

কিন্তু বড় পরিতাপের বিষয়, যারা ইসলামের মধ্যে নতুন ফিত্নার জন্ম দিয়েছে, তাদেরকে আজ দ্বীনের রক্ষক বলে মনে করা হচ্ছে, আর যাঁরা আপন রক্ত দিয়ে ঈমান-ইসলামের ভিত্তিক মজবুত করেছেন, তাদের খিদমতের কোন স্বীকৃতি নেই। ইতিহাসে তাঁদের ব্যাপারে নীরব।

সত্যানুসন্ধানীদেরকে বলতে চাই যে, ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি-এর সংস্কার ও মতাদর্শকে জানার জন্য যেমন তাঁর সমকালীন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অবস্থা জানা প্রয়োজন, তেমনি তাঁর চিন্তা-চেতনা ও চারিত্রিক দৃঢ়তাকে সামনে রাখা প্রয়োজন। আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা আপন সময়ে ‘দেওবন্দী জমাআ’ত নামে এক পথভ্রষ্ট দলের মুখোমুখি হতে হয়েছিলো, যারা একদিকে নিজেদেরকে ‘হানাফী’ও বলতো, আর অন্যদিকে ইবনে আব্দুল ওহাব নজদী ও মৌলভী ইসমাঈল দেহলভীসহ সকল আইম্মায়ে ইলহাদ ও ফিত্নাবাজ ইমামদেরও পতাকাবাহী ছিলো। এ দুযোর্গপূর্ণ মুহূর্তে আ’লা হযরত রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি সংস্কার ও সংশোধনের কাজ আরম্ভ করেন। রুশদ ও হিদায়তের প্রদীপ জ্বালালেন। কলমের তরবারী হাতে নিয়ে একাই উঠলেন। আর আরব-আজমের সর্বত্রে আহলে সুন্নাতের সত্যতা ও সঠিকতাকে তুলে ধরলেন। মু’মিনদের অন্তরে হুযুর সৈয়্যদে আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ভালবাসা, সালফে- সালেহীনদের ভক্তি-শ্রদ্ধা ও পবিত্র শরীয়তের প্রতি আনুগত্যের অনুপ্রেরণা এমনভাবে জাগ্রত করে তুললেন যে, ঈমানদারদের জীবনধারার গতি সম্পূর্ণ বদলে যায়।

তেমনিভাবে হিন্দুস্থানে ওই সময় আরো এমন ভ্রান্ত দল- উপদল ছিলো, যাদের দ্বারা উপমহাদেশের হাজার বছরের ধর্মীয় ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি হয়। আর আ’লা হযরত ওইসব ভ্রান্ত দল-উপদলেরও মুখোশ উন্মোচন করে ধর্মের সঠিক রূপরেখা মুসলমানদের সামনে তুলে ধরেন। বিশেষত ওহাবী ফিতনার স্বরূপ তুলে ধরে আ’লা হযরত উপমহাদেশের মুসলমানদেরকে এক বড় ফিতনায় পতিত হওয়া থেকে রক্ষা করেন। এদের প্রতি তাঁর বিশেষ সতর্ক দৃষ্টি এজন্য ছিলো যে, এ ফিতনাবাজরা নিজেদেরকে ‘হানাফী’ বলে হানাফী মুসলমানদেরকে বিভ্রান্তি করার প্রতারণায় লিপ্ত হয়েছিলো। এবং তাদের ভ্রান্ত-মতাদর্শকে হানাফী মতবাদ বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিলো। অথচ হানাফী মাযহাবের সাথে তাদের মনগড়া মতবাদের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক ছিলো না। এ অবস্থায় আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এ বিপদের আশংকা করেছিলেন যে, যদি সুষ্পষ্ট ও মজবুত দলীল সহকারে এ প্রতারকদের মুখোশ উন্মোচন করা না হয়, তবে উপমহাদেশে হানাফী-মতবাদ দারুন ভ্রষ্টতার শিকার হবে। এ জন্য তিনি প্রতিটি আক্বীদাহ্ ও স্বভাবজাত মাসয়ালাসমূহকে কুরআন, হাদীস, ইমামদের মতামত এবং হানাফী মাযহাবের কিতাবসমূহ থেকে দলীল ও প্রমাণ্যের সমাবেশ করে ‘হানাফী মতবাদ’ এবং ওহাবী মতবাদের মধ্যে ভেদ রেখা টেনে দেন। এজন্য অনেক দেওবন্দী তাঁর বিরুদ্ধে এ অপপ্রচারে লেগে আছে যে, ইমাম আহমদ রেযা ধর্মে বিদ্আতের বিষ ছড়িয়েছেন। অথচ আমরা যখনই ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি-এর গবেষণা ধর্মীয় গ্রন্থ অধ্যয়ন করি তখন তাঁকে আক্বীদাহ ও ধ্যান-ধারণা ইত্যাদিতে পূর্ববর্তী ওলামায়ে কেরাম ও সালফে- সালেহীনদের প্রকৃত অনুসারী হিসেবে পাই। তিনি তাঁর সময়কালে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অঙ্গনে সংস্কার ও পুনরুজ্জীবনে স্বীয় দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছিলেন। খুব সম্ভব, এজন্য অধিকাংশ আরববাসী ওলামায়ে কেরাম তাঁকে ‘মুজাদ্দিদ’ (ধর্মীয় সংস্কারক) খেতাবে ভূষিত করেছেন। অধিকন্তু হাফেযে কুতুবুল হেরম সৈয়্যদ ইসমাইল খলীল মক্কী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা সম্পর্কে মন্তব্য করতে বলেছেন

‘‘যদি তাঁর (আহমদ রেযা) সম্পর্কে বলা হয় যে, তিনি এ শতাব্দীর একজন ‘মুজাদ্দিদ’ (সংস্কারক) তবে একথা সত্য ও সঠিক হবে।’’[ইমাম আহমদ রেযা ঃ ‘হুসামুল হেরমাঈন (লাহোর) ১৯৭৫, পৃষ্ঠা ৫১] ধর্মীয় চিন্তা-চেতনায় তাঁর সংস্কার ও সংশোধনকে আমরা- চারটি পর্বে ভাগ করতে পারি। যেমন-

প্রথম পর্ব
সুন্নী-হানাফী মুসলমানদের ওই সমস্ত আক্বীদাহ্ ও আমল যেগুলোকে দেওবন্দীরা শিরক্ ও হারাম বলে থাকে আ’লা হযরত রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি কুরআন, হাদীস, ফিক্বহী হানাফী ও সালফে-সালেহীনদের কিতাব থেকে উদ্ধৃতি ও প্রমাণ পেশ করে এটা সাব্যস্ত করেছেন যে, ওইসব আমল ও আক্বীদা শিরক, হারাম কিছুই নয়, বরং কুরআন, হাদীস সম্মত ও সালফে-সালেহীনদের নিকট পছন্দনীয়। এসব নতুন সৃষ্ট নয়; বরং ইসলামে অতীত থেকে আমাদের পূর্বসূরীরা এসব কাজ করে আসছেন। এ পর্বে অন্তর্ভুক্ত মাসআলাগুলো হলো এ যে, বৃদ্ধাঙ্গুলি চুম্বন, এয়া রাসূলুল্লাহ্ বলে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে আহবান করা, শাফায়াত, ওসীলা তলব, ইলমে গায়ব, হায়াতুন্নবী, মীলাদ কিয়াম, ওরস ফাতিহা ইত্যাদি বিষয়গুলো।

দ্বিতীয় পর্ব
দেওবন্দীদের ওইসব আক্বীদা, যা তারা লেখনি ও বক্তৃতার মাধ্যমে মুসলিম সমাজে দীর্ঘদিন দিন ধরে প্রচার করে আসছে। তারা এসব ভ্রান্ত-বিশ্বাসকে কুরআন-হাদীসের মত বলে সরলপ্রাণ মুসলমানদেরকে ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে। আ’লা হযরত রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি মুসলিম জাতিকে তাদের এ ঈমানবিধ্বংসী মতবাদ থেকে সতর্ক করেন এবং তাদের ভ্রান্ত-আক্বীদার অপনোদনে গ্রন্থ রচনা করেন। তাদের ওই সব আক্বীদা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং ঈমান ও ইসলামের জন্য ধ্বংসাত্মক বলে রায় দেন। এসব ভ্রান্ত- আক্বীদাসমূহের মধ্যে কতিপয় লক্ষ্য করুন।
১.উম্মত আমলের ক্ষেত্রে কখনো নবীদের অতিক্রম করে যায় [তাহযীরুন নাস] ২. নবীদেরকে নিষ্পাপ মনে করা ভুল।
৩. নামাযে হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর খেয়াল করা শিরক আর গাধা ও গরুর খেয়ালে ডুবে যাওয়ার চেয়ে মারাত্মক। নামাযে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র স্মরণ আসলে নামাযী মুশরিক হয়ে যায়, আর তার নামায বাতিল হয়ে যায়। [সিরাতুল মুস্তকামী] ৪. আল্লাহর জন্য মিথ্যা বলা সম্ভব। [বারাহীনে কা’তীয়া] ৫. ‘রাহমাতুললীল আলামীন’ হওয়া হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে নির্দিষ্ট নয়। উম্মতও রাহমাতুললীল আলামীন হতে পারে। [ফাতাওয়া-ই রশীদিয়া] ৬. হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাদের বড় ভাই, আমরা তাঁর ছোট ভাই [তাকবীয়াতুল ঈমান] এ সবের মতো আরো অনেক কুফরী উক্তি এ দেওবন্দী- ওহাবীদের লেখনির মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। আ’লা হযরত রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাদের ওই সব কুফরী উক্তির দাঁতভাঙ্গা জবাব দেন এবং মুসলিম উম্মাহর হাজার বছরের লালিত আক্বীদা-বিশ্বাসকে বাতিলদের ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা করে সবাইকে একতার বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস পান।

তৃতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্বে দেওবন্দী নেতাদের ওই সব উক্তি, যাতে তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র পবিত্র শানে বেয়াদবীপূর্ণ উক্তি করেছে এবং দ্বীনের মৌলিক ও আবশ্যকীয় বিষয়গুলোর অস্বীকার করে দ্বীন থেকে স্বয়ং নিজেরাই আপন সম্পর্কে ছিন্ন করে নিয়েছে। আ’লা হযরত রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ওই সমস্ত মানহানিকর উক্তি করা থেকে বিরত থাকতে এবং পুনরায় তাওবা করে ফিরে আসতে তাদেরকে আবেদন জানান। কিন্তু সত্যের সামনে মাথানত করতে এসব হতভাগারা লজ্জাবোধ মনে করলো পর্থিব সম্মানকে পরকালের উপর প্রাধান্য দিলো। এসব মানহানিকর উক্তির মধ্যে কপিতয় দৃষ্টান্ত অবলোকন করুন।

১. দেওবন্দী মাযহাবের নেতা মৌলভী আশরাফ আলী থানভী আপন কিতাব ‘হিফযুল ঈমান’-এ রসূল করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর জ্ঞানকে জীব-জন্তুর সাথে তুলনা করে শানে রেসালতের উপর সুষ্পষ্ট মানহানি করা।

২. মৌলভী খলীল আহমদ আম্বেটবী কৃত বারাহীনে কাতীয়া’র ‘‘পৃথিবী সম্পর্কে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র জ্ঞান, শয়তানের জ্ঞান থেকে কম; এমনকি শয়তানের জ্ঞানের ব্যাপকতা দলীল দ্বারা সাব্যস্ত, কিন্তু হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র জ্ঞানের ব্যাপকতার উপর কোন দলীল বা প্রমাণ নেই’’ বলে মন্তব্য করা।

৩. দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মৌলভী কাসেম নানুতুবী কৃত ‘তাহযীরুন নাসে’ হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ‘শেষ নবী’ বলে অস্বীকার করা। অথচ প্রিয়নবীকে ‘শেষ নবী’ বলে বিশ্বাস করা দ্বীনের মৌলিক বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম। এ অস্বীকৃতির কারণে বর্তমান ওহাবীদের মতে তিনিও কাদেয়ানীদের মতো কাফের হওয়াই যুক্তিযুক্ত। উপরোক্ত গোমরাহী ও বিভ্রান্তির প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি স্বীয় জীবনকে উৎসর্গ করেছেন এবং অনেক গ্রন্থ ও পুস্তিকা রচনা করেছেন। প্রদান করে সময়োচিত বক্তব্য বিবৃতি। দেওবন্দী ওহাবীদের উক্ত সব ভ্রান্ত উক্তি ও মতবাদের খণ্ডনে তাঁর নিম্নোক্ত গ্রন্থ ও পুস্তিকাবলী উল্লেখের দাবি রাখে। যথা-

চতুর্থ পব
চতুর্থ পর্যায়ে আ’লা হযরত রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি মুসলিম সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার ও খারাপ রসম-রেওয়াজের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। প্রকৃত ধর্মীয় জ্ঞানের অভাবে মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবন ও সমাজ-সংস্কৃতিতে যেমন বিবাহ, ওরস, ফাতিহা এবং আল্লাহর পুণ্যাত্মা-বান্দাদের কবরে তাওয়াফ, সাজদা, ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে শরীয়তবিরোধী কার্যকলাপ ঢুকে পড়ে। আ’লা হযরত রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ওইসব শরীয়তবিরোধী কার্যকলাপ ও কুসংস্কারের কঠোর বিরোধীতা করেন এবং আপামর মুসলমানদেরকে এসব কাজ থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকার শিক্ষা দেন। তাঁর এ সংস্কার পদ্ধতি দেখে যারা তাঁকে বিদ্আতী বলে জানে তারাও একথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, প্রকৃত পক্ষে আ’লা হযরত ছিলেন অন্যতম প্রকৃত সংস্কারক। সমাজ ও সংস্কৃতি অঙ্গনে তাঁর সংস্কারধর্মী কর্মকাণ্ডের কিছু চিত্র নিম্নে তুলে ধরার প্রয়াস রাখি, যাতে যারা না জেনে তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনা করেন তাঁদের বোধোদয় হয়।

১. শরীয়ত ও তরীক্বত
কিছু লোক এমনও দেখা যায়, যারা শরীয়ত ও তরীক্বতকে দু’টি পৃথক পথ ও মতে বিভক্ত করে থাকে। আ’লা হযরত রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এ বিভাজনকে কঠোরভাবে অস্বীকার করেছেন। আর শরীয়তই যে সব কিছুর মূল এ কথার প্রতি জোর দিতে গিয়ে বলেন-

‘‘শরীয়ত হলো মূল আর তরীক্বত হলো শাখা, শরীয়ত হলো ঝর্ণার উৎসস্থল আর তরীক্বত হলো এ থেকে সৃষ্ট দরিয়া। শরীয়ত থেকে তরীক্বতকে আলাদা করা অসম্ভব এবং সুকঠিন। শরীয়তের উপরই তরীক্বত নির্ভরশীল। শরীয়ত সব কিছুরই মূল ও মাপকাঠি। শরীয়ত এমন এক রাস্তা যা আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয়। এ ছাড়া একে বাদ দিয়ে মানুষ যে পথ অবলম্বন করে তা আল্লাহর পথ থেকে যোজন দূর। আর তরীক্বত হলো ওই পথের উজ্জ্বল অংশ। শরীয়ত ভিন্ন এ চলাটা অবৈজ্ঞানিক ও অসম্ভব। আর শরীয়তের অনুসরণ ব্যতীত সমস্ত পথ প্রকৃতার্থে রহিত ও নষ্ট।’’ [ইমাম আহমদ রেযা ঃ ‘মক্বালুল উরাফা, (করাচী) পৃষ্ঠা ৮-৯]

ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি অল্প কটি কথাতেই আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, যে কেউ তরীক্বতকে শরীয়ত থেকে আলাদ মনে করবে, সে পথ-ভ্রষ্টতার মধ্যেই নিমজ্জিত রয়েছে। তিনি আরো বলেন, ‘‘তরীক্বতের মধ্যে যা কিছু রহস্য লুকায়িত আছে, তা শরীয়তের ইত্তেবায়ের (অনুসরণের) কারণে। না হয় শরীয়তের অনুসরণ ছাড়া বড় বড় কাশ্ফ পাদ্রী, যোগী, সন্ন্যাসীরও অর্জিত। আর তা তাকে কোথায় পৌঁছায়? প্রকৃতপক্ষে তাকে তা জাহান্নামের আগুন এবং কঠিনতম শাস্তির উপযুক্ত কের দেয়।’’[প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৯]

ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি সকল বাতেনী রিপুকে চিহ্নিত করে মু’মিনের কামিয়াবীর লক্ষ্যে। তাদের জীবনে বিপ্লব সাধিত করার আহবান জানিয়ে বলেন, ‘‘অন্তর আর দেহের উপর আল্লাহর যতোগুলো হুকুম আছে সবগুলো মেনে চলুন। না কেউ কবীরা গুনাহ্ সংঘটিত করে বসবে আর না কেউ সগীরা গুনাহ্ ইছরার (বারবার) করবে। নাফসের খারাপ ধারণা ও অভ্যাস যদি দূরীভূত না হয়, তাহলে এর উপর শক্তি প্রয়োগ করবে। উদাহরণস্বরূপ-কারো অন্তরে যদি কৃপণতা থাকে, তাহলে নাফসের উপর জবরদস্তি করে হাতকে (সকলের তরে) প্রসারিত ও উন্মুক্ত রাখবেন। কারো প্রতি হিংসার ভাব উদয় হলে ঐ ব্যক্তির অমঙ্গল যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। (এর উপর ভিত্তি করে সবকিছু করবে)। এটা জিহাদে আকবর -সর্বশ্রেষ্ঠ বড় জিহাদ। আর এজন্যে পরকালে পাকড়াও নেই, আছে মহা পুরস্কার। [‘বায়আ’ত ও খিলাফত, পৃষ্ঠা-৪৯]

২. দ্বীনের অত্যাবশ্যকীয় বিষয় পালনের প্রতি গুরুত্বারোপ
মুসলিম সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নাতে (যা অবশ্যই পালনীয়) বিষয়গুলোকে পরিহার করে কতিপয় মুস্তাহাব ও মুবাহ্ পালনে ব্যতিগ্রস্ত। ইমাম আহমদ রেযা’র দৃষ্টিতে এ আচরণ ইসলামী শরীয়তের সাথে উপহাসের নামান্তর এবং এসব আমলের দ্বারা পুণ্যের (সাওয়াবের) আশা করা বোকামী বৈ কি? শরীয়তের দৃষ্টিতে এসব আমল গুরুত্বহীন। এতদ্ বিষয়ে তিনি হযরত গাউসে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু-এর ‘ফতুহুল গায়ব’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি পেশ করে এক স্থানে লিখেছেন যে,  অর্থাৎ ‘‘যদি শরীয়তের ফরয কার্যাদি আদায়ের পূর্বে সুন্নাত, নফল পালনে ব্যস্ত হয়, তবে ওই সুন্নাত ও নফল কবুল হয় না বরং তিরস্কারের উপযোগী হয়।’’ [ইমাম আহমদ রেযা ঃ (বেরলবী) পৃষ্ঠা-১০]

৩. তাজিমী সাজদ¡ (সম্মানার্থে কাউকে সাজদা করা) প্রসঙ্গে
বাংলাদেশসহ সারা ভারত উপমহাদেশেই অজ্ঞতার দরুণ একজন আরেকজনের মাথায় কপাল ঠেকায়, আবার অনেককে বিভিন্ন ওলী-আউলিয়ার কবরে সাজদা দিতেও দেখা যায়। এ কাজটা কত বড় জঘন্য গুনাহ্, আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ‘আযযুবদাতুয যাকীয়্যাহ্ তাহরীমে সুজুদুত তাহীয়্যাহ’ লিখে গোমরাহীর তীরে দাঁড়ানো মানুষের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, সাজদা দুপ্রকার

১. তাআববুদীঃ আল্লাহ ছাড়া কোন ব্যক্তিকে ইলাহ বা ইলাহর অংশ বা বন্ধু ইত্যাদি মনে করে ইবাদতের নিয়তে যদি সাজদা করাকে সাজদায়ে তা‘আব্বুদী বলে।
২. তাহিয়্যাঃ কোন ব্যক্তি বা বস্তুকে আল্লাহর বন্ধু ও নৈকট্যপ্রাপ্ত মনে করে তার সম্মানার্থেই (ইবাদতের উদ্দেশ্যে নয়) সাজদা করাকে সাজদায়ে তাহিয়্যা বা তা’জীমী বলা হয়।
‘সাজদায়ে তাআব্বুদী’ সর্বসম্মতভাবেই শিরক ও কুফর। এ ব্যাপারে সকল মায্হাবের ফক্বীহগণ একমত। তবে সাজদায়ে তা’জীমীর ব্যাপারে অধিকাংশ ফক্বীহগণের মত হলো, তা’জিমী সাজদা সম্পূর্ণভাবে হারাম। কতেকের মতো তা মাকরূহ। আবার কেউ কেউ বলেছেন মুবাহ্। শেষোক্ত দলের ফক্বীহগণ হাতে গোনা যায়। তবে ফতোয়া ও আমল হল প্রথমোক্ত ফক্বীহদের মতের উপর। আর আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি প্রথমোক্ত দলেই রয়েছেন। কুরআন, হাদীস, ইজমা, কিয়াস ছাড়াও যুক্তি বিজ্ঞান দিয়ে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও বিজ্ঞানময়ভাবে সাজদায়ে তাহিয়্যার উপর উক্ত গ্রন্থটি রচনা করেন। এতে তিনি বলেন, ‘‘হে মুসলমান! ওহে প্রিয় মুসলিম সমাজ! হে মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শরীয়তের অনুসারী! (আল্লাহ ও রাসূলের) ফরমান জেনে রেখো! মনে প্রাণে একীন করো হযরত ইয্যত জাল্লা জালালুহু আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া কারো জন্যে ইবাদতের নিয়্যতে সাজদা করা নিশ্চিত ও সর্বসম্মতভাবে কঠিনতম শিরক এবং প্রকাশ্য কুফরী। আর সাজদায়ে তাহিয়্যা (কারো সম্মানার্থে সাজ্দা করা) হারাম, নিশ্চিতভাবে গুনাহে কবীরা আর তা কুফরী হওয়ার মধ্যে ওলামা (ফক্বীহ) দের মধ্যে মতভেদ আছে। একদল ফক্বীহর মতে তাও কুফরী….।’’ [ইমাম আহমদ রেযাঃ ‘আল যুবদাতুয যাকীয়াহ’ (বেরেলী) পৃষ্ঠা-৫]

রুকুর ন্যায় নত হওয়া 
অনেকে দেখা যায়, কোন কবর ইত্যাদির সামনে এমনভাবে ঝুঁকে পড়ে যেমনটি রুকূতে করা হয়। এ সম্পর্কে ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন, ‘‘মাযারসমূহকে সাজদা এবং এর সামনে জমীনকে চুমো দেয়া হারাম। আর রুকু পর্যন্ত ঝুঁকে পড়া মামনু (নিষিদ্ধ)।’’
তিনি বলেন, ‘‘যিয়ারতের সময় না দেওয়ালে হাত লাগাবে, না চুমো দেবে, না একে জড়িয়ে ধরবে, না এর তাওয়াফ করবে। আর না মাটি চুম্বন করবে। এসব বিদ’আতে কবীহা বা গর্হিত বিদআত।’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘শরহে লুবারের মধ্যে আছে, মাযারকে সাজদা করা তো অকাট্যভাবে হারাম। তাই অজ্ঞমূর্খ যায়েরীনদের কাজ দেখে প্রতারিত হবেন না, বরং আমলসম্পন্ন আলেমদের অনুসরণ করবেন।’’
ফিক্বাহর উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘মাযারকে সাজদা করা থেকে দূরে থাক, কোন কবরের সামনে আল্লাহ তা‘আলাকে সাজদা করাও জায়েয নেই। যদিও তা ক্বিবলার দিকে হয়।’’ কবরস্থানে কোন জায়গা যদি নামাযের জন্য প্রস্তুত করা হয়, আর সেখানে যদি কোন কবর কিংবা নাজাসাতও না থাকে, আর ক্বিবলার দিকে যদি কবর হয়, তবে তখনও নামায মাকরুহ।

তাওয়াফ করা ও কবরে চুমো দেয়া প্রসঙ্গে
তাওয়াফ এবং কবরে চুমো দেয়া সম্পর্কে আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খাঁন রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন, ‘‘তাজীমের নিয়তে মাযারের তাওয়াফ নাজায়িয্। কেননা ঘরসমূহের মধ্যে তাওয়াফ করা একমাত্র খানায়ে কা’বার জন্যই নির্দিষ্ট। মাযারসমূহকে চুমো দেয়া থেকেও বেঁচে থাকা চাই। কেননা এতে সম্মানের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত (বাড়াবাড়ি) করা হয়।’’ [ইমাম আহমদ রেযাঃ ‘ফতাওয়া-ই- রেযভীয়া, (৪র্থখণ্ড) জানাযা অধ্যায়, পৃষ্ঠা-৮] আহকামে শরীয়তের মধ্যে আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি লেখেছেন, পবিত্র কা’বা মুআজ্জামা ব্যতীত অন্য কিছুকে সম্মানার্থে তাওয়াফ করা জায়েয নেই। আর খোদা ছাড়া অন্য কিছুকে সাজদা করা আমাদের শরীয়তে হারাম। কবরকে চুমো দেয়ার ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে মতভেদ আছে। আর ঘেরাও করা নিষেধ। বিশেষত আমাদের (পূর্বসূরী) আলেমরা ব্যাখ্যা করেছেন যে, (যিয়ারতের সময়) কমপক্ষে চার হাত দূরে দাঁড়াবে। এটাই হলো আদব। তারপরও চুমো দেয়া কিভাবে (চিন্তা) ধারণা করা যায়? এটা সেই হুকুম যা সাধারণ মানুষকে দেয়া হয়। (অর্থাৎ সাধারণ মানুষের জন্য এ হুকুম প্রযোজ্য।) আর বিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের স্থান আলাদা।’’[ইমাম আহমদ রেযাঃ ‘আহকাম-ই শরীয়ত’ দ্রষ্টব্য]

৪. ঘরে ছবি রাখা প্রসঙ্গে 
বর্তমান মুসলমানদের ঘরে জীব-জন্তুর ছবি টাঙ্গিয়ে রাখা এবং মূর্তি দিয়ে ঘর সাজানোর এক সর্ব সাধারণ প্রথায় পরিণত হয়েছে। অনেক অশিক্ষিতি মুসলমানতো বরকত লাভের আশায় বোরাকের ছবিও ঘরে স্থাপন করে থাকেন। ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি উহার কঠোর সমালোচনা করেছেন। আর এগুলো রাখার ক্ষেত্রে নিষেধ করেছেন। তবে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পাদুকা মোবারকের নক্শা ও সবুজ গম্বুজের প্রতিচ্ছবি রাখাকে বৈধ ও ভালো বলে মত প্রকাশ করেন। [ইমাম আহমদ রেযা ঃ শিফায়ূল ওয়ালাহ ফী সুয়ারিল হাবীব ও মাযারাহ্ ওয়া নি’আলা’]

৫. চেহলাম ও ফাতিহখানি প্রসঙ্গে
মুসলিম সমাজে ফাতিহা, চেহলাম, বাৎসরিক ইত্যাদি সাধারণভাবে প্রচলন দেখা যায়। ইমাম আহমদ রেযা এগুলোকে বৈধ বলে ফতোয়া দেন। আর দিন নির্দিষ্ট করাকে সকলের আগমন সহজ হওয়ার জন্য বৈধ বলে ফতোয়া দেন।
মৃতের জন্য ফাতেহা ও ইসালে সাওয়াবের উদ্দেশ্যে রন্ধনকৃত খাবারে মৃতের হকদার ও গরীব-মিসকীনকে তিনি প্রাধান্য দিতেন। আর ফাতিহা ও ইসালে সাওয়াবের নির্দিষ্ট শরয়ী নিয়ম-নীতি বেঁধে দেন এবং এ বিষয়ে ‘‘আল হুজ্জাতুল ফায়ীহা লিতীবীত তা’য়ীন ওয়াল ফাতিহা’’ নামক তথ্য নির্ভর পুস্তিকা রচনা করেন।

৬. মহিলাদের মাযার শরীফে গমন ও পর্দা প্রসঙ্গে
আজকাল দেখা যায় যে, আউলিয়ায়ে কেরামের মাযারে মেয়ে লোকদের আনাগোনা এমনভাবে বেড়ে গিয়েছে যে, সেখানে পর্দা-পুশিদার কথা দূরে থাক বরং দু’শ্চরিত্রা নারী তাদের কুমতলব সাধনের লক্ষ্যে বিভিন্ন মাযারসমূহকে নিরাপদ আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করছে। ক্ষেত্রবিশেষে মাযারের কথিত মোতাওয়াল্লী, খাদেম ও ওয়ারিশরা টু পাইস কামানোর জন্যে এসব গর্হিত কাজে বাধাতো দেই না বরং অনেক ক্ষেত্রে সহায়তাও করে থাকে। ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এসব বিদআত ও গোমরাহীর বিরুদ্ধে কুরআন, হাদীস এবং ফিক্বহ’র শতাধিক দলীল দিয়ে মুসলিম উম্মাহর মেয়ে-লোকদের কবরস্থান বা মাযারে যাওয়ার ব্যাপারে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। তিনি বিখ্যাত গুনিয়া কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘‘এটা জিজ্ঞেস করো না যে, মেয়ে-লোকদের মাযারে (কবরে) যাওয়া জায়েয আছে কি নেই বরং এটা জিজ্ঞেস করো যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে ঐ মেয়েলোকদের উপর কতটুকু লা’নত (অভিসম্পাত) করা হয়। আর কতটুকু বা করা হয় কবরবাসীর পক্ষ থেকে, যখন (কবরে যাওয়ার) ইচ্ছা করে তখন লা’নত শুরু হয়ে যায়। আর প্রর্ত্যাবর্তন করা পর্যন্ত ফেরেশতা লা’নত করতেই থাকেন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর রওজায়ে আনোয়ার ছাড়া কোন মাযারে যাওয়ার অনুমতি নেই। রওযায়ে আকদাসের যিয়ারত একটি বড়ো সুন্নাত যা ওয়াজিবের কাছাকাছি। কুরআনে করীমে একে (গুনাহর) মাগফিরাতের উসীলা বলেছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘‘এবং যখন তারা নিজেদের জানের উপর জুলুম করবে, আর আপনার সমীপে হাযির হয়, অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে, আর রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামও যদি তাদের জন্য সুপারিশ করেন, তাহলে অবশ্যই আল্লাহকে তাওবা কবুলকারী ও অতীব দয়ালু পাবে।’’

হাদীস শরীফে ইরশাদ হচ্ছে ‘‘যে ব্যক্তি আমার পবিত্র রওজা শরীফের যিয়ারত করলো, তার জন্যে আমার শাফায়াত ওয়াজিব হয়ে গেলো। অন্য হাদীসে আছে, ‘‘যে হজ্ব করলো এবং আমার জিয়ারত করলো না, নিশ্চয়ই সে আমার উপর জুলুম করলো।’’ প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র কবর শরীফ জিয়ারাত করা একে তো ওয়াজিব আদায় করা; দ্বিতীয়ত তাওবা কবুল হওয়া, তৃতীয়ত শাফায়াত লাভ করা, চতুর্থত (আল্লাহর পানাহ) প্রিয় নবীর সাথে জুলুম করা থেকে বিরত থাকা। কিন্তু অন্যান্য কবর এবং মাযারের ব্যাপারে এমনি তাকিদ যেমন পাওয়া যায় না, তেমনি এতে ফ্যাসাদেরও সম্ভাবনা আছে। কেননা তারা প্রিয়জনদের কবরে ধৈর্য হারিয়ে ফেলবে। আউলিয়ায়ে কিরামের মাযারে হয়তো না বুঝে বেআদবী করবে অথবা অজ্ঞতার কারণে তাজীমের বেলায় অতিরিক্ত করবে, যেমন সর্বজনজ্ঞান ও দৃষ্ট হয়। [মুহাম্মদ মুস্তফা রেযা খাঁনঃ মালফুজাতে-ই- আ’লা হযরত, পৃষ্ঠা-১২৫]

তাছাড়া এক্ষেত্রে পর্দা-পুশিদার বালাই থাকে না। উল্লেখ্য, পর্দা-পুশিদা এমনিতেই ফরয। সে জন্যে আ’লা হযরত রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এক্ষেত্রে পর্দার কথা উল্লেখ করেন নি।

ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘কবর যিয়ারত করা মেয়েদের জন্য নিষিদ্ধ। হাদীসের মধ্যে আছে-‘‘আল্লাহর লানত (অভিসম্পাত) সেই সমস্ত নারীদের প্রতি, যারা কবর জিয়ারত করতে যায়।’’

ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি নারীদের মাযারে যাওয়ার নিষেধ মর্মে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এর নাম হচ্ছে-‘‘জামালুন নূর ফী নাহয়িন নিসায়ী আন যিয়ারাতিল কুবূর’’। উক্ত গ্রন্থে তিনি ফিক্বাহর প্রসিদ্ধ কিতাব আইনী ৩য় খণ্ডের বরাত দিয়ে উল্লেখ করেন, ‘‘হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেছেন, মেয়েলোকের আপাদমস্তক লজ্জার বস্তু। আপনাপন ঘরের মধ্যেই তারা আল্লাহর নিকটবর্তী থাকে। আর যখন ঘর থেকে বেরোয়, তখন তার উপর শয়তান দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।
উল্লেখ্য, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু জুমার দিনে দাঁড়িয়ে কংকর মারতে মারতে মসজিদ থেকে মেয়েলোকদের বের করে দেন।

ইমাম ইবরাহীম নখয়ী, (তাবেয়ী), যিনি ইমাম আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি-এর ওস্তাদ ছিলেন, তাঁর ঘরের মেয়ে লোকদেরকে জুমা এবং জামায়াতে যেতে দিতেন না; যখন সেই উত্তম যুগ বড় বেশী ফয়ূজ এবং বরকতের সময়ে নারীদেরকে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে, তাহলে কি এ নষ্টামীর যুগে, ফ্যাসাদের যুগে, এ অল্প সংখ্যক এবং ধারণাকৃত ফুয়ুজাতের বাহানায় মেয়ে-লোকদেরকে অনুমতি দেয়া হবে? আর এই জিয়ারতই বা কিভাবে কবুল করা হবে, যা শরীয়ত তাকিদ দেয় না? বিশেষত এ সমস্ত মেলা-উৎসবে যা খোদাদ্রোহীরা মাযারসমূহে খুলে বসেছে। এটা পবিত্র শরীয়তের সাথে কতটুকু মুনাফেক্বী? [ইমাম আহমদ রেযাঃ জামালুন নূর………দ্রষ্টব্য]

ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ফাতাওয়া-ই রেযভীয়া’র মধ্যে কুরআন, হাদীস এবং ফিক্বাহর বিভিন্ন প্রমাণাদির মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, মেয়েলোক তথা নারীদের কবরে যাওয়া অবশ্যই না জায়েয ও হারাম।

৭. কবরে বাতি জ্বালানো প্রসঙ্গে
কবরে বাতি জ্বালানো সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি তার জবাবে এটাকে বিনা প্রয়োজনে সম্পদের অপচয় করা হয় বলে মন্তব্য করেন। তবে এ হিসেবে এটাকে বৈধ বলেছেন যে, যদি কবর মসজিদ ও রাস্তার পাশে হয় আর বাতি জ্বালানোতে যদি নামাযী ও জিয়ারতকারী পথিকের উপকারে আসে তবে বৈধ। আ’লা হযরতের মতে, ‘যে কাজ দ্বীনি উপকার অথবা পার্থিব বৈধ লাভ উভয় থেকে শূন্য, এমন কাজ অনর্থক বৈ কিছু নয়। আর অনর্থক কাজ স্বয়ং মাকরূহ (অপছন্দনীয়) এবং এতে সম্পদ ব্যয় করা অপচয়ের নামান্তর। আর অচয় হলো হারাম। [ইমাম আহমদ রেযা ঃ ‘বরীকুল মানার বিশামুউল মাযার’ ও আহকামে শরীয়ত দ্রষ্টব্য]

৮. আউলিয়ায়ে কেরামদের কবরে গিলাফ দেয়া প্রসঙ্গে
সালেহীনদের কবরে গিলাফ বা চাদর চড়ানোর ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি এ সম্পর্কে বলেছেন যে, তা বৈধ যেন সাধারণ লোক তাঁদের দিকে আকৃষ্ট হয়ে বরকত ও ফয়ূজাত লাভে ধন্য হতে পারে। তাও একটি মাত্র চাদর বা গিলাফ। যদি তা’ ফেটে যায় অন্যটি দেবে। উহার বিপরীত একটি ফেটে বা পুরাতন হয়ে না যাওয়াতেই অন্য নতুন চাদর বা গিলাফ চড়ানো তাঁর মতে বৈধ নয়। তিনি এ প্রকার প্রথার বশীভূত হয়ে চাদর চড়ানোকে অপচয় বলে মত প্রকাশ করেন। আর লিখেছেন যে, ‘‘এ প্রকার চাদর না দিয়ে আল্লাহর ওলীদের ইসালে সাওয়াবের নিয়্যতে নিঃস্বদেরকে তার মূল্য দান করা চাই।’’

৯. ওরস ও কাউয়ালী প্রসঙ্গে
আউলিয়ায়ে কেরামের ওরস করা শরীয়ত মতে মুস্তাহাব। আমাদের দেশে কয়েকটি বাতিল সম্প্রদায় এ ওরসকে পূজার সাথে তুলনা করে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রয়াস চালায়। আবার কিছু স্বার্থান্বেষী মহল এ ওরস উদ্যাপন করতে গিয়ে শরীয়তবিরোধী নানা রকম কার্যকলাপের মেলা জুড়ে দেয়। ঢোল, তবলা, বাঁশী সহযোগে গান-বাজনা করা শরীয়তের দৃষ্টিতে হারাম ও সর্বতোভাবে বর্জনীয়। এ সম্পর্কে ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন; এ সমস্ত গর্হিত কার্যকলাপ দ্বারা বুযুর্গদের কষ্ট দেয়া হয় এবং এসব কারণে ওইসব হযরাত তাঁদের শুভদৃষ্টি কম করে দিয়েছেন। না হয় পূর্বে যেভাবে ফয়ূজাত ছিলো, এখন তা কোথায়? (সেভাবে হচ্ছে না কেন?।

সেমা-কাউয়ালী
পাক ভারত উপমহাদেশে বুযর্গানে দ্বীন যেখানে তাঁদের আদর্শের মাধ্যমে ইসলামের নূর প্রসারিত করেছেন, সেখানেই তারা ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতিও প্রসার করেছেন। তখনকার চিশতীয়া তরীকার মাশাইখরা হিন্দুদের মোকাবেলায় ইসলামের তাবলীগের জন্যে ‘সেমা’র পন্থা উদ্ভাবন করেছেন। যা পরবর্তীতে কাউয়ালী নামে রূপ ধারণ করে। এমনকি তা বিভিন্ন যান্ত্রিক বাদ্য বাজনার সাথে অনুষ্ঠিত হতে থাকে। অথচ সূফীয়া-ই কিরামের উদ্ভাবিত ‘সেমা-মাহফিল’র সাথে বর্তমান যুগের কাউয়ালীর দূরতমও সম্পর্ক নেই। ইসলামে যেহেতু বাদ্যযন্ত্র হারাম সেহেতু ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে গিয়ে ইসলামী সমাজকে সংস্কার করার জন্যে বাদ্যযন্ত্র সহযোগে অনুষ্ঠিত কাউয়ালীকে হারাম হিসেবে মত প্রকাশ করেন। তাঁর অমর গ্রন্থ ‘আহকামে শরীয়তে’ বাদ্য- বাজনার সাথে কাউয়ালী করা সম্পর্কে বলেন, ‘‘শুধু কাউয়ালী করা জায়েয আছে। আর বাদ্রযন্ত্র হারাম। হযরত সুলতানুল মাশাইখ মাহবুবে ইলাহী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ‘ফাওয়াদেুল ফুয়াদ শরীফে’র মধ্যে বলেন, (মাযামীর (বাদ্যযন্ত্র) হারাম। হযরত মাখদূম শরফুল মিল্লাত ওয়াদ দ্বীন ইয়াহইয়া মুনীরী (কুদ্দিসা সিররুহ) মাযামীরকে যিনার সাথে তুলনা করেছেন। শীর্ষ স্থানীয় ওলীগণ বলেছেন, শুধুমাত্র খ্যাতি শুনেই কারো কাছে যেওনা, যতক্ষণ না শরীয়তের নিক্তির উপর তাকে অটল দেখতে না পাও। পীর ধরার (পীরের হাতে বায়আত হওয়ার) জন্যে চারটি শর্ত অবশ্যই প্রয়োজনীয়। তন্মধ্যে একটি হলো কোন ব্যাপারে পীর সাহেব শরীয়তের বিরোধিতা করবে না। না জায়েযকে না জায়েয হিসেবে জানবে। এমনস্থানে কারো সম্পর্কে বিতর্কে যাবে না।’’

এক ব্যক্তি আ’লা হযরত রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এর কাছে প্রশ্ন করলো যে, এক জায়গায় ওরসে গিয়ে দেখতে পেলাম এমন অবস্থায় কাউয়ালী হচ্ছে যে, ঢোল, দু’টি সারঙ্গী বাজছে আর কিছু কাউয়াল গাউছে পাক এবং প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শানে কাউয়ালী পরিবেশন করছে। তাদের এহেন কাজে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এবং আউলিয়ায়ে কেরাম খুশী আছেন কি-না? শ্রোতারা গুনাহগার হবে কি না? এবং কাউয়ালী জায়েয আছে কি না?

ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি উত্তরে বলেন, ‘‘এমন কাউয়ালী হারাম; উপস্থিত সব শ্রোতারাই গুনাহগার। আর সবার গুনাহ এমনভাবে ওরস উদ্যাপনকারী ও কাউয়ালদের উপর আবির্তত হবে এবং কাউয়ালদের গুনাহও ওরস উদ্যাপনকারীদের উপর পড়বে, কিন্তু কাউয়াল এবং শ্রোতাদের গুনাহ্ এতটুকুনও হ্রাস পাবে না। কাউয়ালদের উপর সবার সমান গুনাহ এজন্য যে, তারা যদি ঢোল-সারঙ্গী ইত্যাদির মাধ্যমে কাউয়ালী না করতো, তাহলে উপস্থিত লোকদের কিভাবে গুনাহ হতো? এজন্যে তাদের সবার গুনাহ কাউয়ালদের উপর বর্তাবে। আবার কাউয়ালদের এ গুনাহের (তার নিজের ও অপরের) কারণ হলো উদ্যাপনকারীরা। তারা যদি ওরস না করতো, কাউয়ালদের আমন্ত্রণ না জানাতো, তারা কিভাবে এবং কেন আসতো, আর বাদ্য বাজাতো? সুতরাং কাউয়ালদের গুনাহ্ও ওরসকারীদের উপরই বর্তাবে।[ইমাম আহমদ রেযাঃ আহ্কামে-ই শরীয়ত দ্রষ্টব্য]

তাহলে ভেবে দেখুন, আমাদের দেশে ওরসের নামে আজ যেভাবে বাদ্য বাজনা, নাচ-গান, নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা চলছে, তা কতইনা গর্হিত কাজ? দ্বীন ইসলামের প্রতি কতই না ঠাট্টা-বিদ্রুপের শামিল? সময় থাকতে এগুলোর প্রতিরোধ করা আমাদের অবশ্যই কর্তব্য নয় কি? এরপর ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি আলায়হি হাদীস ও ফিক্বাহর দলীলাদি এবং আউলিয়ায়ে কেরামদের মতামতের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, বাদ্যযন্ত্রের সাথে কাউয়ালী না জায়েয।

এ মাসআলার উপর গবেষণা ও আলোচনা করতে গিয়ে তিনি ‘বে আমল’ এবং মিথ্যুক সূফী (?) দের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়ে বলেন, ‘‘কিছু মুর্খ, হারাম কাজে অভ্যস্থ, অথবা মোল্লা নামধারী, নাফস দ্বারা প্ররোচিত বা মিথ্যুক সূফীরা সিহাহ হাদীসসমূহ, ‘মারফু’ (যা রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত বিশুদ্ধ সনদসহ বর্ণিত) ‘মুহকাম’ (যা স্পষ্টভাবে বর্ণিত) ইত্যাদির পরিবর্তে কিছু দুর্বল কিচ্ছা অথবা সন্দেহযুক্ত ঘটনাবলী পেশ করে থাকে। তাদের কাছে এতটুকু জ্ঞানও নেই অথচ ইচ্ছাকৃতভাবে মূর্খ সাজে (না জানার ভান করে,) অথচ সহীহ (হাদীস) এর মুকাবিলায় জয়ীফ, সুনির্দিষ্ট এর মুকাবিলায় সন্দেহযুক্ত, স্পষ্ট এর স্থানে অস্পষ্ট গ্রহণ না করাটা ওয়াজিব……….।’’[প্রাগুক্ত গ্রন্থে দ্রষ্টব্য]

তাই ইমাম আহমদ রেযা ওরস উদ্যাপন করাকে বৈধ বলে মত দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তাতে যেন শরীয়ত গর্হিত কোন কাজ না হয় তার শর্তারোপও করেছেন। অন্যথায় এমন ওরসে অংশগ্রহণকে পর্যন্ত তিনি হারাম বলে জানতেন। [বিস্তারিত জানার জন্য ইমাম বেরেলভী কৃতঃ

১০. আত্শ বাজি
বিয়ে-শাদী, শবে-বরাত ও পবিত্র ঈদ প্রভৃতি উপলক্ষে অনেক জায়গায় এক শ্রেণীর অসাধু লোকেরা আত্শবাজি, ফটকাবাজি ইত্যাকার মাধ্যমে ধর্মীয় দিবসের পবিত্রতা ক্ষুণœ করার পাশাপশি আনন্দ উল্লাসের নামে বিপুল পরিমাণে অর্থ অপচয় করে। আ’লা হযরত এ সব অনর্থক ক্রিয়াকাণ্ড প্রতিরোধে এগিয়ে আসার জন্য মুসলিম জনসাধারণকে আহবান করেন। এ বিষয়ে তিনি পুস্তকও রচনা করে যান। যার শিরোনাম এ যে, ‘‘হাদীয়ূন্নাছ ফী রুছুমীল আরাছ’’।

বস্তুত আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা মুসলিম সমাজের প্রতিটি অঙ্গনে মুসলমানদেরকে অপব্যয় করা থেকে বাধা দিয়েছেন। যে অপব্যয়ের দরুন তাদের অর্থনৈতিক জীবন পর্যুদস্ত হতে বাধ্য। তিনি কুসংস্কারকে দ্বীন ও সমাজ জীবনে এক মহাব্যাধি বলে মনে করতেন। যে কারণে মানুষ সত্য ও ন্যায় গ্রহণ করার আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। তিনি এক স্থানে লিখেছেন যে, ‘‘আত্মা যতোক্ষণ পরিষ্কার থাকবে, সত্যের দিকে আহবান করবে, আর গুনাহ্ এবং বিশেষ করে সমাজ দেহে কুসংস্কারের আধিক্যের দরুন (আত্মাকে) অন্ধ করে দেয়া হয়। তখন তা দ্বারা হক বা ন্যায় দেখার, বুঝার বা এ নিয়ে চিন্তা করার যোগ্যতা থাকে না। তখন কিন্তু ন্যায়ের বাণী শ্রবণ করার যোগ্যতাটুকুই অবশিষ্ট থাকে।’’ [মুহাম্মদ মোস্তফা রেযাঃ ‘মালফুজাত-ই-আ’লা হযরত’ (৩য় খণ্ড) পৃষ্ঠা-৫৪]

মাওলানা আ’লা হযরত রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি প্রত্যেক কালেমাধারী ব্যক্তিকে মুসলমান বলে জানতেন। সে সাথে তার মাঝে ইসলামের বিধি-বিধান প্রতিফলন হওয়াকে তিনি পছন্দ করতেন। যে পর্যন্ত তার কথা ও কর্ম শরীয়ত তথা ধর্মের বিরুদ্ধে না হতো, সে পর্যন্ত তিনি তাকে ছেড়ে দিতেন অর্থাৎ মুসলমান বলে জানতেন।

তিনি প্রত্যেক ঐ ব্যক্তিকে যে ধর্মে নতুন নতুন কথা (যা শরীয়ত বিরোধী) প্রবেশ করাতো ‘বিদ্আতী’ বলে সাব্যস্থ করতেন। আর ঐ ব্যক্তির কঠোর সমালোচনায় অবতীর্ণ হতেন যিনি সংস্কারের নামে ভ্রান্ত নতুন পথ ও মত ধর্মে আবিষ্কার করতেন। আ’লা হযরত রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি সামাজিক মূল্যবোধের বিপরীতে যাবতীয় রসম- রেওয়াজ (যা সমাজে প্রচলিত দেখা যায়) এর উপর বিরূপ সমালোচনা করতে কখনো কুণ্ঠিত হননি।

এভাবে আ‘লা হযরত রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিকে আমরা ইলমে আক্বাইদ, ইলমে ফিক্বাহ্ ইলমে ইসলাহ্ প্রভৃতিতে একজন সফল মুজাদ্দিদের ভূমিকায় দেখতে পাই। ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর সংস্কার আমরা প্রত্যক্ষ করি। এভাবে তাঁর ব্যক্তিত্বের মধ্যে একাধারে বহুবিধ গুণের সমাবেশ ঘটেছে। আর প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি সফলতার উচ্চ শিখরে উপনীত হতে সক্ষম হন। আজ পর্যন্ত তাঁর কলমের উপর কেউ কলম ধরতে সাহস পায়নি। আসুন সব রকমের ভ্রান্তির জাল ছিন্ন করে উদার মনোভাব নিয়ে এ মহান মনীষীর জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করি এবং তাঁর শিক্ষা ও আদর্শকে শরীয়তের কষ্টি পাথরে পরীক্ষা করে তাঁর মতাদর্শের অনুসরণ ও অনুকরণ করি। আল্লাহ আমাদেরকে তৌফিক দিন। আমীন।