আ’লা হযরত : মুসলিম সমাজ যাঁর কাছে ঋণী – মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান

আ’লা হযরত : মুসলিম সমাজ যাঁর কাছে ঋণী – মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান

আ’লা হযরত : মুসলিম সমাজ যাঁর কাছে ঋণী
মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান

============

যখন এ উপমহাদেশে ইসলামী সালতানাতের সূর্য অস্তমিত হচ্ছিলো, অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছিলো, হৃদয়-সূর্য ডুবন্ত প্রায় হলো ও বুকের সাহস দ্রুত হ্রাস পাচ্ছিলো, ঠিক তখনই আল্লাহর রহমতের সমুদ্র ঢেউ খেললো। পুনরায় একটি সূর্য উদিত হলো। সেটা আবার আকাশকে আলোময় করলো। ডুবন্ত হৃদয়কে উঠে আসার অবলম্বন দিলো। সকলের মনে নতুন করে সাহস যোগালো। অন্ধাকার আকাশে উদিত এ সূর্য কে ছিলেন? তিনি হলেন ইমামে আহলে সুন্নাত, মুজাদ্দিদে মিআত, আ’লা হযরত আহমদ রেযা বেরলভী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আন্হু, আরব ও আজম যাঁর মহত্ব ও সম্মানের পক্ষে সাক্ষ্য দিলো, যিনি নিজের খোদা-প্রদত্ত অসাধারণ যোগ্যতা, নাম ও খ্যাতিকে দ্বীন-ইসলাম ও ইসলামের নবী আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্সালাম-এর শরীয়তের প্রসার ও পুন:প্রতিষ্ঠার জন্য উৎসর্গ করেছিলেন এবং যাঁর অসাধারণ ও ফলপ্রসূ অবদানগুলো গোটা মুসলিম সমাজকে তাঁর প্রতি চিরঋণী করে রেখেছে।

ইমাম আহমদ রেযা বেরলভী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র বিশাল কর্মময় জীবনী পর্যালোচনা করলে উপরিউক্ত সত্যটি মধ্যাহ্ন সূর্যের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সুখের বিষয় যে, এ ক্ষুদ্র পরিসরে তাঁর জীবনী বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা সম্ভব না হলেও বিভিন্নভাবে এ মহান ইমামের জীবনের উপর আলোচনা হয়েছে ও হচ্ছে, আগামীতেও হতে থাকবে। আজ এদেশের প্রায় সবার নিকট একথাটি স্পষ্ট হয়েছে যে, শতাব্দির এ মহান ইমাম ও মুজাদ্দিদ জান্মগতভাবে অসাধারণ প্রতিভাবান (‘আবক্বারী) ও পঞ্চান্নটি বিষয়ে সহস্রাধিক অকাট্য ও প্রমাণ্য গ্রন্থ-পুস্তকের প্রণেতা ছিলেন। তিনি বেলায়তেরও উচ্চাসনে আসীন ছিলেন। হযরত সাইয়্যেদ আ-লে রসূল, মারহারা শরীফের হাতে বায়‘আত গ্রহণ করেন। ২১ বছর বয়সে আপন পিতার সাথে হজ্ব করতে গেলে ওলামা-ই হিজায তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রতি প্রভাবিত হয়ে তাঁকে ‘যিয়াউদ্দিন আহমদ’ (দ্বীনের আলো আহমদ রেযা/হুযূর আহমদ মুজতাবার দ্বীনের আলো) উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। পাক-ভারত উপমহাদেশের বৃহত্তর দ্বীনী প্রতিষ্ঠান ‘মানযারুল ইসলাম’ কায়েম করেছেন। ১৯১১ইংরেজীতে (১৩৩০হিজরী) মুসলিম উম্মাহর জন্য বিশুদ্ধতম উর্দু তরজমা-ই ক্বোরআন ‘কান্যুল ঈমান’ প্রণয়ন করেন। তাঁর পবিত্র জন্ম ১০ শাওয়াল ১২৭২ হিজরি ১৪ জুন, ১৮৫৬ ইংরেজীতে এবং ওফাত ২৫ সফর, ১৩৪০ হিজরিতে (নভেম্বর ১৯২১)।

আ’লা হযরতের উপরিউক্ত সহস্রাধিক গ্রন্থ-পুস্তকের মধ্যে ‘ফাতাওয়া-ই আলমগীরী’র পর হানাফী ফিক্বহের মহার্কীতি হচ্ছে ‘ফাতাওয়া-ই রেযভিয়্যাহ’। তাঁর এ ফাত্ওয়া গ্রন্থ ইসলামী আইন্ শাস্ত্রের অন্যতম প্রধান ও নির্ভরযোগ্য উৎস-গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা ড. মুহাম্মদ ইক্ববাল ফিক্বহ শাস্ত্রে ইমাম আহমদ রেযার দক্ষতা, তীক্ষ¥ দৃষ্টি, মেধা ও গবেষণার গভীরতার স্বীকৃতি স্বরূপ বলেছেন- ‘‘ভারতে এ শেষ যুগে হযরত আহমদ রেযার মতো সুস্থ-স্বভাব ও মেধাসম্পন্ন ফক্বীহ্ (ফিক্বহ্শাস্ত্রবিদ) আর পয়দা হয়নি। আমার এ মন্তব্য তাঁর ‘ফাতাওয়া গ্রন্থ’ পাঠ-পর্যালোচনা করে স্থির করেছি, যা তাঁর মেধা, তীক্ষ্মবুদ্ধি, উন্নত স্বভাব, পূর্ণ অনুধাবন ক্ষমতা ও দ্বীনী জ্ঞানে গভীরতার জ্বলন্ত সাক্ষী। ইমাম আহমদ রেযার মহান জ্ঞানগত প্রচেষ্টা ও সংস্কারমূলক কর্মতৎপরতার প্রতি গভীরভাবে দেখা হলে, তাঁকে ইমাম গায্যালী, ইমাম মুহিউদ্দিন ইবনুল আরবী, ইমাম আবুল হাসান শা’রানী, ইমাম আবুল মানসুর মা-তুরীদী, আল্লামা আবূ বকর মুহাম্মদ ইবনে তাইয়্যেব বাক্বিল্লানী ও হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম-এর মতো মহান জ্ঞানী, রূহানী ও সংস্কারক ব্যক্তিবর্গের কাতারেই দেখা যায়।’’ এভাবে বিশ্ববরেণ্য জ্ঞান-গুণী ব্যক্তিবর্গের মন্তব্যাদি ও বাস্তবতার নিরিখে ইমাম আহমদ রেযা আহমদের মুসলিম সমাজের জন্য একটি মহা নি’মাত ও গৌরবময় ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রতি চিরদিন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শেষ করা যাবে না।

পক্ষান্তরে, অকৃতজ্ঞ, ঈর্ষাপরায়ণ ও স্বার্থপর লোকেরা তাঁর বিরোধিতা করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। আমাদের বাংলাদেশেও আক্বীদাগত এবং আদর্শগত বিরোধীরাও সুযোগ বুঝে এ মহান ইমামের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে চাচ্ছে। কিন্তু সুখের বিষয় যে, প্রতিটি যুগে এ বিরুদ্ধবাদীদেরও দাঁত ভাঙ্গা জবাব দেয়া হয়েছে, এহেন পরিস্থিতিতে আল্লামা মুহাম্মদ শরফ ক্বাদেরী এক অবিবেচক ও মিথ্যাচারী লেখক ইহসান-ই ইলাহী যহীরের ‘আল-বেরলভিয়্যাহ’র দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়ে ‘আল-বেরলভিয়্যাহ কা তাহক্বীক্বী আওর তান্ক্বীদী জায়েযাহ্’ নামক যে পুস্তকটি লিখেছেন তার ভূমিকায় ড. মুহাম্মদ মাস‘ঊদ আহমদ মরহুম একটি প্রামাণ্য প্রতিবেদন লিখেছেন। বর্তমানকার অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেটা অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। এ নিবন্ধে আমি সেটা সংক্ষিপ্তকারে উপস্থাপন করা সমীচীন মনে করছি। তা নিম্নরূপ-

আ’লা হরতের তিরোধানের পর তাঁর প্রতি সত্যপন্থীদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও তাঁকে নিয়ে ব্যাপক চর্চা; পক্ষান্তরে বাতিলপন্থী হিংসুকদের বিরোধিতা ও ষড়যন্ত্রের দীর্ঘ অর্ধ শতাব্দি কাল অতিবাহিত হয়ে গেলো। হঠাৎ ইসলামী গুলশানে নতুন বসন্তের মনোরম হাওয়া বইতে লাগলো। প্রকৃত ইসলামী বৃক্ষের ডালগুলো আন্দোলিত হচ্ছিলো। ফুল ফুটতে আরম্ভ করলো। বুলবুলিগুলোর গুঞ্জন শুরু হলো। আজ থেকে ২৪ বছরাধিক কাল পূর্বে পাকিস্তানের লাহোর ‘কেন্দ্রীয় মজলিসে রেযা’ (মারকাযী মজলিসে রেযা) নামে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কায়েম হলো। এটা ইমাম আহমদ রেযার জীবন ও চিন্তাধারার উপর বহু পুস্তকের লক্ষ লক্ষ কপি প্রকাশ ও প্রচার করলো। এক যুগাধিককাল পূর্বে করাচীতে ‘ইদারাহ-ই তাহ্ক্বীক্বাত-ই ইমাম আহমদ রেযা’ প্রতিষ্ঠিত হলো। এটাও তার প্রকাশিত বহু লেখনী গোটা দুনিয়ায় প্রচার করে যাচ্ছে। অর্ধযুগ পূর্বে লাহোরে ‘রেযা একাডেমী লাহোর’ প্রতিষ্ঠালাভ করে দ্রুতগতিতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া, রেযা একাডেমী, ইউ-কে, রেযা একাডেমী বোম্বাই, সুন্নী রেযভী সোসাইটি (দক্ষিণ আফ্রিকা), রেযা ইন্টারন্যাশনাল একাডেমী (সাদিক্ব আবাদ), ‘আল মুজাম্মা’উল ইসলামী’ (ইসলামী কমপ্লেক্স, মুবারকপুর) ইত্যাদি ইমাম আহমদ রেযার জীবন ও চিন্তাধারার উপর অবিরাম গতিতে গ্রন্থ-পুস্তক প্রকাশ করে যাচ্ছে। ‘সুন্নী দারুল ইশা‘আত, মুবারকপুর ‘ফাতাওয়া-ই রেযভিয়াহ’ প্রকাশ করেছে। (প্রসঙ্গেক্রমে উল্লেখ্য, আমাদের বাংলাদেশেও ‘ইমাম আহমদ রেযা রিসার্চ একাডেমী, চট্টগ্রাম’ ‘আ’লা হযরত’ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ এবং ‘রেযা ইসলামিক একাডেমী বাংলাদেশ’ ইমাম আহমদ রেযা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র জীবন ও কর্মের উপর এবং তাঁর মূল্যবান কিতাবগুলোর অনুবাদ, প্রকাশনা ও প্রচারের ক্ষেত্রে কাজ করে আসছে)।

আলহামদু লিল্লাহ! এ সব প্রতিষ্ঠানের প্রচেষ্টার সুফলও বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষ থেকে আরম্ভ করে উঁচু পর্যায়ের বুদ্ধিজীবী মহেলও ইমাম আহমদ রেযার চর্চা হচ্ছে। পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষার প্রশ্নগুলোতে ইমাম আহমদ রেযার উপর প্রশ্ন করা হচ্ছে। পাক-ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এম.ফিল ও পি.এইচ.ডি’র জন্য গবেষণামূলক প্রবন্ধ (ঞযবংরং) লেখা হচ্ছে, ডিগ্রী পাওয়া যাচ্ছে। উপমহাদেশের ১৯৯১ ইংরেজী পর্যন্ত, চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬ জন স্কলার ‘গবেষণামূলক প্রবন্ধ’ (ঞযবংরং) লিখে এম.ফিল ও পি.এইচ.ডি ডিগ্রী লাভ করেছেন। এগারজন স্কলার গবেষণারত আছেন, আরো অনেকে রেজিষ্ট্রেশনের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন। বিরোধীরা যখন এ সূর্যকে ডুবাতে চেষ্টা করছে, তখন এ সেটা নবনবরূপে উদিত হচ্ছে। এক কবি অতি সুন্দর বলেছেন-
অর্থাৎ দাগবিহীনদের চিহ্ন নিশ্চিহ্ন হয় না। নিশ্চিহ্ন হতে হতে প্রসিদ্ধই হয়ে যায়। নি:সন্দেহে আশ্বিক্ব মরে না; সে শহীদ হয়েও জীবিত থাকে; বরং তাদের মৃত্যু জীবিত মানুষের জন্য ঈর্ষার কারণ হয়ে যায়। এক ফার্সী কবি বলছেন-
অর্থাৎ ওই সৌভাগ্য দেখো, যা ইশক্বের তরবারিতে নিহত আশিক্ব পেয়েছে! এটা তো এমন মৃত্যু, যার জন্য জীবিতরাও তাদের দো‘আয় কামনা করছে!
বিরুদ্ধবাদীরা বিরোধিতা করেছে, আধুনিক জ্ঞানের সভা-মজলিসে তাঁর নামে সমালোচনা করেছে, কিন্তু আবার ওই জ্ঞানের বৃত্ত থেকে তাঁর প্রশংসা বাক্য ধ্বনিত হতে থাকে। সত্তর বছর পর আরেকটি অভিযান চালানো হলো। ১৯৭০ সনে ড. মুহাম্মদ মাস’ঊদ আহমদ ইমাম আহমদ রেযার পুস্তিকা ‘আল মুহাজ্জাতুল মু’তামানাহ্ ফী আয়াতিল্ মুমতাহানাহ’র অলোকে একটি প্রবন্ধ লিখলেন। সেটা ১৯৭১ সালে ‘মারকাযী মজলিসে রেযা, লাহোর’ প্রকাশ করেছেন এ প্রবন্ধে ঐতিহাসিক পটভূমিকা উপস্থাপন করা হলে প্রসঙ্গক্রমে সাইয়্যেদ আহমদ বেরেলভীর কথা এসে গেছে। এতে তাঁর সম্পর্কে এ তথ্য প্রকাশ পেলো যে, ‘সাইয়্যেদ আহমদ বেরলভীর কর্মকাণ্ডের ফলে আর কিছু না হলেও ইংরেজদের উপকার হয়েছে।’ এটা ওইসব তথাকথিত গবেষক ও ইতিহাসবিদদের বিপক্ষে গেলো, যারা এতদিন যাবৎ তাদের মিথ্যা বর্ণনা ও ইতিহাস বিকৃতির জন্য যথেষ্ট পরিশ্রম করে এসেছিলো। এরপর তাঁর (ড. মাসউদ) গবেষণা মূলক প্রবন্ধ ‘ফাযেলে বেরলভী আওর তর্কে মুআলাত’ প্রকাশিত হলো। এটা দেখে বিরুদ্ধাবাদীরা ক্রোধে ফেটে পড়লো। কিন্তু বাস্তব তথ্যের সামনে তাদের ষড়যন্ত্রের জাল মাকড়সার জালের মতো ছিন্ন ও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো। সাইয়্যেদ আহমদ বেরলভীর ইংরেজ প্রীতির যেই তথ্য ড. মাস‘ঊদ সাহেব লিখেছিলেন তার সমর্থন করলো- বিরোধী মোর্চার মৌলভী হোসাইন আহমদ দেওবন্দী তাঁর ‘শিহাবুস্ সাক্বিব’-এ এবং হল্যাণ্ডের লীডন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ড. জে.এম. এস. বিলিয়ান। এ শেষোক্তজন লিখেছেন- ‘‘সাইয়্যেদ সাহেব ইংরেজদের বিরুদ্ধে কোনরূপ প্রচেষ্টা চালান নি।’’ এরপর বিরুদ্ধবাদীরা নিশ্চুপ হয়ে গেলো। তারপর ড. মাস‘ঊদ সাহেব যখন ‘ফাযেলে বেরলভী ওলামা-ই হিযাজ কী নযর মে’ (মক্কা মুকাররামাহ্ ও মদীনা মুনাওয়ারাহ্র বিজ্ঞ আলিমদের দৃষ্টিতে ফাযেলে বেরলভী ইমাম আহমদ রেযা) প্রকাশ পেলো তখন বিরুদ্ধবাদীরা এ প্রসঙ্গে নির্বাক হতে বাধ্য হলো। অনেকে ‘আ’লা হযরত সম্পর্কে তাদের ভুল ধারণা থেকে রুজূ’ করেছেন। তাঁদের মধ্যে আলীগড় মুসলিম ইউনির্ভারসিটির একজন অধ্যাপকও ছিলেন।

ইমাম আহমদ রেযার তরজমা-ই ক্বোরআন ‘কান্যুল ঈমান’ ছাপিয়ে যখন এর সহস্র-লক্ষ কপি প্রাচ্য ও পাশ্চত্যে বিলি করা হলো, তখন বিরোধীরা এর বিরুদ্ধেও চক্রান্ত করলো। সৌদী আরবের ওহাবীরা তো সরকারীভাবে সেটার বিরুদ্ধে পাবন্দি লাগালো; কিন্তু এ কিতাবের বিশুদ্ধতা অক্ষুণœই রয়েছে। তাদের চক্রান্ত নিষ্ফলই হলো।

ইমাম আহমদ রেযার চর্চা ক্রমশ বাড়তেই লাগলো। ইতিহাসের এক পর্যায়ে এসে ‘এহসানে ইলাহী যহীর’ নামের এক লোক ‘আল-বেরলভিয়াহ’ নামে এক পুস্তক লিখলো। পুস্তকটি আরবী ভাষায় লেখা হলো, যাকে আসলে ‘মিথ্যার সম্ভার’ বললেও অত্যুক্তি হবে না। তাতে ইমাম আহমদ রেযার বিরুদ্ধে ইচ্ছামতো মিথ্যাচার করা হয়েছে। যার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন- আল্লামা মুহাম্মদ আবদুল হাকীম শরফ ক্বাদেরী (পাকিস্তান)।

উক্ত কিতাবে (আল-বেরলভিয়্যাহ্) অপবাদ দেয়া হলো- ইমাম আহমদ রেযা বেরলভীর সাথে নাকি শিয়া ও ক্বাদিয়ানীর সাথে সম্পর্ক ছিলো। অথচ ‘আ’লা হযরত এ দু’ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ও খণ্ডনে একাধিক অকাট্য কিতাব লিখেছেন। শুধু তা নয়, সৌদি আরবের রিয়াদ থেকে একটি কিতাবে আ’লা হযরতের বিরুদ্ধে লিখা দেখে সাথে সাথে লেখকের নিকট আ’লা হযরতের উপর লিখিত কিচু আরবী কিতাব পাঠিয়ে দিলেন। তারা ধন্যবাদ দিয়ে আগামী সংস্করণে সেগুলো সংশোধন করে নেবেন বলে ওয়াদা করেছেন। এভাবে বৈরুত থেকেও আ’লা হযরতের বিরুদ্ধে এক লেখক লিখেছিলো। ওই কিতাবের প্রকাশককেও এ ব্যাপারে অবহিত করা হলে তাঁরাও তা সংশোধন করে নেবেন বলে প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন।

শত্র“ শত্র“তার মধ্যে কখনো সীমা ছাড়িয়ে যায়। কখনো কখনো তার এ শত্র“তা তার বিপক্ষীয়ের জন্য রহমত হয়ে যায়। যেমন- ‘আল-বেরলিভ্যাহ্’র প্রণেতা শত্র“তা সীমাতিক্রম করে গেছে। এদিকে ‘আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা আলায়হির রাহমার জন্য তা ‘রহমত’ প্রমাণিত হয়েছে। এরপর থেকে আ’লা হযরতের উপর আরবীতে প্রচুর কাজ হয়েছে ও হচ্ছে। এর পূর্বে জাষ্টিজ সাইয়্যেদ শাজা‘আত আলী ক্বাদেরীর ‘মুজাহিদুল উম্মাহ্’ প্রকাশিত হয়েছিলো। মাওলানা মুহাম্মদ আহমদ মিসবাহীর একটি প্রবন্ধ (আরবী) ‘ইদারাহ্-ই তাহক্বীক্বাত-ই ইসলামী, ইসলামাবাদ-এর আরবী ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিলো। কিন্তু ‘আল-বেরলভিয়্যাহ্’ প্রকাশিত হয়ে তাতে আ’লা হযরতের শানে বেয়াদবী ও মিথ্যাচার করা হলে তার খণ্ডনের সাথে সাথে তাঁর লিখিত আরবী কিতাবগুলো এবং তার বহু কিতাব আরবীতে অনূদিত হয়ে বহুলভাবে প্রচারিত হতে লাগলো। যেমন- আ’লা হযরতের লিখিত ‘ফাতাওয়া-ই শামী’র উপর হাশিয়া ‘জাদ্দুল মুমতার’ হায়দারাবাদ দক্ষিণ থেকে ছাপিয়ে ‘ইসলামী কমপ্লেক্স’ মুবারকপুর থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এর সাথে মাওলানা মুহাম্মদ আহমদ মিসবাহী, মাওলানা ইফতিখার আহমদ ক্বাদেরী ও মাওলানা আবদুল মুবীন নো’মানী, আ’লা হযরতের জীবনী ও চিন্তাধারা এবং আল্লামা ইবনে আবেদীন শামীর জীবনীও আরবীতে লিখে সংযোজন করেছেন। ড. আবদুল বারী নদভীর তত্ত্বাবধানে আলীগড় মুসলিম ইউনির্ভারসিটি থেকে প্রফেসর ড. মাহমূদ হোসাঈন বেরলভী আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযার আরবী ভাষায় কর্ম ও নিদর্শনাবলীর উপর গবেষণামূলক প্রবন্ধ ((ঞযবংরং) লিখে এম.ফিল করেছেন। ওসমানিয়া ইউনিভার্সিটি, হায়দারাবাদ দক্ষিণ থেকে প্রফেসর আবদুস সামী’ ইমাম আহমদ রেযার আরবী কাব্য রচনার উপর এম.ফিলের জন্য থিসিস (ঞযবংরং) লিখেছেন, মুফতী মুহাম্মদ মুকাররাম আহমদ (শাহী ইমাম, মসজিদ ফতেহপুর, দিল্লী) আন্তর্জাতিক ‘ইমাম আহমদ রেযা কনফারেন্স’ (করাচীতে অনুষ্ঠিত) -এ আ’লা হযরতের আরবী ক্বসীদা-গুলোর উপর প্রশংসনীয় প্রবন্ধ পাঠ করেছেন। করাচী ইউনিভার্সিটির প্রফেসর জালাল উদ্দীন নূরী ইমাম আহমদ রেযার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি’র উপর একটি বিস্তারিত প্রবন্ধ লিখেছেন, যা মুদ্রিত হয়ে বাগদাদে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামী কনফারেন্সে বিলি করা হয়েছিলো। তিনি আ’লা হযরতের উপর আরবীতে একটি বিরাটকার কিতাবও লিখেছেন। আফগানিস্তানের এককালীন সরকারের চিফ জাষ্টিজ মুহাম্মদ নসরুল্লাহ্ খান ইমাম আহমদ রেযার জীবন ও চিন্তাধারার উপর উচাঙ্গের আরবী ভাষায় একটি শানদার প্রবন্ধ লিখেছেন। ড. মুহাম্মদ মাসঊদ সাহেবও একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেছেন, যার আরবী অনুবাদ করেছেন মাওলানা মুমতাজ আহমদ সাদীদী। এ প্রবন্ধ ‘মুজাম্মা‘উল মুল্কী লিবুহূ-সিল হাদ্বা-রাতিল ইসলামিয়াহ্’, আম্মান, জর্ডান থেকে প্রকাশিত ‘ইন্সাইক্লোপিডিয়া’র প্রথম খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর (ড. মাসঊদ) আরেকটি বিস্তারিত প্রবন্ধ, যা তিনি পাকিস্তান হিজরত কাউন্সিল, ইসলামাবাদ থেকে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক মুসলিম মনীষীদের ইন্সাইক্লোপিডিয়ার জন্য লিখেছিলেন। মাওলানা মুহাম্মদ আরিফুল্লাহ্ মিসবাহী সেটার অনুবাদ আরবীতে করেছেন, যা ‘ইদারা-ই তাহক্বীক্বাত-ই ইমাম আহমদ রেযা ইন্টারন্যাশনাল, করাচী’ এবং ‘রেযা ফাউন্ডেশন জামেয়া নেযামিয়া রেযভিয়াহ্’, লাহোর-এর সহযোগিতায় ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয়েছে। এভাবে আর কতো উদ্ধৃতি দেবো!
অর্থাৎ এ অতল সমুদ্রের জন্য বড় জাহাজের প্রয়োজন।

মোটকথা, আ’লা হযরতের বিরুদ্ধাবাদী শত্র“দের শত্র“তায় তাদের কোন উপকার হয়নি, পূর্ণাঙ্গ উপকার আহলে সুন্নাতেরই হয়েছে। রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ও রসূরে পাকের আশিক্বদের শানে গোস্তাখী ও কটুক্তির ফল ভাল হয় না। আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল লিল আ’লামীন, মাহবূবে রাব্বুল আলামীনের সাচ্চা আশিক্ব ছিলেন। তাঁর শুরু ও শেষ উভয়টি, একটার চেয়ে অপরটা উত্তমই হয়েছে। তাঁর ইশক্বে রসূলের এ অবস্থা ছিলো যে, তাঁর শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকেও সেটার আওয়াজ ধ্বনিত হতো। তিনি যেন একথাই বলতেন-অর্থাৎ আহা! হে আল্লাহর রসূল! যদি আমার প্রতি চুল ও লোম আপনার প্রশংসার জন্য রসনা হতো!

তাঁর লিখিত ‘সালাম’ (মুস্তাফা জানে রহমত পেহ্- লাঁখো সালাম) আজ আরব ও অনরাবীয় দেশগুলোর সর্বত্র, এমনকি মদীনা মুনাওয়ারাহয় ও পড়া হচ্ছে। তিনি ও তাঁর ‘সালাম’গুলো রসূলে পাকের পবিত্র দরবারে কতোই মাক্বূল (গ্রহণীয়)! আল্লাহ্ তাঁর রসূলের ভালবাসা এবং আউলিয়া-ই কেরামের ভক্তি-শ্রদ্ধার ক্ষেত্রে আ’লা হযরত এক জ্বলন্ত আদর্শ ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

আসুন, আমরা ‘আল্লাহ্ তা‘আলার মহান নি’মাত আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞানার্জন করি। তাঁর অবদানগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞ হই। আল্লাহ পাক তাঁর আদর্শ অনুসরণের তাওফিক্ব দিন! পক্ষান্তরে, যারা আক্বীদাগত কারণে কিংবা দুনিয়াবী স্বার্থে আল্লাহর এমন নি’মাতকে উপেক্ষা করে চলছে কিংবা বিরোধিতা করার জন্য সুযোগের সন্ধান করছে, আল্লাহ পাক তাদেরকেও বুঝার ও সঠিক পথে চলার তাওফিক্ব দিন এবং তাঁদেরকে একথা ববুঝার সামর্থ্য দিন যে, ইসলাম ও মুসলমানদের এমন হিতাকাক্সক্ষী ইমামের বিরোধিতা করার জন্য কেউ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে আ’লা হযরতের অগণিত ভক্ত-অনুসারী ও প্রকৃত সুন্নী মুসলমানরা তা প্রতিহত করার জন্য সদা প্রস্তুত আছেন। কারণ, আ’লা হযরতের উপস্থাপিত আদর্শ ইসলামের প্রকৃত আদর্শ, সেটাই আহলে সুন্নাতের সঠিক মতাদর্শ ও শিক্ষা।