আল কুরআনের আলোকে মাযহাব  অনুসরণ ওয়াজিব হওয়ার দলিল

আল কুরআনের আলোকে মাযহাব অনুসরণ ওয়াজিব হওয়ার দলিল

মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি
অধ্যক্ষ, মাদরাসা -এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল
মধ্য হালিশহর, বন্দর, চট্টগ্রাম।

মহাগ্রন্থ আল কুরআনুল করীমের অসংখ্য আয়াত দ্বারা মাযহাব অনুসরণ অপরিহার্য হওয়ার ব্যাপারে প্রমাণ পাওয়া যায়। নিম্নে কয়েকটি আয়াতে করীমা পেশ করা হলোÑ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ،
Ñহে ঈমানদারগণ নির্দেশ মান্য করো আল্লাহর এবং নির্দেশ মান্য করো রসূলের আর তাদেরই যারা তোমাদের মধ্যে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত।
উল্লিখিত আয়াতে أُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ (উলীল আমরে মিনকুম) দ্বারা শরিয়তের হক্কানী আলেমেদ্বীন মুর্শিদে কামিল, মুজতাহিদ ইমাম, ইসলামী সুলতান (রাষ্ট্রপ্রধান) এবং ইসলামী বিচারকগণ এর আনুগত্য করা ওয়াজিব। এ আয়াত থেকে তাকলিদ তথা মাযহাবের ইমামের অনুসরণ অপরিহার্য।
اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ، صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ.
Ñআমাদেরকে সোজা পথে পরিচালিত করো, তাদেরই পথে যাঁদের উপর তুমি অনুগ্রহ করেছো।
আয়াতে বর্ণিত সিরাতাল মুস্তাকিম দ্বারা ইসলাম কুরআন মজীদ, প্রিয়নবী হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জীবনাদর্শ, আহলে বায়তে রসূল, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈ, তবে তাবেঈ, সালেহীন, আউলিয়ায়ে কামেলীন, মুজতাহিদ ইমামগণের অনুসৃত পথ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের বৃহত্তম জামাআতকে বুঝানো হয়েছে। সোজা পথ বলতে সকল মুফাস্সির, মুহাদ্দিস, ফকীহ্, গাউস কুতুব, আবদাল ও অলী আল্লাহর অনুসৃত পথকে বুঝানো হয়েছে। তাঁরা সকলেই ছিলেন, মুকাল্লিদ তথা মাযহাবের অনুসারী, মাযহাব মান্য করা এ আয়াতের নির্দেশ মান্য করার নামান্তর।
কুরআনুল করীমের নিম্নোক্ত আয়াতেও মুজতাহিদ ইমামগণের তাকলিদ তথা অনুসরণের ইঙ্গিত রয়েছে। সমস্যা সমাধানে তাঁদের পথ নির্দেশ (এঁরফব ষরহব) উম্মতের জন্য দিশারীর ভূমিকা পালন করবে। এরশাদ হয়েছেÑ
وَإِذَا جَاءَهُمْ أَمْرٌ مِنَ الْأَمْنِ أَوِ الْخَوْفِ أَذَاعُوا بِهِ وَلَوْ رَدُّوهُ إِلَى الرَّسُولِ وَإِلَى أُولِي الْأَمْرِ مِنْهُمْ لَعَلِمَهُ الَّذِينَ يَسْتَنْبِطُونَهُ مِنْهُمْ،
অর্থ যখন তাঁদের কাছে আসে কোন নিরাপত্তার বিষয় অথবা কোন ভয়ভীতির বিষয় তখন তাঁরা তা প্রচার করে। যদি তাঁরা তা রাসূল ও তাঁদের মধ্যকার নেতৃস্থানীয় আলিম (ওলীল আমর) দের নিকট উপস্থিত করত তবে নিশ্চয় তাঁদের নিকট থেকে সেটার বাস্তবতা জানতে পারতো।
বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন,
فَثَبَتَ أَنَّ الِاسْتِنْبَاطَ حُجَّةٌ، وَالْقِيَاسُ إِمَّا اسْتِنْبَاطٌ أَوْ دَاخِلٌ فِيهِ، فَوَجَبَ أَنْ يَكُونَ حُجَّةً. إِذَا ثَبَتَ هَذَا فَنَقُولُ: الْآيَةُ دَالَّةٌ عَلَى أُمُورٍ: أَحَدُهَا: أَنَّ فِي أَحْكَامِ الْحَوَادِثِ مَا لَا يُعْرَفُ بِالنَّصِّ بَلْ بِالِاسْتِنْبَاطِ. وَثَانِيهَا: أَنَّ الِاسْتِنْبَاطَ حُجَّةٌ. وَثَالِثُهَا: أَنَّ الْعَامِّيَّ يَجِبُ عَلَيْهِ تَقْلِيدُ الْعُلَمَاءِ فِي أَحْكَامِ الْحَوَادِثِ.
অর্থ প্রমাণিত হলো যে, মুজতাহিদ কর্তৃক ফিকহী হুকুম উদ্ঘাটন ও উদ্ভাবিত হুকুম শরীয়তের স্বীকৃত দলিল। আর কিয়াসের বিষয়টি ইজতিহাদের সমার্থক কিংবা অন্তর্ভুক্ত বিধায় কিয়াস ও শরিয়তের দলিল।
বর্ণিত আয়াতে কয়েকটি বিষয় প্রমাণিত। প্রথমত- কুরআন হাদীসের দলিলের প্রত্যক্ষভাবে কোন বিষয় জানা না গেলে ইজতিহাদের দ্বারস্থ হওয়া। দ্বিতীয়ত: ইজতিহাদ তথা মুজতাহিদ ইমামগণের উদ্ঘাটিত সমাধান শরিয়তের দলিল, তৃতীয়ত উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে মুজতাহিদ, ইমাম ব্যক্তিগণ মুজতাহিদ, ইমামগণের তাকলিদ করা অপরিহার্য। সূরা তাওবার নিম্নোক্ত আয়াত তাকলিদ তথা মাযহাব অনুসরণের অপরিহার্যতা প্রমাণ করে। এরশাদ হয়েছে-
فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ،
অর্থ অতঃপর কেন বের হয় না প্রত্যেক বড় দল থেকে একটি ছোট দল (طائفة) যেন তারা দ্বীনের আহকাম সম্বন্ধে গভীর প্রজ্ঞা অর্জন করতে পারে যখন তারা নিজ স¤প্রদায়ের কাছে ফিরে আসে যে তখন তাঁদেরকে সতর্ক করতে পারে এ আশায় যে তারা সতর্ক হবে।
আয়াতে বর্ণিত طَائِفَةٌ (ছোট দল) হচ্ছে اُوْلِىْ الْاَبْصَارِ বা চিন্তাশীল ব্যক্তিরা, যাঁদের উপর আল্লাহ্ আহকাম উদ্ভাবনের দায়িত্ব ন্যস্ত করেছেন। ইসলামী শরিয়তের মুজতাহিদ ইমাম কর্তৃক শরয়ী মাসআলা তথা আহকাম উদ্ঘাটন ও বের করার ব্যবস্থা এজন্য করা হয়েছে যে, যেন ইসলামী শরীয়ত সর্বযুগে সর্বকালে সর্বাবস্থায় পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত থাকে যেন মুসলমানদের সমস্যা সমাধানে পৃথিবীর অন্য কোন মতবাদের দ্বারস্থ বা মুখাপেক্ষী হতে না হয়।
মুজতাহিদ ইমামগণ মুহাজির, আনসার সাহাবীদের অনুসারী। মাযহাবের ইমামগণের তাকলিদ তথা অনুসরণে সাহাবীদের অনুসরণ নিহিত। এরশাদ হয়েছে-
وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ،
Ñএবং সবার মধ্যে অনুগামী প্রথম মুহাজির ও আনসার আর যারা সৎকর্মের সাথে তাদের অনুসারী হয়েছে আল্লাহ্ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট।
আয়াত থেকে প্রমাণিত হলো আল্লাহ্ তা‘আলা তিন শ্রেণির বান্দার উপর সন্তুষ্ট। যথাÑ ১. মুহাজির; ২. আনসার ও ৩. মুহাজির আনসার সাহাবীদের অনুসরণকারী মুসলমানগণ।
মুজতাহিদ ইমাম তথা তাকলিদ বা মাযহাব মান্যকারী মুসলমানগণ এ আয়াতের অন্তর্গত। যারা তাকলীদে তথা মাযহাবে বিশ্বাস করে না, মাযহাবের সম্মানিত মুজতাহিদ ইমামগণের প্রতি কটূক্তি ও সমালোচনায় লিপ্ত, মাযহাব অনুসরণ করাকে গুনাহ্ ও শিরক বলে আক্বিদা পোষণ করে তারা এ আয়াতের বাইরে। তারা অভিশপ্ত, ঘৃণিত। আয়াত থেকে আরো প্রমাণ হলো যারা মুহাজির ও আনসার সাহাবাদের তাকলীদ করেন, (অনুসরণ) তাঁদের প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্টি রয়েছে। এ কারণে পৃথিবীতে দিন দিন মাযহাব অনুসারীগণের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আলিমগণ হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী, হাম্বলী চারটি প্রসিদ্ধ মাযহাবের যে কোন একটি মাযহাবের অনুসরণ করাকে অপরিহার্য মনে করে থাকেন।
শরয়ী জ্ঞানে অভিজ্ঞ আলিমদের শরণাপন্ন হয়ে অজানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা, অস্পষ্ট বিষয়ে সঠিক ধারণা লাভের ব্যাপারে আল্লাহ্ পাকের নির্দেশ রয়েছে। এরশাদ হয়েছেÑ
فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ،
Ñজ্ঞানবানদের কে জিজ্ঞাসা করো, যদি তোমাদের জ্ঞান না থাকে। এ আয়াত দ্বারা মাযহাবের ইমামের তাকলিদ করা ওয়াজিব করা হয়েছে।
—০—

Share:

Leave Your Comment