তরুণদের মন-মননে গেঁথে দিতে হবে বিজয়ের প্রকৃত ইতিহাস ও গৌরবগাথা

তরুণদের মন-মননে গেঁথে দিতে হবে বিজয়ের প্রকৃত ইতিহাস ও গৌরবগাথা

মুহাম্মদ আনোয়ার শাহাদাত>

পৃথিবীর ইতিহাসে যে সব দেশ যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। বাঙালি জাতির এই ত্যাগ ও বীরত্বগাথা যুগে যুগে মুক্তিকামি মানুষের জন্য এক অনন্য প্রেরণা ও সাহসের প্রতীক হয়ে থাকবে। ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাসের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীন হয়েছি, বিজয় ছিনিয়ে এনেছি পাকিস্তানি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে। তাই ডিসেম্বর বাঙালি জাতির জন্য এক গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিময় মাস। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের মহান বিজয় দিবস। লক্ষ শহীদ, অগণিত মা-বোনের ইজ্জত আর এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই অমূল্য বিজয়। এ কারনে ডিসেম্বর আসলে আমাদের মন-মননে জেগে উঠে বিজয়ের আনন্দ হিল্লোল। শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হয় মুক্তির অনুরণন। একদিকে পাওয়ার অনাবিল আনন্দ, অপর দিকে হানাদারদের নারকীয় তান্ডব আর বিয়োগ-বেদনার অসহনীয় যন্ত্রণার ক্যানভাস ভেসে উঠে স্মৃতিপটে।

ডিসেম্বর মাস আসলেই দেশব্যাপী শুরু হয় বিজয়ের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও বাঙালি জাতির রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বীরত্বগাথা আর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর অত্যাচার, নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের লোমহর্ষক ইতিহাসের স্মৃতিচারণ। বিশেষ করে ১৬ ডিসেম্বর সারাদেশে মহা ধুমধামের সাথে উদযাপন করা হয় মহান বিজয় দিবস। লাল-সবুজের পতাকাকে আপন করে পাওয়ার ইতিহাস উচ্চারিত হয় সবখানে, তুলে ধরা হয় দীর্ঘ নয়মাসের প্রাণপন লড়াইয়ের গা শিওরে উঠা সেই মুক্তিযুদ্ধের কথা, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কথা। মানব ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার নিষ্ঠুর ও বর্বরতম সময়ের কথা বার-বার ভেসে উঠে, যে চেতনাকে ধারণ করে সেদিন দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা এক অসম যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাদের সেই স্বপ্নের কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে, তাদের মন-মননে সাজানো স্বপ্নীল প্রত্যাশাগুলো প্রকৃত ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে কিনা তার একটি নস্টালজিক প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে এই বিশেষ দিনে। নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা হয় স্বাধীন বাংলাদেশ জন্মের ইতিহাস এবং এর পেছনে দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগের কথা। যাতে নতুন প্রজন্ম জানতে পারে প্রিয় মাতৃভূমির প্রকৃত ইতিহাস। পূর্ব পাকিস্তান থেকে কীভাবে ‘বাংলাদেশ’ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে সেই সংগ্রামী ইতিহাস বার-বার ধ্বনিত হয় বিজয় দিবসে। তরুণ প্রজন্মের অন্তরে দেশের স্বাধীনতা ও বিজয়ের রক্তাক্ত ইতিহাস গেঁথে দেয়ার জন্য বিজয় দিবসের বিভিন্ন আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, তারা জন্ম থেকে স্বাধীন দেশের নাগরিক তাই স্বাধীনতা সংগ্রামের পেছনের ইতিহাস, পাকিস্তান কর্তৃক ইতিহাসের নৃশংস গণহত্যা, লক্ষ শহীদদের কথা, পঙ্গু হয়ে বেঁচে থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কথা, স্বাধীনতা সংগ্রামকে সফল করার কুশীলবদের কথা, বাংলার সর্বস্তরের মানুষের আত্মত্যাগ, যুদ্ধে সর্বস্ব হারানো বীরাঙ্গনাদের কথা তাদের জানা নেই। যতটুকু জানে বা জানবে তা বাপ-দাদা, জীবিত কোন মুক্তিযোদ্ধা কিংবা মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বই-পুস্তক, প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, বিভিন্ন আলোচনা কিংবা সেমিনার থেকে। কিন্তু কথা হচ্ছে যেখান থেকে আমাদের তরুণ প্রজন্ম বিজয়ের ইতিহাস জানছে বা জানবে তা কতটুকু নিখাদ-খাটি বা প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত ভিত্তিক? নানামাত্রিক ব্যাখ্যা আর সত্য-মিথ্যা মেশানো ইতিহাস আর পরিবেশনা থেকে আমাদের প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ কিংবা বিজয়ের প্রকৃত ইতিহাস কতটুকু জানতে পারছে এবং হৃদয়ে ধারণ করছে সেটা ভাববার বিষয়। বর্তমান তরুণরা এমনিতেই প্রযুক্তির নেশায় বুদ হয়ে বিভিন্ন বৈদেশিক সংস্কৃতিতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নামে ‘সেলফি এবং টিকটক’ প্রজন্ম হয়ে বড় হচ্ছে। জ্ঞানচর্চা, ইতিহাস চর্চা কিংবা বই পড়ার পরিবর্তে বিভিন্ন ডিভাইস নিয়ে সময় কাটাচ্ছে বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী। তারা আজ ভার্চুয়াল জগতের বাসিন্দা। একটা ভালো বই পড়া, ইতিহাস অনিসন্ধিৎসু পাঠক হওয়া, সমাজের অসঙ্গতি নিয়ে প্রশ্ন করা, মননশীলতার চর্চা করা যেন একেবারেই কমে গেছে। আমাদের নতুন প্রজন্মের কতজনের কাছে ’চিলকোঠার সেপাই’ ‘একাত্তরের ডায়েরি’, ‘একাত্তরের দিনগুলি’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ অথবা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীর’ মতো ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসনির্ভর বইগুলো পরিচিত বা কতজনই এসব পড়েছে বা পড়ার তাগিদ বোধ করে? অথচ ৫২,৬২, ৬৬,৬৯, ৭১ এবং স্বাধীনতা পরবর্তী ৯০ এর গণঅভ্যুত্থান সহ সকল আন্দোলন সংগ্রামে আমাদের ছাত্রসমাজ তথা তরুণদের অংশগ্রহন ও ত্যাগ ছিল উল্লেখ করার মতো। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি ধ্রুবসত্য ইতিহাসকে ব্যক্তি কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থে বিভিন্ন ব্যাখ্যায় একপেশে এবং অনেক সময় মিথ্যা-বানোয়াট কাহিনী দিয়ে উপস্থাপন করা হচ্ছে নতুন প্রজন্মের কাছে। তাই একেক জনের লেখায় বা আলোচনায় একেক ধরনের বর্ণনা শুনে আমাদের প্রজন্ম আজ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্তিতে ভুগছে যা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সময়ের বিবর্তনে সত্য ইতিহাস বিকৃত হতে হতে একসময় একটি সাধারণ ও আবেগহীন ইতিহাসে পরিণত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস নিয়ে সমস্ত লেখনী হওয়া উচিত ছিল নিরেট সত্য ও সঠিক তথ্য-উপাত্ত ভিত্তিক। অথচ এই জায়গাটিতে পর্যন্ত আমরা নিরপেক্ষতা ও মৌলিকত্ব অক্ষুণœ রাখতে পারিনি। যে যার মতো করে বিজয়ের ইতিহাস রচনা করছি। সুযোগ পেলেই মুক্তিযোদ্বাকে রাজাকার আর রাজাকারকে মুক্তিযুদ্বা হিসেবে তালিকাভুক্তি করছি। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমাদের জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা, মুক্তিযুদ্ধকালীন নেতৃত্ব দেয়া বিভিন্ন বাহিনীর অবসরপ্রাপÍ পদস্থ কর্মকর্তাগণ, রাজনীতিবিদ, ইতিহাবিদ, গবেষক, লেখক, কবি সহ সুশীল সমাজের ব্যক্তিবগ অনেক ক্ষেত্রেই পক্ষপাতদুষ্ট। যার কারনে আমাদের ইতিহাস বলুন, গবেষণা বলুন কিংবা কবিতা-উপন্যাস বলুন প্রায় সবক্ষেত্রে দেখবেন এক ধরনের পক্ষপাদমূলক আচরণ এবং একটি বিশেষ দল বা গোষ্ঠীকে খুশি করায় ব্যস্ত। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের মহানায়ক, বাংলাদেশের মহান স্থপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তুলনা যেমন কারো সাথে হওয়ার নয় তেমনি একজন সাধারণ গ্রাম্য মুক্তিযোদ্ধার অবদানকেও হেয় করে দেখার কোন সুযোগ নেই। সকলের ঐকান্তিক ও মরণপন যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এই বিজয় কারো একার নয়। তাই ইতিহাসটাও সেভাবে তুলে ধরা উচিত আমাদের তরুণ ও নতুন প্রজন্মের সামনে। যাতে তারা প্রিয় বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারে এবং এই বিজয়ের মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজকে আমাদের বিজয় দিবস উদযাপন বলুন বা অন্যসব জাতীয় দিবস বলুন, সব যেন অনুষ্ঠাননির্ভর হয়ে পড়েছে। সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা কিংবা লাল-সবুজ পাঞ্জাবি, বর্ণমালা খচিত শাড়ি কিংবা টিশার্ট পড়ে ফুলের তোড়া বা মালা নিয়ে শহীদ মিনারে গেলেই বোধহয় অমাদের সকল দায়িত্ব-কর্তব্য শেষ! অথচ এই লাল-সবুজের পতাকা নিজেদের করে পেতে কতলক্ষ প্রাণ আর স্বপ্নের বলিদান দিতে হয়েছে সেই মর্মবেদনা কি এই প্রজন্মু উপলব্ধি করে বা আমরা তাদের মননে এই উপলব্ধি কি গেঁথে দিতে পেরেছি? বিজয়ের এত বছর পর এসেও আজকে অনেক তরুণ-যুবক আমাদের জাতীয় দিবস সম্পর্কে পরিপূর্ণ অবগত নয়। কোনটি স্বাধীনতা দিবস, কোনটি শহীদ দিবস বা কোনটি বিজয় দিবস এবং এগুলোর তাৎপর্যই বা কী সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও গভীর কোন ধারণা নেই। এটি কিন্তু তাদের একক ব্যর্থতা নয়। এটির ব্যর্থতা আমাদের নীতি নির্ধারক, শিক্ষাব্যবস্থা, পক্ষপাতদুষ্ট ঐতিহাসিক বা লেখক, স্বাধীনতা সংগ্রাম কিংবা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিভক্তি ও হীনরাজনীতি, লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি, ছাত্রসমাজকে রাজনীতির নামে বিভিন্ন অন্যায্য ও অপরাধমূলক কর্মকান্ডে ব্যবহার করা, প্রযুক্তির প্রতি অনৈতিক অত্যাসক্তি এবং সর্বোপরি আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট।

আমাদের নৈতিকতাহীন রাজনীতি আর ক্ষমতালিপ্সু নেতৃত্বের কারনে ম্লান হচ্ছে আমাদের বিজয়ের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস এবং আমাদের তরুণ প্রজন্ম বড় হচ্ছে একটি জগাখিচুড়ি মার্কা মতাদর্শের বলয়ে। আমাদের তরুণ-যুবকরা যখন সব সময় দেখে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ, মারামারি, খুন, গুম, চুরি, ছিনতাই, ধর্ষণ, হল দখল এবং সর্বোপরি যখন নিজেদের ভোটাধিকার পর্যন্ত প্রয়োগ করার সুযোগ পায় না তখন তাদের কাছে বিজয়ের এই গৌরবমাখা ইতিহাসও বিরাট প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গ করা শহীদদের রক্ত যেন বৃথা না যায়, প্রিয় মাতৃভূমি যেন আর কোন অপশক্তির হাতে শোষিত না হয়, দীর্ঘ সংগ্রাম আর ত্যাগের ইতিহাস যেন বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে না যায়, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য সাহসীকতা আর বীরত্বগাথা ধারণ করে আমাদের তরুণ প্রজন্ম যেন একটি দূর্নীতি মুক্ত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে কাজ করতে পারে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম যেন বিজয়ের অমূল্য মর্মবাণী উপলব্ধি পূর্বক দেশমাতৃকার জন্য সর্বদা সর্বস্ব ত্যাগে প্রস্তুত থাকে সেই শিক্ষা তাদের অন্তরে গেঁথে দিতে হবে। তবেই বাংলাদেশ পাবে উপযুক্ত দেশপ্রেমিক তারুণ্য যারা মাতৃভূমির সার্বভৌমত্ব অক্ষণœ রাখতে সর্বদা প্রস্তুত থাকবে এবং বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশকে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ হিসেব দাঁড় করাতে সক্ষম হবে।

লেখক : প্রবাসী প্রাবন্ধিক, সৌদি আরব।