ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় অপচয়ের ক্ষতিকর প্রভাব একটি পর্যালোচনা

ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় অপচয়ের ক্ষতিকর প্রভাব একটি পর্যালোচনা

মাওলানা মুহাম্মদ মুনিরুল হাছান >

আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদেরকে অসংখ্য নিয়ামত দান করেছেন। ধনসম্পদ, সুস্থতা, পরিবার-পরিজন, ছেলে-মেয়ে আরো কতকিছু। মানুষের পার্থিব জীবন পরিচালনার জন্য সম্পদের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। ইসলামে সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে বৈধ পন্থা অবলম্বনের সাথে সাথে সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারিতা, অপচয় ও অপব্যবহারকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সম্পদের সঠিক ও যথার্থ ব্যবহার না করে অপাত্রে খরচ করলে বা অপব্যবহার করলে আল্লাহর দেওয়া নিয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, لَىِٕنْ شَكَرْتُمْ لَاَزِیْدَنَّكُمْ وَ لَىِٕنْ كَفَرْتُمْ اِنَّ عَذَابِیْ لَشَدِیْدٌ
যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর তবে তোমাদেরকে আরও দেব এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও, তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর। (সূরা ইবরাহীম-৭)
অপচয় ও অপব্যবহারের কারণে আয় উপার্জনে বরকত উঠে যায়। বরকত হলো কোন বিষয়ে অফুরন্ত বৃদ্ধি, আশাতীত প্রাচুর্য এবং আল্লাহ প্রদত্ত সৌভাগ্যকেই বুঝানো হয়। প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা (খাওয়ার সময়) বিসমিল্লাহ বলে এবং আল্লাহর বরকত প্রার্থনা করে আহার করো।(হাকেম, মুসতাদরাক-৭০৮৪)
যখনই বরকত উঠে যায় তখনই দেখা দেয় অভাব-অনটন, খাদ্য ঘাটতি, সামাজিক অস্থিরতা, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি। দু’বেলা আহার যোগাড় করতে কেউ দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে। আর কেউ অত্যধিক সম্পদের মালিক হয়ে ভোগবিলাসে মত্ত থাকে। ধণিদের সম্পদে আল্লাহ তাআলা গরিবের হক রেখছেন। গরিবের অংশ তাদেরকে দিয়ে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কিছু মানুষ আছে যারা প্রয়োজনীয় খরচ না করে কৃপণতা অবলম্বন করে। কৃপণতা আখলাকে যামিমাহ বা মন্দ স্বভাবের অন্তর্ভুক্ত। হাদীসের ভাষায় কৃপণ ব্যক্তি আল্লাহর রহমত থেকে দূরে বরং জাহান্নামের নিকটবর্তী। আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে মানুষের বিচরণ ও জীবন ধারণের কর্মপদ্ধতি বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। সাথে সাথে সম্পদের অপচয় ও অপব্যবহারও বেড়েছে। অথচ অপচয় ইসলামে স্পষ্ট হারাম।

অপচয় কী
পৃথিবীতে বহু মানুষের যদিও সম্পদের অভাব রয়েছে। তথাপি অনেক লোক অপচয় করে থাকে। মূল্যবান সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের ব্যর্থতাকে অপচয় বলা হয়ে থাকে। অপচয় বলতে শুধুমাত্র সম্পদের অপচয় উদ্দেশ্য নয় বরং সময়, কথা, বিদ্যুৎ,গ্যাস ও পানির ন্যায় জাতীয় সম্পদ অপচয়ও বুঝানো হয়। উপার্জনের পদ্ধতি অনেক ক্ষেত্রে কষ্টকর বিষয় হলেও খরচের ক্ষেত্রে মানুষ অনেকটা স্বাধীন। ভোগবাদি মনোভাব, বিলাসীতা, অসৎ বন্ধুর সংস্পর্শ, খ্যাতিলাভের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মগ্ন হয়ে মানুষ অপচয়ে লিপ্ত হয়ে পড়ে। অপচয় অর্থ হলো ক্ষতি, হ্রাস ইত্যাদি। অপচয় এর আরবি প্রতিশব্দ হলো الاسراف (আল ইসরাফ)। ইসরাফ এর আভিধানিক অর্থ হলো সীমালঙ্ঘন করা, অপচয় করা, অমিতব্যয় করা,অযথা খরচ করা,বাড়াবাড়ি করা ইত্যাদি। ইসরাফ বা অপচয় হলো কোনো বস্তুকে তার প্রকৃত স্থানে না রাখা। ভাষাতত্ত্ববীদগণ ‘ইসরাফ’ শব্দকে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ও খাবার অপচয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা বলেন, যে ব্যক্তি অনর্থক কাজে এক দিরহামও খরচ করল সেটাই অপচয়। (ইমাম কুরতুবী, আল জামে লি আহকামুল কুরআন, ১৩/৭৩)। পরিভাষায় ইসরাফ বলা হয়, আল্লাহ তাআলার আনুগত্যের বাইরে গিয়ে নিষিদ্ধ পথে খরচ করা, সেটা পরিমাণে অল্প হোক বা বেশি হোক।
(ইবনে মনজুর, লিসানুল আরব) আল্লামা শরীফ জুরজানী (৭৪০-৮১৬ হিঃ)
‘ইসরাফ’ এর সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে, ইসরাফ হলো কোন হীন উদ্দেশ্যে প্রচুর অর্থ-সম্পদ ব্যয় করা এবং ব্যয়ের ক্ষেত্রে সীমা লঙ্ঘন করা। কেউ কেউ বলেন, কোন ব্যক্তির অবৈধ বস্তু ভক্ষণ করা বা হালাল খাবার থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত আহার করা। (ইমাম জুরজানী, কিতাবুত তারিফাত- ৩৮)
কুরআন মজিদে মহান আল্লাহ বলেন, وَكُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ وَلَا تُسۡرِفُوٓاْۚ إِنَّهُۥ لَا يُحِبُّ ٱلۡمُسۡرِفِينَ- খাও এবং পান কর এবং অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদেরকে পছন্দ করেন না। (সূরা আল আ‘রাফ-৩১)
অপচয় একটি বহুমাত্রিক ধারণার বিষয়। ক্ষেত্র ও দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে অপচয়ের সংজ্ঞা ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। সম্পদ নষ্ট হলে একদিকে যেমন আল্লাহর দেয়া নিয়ামতের প্রতি যেভাবে অকৃতজ্ঞতা হয়, তেমনি আমাদের পার্থিব জীবনের অবলম্বনও নষ্ট হয়। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত, وَلَا تُسۡرِفُوٓاْۚ (সূরা আরাফ-৩১)
আয়াতে “তোমরা অপচয় করিও না” এর ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণ বলেন, তোমরা পবিত্র জিনিসকে হারাম মনে করিও না। (মুআলিমুত তানজিল)
হযরত উমর রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু বলেন, ‘তোমরা বেশি পানাহার থেকে বেঁচে থাক। কেননা অতিরিক্ত পানাহার শরীরের জন্য ক্ষতিকর, অকর্মন্যতা আনয়নকারী ও সালাত থেকে অলসকারী। তোমরা পানাহারের ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর। কেননা পরিমিত পানাহার সুস্থতার পক্ষে উপকারী এবং অপচয় থেকে দূরবর্তী। (রুহুল মা’আনি)

১. আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা: ‘ ইসরাফ’ আল্লাহ তাআলার সাথে শরীক করার অর্থেও ব্যবহার হয়ে থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
لَا جَرَمَ اَنَّمَا تَدۡعُوۡنَنِیۡۤ اِلَیۡهِ لَیۡسَ لَهٗ دَعۡوَۃٌ فِی الدُّنۡیَا وَ لَا فِی الۡاٰخِرَۃِ وَ اَنَّ مَرَدَّنَاۤ اِلَی اللّٰهِ وَ اَنَّ الۡمُسۡرِفِیۡنَ هُمۡ اَصۡحٰبُ النَّارِ
নিঃসন্দেহ যে, তোমরা আমাকে যার দিকে ডাকছ, সে দুনিয়া ও আখিরাতে কোথাও ডাকের যোগ্য নয়। আর আমাদের ফিরে যাওয়া তো আল্লাহর দিকে এবং নিশ্চয় সীমালঙ্ঘনকারীরা আগুনের অধিবাসী। (সূরা মুমিন- ৪৩)
২. গুনাহের কাজে জড়িত হওয়ার অর্থে: গুনাহের কাজে জড়িত হওয়াকে ইসরাফ বলা হয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
قُلۡ یٰعِبَادِیَ الَّذِیۡنَ اَسۡرَفُوۡا عَلٰۤی اَنۡفُسِهِمۡ لَا تَقۡنَطُوۡا مِنۡ رَّحۡمَۃِ اللّٰهِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ یَغۡفِرُ الذُّنُوۡبَ جَمِیۡعًا ؕ اِنَّهٗ هُوَ الۡغَفُوۡرُ الرَّحِیۡمُ
বলুন, হে আমার বান্দাগণ! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ; আল্লাহ্র অনুগ্রহ থেকে হতাশ হয়ো না, নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা যুমার-৫৩)

অপব্যয় কী
ইসলামে সম্পদের অপচয় বুঝাতে অপব্যয় শব্দটিও ব্যবহার করা হয়। অপব্যয় এর আরবি প্রতিশব্দ হলো التبذير (তাবজির) । ‘তাবজির’ এর অপর অর্থ অপব্যয়, বাজে খরচ, অমিত ব্যয়। বৈধকাজে প্রয়োজনের চাইতে অতিরিক্ত ব্যয় করার নাম অপচয়, আর অবৈধ কাজে অন্যায় ও অযৌক্তিক সম্পদ খরচ করাকে ‘অপব্যয়’ বলা হয়।
ইবনে আবেদীন রহমাতুল্লাহি আলায়হি (১১৯৮-১২৫২) বলেন, অপব্যয় বলতে ব্যপক অর্থে অপচয়কে বুঝানো হয়ে থাকে। তবে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। ইসরাফ হলো প্রয়োজনীয় কাজে অতিরিক্ত খরচ করা। আর তাবজির হলো অপ্রয়োজনীয় কাজে বা অপাত্রে খরচ করাকে বুঝায়।
পরিভাষায় তাবজির বলা হয়, সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার না করা এবং তা অনুচিত কাজে ব্যয় করা।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا، إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ ،
وَ کَانَ الشَّیۡطٰنُ لِرَبِّهٖ کَفُوۡرًا-
এবং কিছুতেই অপব্যয় করবে না, নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।
(বনি ইসরাইল: ২৬-২৭)
শয়তান যার সঙ্গী হয় সে যেকোন পাপ কাজে লিপ্ত হয়ে পড়তে পারে। এমনকি শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে লোভ লালসা, দুনিয়ার মোহ ইত্যাদি পাপে লিপ্ত হয়ে যায়। দিনে দিনে পাপের মাত্রা ভারী হয়ে একপর্যায়ে মানুষ কুফরী ও শিরক পর্যন্ত পৌঁছে যায়। (নাউজুবিল্লাহ)।

অপচয়ের কারণ
যেকোনো অর্থনীতির মেরুদন্ড হলো অপচয় রোধ ও অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণ। অপচয় ও অপব্যবহার মানুষকে পাপাচারি বানায়, দারিদ্রতার দিকে ধাবিত করে ও সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করে। সমাজে বিভিন্ন কারণে অপচয় সংঘটিত হয়ে থাকে।

১. খ্যাতি লাভের আকাক্সক্ষা
মানুষ অনেক সময় নিজের খ্যাতি প্রকাশ করতে গিয়ে অপচয় ও অপব্যয়ের দিকে ধাবিত হয়। যারা পার্থিব জীবনের যশখ্যাতিকে প্রাধান্য দেয় তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,
مَنۡ کَانَ یُرِیۡدُ الۡحَیٰوۃَ الدُّنۡیَا وَ زِیۡنَتَهَا نُوَفِّ اِلَیۡهِمۡ اَعۡمَالَهُمۡ فِیۡهَا وَ هُمۡ فِیۡهَا لَا یُبۡخَسُوۡنَ , اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ لَیۡسَ لَهُمۡ فِی الۡاٰخِرَۃِ اِلَّا النَّارُ ۫ۖ وَ حَبِطَ مَا صَنَعُوۡا فِیۡهَا وَ بٰطِلٌ مَّا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ
যে কেউ দুনিয়ার জীবন ও তার শোভা কামনা করে, দুনিয়াতে আমি তাদের কাজের পূর্ণ ফল দান করি এবং সেখানে তাদেরকে কম দেয়া হবে না। তাদের জন্য আখিরাতে আগুন ছাড়া অন্য কিছুই নেই এবং তারা যা করেছিল আখিরাতে তা নিস্ফল হবে। আর তারা যা করত তা ছিল নিরর্থক।
(সূরা হুদ: ১৫-১৬)
হযরত কা’ব ইবন মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দুটি ক্ষুধার্ত নেকড়েকে একটি মেষপালের মধ্যে ছেড়ে দিলে নেকড়ে দুটি মেশপালের যে ক্ষতি করে, সম্পদ ও সম্মানের লোভ মানুষের দীনের তার চেয়েও বেশি ক্ষতি করে। (তিরমিযী- ৪/৫৮৮, কিতাবুয যুহদ)

অপচয় ও অপব্যয় রোধে করণীয়
১. মধ্যপন্থা অবলম্বন
মধ্যমপন্থা অবলম্বন সমাজে শান্তি ও সমৃদ্ধি বয়ে আনে। পক্ষান্তরে অপচয় ও অপব্যয় সমাজে নানা অশান্তি সৃষ্টি করে। রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, من فقه الرجل رفقه في معيشته ব্যয় করার ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তার লক্ষণ। (মুসনদে আহমাদ)
মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী আল্লাহ তায়ালার নিয়ামতের যথাযথ ব্যবহার করেন বলে অসংখ্য সওয়াবের অধিকারী হন। হযরত আবু উমামা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হে আদম সন্তান! তোমার প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদ যদি তুমি (সৎকাজে) খরচ করে ফেল তাহলে তা তোমার জন্য কি কল্যাণকর তুমি যদি তা গচ্ছিত রাখ তাহলে তা তোমার জন্য অকল্যাণকর। তোমার প্রয়োজন পরিমাণ সম্পদ জমা রাখলে তাতে কোন দোষারোপ করা হবে না। আর তোমার পোষ্যদের হতেই (দান-সাদকা) আরম্ভ কর। নীচের হাত হতে উপরের হাত উত্তম।
(তিরমিজি-২৩৪৩)

২. যশ বা খ্যাতি অর্জনের প্রতিযোগিতা থেকে বিরত থাকা
যশ-খ্যাতি অর্জনের লোভ, অহংকার প্রদর্শনের কারণে অপচয় ও অপব্যয় হয়ে থাকে। এলক্ষ্যে ভালো কাজ করা হলেও আল্লাহর কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। লোকদেখানো ইবাদত, দান সাদকা সহ যেকোন পূণ্যময় কাজ কিয়ামতের দিন অন্তঃসারশূন্য হয়ে দাঁড়াবে। আল্লাহ তাআলা দানকারী বান্দাহদেরকে সতর্ক করে ইরশাদ করেছেন, হে ঈমানদার বান্দাহগণ, তোমরা তোমাদের দানের কথা প্রচার করে ও দান গ্রহীতাকে কষ্ট দিয়ে তোমাদের দানকে ওই ব্যক্তির মত নিস্ফল করো না, যে নিজের ধন থেকে লোক দেখানোর জন্য ব্যয় করে থাকে এবং আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে না। তার উপমা একটি মসৃন পাথর, যার ওপর কিছু মাটি থাকে। তারপর তার ওপর প্রবল বৃষ্টিপাত তাকে পরিস্কার করে রেখে দেয়। যা তারা উপার্জন করেছে তার কিছুই তারা তাদের কাজে লাগাতে পারবে না। আল্লাহ অবিশ্বাসী সম্প্রদায়কে সৎপথে পারিচালিত করেন না। (সূরা বাকারাহ- ২৬৪)
৩. জীবিকা অর্জনে সতর্কতা অবলম্বন করা ইবাদত কবুল হওয়ার প্রধান শর্ত হলো হালাল উপার্জন। হারাম বা অবৈধ উপার্জন সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য। সাধারণত বৈধ পন্থায় পরিশ্রমের মাধ্যমে উপার্জন করলে অপচয় ও অপব্যবহার কম হয়ে থাকে। হাদীসে রয়েছে,
وَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم كُلُوا وَاشْرَبُوا وَالْبَسُوا وَتَصَدَّقُوا فِي غَيْرِ إِسْرَافٍ وَلاَ مَخِيلَةٍ وَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ كُلْ مَا شِئْتَ وَالْبَسْ مَا شِئْتَ مَا أَخْطَأَتْكَ اثْنَتَانِ سَرَفٌ أَوْ مَخِيلَةٌ
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা খাও, পান কর, পরিধান কর এবং দান কর, কোন অপচয় ও অহঙ্কার না করে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেছেন, যা খুশি খাও, যা খুশি পরিধান কর, যতক্ষণ না দু’টো জিনিস তোমাকে বিভ্রান্ত করে- অপচয় ও অহঙ্কার।(সহীহ বুখারী-৫৭৮৩)

৪. সৎকাজেও অপচয় নিষিদ্ধ
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নদীতে বসে অযু করলেও তাতে অপচয় করতে নিষেধ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে সাহাবি আবদুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত সা’দ রাদিয়াল্লাহু আনহুর এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি অজু করছিলেন। রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
مَا هَذَا السَّرَفُ فَقَالَ: أَفِي الْوُضُوءِ إِسْرَافٌ، قَالَ: نَعَمْ، وَإِنْ كُنْتَ عَلَى نَهَرٍ جَارٍ.
অপচয় করছো কেন! সা’দ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বললেন, অজুতেও কি অপচয় হয়? রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ, প্রবাহমান নদীতে বসেও যদি তুমি অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করো তা অপচয়। (সুনানে ইবন মাজাহ-৪২৫)

৫. অতিরিক্ত আলোকসজ্জা পরিহার করা
বর্তমানে আমাদের সমাজে বিবাহের নামে গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান, জন্মদিন, পিকনিক, থার্টি ফার্স্ট নাইট ইত্যাদি অনুষ্ঠানের নামে বিজাতীয় সংস্কৃতির চর্চা হয়ে থাকে। এতে অপ্রয়োজনীয় আলোকসজ্জা করে বিদ্যুতের অপব্যাবহার করা হয়। ক্ষেত্র বিশেষে উচ্চ স্বরে বাদ্য-বাজনা করে, আতশবাজি ফুটানোর মাধ্যমে পরিবেশ ও শব্দ দূষণ তৈরি হয়। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় ২০২২ সালে আতশবাজির শব্দে ভয় পেয়ে হার্টের ছিদ্র নিয়ে জন্মগ্রহণ করা উমায়ের নামে এক শিশুর করুন মৃত্যু হয়েছিল। (দৈনিক কালের কণ্ঠ, ৫/১/২০২২)।
সুতরাং পরিবেশ ও জানমালের রক্ষার্থে এধরনের অপচয় থেকে দূরে থাকতে হবে।

৬. জাতীয় সম্পদ গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা
দৈনন্দিন জীবনের অন্যতম প্রয়োজনীয় সামগ্রী হলো গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি। জনজীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে বণ্টন করা হয়ে থাকে।
অনেক সময় বাসা-বাড়ি, ও অফিসে বিনা প্রয়োজনে বৈদ্যুতিক লাইট জ্বলতে থাকে। ক্ষুদ্র একটি মেসের কাঠি বাঁচবার জন্য দীর্ঘক্ষণ গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখে।
অন্যায় ভাবে গ্যাস ও বিদ্যুৎ চুরি করে অপব্যবহার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এত করে জাতীয় ব্যবস্থাপন বিপর্যয় দেখা দেয়। সুতরাং প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে লাইট, ফ্যান, গ্যাসের চুলা ইত্যাদির সুইস বন্ধ করতে হবে।

অপচয়ের পরিণতি
১. পরকালে অপচয়কৃত সম্পদের হিসাব দিতে হবে
যারা বেহিসেবি হয়ে অপচয় ও অপব্যয়ের মধ্যে লিপ্ত হয়ে পড়েন কিয়ামতের ময়দানে তাদেরকে আল্লাহ তাআলার কাছে জবাব দিতে হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
لاتَزُولُ قَدَمَا عَبْدٍ يَوْمَ القِيَامَةِ حَتّى يُسْأَلَ عَنْ عُمُرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ ، وَعَنْ عِلْمِهِ فِيمَ فَعَلَ ، وَعَنْ مَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ أَنْفَقَهُ ، وَعَنْ جِسْمِهِ فِيمَ أَبْلاَهُ.
কিয়ামতের দিন এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হওয়ার আগে কোনো বান্দার পা-ই নড়বে না-তার জীবন সে কীসে ব্যয় করেছে, তার ইলম অনুসারে সে কী আমল করেছে, তার সম্পদ সে কোত্থেকে উপার্জন করেছে এবং কোথায় ব্যয় করেছে আর তার শরীর কীসে নষ্ট করেছে? (জামে তিরমিযী-২৪১৬)
২. অপচয় নফসে আম্মারাকে জাগ্রত করে: মানুষের তিনটি প্রকারের নফস রয়েছে। তম্মধ্যে একটা হল “নাফসে আম্মারা” যেটি মানুষকে খারাপ কাজের দিকে ধাবিত করে বা প্ররোচনা দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَ اِذَا مَسَّ الۡاِنۡسَانَ الضُّرُّ دَعَانَا لِجَنۡۢبِهٖۤ اَوۡ قَاعِدًا اَوۡ قَآئِمًا ۚ فَلَمَّا کَشَفۡنَا عَنۡهُ ضُرَّهٗ مَرَّ کَاَنۡ لَّمۡ یَدۡعُنَاۤ اِلٰی ضُرٍّ مَّسَّهٗ ؕ کَذٰلِکَ زُیِّنَ لِلۡمُسۡرِفِیۡنَ مَا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ-
আর মানুষকে যখন দুঃখ-দৈন্য স্পর্শ করে তখন সে শুয়ে, বসে বা দাঁড়িয়ে আমাকে ডেকে থাকে অতঃপর আমি যখন তার দুঃখ-দৈন্য দূর করি, তখন সে এমনভাবে চলতে থাকে যেন তাকে দুঃখ-দৈন্য স্পর্শ করার পর তার জন্য সে আমাকে ডাকেইনি। এভাবেই সীমালংঘনকারীদের কাজ তাদের কাছে শোভনীয় করে দেয়া হয়েছে। (সূরা ইউনুস-১২)

৩. অপচয়কারী হেদায়েতের পথ থেকে দূরে চলে যায়:
আল্লাহ তাআলা অপচয়কারী কে হেদায়েত দান করেন না। ফলে অপচয়কারী সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন,
اِنَّ اللّٰهَ لَا یَهۡدِیۡ مَنۡ هُوَ مُسۡرِفٌ کَذَّابٌ- নিশ্চয় আল্লাহ্ তাকে হেদায়াত দেন না, যে সীমালংঘনকারী, মিথ্যাবাদী। (সূরা গাফের-২৮)
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, کَذٰلِکَ یُضِلُّ اللّٰهُ مَنۡ هُوَ مُسۡرِفٌ مُّرۡتَابُۨ
এভাবেই আল্লাহ যে সীমালঙ্ঘনকারী, সংশয়বাদী তাকে বিভ্রান্ত করেন। (সূরা গাফের-৩৪)

৪. অপচয়ের কারণে সম্পদ নষ্ট হয়
আল্লাহ তাআলা মানুষকে সম্পদ দিয়েছেন আমানত হিসেবে, মানুষ যদি তা নষ্ট করে বা অনর্থক খরচ করে তখন আল্লাহ তাআলা ক্রোধান্বিত হন। রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- إِنّ اللهَ كَرِهَ لَكُمْ ثَلاَثًا قِيلَ وَقَالَ وَإِضَاعَةَ الْمَالِ وَكَثْرَةَ السّؤَالِ.
আল্লাহ তোমাদের জন্যে তিনটি বিষয়কে অপছন্দ করেন- ১. অপ্রয়োজনীয় প্রসঙ্গে আলোচনা করা, ২. সম্পদ নষ্ট করা, ৩. অধিক প্রশ্ন করা।
(সহীহ বুখারী- ১৪৭৭)

৬. খাদ্য অপচয় দুর্ভিক্ষ ডেকে আনে
এক প্রকার মানুষের বিলাসিতা ও আভিজাত্য প্রদশর্নেচ্ছার কারণে প্রচুর খাবার অপচয় হয়। রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাবারের প্লেটে সামান্য পরিমাণ খাবারও নষ্ট হতে দিতেন না।
হযরত আনাস রাদিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোন খাদ্য খেতেন তখন তাঁর আঙ্গুল তিনটি চেটে খেতেন এবং তিনি বলেছেনঃ তোমাদের কারো লোকমা যদি মাটিতে পড়ে যায় তবে সে যেন তা হতে ময়লা দূর করে এবং খাবারটুকু খেয়ে ফেলে, তা যেন শয়তানের জন্য রেখে না দেয়। আর তিনি আমাদের প্লেট মুছে খেতে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, তোমরা জান না, তোমাদের খাবারের কোন অংশে কল্যাণ রয়েছে’। (সহীহ মুসলিম -২০৩৪)
দৈনন্দিন জীবনে অপচয় ও অপব্যয় হলো বৈধ কাজে অতিরঞ্জিত করা, প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার টেবিলে রাখা, রুটির সাইড বাদ দিয়ে শুধু মাঝখান থেকে খাওয়া, খাবারের লোকমা বা গ্রাস হাত থেকে পড়ে গেলে তা না উঠানো, বিনা প্রয়োজনে লাইট ফ্যান চালানো, আলোকসজ্জা করা,এসি ও ফ্যান একসাথে চালানো, ইত্যাদি। অনুরূপভাবে বিনাকাজে আড্ডা, গল্প গুজবে লিপ্ত হওয়া হলো সময়ের অপব্যবহার। অপচয় ও অপব্যয়ের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। পরিবার, সমাজ, ও রাষ্ট্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কাজেই অপচয় ও অপব্যবহার সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য। আমাদেরকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা ও তার প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদেশ নিষেধ মেনে চলতে হবে, অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগ্রত করতে হবে। তাহলেই পরকালে আমরা নাজাত পাবো।

লেখক: সিনিয়র শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা) চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল এন্ড কলেজ।