ইসলামের দৃষ্টিতে মুনাফিক্ব’র পরিচয়

ইসলামের দৃষ্টিতে মুনাফিক্ব’র পরিচয়

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি >

عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ عِنِ النَّبِىِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ اَيَةُ الْمُنَافِقِ ثَلَاثٌ اِذَا حَدَّثَ كَذَّبَ وَ اِذَا وَعَدَ اَخْلَفَ وَاِذَا اُتْمِنَ خَانَ -(رواه البخارى)
عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَصْلَتَانِ لَاتَجْتَمِعَانِ فِىْ مُنَافِقٍ حُسُنُ سَمَتٍ وَلَا فِقْهُ فِى الدِّيْنَ -(رواه الترمذى)
অনুবাদ: হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, মুনাফিক্বের চিহ্ন তিনটি, যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, যখন ওয়াদা করে ভঙ্গ করে, যখন তার কাছে আমানত রাখা হয় তা আত্মসাৎ করে বিশ^াসঘাতকতা করে। [বুখারী শরীফ: ১/৩৩]
হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, এমন দুটি গুণ আছে যা মুনাফিক্বের মধ্যে একত্র হতে পারে না। ১. উত্তম স্বভাব, ২. দ্বীনের সঠিক জ্ঞান। [তিরমিযী শরীফ, হাদীস: ২৬৮৫]

প্রাসঙ্গিক আলোচনা
বর্ণিত হাদীস শরীফদ্বয়ে মুনাফিক্বের পরিচিতি সম্পর্কে আলোকপাত হয়েছে। মুনাফিক্ব শব্দটি ‘নফকুন’ শব্দ থেকে গৃহীত। এর অর্থ মাটিতে গর্ত অথবা সুড়ঙ্গ পথ যাতে লুকিয়ে থাকা যায়, দ্বিমুখী স্বভাবের লোককে মুনাফিক্ব বলা হয়।
শরীয়তের পরিভাষায়: ভেতরে কুফরীকে গোপন রেখে বাহ্যিকভাবে ইসলামকে প্রকাশ করা মুসলমানদের সম্মুখে এক প্রকার কথা বলে কাফিরদের সম্মুখে ভিন্নরূপ কথা বলে।
মুনাফিক্বের অন্যতম পরিচয় হলো, তারা ইসলামের প্রতি প্রকাশ্যে আনুগত্য দেখাবে মুনাফিক্ব, অন্তরে ইসলামের প্রতি ঘৃণা লালন করে, মুনাফিক্বরা ইসলামের প্রধান শত্রু ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি সাধনে তারা কাফিরদের চেয়ে ভয়ানক ও মারাত্মক। মুনাফিক্বরা দ্বিমুখী চরিত্র ও স্বভাবের অধিকারী ইসলামের ইতিহাসে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুনাফিকদের দ্বিমুখী চরিত্র ও চক্রান্তের কারণেই ইসলাম সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
মুনাফিক্ব সর্দার আবদুল্লাহ্ ইবনে ওবাই ইবনে সালুল এর নানাবিধ চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের কারণে সে ও তার উত্তরসূরীরা অভিশপ্ত ও কলংকিত হয়ে আছে। মুনাফিক্বের দ্বিমুখী চরিত্র প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন-وَإِذَا لَقُواْ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا قَالُوْا اٰمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا إِلٰى شَيٰطِيْنِهِمْ قَالُوْا إِنَّا مَعَكُمْ إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِءُوْنَ-
অর্থ: যখন তারা মু’মিনগণের সংস্পর্শে আসে তখন বলে আমরা ঈমান এনেছি আর যখন তারা নিভৃতে তাদের শয়তানদের সাথে মিলিত হয় তখন বলে আমরা তোমাদের সঙ্গেই রয়েছি। আমরা শুধু তাদের সাথে ঠাট্টা তামাশা করে থাকি। [সূরা বাক্বারা, আয়াত-১৪]
মহাগ্রন্থ আল ক্বোরআনের সর্ববৃহৎ সূরা আল্ বাক্বারার ১৩টি আয়াতে মুনাফিক্বদের শটতা-কপটতা ও বৈশিষ্ট্য আলোকপাত হয়েছে।
এ ছাড়াও বিভিন্ন সূরায় মুনাফিক্বদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বর্ণনায় ৩৮টি আয়াতে তাদের চক্রান্ত, ভন্ডামী, দ্বিমুখী নীতি ও ভ্রান্ত আক্বিদা বিশ^াসের কথা আলোকপাত হয়েছে। মুনাফিক্বরা মুখে ইসলামে বিশ^াসী প্রকাশ করলেও অন্তরে আল্লাহ্ ও তদীয় রসূলের প্রতি অবিশ^াস ও বিদ্বেষ লালন করে থাকে। মুনাফিক্বরা বাহ্যিকভাবে ইসলামের বেশভূষা ধারণ করে নিজেদেরকে মুসলিম হিসেবে প্রকাশ করলেও তাদের ব্যবহারিক জীবনের চালচলন, আচার-আচরণ, লেনদেন, কথাবার্তা, আক্বিদা-বিশ^াস তাদের মুনাফিক্বী চরিত্র প্রকাশ পেয়ে থাকে। তাদের পরিচয়ের সুস্পষ্ট আলামত ও লক্ষণ বর্ণিত হাদীসে বিঘোষিত হয়েছে।
মুনাফিক্বরা দ্বীনের সঠিক জ্ঞান, ক্বোরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামের সঠিক রূপরেখা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের আক্বিদা বিশ^াস তথা ইসলামের মূলধারা সম্পর্কিত সঠিক ইসলামী আক্বিদা থেকে তারা বঞ্চিত হবে। তারা ধর্মীয় জ্ঞানে জ্ঞানী ও পারদর্শী হলেও দ্বীনের মর্মকথা রাসূলুল্লাহ্র সুমহান শান-মর্যাদা অনুধাবনে তারা ব্যর্থ হবে। ইসলামের বিকৃতি ও অপব্যাখ্যার মাধ্যমে সরল প্রাণ মুসলিম জনসাধারণকে পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত করবে। উপরন্তু উত্তম আদর্শ ও চরিত্র থেকে তারা বঞ্চিত হবে। সত্যের মাপকাঠি সাহাবায়ে কেরামের দোষত্রুটি অনুসন্ধানে তারা ব্যস্ত থাকে।

দ্বিমুখী চরিত্রে মুনাফিক্বের দৃষ্টান্ত
মুনাফিক্বদের মধ্যে স্থিতিশীলতা নেই, নীতি আদর্শের প্রতি তার আস্থা নেই। মুনাফিক্ব সুযোগ সন্ধানী, সুবিধাভোগী। ন্যায়-নীতির প্রতি অটল, অবিচলতা তার স্বভাব বিরুদ্ধ। সে ভালো-মন্দের মধ্যে পার্থক্য বিধান করে না। সত্য ও অসত্য উভয় পক্ষের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে অভ্যস্থ। সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা হিসেবে মানতে ও জানতে স্বীকার করতে মুনাফিক্ব অভ্যস্থ নয়। তার দিমুখী চরিত্র সম্পর্কে হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
عَنِ ابْنِ عُمَرَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ “‏ مَثَلُ الْمُنَافِقِ كَمَثَلِ الشَّاةِ الْعَائِرَةِ بَيْنَ الْغَنَمَيْنِ تَعِيرُ إِلَى هَذِهِ مَرَّةً وَإِلَى هَذِهِ مَرَّةً- (رواه مسلم)
অর্থ: হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, মুনাফিক্বের দৃষ্টান্ত হলো, দুটি ছাগলের মাঝে একটি বানডাকা বকরীর মতো, যে একবার এই পালের দিকে ছুটে যায় আরেকবার অন্য পালের দিকে দৌঁড়ায়।
[মুসিলম শরীফ: হাদীস নং -২৭৮৪]
نِيَّةُ الْمُؤْمِنِ خَيْرٌ مِنْ عَمَلِه وَعَمَلُ الْمُنَافِقِ خَيْرٌ مِنْ نِيَّتِه وَكُلٌّ يَعْمَلُ على نِيَّتِهِ فَاِذَا عَمِلَ الْمُؤْمِنٌ عَمَلًا فَارَ فِىْ قَلْبِهِ نُوْرٌ- (المعجم الكبير للطبران)
অর্থ: মু’মিনের নিয়্যত (মনের ইচ্ছা) তার কাজের চেয়ে উত্তম। মুনাফিক্বের কাজ তার নিয়্যতের চেয়েও উত্তম, প্রত্যেকে নিজ নিজ নিয়্যত অনুযায়ী কাজ করে। মু’মিন যখন কোনো কাজ করে তখন তার অন্তরে এক ধরনের নূর জ্যোতি প্রজ্জ্বলিত হয়। [তাবরানী কাবীর, হাদীস: ৫৯৪২]

মুনাফিক্বের নয়টি আলামত
হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
إِنَّ لِلْمُنَافِقِينَ عَلَامَاتٍ يُعْرَفُونَ بِهَا: تَحِيَّتُهُمْ لَعْنَةٌ، وَطَعَامُهُمْ نُهْبَةٌ، وَغَنِيمَتُهُمْ غُلُولٌ، وَلَا يَقْرَبُونَ الْمَسَاجِدَ إِلَّا هَجْرًا، وَلَا يَأْتُونَ الصَّلَاةَ إِلَّا دَبْرًا، مُسْتَكْبِرِينَ، لَا يَأْلَفُونَ وَلَا يُؤْلَفُونَ، خُشُبٌ بِاللَّيْلِ، صُخُبٌ بِالنَّهَارِ- (مسند احمد)
অর্থ: মুনাফিক্বদের কিছু আলামত রয়েছে। যদ্দারা তাদের চেনা যায়:
১. এদের অভিভাদনে থাকে অভিশাপ।
২. এদের খাবারের উৎস হলো লুটপাট, (অবৈধ পন্থায় উপার্জন)।
৩.যুদ্ধলব্ধ সম্পদ এদের কাছে খিয়ানতের বিষয়।
৪. এরা মসজিদের কাছে আসলে ঘৃণার মনোভাব নিয়ে আসে।
৫. এরা অহংকারী।
৬. নামাযে এলেও পিছনে থাকার মানসিকতা নিয়ে আসে।
৭. এরা না অন্যদের ভালোবাসে না অন্যদের ভালোবাসা পায়।
৮. এদের রাত কাটে নিস্প্রাণ ও হইহুল্লোড়ের মধ্যে।
[মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৭৯২৬]
হে আল্লাহ্ আমাদেরকে মু’মিন বান্দা হিসেবে কবুল করুন। মুনাফিকের সংশ্রব ও চরিত্র থেকে হিফাজত করুন। আমীন।

লেখক: অধ্যক্ষ, মাদ্রাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রি), বন্দর, চট্টগ্রাম