আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসূলগণের অনুসরণ-ই নাজাতের নিশ্চিত অবলম্বন

আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসূলগণের অনুসরণ-ই নাজাতের নিশ্চিত অবলম্বন

অধ্যক্ষ হাফেয কাজী আবদুল আলীম রিজভী

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ
وَ اَنَّهٗ هُوَ رَبُّ الشِّعْرٰى (৪৯) وَ اَنَّهٗۤ اَهْلَكَ عَادَاﰳ الْاُوْلٰى (৫০) وَ ثَمُوْدَاۡ فَمَاۤ اَبْقٰى (৫১) وَ قَوْمَ نُوْحٍ مِّنْ قَبْلُؕ-اِنَّهُمْ كَانُوْا هُمْ اَظْلَمَ وَاَطْغٰىﭤ (৫২ ) وَالْمُؤْتَفِكَةَ اَهْوٰى (৫৩) فَغَشّٰىهَا مَا غَشّٰى(৫৪) فَبِاَیِّ اٰلَآءِ رَبِّكَ تَتَمَارٰى (৫৫) هٰذَا نَذِیْرٌ مِّنَ النُّذُرِ الْاُوْلٰى(৫৬) اَزِفَتِ الْاٰزِفَةُ (৫৭) لَیْسَ لَهَا مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ كَاشِفَةٌﭤ (৫৮) اَفَمِنْ هٰذَا الْحَدِیْثِ تَعْجَبُوْنَ (৫৯) وَتَضْحَكُوْنَ وَلَا تَبْكُوْنَ (৬০) وَاَنْتُمْ سٰمِدُوْنَ (৬১) فَاسْجُدُوْا لِلّٰهِ وَاعْبُدُوْا (৬২)

তরজমা: এবং এ যে, তিনিই ‘শিরা নক্ষত্রের মালিক এবং এ যে, তিনিই প্রথম ‘আদকে ধ্বংস করেছেন এবং সামূদ কে, সুতরাং কাউকেও অবশিষ্ট রাখেন নি। এবং তাদের পূর্বে নূহ (আ.) এর সম্পদ্রায়কে, নিশ্চয় তারা তাদের চেয়েও অধিক যালিম ও অবাধ্য ছিল। এবং তিনি পাল্টে যাবার বস্তিকে নীচে পতিত করেছেন। অতঃপর সেটার উপর আচ্ছন্ন করেছে যা কিছু আচ্ছন্ন করার ছিল। সুতরাং (হে শ্রোতা!) আপন প্রতিপালকের কোন অনুগ্রহের মধ্যে সন্দেহ করবে? ইনি একজন সতর্ককারী, পূর্ববর্তী সতর্ককারীদের ন্যায়। নিকটে এসেছে (ক্বেয়ামত) নিকটে আগমনকারী। আল্লাহ ব্যতীত কেউ সেটার প্রকাশকারী নেই। (অর্থাৎ একমাত্র তিনিই সেটার প্রকাশ করবেন) তোমারা কি এ বাণীতে (অর্থাৎ কুরআন মজিদে) বিস্মিত হও? এবং হাসছো এবং কাঁদছো না? এবং তোমরা খেলাধূলায় মগ্ন আছো । সুতরাং আল্লাহর সিজদা করো এবং তার ইবাদত করো। [সূরা আন্ নাজম ৪৯-৬২ নং আয়াত]

আনুষঙ্গিক আলোচনা
وَثَمُودَا فَمَا أَبْقَىٰ -وَأَنَّهُ أَهْلَكَ عَادًا الْأُولَىٰ
উদ্ধৃত আয়াতদ্বয়ের ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম বর্ণনা করেছেন মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন উপরোক্ত আয়াতদ্বয়ে অবাধ্য আদ সম্প্রদায় ও সামূদ সম্প্রদায়ের ধ্বংস প্রাপ্ত হওয়ার ঘটনা আরবের কাফির-মুশরিকদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। আদজাতি ছিল বিশ্বের শক্তিশালী দুর্ধর্ষতম জাতি। তাদের দুটি শাখা পর পর প্রথম শাখা হুদ সম্প্রদায় ও দ্বিতীয় শাখা সামূদ সম্প্রদায় নামে পরিচিত।

আদ সম্প্রদায় ধ্বংস হওয়ার ঘটনা
আদ সম্প্রদায়ের নিকট সাইয়্যেদুনা হুদ আলায়হিস সালাম নবী হিসেবে প্রেরিত হয়ে তাদের প্রতি দাওয়াত প্রদান করে বললেন- যদি তোমরা এ দাওয়াতকে প্রত্যাখান করতে থাক, তবে জেনে রাখ, যে পয়গাম পৌছাবার জন্য আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে, আমি তা যথাযথভাবে তোমাদের নিকট পৌছিয়েছি। অতএব তোমাদের অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে যে, তোমাদের উপর আল্লাহর আযাব ও গযব পতিত হবে। তোমরা সমূলে নিপাত ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আর আমার ¯্রষ্টা রব্বুল আলামীন আল্লাহ তোমাদের স্থলে অন্য এক জাতিকে পৃথিবীতে আবাদ করবেন। তাই যা করছ তাতে তোমাদেরই সর্বনাশ করছ, আল্লাহর কোন ক্ষতি করছ না। আমার প্রতিপালক সবকিছু লক্ষ্য রাখেন, রক্ষণাবেক্ষন করেন, তোমাদের সব ধ্যান-ধারনা ও কার্যকল্পের তিনি খবর রাখেন।
কিন্তু হতভাগার দল আ’দ সম্প্রদায় সাইয়্যেদুনা হযরত হুদ আলায়হিস সালামের কোন কথায় কর্ণপাত করল না, তারা নিজেদের হঠকারিতা ও অবাধ্যতার উপর অবিচল রইল। অবশেষে প্রচন্ড ঝড়-তুফান রূপে আল্লাহর আযাব নেমে এল, সাত দিন আট রাত যাবত অবিরাম ঝড়-তুফান বইতে রইল। বাড়ি-ঘর ধ্বসে গেল, গাছ-পালা উপড়ে গেল, গৃহ-ছাদ উড়ে গেল। এ ভাবেই সুঠাম দেহের অধিকারী শক্তিশালী আ’দ জাতি সম্পূর্ণ ধ্বংস ও বরবাদ হয়ে গেলো। উল্লেখ্য যে, আদ জাতির উপর যখন প্রতিশ্রুত আযাব নাযিল হয়, তখন আল্লাহ তাঁর চিরন্তন বিধান অনুযায়ী সাইয়্যেদুনা হযরত হুদ আলায়হিস্ সালাম ও তাঁর সঙ্গী ঈমানদার গণকে সেখান থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে আযাব হতে রক্ষা করেন।

সামূদ সম্প্রদায়ের ধ্বংস যজ্ঞ
আ’দ জাতির দ্বিতীয় শাখা সামূদ সম্প্রদায়ের নিকট সাইয়্যেদুনা সালেহ আলাইহিস সালাম নবী হিসেবে প্রেরিত হয়ে তাদেরকে তাওহীদের প্রতি দাওয়াত দিলেন। কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করে বলল আপনি এ পাহাড়ের প্রস্তর খন্ড থেকে আমাদের সম্মুখে যদি একটি জীবন্ত উষ্ট্রী বের করে দেখাতে পারেন তাহলে আমরা আপনাকে সত্য নবী বলে মানতে রাজি আছি। সাইয়্যেদুনা সালেহ আলাইহিস সালাম তাদেরকে এই বলে সতর্ক করলেন যে, তোমাদের চাহিদা মোতাবেক মুজেযা প্রদর্শনের পরেও যাদি ঈমান আনয়ন করতে দ্বিধা প্রকাশ কর তাহলে কিন্তু আল্লাহর বিধান অনুসারে তোমাদের উপর আযাব নেমে আসবে, তোমরা সমূলে ধ্বংস হয়ে যাবে। এতদসত্ত্বেও তারা নিজেদের হঠকারিতা থেকে বিরত হল না। আল্লাহ তাঁর অসীম কুদরতে তাদের চাহিদা মোতাবেক মুজেযা যাহির হল। বিশাল প্রস্তরখন্ড বিদীর্ণ হয়ে তাদের কথিত গুণাবলী সম্পন্ন উষ্ট্রী আত্মপ্রকাশ করল। মহান আল্লাহ হুকুম দিলেন যে, এ উষ্ট্রীকে কেউ যেন কষ্ট না দেয় যদি এরূপ করা হয় তবে তোমাদের প্রতি আযাব নাযিল হয়ে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু তারা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করল, উষ্ট্রীকে হত্যা করল তখন আল্লাহ্ কঠোরভাবে তাদের পাকড়াও করলেন। এরশাদ হয়েছে-الصيحة واخذ الذين ظلموا অর্থাৎ ঐ পাপিষ্ঠদেরকে এক ভয়ঙ্কর গর্জন এসে পাকড়াও করল। এটা ছিল সাইয়্যেদুনা জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম-এর গর্জন, যা হাজার হাজার বজ্জ্রধ্বনির সম্মিলিত শক্তির চেয়েও ভয়াবহ। যা সহ্য করার ক্ষমতা মানুষ বা জীব জন্তুর হতে পারে না। এরূপ প্রাণ কাঁপানো গর্জনে সকলে মৃত্যুবরণ করেছিল। সাইয়্যেদুনা হযরত সালেহ আলায়হিস্ সালাম ও তাঁর সঙ্গী মুমিনগণ নিরাপদে রক্ষা পেলেন। [তাফসীরে মাযহারী]

فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكَ تَتَمَارَىٰ
উদ্ধৃত আয়াতে কুরআনের ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন تمارىশব্দটিباب تفاعل হতে ব্যবহৃত। এর আভিধানিক অর্থ হলো পরস্পর বিবাদ ও বিরোধিতায় অবতীর্ণ হওয়া। সাইয়্যেদুনা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন এ আয়াতে মহান আল্লাহ প্রত্যেক মানুষ কে সম্বোধন করে বলেছেন পূর্ববর্তী আয়াত সমূহ এবং সাইয়্যেদুনা হযরত মূছা ও সাইয়্যেদুনা হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস সালাম এর উপর অবতীর্ণ ছহিফায় বর্ণিত আয়াত সম্পর্কে সামান্য চিন্তা ভাবনা ও বিচার-বিশ্লেষণ করলে রাসূলে করীম রউফুর রহীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রদর্শিত শিক্ষার সত্যতায় বিন্দু মাত্র ও সন্দেহের অবকাশ থাকে না। এবং পূর্ববর্তী জাতি সমূহ তথা হযরত নূহ, হযরত হূদ, হযরত সালেহ এবং লূত আলায়হিস সালাম এর সম্প্রদায়ের ধ্বংসযজ্ঞ ও আলীর এর ঘটনাবলী শুনে বিরোধিতা কিংবা বিরুদ্ধাচরণ বর্জন করার চমৎকার সুযোগ পাওয়া যায়। এটা মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের একটি বিশেষ অনুগ্রহ স্বরূপ, এতদসত্ত্বেও তোমরা আল্লাহর কোন কোন অনুগ্রহ সম্পর্কে বিবাদ ও বিরোধিতা করতে থাকবে, এ আয়াতের প্রকৃত মর্ম ও লক্ষ্য হলো সূরাহ আর রহমান এ বারংবার উল্লেখিত فباى الاء ربكما تكذبان অর্থাৎ হে মানব ও জ্বিন সম্প্রদায়! তোমরা উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন কোন অনুগ্রহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে? এর মূল মর্ম ও লক্ষ্য এর অনুরূপ, এ কুরআনের শুরুতেই দ্ব্যার্থহীন কন্ঠে বলা হয়েছে لاريب فيه অর্থাৎ এতে কোনরূপ সন্দেহ এর সুযোগ নেই। এরপর কি তোমরা এ কোরআনের প্রদত্ত বিধি-বিধান ও নির্দেশনা নিয়ে বিবাদ বিরোধিতা কিংবা অস্বিকার করবে? افلا تتفكرون অর্থাৎ এ কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা বা পর্যবেক্ষণ-পর্যালোচনা করবে না।

লেখক: অধ্যক্ষ-জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসা, চট্টগ্রাম।