Anjuman-E Rahmania Ahmadia Sunnia Trust

ফজিলতপূর্ণ জুমার দিবসে করণীয়

ফজিলতপূর্ণ জুমার দিবসে করণীয়

মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম >
সপ্তাহের মহিমান্বিত দিন জুমার দিন। এ দিবসকে মহান আল্লাহ তাআলা অন্য দিনসমূহের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। এ দিন কালক্রমে সংঘটিত এমন কিছু ঘটনার নীরব সাক্ষী, যা পৃথিবীর মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। এমনিভাবে এ দিনই সংঘটিত হবে ওই মহাপ্রলয়, যা এই নশ্বর পৃথিবীর সমাপ্তি ঘটিয়ে এক অবিনশ্বর জগতের সূচনা করবে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنّ يَوْمَ الْجُمُعَةِ سَيِّدُ الْأَيّامِ وَأَعْظَمُهَا عِنْدَ اللهِ مِنْ يَوْمِ الْأَضْحَى وَيَوْمِ الْفِطْرِ، فِيهِ خَمْسُ خِلَالٍ: خَلَقَ اللهُ فِيهِ آدَمَ، وَأَهْبَطَ اللهُ فِيهِ آدَمَ، وَفِيهِ تَوَفّى اللهُ آدَمَ، وَفِيهِ سَاعَةٌ لَا يَسْأَلُ اللهَ الْعَبْدُ فِيهَا شَيْئًا إِلّا أَعْطَاهُ إِيّاهُ، مَا لَمْ يَسْأَلْ حَرَامًا، وَفِيهِ تَقُومُ السّاعَةُ، مَا مِنْ مَلَكٍ مُقَرّبٍ، وَلَا أَرْضٍ وَلَا سَمَاءٍ، وَلَا رِيَاحٍ وَلَا جِبَالٍ وَلَا بَحْرٍ، إِلّا وَهُنّ مُشْفِقُونَ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ.
অর্থাৎ নিশ্চয়ই জুমার দিন হল সমস্ত দিনের সর্দার। জুমার দিন আল্লাহ তাআলার নিকট সবচেয়ে বড় ফযিলতপূর্ণ দিবস। এমনকি এই দিন আল্লাহ তাআলার কাছে ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর তথা ইসলামের দুই ঈদের দিন থেকেও মহান। এ দিনের বিশেষ পাঁচটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এ দিন আল্লাহ তাআলা হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করেছেন। এ দিন তাঁকে জান্নাত থেকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। এদিনেই আল্লাহ তাঁকে মৃত্যু দান করেছেন। জুমার দিন এমন একটা সময় আছে, যখন বান্দা আল্লাহর কাছে যা প্রার্থনা করবে আল্লাহ তাআলা তাকে তা-ই দান করবেন, যদি না সে হারাম কোন বিষয়ের প্রার্থনা করে। তদ্রুপ, কিয়ামতও সংঘটিত হবে জুমার দিনেই। নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতারা জুমার দিন (কিয়ামতের আশঙ্কায়) ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে। পৃথিবী, আকাশ, বাতাস, পাহাড়, পর্বত, সাগর সবকিছু জুমার দিন (কিয়ামতের আশঙ্কায়) উদ্বিগ্ন থাকে।  প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
نَحْنُ الآخِرُونَ السّابِقُونَ يَوْمَ القِيَامَةِ، بَيْدَ أَنّهُمْ أُوتُوا الكِتَابَ مِنْ قَبْلِنَا، ثُمّ هَذَا يَوْمُهُمُ الّذِي فُرِضَ عَلَيْهِمْ، فَاخْتَلَفُوا فِيهِ، فَهَدَانَا اللهُ، فَالنّاسُ لَنَا فِيهِ تَبَعٌ: اليَهُودُ غَدًا، وَالنّصَارَى بَعْدَ غَدٍ.
অর্থাৎ আমরা পরে আগমনকারীরাই কিয়ামতের দিন অগ্রগামী হব। তবে অন্যদেরকে (আসমানী) কিতাব দেওয়া হয়েছে আমাদের পূর্বে। এই দিন  (অর্থাৎ শ্রেষ্ঠতম একটি দিনে সকলে একত্র হয়ে বিশেষ ইবাদত করা) তাদের উপর ফরয করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এতে মতবিরোধ করেছে। আর আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সঠিক দিনটির সন্ধান দিয়েছেন। সুতরাং এক্ষেত্রে মানুষ আমাদের অনুগামী। ইহুদীদের শ্রেষ্ঠ দিন জুমার পরের দিন শনিবার আর খ্রিস্টানদের শ্রেষ্ঠ দিন এর পরের দিন রবিবার।
জুমার দিন সমস্ত দিনের সর্দার
রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
سَيِّدُ الْأَيّامِ يَوْمُ الْجُمُعَةِ، فِيهِ خُلِقَ آدَمُ، وَفِيهِ أُدْخِلَ الْجَنّةَ، وَفِيهِ أُخْرِجَ مِنْهَا، وَلَا تَقُومُ السّاعَةُ إِلّا يَوْمَ الْجُمُعَةِ.
অর্থাৎ জুমার দিন হচ্ছে, সকল দিনের সর্দার। এই দিন আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছে, এই দিন তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করা হয়েছে এবং এই দিনই তাঁকে জান্নাত থেকে দুনিয়াতে প্রেরণ করা হয়েছে। আর জুমার দিনই সংঘটিত হবে কিয়ামত।
মুমিনের ঈদের দিন
হাদিসে কুদসিতে জুমার দিনকে মুমিনদের জন্য সাপ্তাহিক ঈদের দিন ঘোষণা করা হয়েছে। হযরত আনাস বিন মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
عن أنس بن مالك -رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ- أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: أتاني جبريلُ بمثل هذه المرآة البيضاء فيها نُكْتة سوداء، قلت: يا جبريلُ ما هذه؟ قال: هذا الجُمُعة جعلها الله عيدًا لك ولأمتك فأنتم قبل اليهود والنصارى،
অর্থাৎ হযরত জিবরিল আলাইহিস সালাম সাদা আয়নার সদৃশ্য বস্তু নিয়ে আমার নিকট আসলেন, যাতে কালো একটি ফোঁটা রয়েছে। আমি বললাম: হে জিবরিল, এটা কি? তিনি বললেন, এ হচ্ছে জুমা, আল্লাহ তাআলা যা আপনার ও আপনার উম্মতের জন্য ঈদ বানিয়েছেন, আপনারাই ইহুদি ও খৃস্টানদের পূর্বে (অর্থাৎ তাদের সাপ্তাহিক ঈদের পূর্বদিন আপনাদের ঈদের দিন)।
জুমার দিনের আমল
এই দিবা-রাত্রির বিশেষ কিছু ইবাদত আছে, যা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার জীবনার্দশে ফুটে ওঠে। যথা-
এক. জুমারাতে আল্লাহ তাআলার কাছে বান্দার আমল পেশ করা হয়। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ أَعْمَالَ بَنِي آدَمَ تُعْرَضُ كُلّ خَمِيسٍ لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ،
 فَلَا يُقْبَلُ عَمَلُ قَاطِعِ رَحِمٍ.
অর্থাৎ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে অর্থাৎ জুমারাতে আদম সন্তানের আমল (আল্লাহর সামনে) পেশ করা হয়। তখন আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীদের আমল কবুল করা হয় না।  রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে সম্বোধন করে বলেন, ‘হে আলী! শুক্রবার রাতের শেষ তৃতীয়াংশে সাহস করে উঠে পড়ো, কারণ এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় এবং এতে দোয়া কবুল হয়।  আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘জুমার দিনে ও রাতে আমার ওপর দরুদ পাঠ করো, যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরুদ পাঠ করে, আল্লাহ তার ওপর ১০ বার রহমত বর্ষণ করবেন।
অন্যত্র ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন ও রাতে আমার ওপর দরুদ পাঠ করবে, আল্লাহ তার ১০০টি প্রয়োজন পূরণ করবেন। এর মধ্যে ৭০টি আখিরাতে এবং ৩০টি পৃথিবীতে।
দুই. জুমার দিন ফজরে সূরা সিজদা এবং সূরা দাহর তিলাওয়াত করা। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুক্রবার ফজরের নামাযে সূরা সিজদা এবং সূরা দাহর তিলাওয়াত করতেন।  জুমার দিন রাসূলুল্লাহ এই সুরা তিলাওয়াত করার কারণ এই সুরাতে হযরত আদম আলাইহিস সালাম এর সৃষ্টির কথা, পুনরুত্থানের কথা, কিয়ামতের দিন সমবেত হওয়া ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আর এসব হবে জুমার দিন। সে জন্য এই সূরা পাঠ করে উম্মতকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়।
তিন. এ দিবসে বেশি পরিমাণে দরুদ শরিফ পড়া বরকতময় কাজ। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা জুমার দিন আমার ওপর বেশি বেশি দরুদ পাঠ করো। কেননা তোমাদের পাঠকৃত দরুদ আমার সামনে পেশ করা হয়।
চার. সুরা কাহফ পড়া। হযরত আবু সাঈদ খুদরি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন সুরা কাহফ পাঠ করবে তার জন্য দুই জুমার মধ্যবর্তীকাল জ্যোতির্ময় হবে।’
পাঁচ. জুমার নামায আদায় করা। ফরজ ইবাদত সমূহের মধ্যে অতিব গুরুত্বপূর্ণ জুমার নামায। আরাফার দিবসের পর এদিনই সবচেয়ে বেশি মানুষ একসঙ্গে সমবেত হয়। জুমার নামাযের গুরুত্বারোপ করে রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ
অর্থাৎ হে মুমিনগণ! জুমার দিনে যখন নামাযের আজান দেয়া হয়, তোমরা আল্লাহর স্মরণে দ্রুত চলো এবং বেচাকেনা বন্ধ কর। এটা তোমাদের জন্যে উত্তম যদি তোমরা বুঝ।  যারা জুমার নামাযকে অলসতা কিংবা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ছেড়ে দেয়, তাদের হৃদয়ে আল্লাহ তাআলা মোহর মেরে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোন শরিয়তসম্মত কারণ ছাড়া জুমার নামায বর্জন করবে, তার নাম মুনাফিক হিসেবে এমন দফতরে লিপিবদ্ধ হবে, যা মুছে ফেলা হবে না এবং পরিবর্তনও করা যাবে না।
জুমার রাকাত সংখ্যা
জুমার নামায জামাতের সাথে আদায় করা আবশ্যিক এবং তা একাকী আদায় করার নিয়ম নেই। ইসলামি শরিয়তের বিধান অনুযায়ী জুমার দিন ২ রাকাত নামায পড়া ফরজ। ফরজ নামাযের পূর্বে চার রাকাত কাবলাল জুমা এবং পরে চার রাকাত বাদাল জুমা (সুন্নাত নামায) আদায় করতে হয়। এ প্রসঙ্গে হযরত মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন,
كان رسول الله يصلي قبل الجمعة أربعا وبعدها أربعا يجعل التسليم في آخرهن ركعة
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমার পূর্বে পড়তেন চার রাকাত, পরে পড়তেন চার রাকাত। আর চার রাকাতের পরেই তিনি সালাম ফেরাতেন।  উপর্যুক্ত রাকাতের সংখ্যা বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও আজকাল কিছু মিডিয়ায় অপপ্রচার শুরু করেছে, জুমআর আগে পরে কোন সুন্নত নাই। তাদেরকে না চেনার কারণে অনেকে ধোঁকায় পড়ে যাচ্ছে। আল্লাহ হিফাজত করুন।
জুমার নামাযের সূচনা
জুমার নামায ফরজ হয় প্রথম হিজরিতে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরতকালে কুবাতে অবস্থান শেষে শুক্রবার দিনে মদিনা মনোয়ারায় পৌঁছেন এবং বনি সালেম গোত্রের উপত্যকায় পৌঁছে যোহরের ওয়াক্ত হলে সেখানেই তিনি জুমার নামায আদায় করেন। এটাই ইতিহাসের প্রথম জুমার নামায। জুমার দুই রাকাত ফরজ নামায ও ইমামের খুতবাকে যোহরের চার রাকাত ফরজ নামাযের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ক্রীতদাস, মহিলা, নাবালেগ বাচ্চা ও অসুস্থ ব্যক্তি-এই চার প্রকার মানুষ ছাড়া সকল মুসলমানের ওপর জুমার নামায জামাতে আদায় করা অপরিহার্য কর্তব্য।
জুমা ফরয হওয়ার শর্তাবলী
জুমার নামায দুই রাকাত। নি¤েœর শর্তের ভিত্তিতে জুমা ফরয করা হয়েছে। যথা- (১) শহরে মুকীম হওয়া (মুসাফির না হওয়া) (২) সুস্থ হওয়া, অসুস্থের উপর জুমু’আহ ফরয নয়। অসুস্থ দ্বারা উদ্দেশ্য যে, জুমা মসজিদ পর্যন্ত যেতে অক্ষম অথবা মসজিদে গেলে রোগ বৃদ্ধির কিংবা দেরীতে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা হয়েছে। অতিশয় বৃদ্ধ ব্যক্তি অসুস্থের হুকুমের অন্তর্ভূক্ত। (৩) স্বাধীন হওয়া, গোলামের উপর জুমা ফরয নয়। তার মনিব তাকে জুমা আদায়ে বাধা দিতে পারবে। (৪) পুরুষ হওয়া, (৫) প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া, (৬) বিবেকবান হওয়া, (৭) দৃষ্টি শক্তি সম্পন্ন হওয়া, (৮) হাঁটতে সক্ষম হওয়া, (৯) বন্দী না হওয়া, (১০) বাদশা (শাসক) অথবা চোর, ডাকাত ইত্যাদির কোন প্রকারের জালিমের ভয়ের আশংকা না থাকা। (১১) ঝড়, তুফান, বরফ ও ঠা-া ইত্যাদির ক্ষতির সম্ভাবনা হতে মুক্ত হওয়া। যার উপর নামায ফরয কিন্তু কোন শরয়ী ওযরের কারণে জুমার নামায আদায় করেনি, তাকে অবশ্যই জুমার দিন যোহরের নামায পড়ে দিতে হবে। কেননা, জুমার দিন শরয়ী ওজরে জুমার নামায পড়তে না পারলে কিংবা শর্ত পাওয়া না যাওয়ার কারণে জুমার নামায ফরয না হলে যোহরের নামায মাফ হবে না। তা অবশ্যই পড়ে নিতে হবে।
জুমার সুন্নাত সমূহ
জুমার নামাযের জন্য প্রথম কাতারে বসা মুস্তাহাব এবং জুমার দিন গোসল করা, মিসওয়াক করা, উত্তম (ভাল) ও সাদা কাপড় পরিধান করা, তৈল ও সুগন্ধি লাগিয়ে প্রথম ওয়াক্তে মসজিদে চলে যাওয়া সুন্নাত এবং নামায ও দুআ-যিকিরে মগ্ন থাকা মুস্তাহাব।
এরপর একাগ্রতার সাথে ইমাম সাহেবের খুতবা শোনা এবং উত্তমরূপে জুমার নামায আদায় করা জুমার দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সর্বাধিক ফযীলতময় আমল। এ প্রসঙ্গে  হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন –
مَنْ اغْتَسَلَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ، وَلَبِسَ مِنْ أَحْسَنِ ثِيَابِهِ، وَمَسّ مِنْ طِيبٍ إِنْ كَانَ عِنْدَهُ، ثُمّ أَتَى الْجُمُعَةَ، فَلَمْ يَتَخَطّ أَعْنَاقَ النّاسِ، ثُمّ صَلّى مَا كَتَبَ اللهُ لَهُ، ثُمّ أَنْصَتَ إِذَا خَرَجَ إِمَامُهُ، حَتّى يَفْرُغَ مِنْ صَلَاتِهِ، كَانَتْ كَفّارَةً لِمَا بَيْنَهَا وَبَيْنَ جُمُعَتِهِ الّتِي قَبْلَهَا.
অর্থাৎ যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করল, তার কাছে থাকা সুন্দরতম জামাটি পরিধান করল এবং সংগ্রহে থাকলে সুগন্ধি ব্যবহার করল, এরপর জুমাতে উপস্থিত হল, কারো কাঁধ ডিঙ্গিয়ে গেল না, তারপর আল্লাহর তাওফীক অনুযায়ী সুন্নত-নফল পড়ল, অতঃপর খতীব (খুতবার জন্য) বের হওয়া থেকে নামায শেষ করা পর্যন্ত নিশ্চুপ থাকল, তার এই নামায এ জুমা থেকে সামনের জুমা পর্যন্ত (গুনাহের) কাফ্ফারা হবে।  অন্যত্র বর্ণিত আছে, তার জন্য প্রতি কদমে এক বছরের রোযা রাখা ও তার রাত জেগে নামায পড়ার সমান নেকী রয়েছে।
নামাযে প্রথম আগমনকারীর সওয়াব
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,‘জুমার দিন মসজিদের দরজায় ফেরেশতারা অবস্থান করেন এবং ক্রমানুসারে আগে আগমনকারীদের নাম লিখতে থাকেন। সবার আগে আগমনকারীর নামে একটি সতেজ উট কোরবানির সওয়াব লেখা হয়। এরপর আগমনকারীর নামে একটি গাভী কোরবানির সওয়াব লিখা হয়। এরপর আগমনকারীর নামে মুরগি দানের সওয়াব লিখা হয়। অতঃপর ইমাম বের হলে ফেরেশতারা লেখা বন্ধ করে দেন এবং মনোযোগ দিয়ে খুতবা শুনতে থাকেন।’
নীরবে খুতবা শোনা আবশ্যক
যে সমস্ত কাজ নামাযের মধ্যে হারাম যেমন- পানাহার করা, সালাম ও সালামের জবাব দেয়া ইত্যাদি তা খুতবার সময়ও হারাম। এমনকি নেকীর দা’ওয়াত দেয়াও হারাম। তবে খতিব সাহিব নেকীর দাওয়াত দিতে পারবেন। যখন খুতবা পাঠ করা হয় তখন খুতবা শোনা এবং নীরব থাকা উপস্থিত সকল মুসল্লীদের উপর ফরয। আর যে সমস্ত লোক ইমাম থেকে দূরে এবং খুতবার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন। তাদের ওপর নীরব থাকা ওয়াজিব। খুতবা পাঠের সময় কাউকে কোন খারাপ কথা বলতে দেখলে তাকে হাত বা মাথার ইশারা দ্বারা নিষেধ করতে হবে। মৌখিকভাবে নিষেধ করা যাবে না। হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন হুযুর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন (খুতবা পাঠাবস্থায়) তার সাথীকে ‘চুপ’ বলল, সে অনর্থক কাজ করল । আর যে অনর্থক কাজ করল, তার জন্য ওই জুমায় কোন প্রতিদান থাকবে না।  অন্যত্র বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি ইমাম জুমার খুতবা দেয়ার সময় কথা বলে, তার দৃষ্টান্ত ভারবাহী গাধার অনুরূপ। আর ঐ সময় য কেউ তার সাথীকে এরূপ বলল যে, “চুপ থাক” বলে সে জুমার নামায পড়লেও জুমার সাওয়াব পাবে না।
প্রতি কদমে নফল রোজা ও নামাজের সওয়াব
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিনে সকাল সকাল গোসল করল, তারপর ইমামের কাছে বসে চুপ করে মনোযোগসহ খুতবা শুনল, প্রত্যেক কদমের বিনিময়ে সে এক বছরের নফল রোজা ও নামাযের সওয়াব পাবে।’
খুতবার সময় মুসল্লী বসার পদ্ধতি
ইমামের সামনে উপস্থিত ব্যক্তিগণ ইমাম মুখী হয়ে আর ডানে-বামের ব্যক্তিগণ ইমামের দিকে ফিরে বসবে। ইমামের নিকটবর্তী বসা অতি উত্তম । তবে ইমামের নিকটবর্তী হওয়ার জন্য পা লাফিয়ে-উচিয়ে অগ্রসর হওয়া জায়েজ নেই। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, “যে ব্যক্তি জুমার দিন মানুষের গর্দান টপকিয়ে সামনে যায়, সে যেন জাহান্নামের দিকে পুল তৈরী করল। অর্থাৎ তার উপর আরোহণ করে মানুষ জাহান্নামে প্রবেশ করবে।  যদি ইমামের খুতবা আরম্ভের পূর্বে সামনে জায়গা থাকে এবং স্বাভাবিকভাবে যাওয়া যাবে তবে যেতে পারবে। খুতবা  শুরু হওয়ার পরে আসলে মসজিদের এক পার্শ্বে বসে পড়বে। খুতবা শ্রবণকালে নামাযে বসার ন্যায় দোজানু হয়ে বসবে।  এ প্রসঙ্গে বুজুর্গানে দ্বীন বলেন, প্রথম খুতবার সময় (নামাযের মত) হাত বেঁধে এবং দ্বিতীয় খুতবায় উরুর উপর হাত রেখে খুতবা শুনলে দুই রাকাআত নামাযের সাওয়াব পাওয়া যাবে।  আলা হযরত ইমাম আহমদ রযা খান রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “খুতবার মধ্যে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার নাম মুবারক শুনলে মনে মনে দুরুদ শরীফ পড়তে হবে। কেননা খুতবা পাঠের সময় চুপ থাকা ফরয ।”
মাসআলা: খুতবার আগে যে চার রাকা’আত সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ আছে, কোন ব্যক্তি যদি ওই রাকাআতের নিয়ত করলো এমন সময়ে খতীব খুতবাও শুরু করলো তখন ওই ব্যক্তি দু রাকাআত পড়ে সালাম ফিরায়ে নিবে এবং খুতবা শ্রবণ করবে। পরবর্তীতে জামাআত সহকারে জুমার দু রাকা’আত পড়ে বাদাল জুমা চার রাকা’আত সুন্নাত নামায পড়ে ওই আগের চার রাকাআত কাবলাল জুমা সুন্নাত আবার পড়ে নিবে।
মাসআলা: খতীব খুতবা প্রদানকালে মুসলমানদের জন্য দু’আ করলে ওই দু’আতে শ্রোতাদের হাত উঠানো এবং আমিন বলা নিষেধ। যদি তা করা হয়, তবে গুনাহগার হবে।
খুতবার মধ্যে যেসব বিষয় থাকা জরুরী
হামদ (আল্লাহর প্রশংসা) দ্বারা শুরু করা, সানাখানি (গুণগান) করা, শাহাদাতাঈন (তওহিদ ও রিসালাতের সাক্ষ্য) পাঠ করা, দরুদ শরিফ পড়া, কুরআনুল করিমের প্রাসঙ্গিক আয়াত তিলাওয়াত করা, সংশ্লিষ্ট হাদিস পাঠ করা, প্রয়োজনীয় মাসআলা বর্ণনা করা, ওয়াজ-নসিহত করা, সৎকর্মে উদ্বুদ্ধকরণ ও মন্দ কাজ থেকে নিরুৎসাহিত করা, মুসলমানদের জন্য দোয়া করা।  দুই খুতবা আরবী ভাষায় হওয়া সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। জুমার দিন খুতবার আগে স্থানীয় ভাষায় যে দ্বীনি আলোচনা করা হয়, তা খুতবায়ে মাসনুনা বলে গণ্য হবে না। কিছু কিছু মানুষ এই দ্বীনি আলোচনাকেও জুমার খুতবা মনে করেন। তাঁদের ধারণা সঠিক নয়।
খুতবা প্রদান কালে সুন্নাত
অজু অবস্থায় থাকা (পবিত্র থাকা)। জুমার খুতবার প্রারম্ভে (মিম্বারে) বসা। জুমার খুতবা মিম্বারে দাঁড়িয়ে দেওয়া। মুসল্লিদের (শ্রোতা-দর্শকদের) দিকে ফিরে খুতবা দেওয়া। খুতবা আরম্ভের আগে মনে মনে ‘আউজুবিল্লাহ’ ও ‘বিসমিল্লাহ’ পড়া। খুতবা আরবি ভাষায় হওয়া। সশব্দে (শ্রোতা-দর্শক শুনতে পায় এমনভাবে) খুতবা পরিবেশন করা। উভয় খুতবা সংক্ষিপ্ত হওয়া। উভয় খুতবা (প্রতিটি) ‘তিওয়ালে মুফাছ্ছল’ (সুরা হুজুরাত থেকে সুরা বুরুজ পর্যন্ত) সুরার চেয়ে দীর্ঘ না হওয়া। দুই খুতবার মাঝে বসা। ঈদের খুতবার প্রারম্ভে না বসা। ঈদের প্রথম খুতবার শুরুতে ৯ বার; ঈদের দ্বিতীয় খুতবার শুরুতে ৭ বার এবং শেষে ১৪ বার তাকবির বলা।
খতিবের কতিপয় গুণাবলি
মুত্তাকি (তাকওয়া), মুখলিস (ইখলাস), আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীল (তাওয়াক্কুল), বিজ্ঞ আলেম, ধৈর্যশীল ও সহিষ্ণু, কপটতামুক্ত, সরলমনা, বিনয়ী, সুমিষ্টভাষী, ভদ্র প্রভৃতি গুণে খতিব সাহেব গুণান্বিত হওয়া অতিব জরুরী। এ ছাড়া খতিবের শিক্ষাগত যোগ্যতা, বয়স, অবয়ব (সুরত), আখলাক (সিরত), পোশাক-আশাক ইত্যাদিও গুরুত্বপূর্ণ।
মিম্বার প্রসঙ্গ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমত একটি খেজুরগাছের খুঁটির সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে খুতবা দিতেন। মিম্বার তৈরি হওয়ার পর তিনি তার ওপর দাঁড়িয়ে খুতবা দিতেন। ওই মিম্বারে তিনটি তাক ছিল। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তৃতীয় তাকে দাঁড়াতেন ও বসতেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার ওফাতের পর হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফতকালে তিনি দ্বিতীয় তাকে দাঁড়াতেন। হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফতের সময় তিনি তৃতীয় তাকে দাঁড়াতেন। অতঃপর হযরত উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফতের সময় তিনি দ্বিতীয় তাকে দাঁড়াতেন এবং এ প্রথাই বর্তমানে প্রচলিত। তবে প্রয়োজনে মিম্বারের তাকের সংখ্যা কম-বেশি হতে পারে এবং সুবিধানুযায়ী খতিব যেকোনো তাকে দাঁড়াতে পারেন।
দোয়া কবুলের সময়
জুমার দিনে দোয়া কবুল হওয়ার সময়ের ব্যাপারে ৪৫টি মতামত পাওয়া যায়। তবে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মত হলো, আসরের নামাযের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত দোয়া কবুলের সময়। হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘জুমার দিনের কাক্সিক্ষত সময় হলো আসরের পর থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত।’ মুসনাদে ইবনে আবি শায়বা, হাদীস: ৫৪৬০; জামে তিরমিযি, হাদীস: ৪৮৯
জুমার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করে প্রত্যেক মুসলমানের উচিত এই দিনটিকে উত্তমরূপে কাজে লাগানো এবং সমস্ত প্রকারের কবিরা ও সগিরা গুনাহ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে জুমার দিবসের ফযিলত অনুধাবন করে আমল করার তাওফিক দান করুন।
   লেখক: আরবি প্রভাষক-তাজুশ শরী’আহ মাদরাসা, ষোলশহর, চট্টগ্রাম।