মসজিদুল আকসা মুসলমানদের প্রথম ক্বিবলা

মসজিদুল আকসা মুসলমানদের প্রথম ক্বিবলা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি>

عَنْ اَبِىْ سَعِيْدِ نِ الْخُدْرِىْ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لاَ تُشَدُّ الرِّحَالُ اِلاَّ اِلٰى ثَلاَثَةِ مَسَاجِدَ مَسْجِدِ الْحَرَامِ وَمَسْجِدِ الْاَقْصٰى وَمَسْجِدِىْ هذَا [متفق عليه]
عَنْ اَبِىْ ذَرٍّ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ سَأَلْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ اَوَّلَ مَسْجِدٍ وُضِعَ فِى الْاَرْضِ قَالَ اَلْمَسْجِدِ الْحَرَامِ قُلْتُ ثُمَّ اَيٌّ قَالَ الْمَسْجِدِ الْاَقْصٰى ـ قُلْتُ كَمْ بَيْنَهُمَا قَالَ اَرْبَعُوْنَ عَامًا [رواه مسلم]

অনুবাদ: হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তিন মসজিদ ভিন্ন অপর কোন দিকে সফর করা যায় না। মসজিদে হারাম, মসজিদে আকসা ও আমার মসজিদ। [বুখারী ও মুসলিম]

হযরত আবু যর গিফারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম বিশ্বের সর্বপ্রথম নির্মিত মসজিদ কোনটি? তিনি বললেন, মসজিদুল হারাম, অতঃপর আরজ করলাম এরপর কোনটি? তিনি বললেন মসজিদুল আকসা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এতদুভয়ের মধ্যে কতদিনের ব্যবধান রয়েছে, তিনি বললেন, চল্লিশ বছর। [মুসলিম শরীফ]

প্রাসঙ্গিক আলোচনা
বর্ণিত হাদীস শরীফ দ্বয়ের প্রথমটিতে তিন মসজিদের ফযীলত ও মর্যাদা বুঝানোর উদ্দেশ্যে নূর নবীজির উপরোক্ত বাণী এরশাদ হয়েছে, যেহেতু বর্ণিত তিন মসজিদে অধিক সওয়াবের প্রত্যাশায় সফরের অনুমতি দেয়া হয়েছে, এত্দভিন্ন অন্য কোন স্থানে ভ্রমণ নিষিদ্ধ বুঝানো উদ্দেশ্য নয়।
দ্বিতীয় হাদীস শরীফে দুই মসজিদের নির্মাণের মধ্যকার সময়ের ব্যবধান সম্পর্কে আলোকপাত হয়েছে।
মুজাহিদ রহমাতুল্লাহি আলায়হির বর্ণণামতে মসজিদে আকসা হযরত সোলায়মান আলায়হিস্ সালাম নির্মাণ করেছেন। [তাফসীরে কুরতুবী, খ–৪, পৃ. ১২৭]
মসজিদুল আকসা প্রসঙ্গে মহাগ্রন্থ আল কুরআনের পনের পারার সূরা বনী ইস্রাঈলের প্রথম আয়াতে উল্লেখ হয়েছে আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন,
سُبْحٰنَ الَّذِیْۤ اَسْرٰى بِعَبْدِهٖ لَیْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ اِلَى الْمَسْجِدِ الْاَقْصَا الَّذِیْ بٰرَكْنَا حَوْلَهٗ لِنُرِیَهٗ مِنْ اٰیٰتِنَاؕ-اِنَّهٗ هُوَ السَّمِیْعُ الْبَصِیْرُ(১(
তরজমা: পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি আপন বান্দাকে রজনীতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত। যার আশে পাশে আমি বরকতময় করেছি, তাঁকে আমার মহান নিদর্শনসমূহ দেখানোর জন্য নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা: [সূরা ১৭:১]

বর্ণিত আয়াতে ‘মসজিদুল আকসা’ যা বায়তুল মুকাদ্দাস নামে পরিচিত এটি আল কুদস ফিলিস্তিনের পূণ্যভূমি জেরুজালেমে অবস্থিত। ‘আকসা’ অর্থ দূরত্ব, যেহেতু এ মসজিদ মক্কা মুকাররমার হেরম থেকে বহুদূরে অবস্থিত সেহেতু এটাকে মসজিদুল আকসা বলা হয়। [তাফসীর নূরুল ইরফান, খন্ড-২, পৃ. ৪৩]

আল্লাহর নবী হযরত ইবরাহীম আলায়হিস্ সালাম কর্তৃক বায়তুল্লাহ্ শরীফ তথা কা’বা ঘর নির্মাণের চল্লিশ বছর পর তদীয় পুত্র হযরত ইসহাক আলায়হিস্ সালামের পুত্র হযরত ইয়াকুব আলায়হিস্ সালাম ফিলিস্তিনের জেরুজালেম নামক স্থানে আল আকসা মসজিদ নির্মাণ করেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের নবুওয়ত প্রকাশের একাদশ সনে প্রায় ৬২১ খ্রিস্টাব্দে ২৭ রজব সোমবার শেষ রজনীতে সশরীরে জাগ্রতাবস্থায় মিরাজ তথা ঊর্ধ্বজগতের পরিভ্রমণ হয়েছিল, মসজিদুল আকসা থেকেই। নবীজির আসমানী প্রত্যাদেশ ওহী লাভ ও নবুওয়ত প্রকাশের সময় বাতুল মুকাদ্দসই মুসলমানদের ক্বিবলা ছিল।

মিরাজ গমনের পূণ্যময় রজনীতে মসজিদুল আকসাতে আমাদের নবী মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের ইমামতিতে সকল সম্মানিত নবী রসূল নামায আদায় করার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। নবী রসূলগণের সর্দার হিসেবে এতে আমাদের মহান রাসূল ইমামুল আম্বিয়া ও সৈয়দুল মুরসালিন উপাধিতে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হন, অসংখ্য নবী রাসূলের স্মৃতি বিজড়িত ও বরকতময় পদধূলিতে ধন্য এ বায়তুল মুকাদ্দাস তথা মসজিদুল আকসা।
ইসলামী শিক্ষা আদর্শ সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রচারকেন্দ্র মসজিদুল আকসা, পৃথিবীর মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত রয়েছে। এ পবিত্র ভূমির প্রতি হৃদয়ের গভীর ভালোবাসা ও বিন¤্র শ্রদ্ধা। ইসলামে তিনটি মসজিদের বিশেষ মর্যাদা ও গুরুত্বের কথা বিঘোষিত হয়েছে, হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, মক্কা মুকাররমার মসজিদুল হারামে এক রাকাত নামায আদায়ে রয়েছে, এক লাখ গুণ সওয়াব, মদীনা মনোয়ারার মসজিদে নবভীতে এক রাকাআত নামায আদায়ে পঞ্চাশ হাজার গুণ সওয়াব। বায়তুল মুকাদ্দাস তথা মসজিদুল আকসাতে এক রাকা‘আত নামায আদায়ে পঁচিশ হাজার গুণ সওয়াব।
অথচ মুসলমানদের প্রথম কিবলা মসজিদুল আকসাতে মুসলমানরা আজ নিষিদ্ধ, স্বাধীনভাবে নামায আদায় করে সওয়াব ও বরকত লাভের সুযোগ থেকে তারা আজ বঞ্চিত।
বর্বর জালিম অত্যাচারী ইহুদী কর্তৃক প্রতিনিয়ত নির্যাতিত নিষ্পেষিত, ফিলিস্তিনের পূণ্যভূমি আজ মজলুম অসহায় মুসলমানদের রক্তে রঞ্জিত। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন-وَ مَنْ اَظْلَمُ مِمَّنْ مَّنَعَ مَسٰجِدَ اللّٰهِ اَنْ یُّذْكَرَ فِیْهَا اسْمُهٗ وَسَعٰى فِیْ خَرَابِهَاؕ-
তরজমা: এবং তার চেয়ে অধিকতর যালিম আর কে? যে আল্লাহর মসজিদগুলোতে বাঁধা দেয়, সেগুলোতে আল্লাহর নামের চর্চা হওয়া থেকে। আর সেগুলোর ধ্বংস সাধনে প্রয়াসী হয়। [সূরা বাক্বারা: আয়াত-১১৪]

ইহুদীরা পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণিত জাতি
ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণিত ও কলংকিত জাতি ইহুদীরা বাতুল মুকাদ্দাসকে বিরাণ ভূমিতে পরিণত করেছে, আল কুদুস নগরী ফিলিস্তিনকে মুসলিম শূণ্য করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। ফিলিস্তিনি মুসলমানদের জনজীবন ইতিহাসের এক কঠিন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, সম্মিলিত ইয়াহুদী ও খৃস্টানচক্র আজ ফিলিস্তিনের জনগণকে তাদের আবাসভূমি প্রিয় মাতৃভূমি থেকে উৎখাত করার জন্য মার্কিনীদের মদদপুষ্ঠ পশ্চিমা বিশ্ব ইসরাইলী ইয়াহুদীরা আজ ঐক্যবদ্ধ।

মুসলিম উম্মাহর অনৈক্য দূরাবস্থার অন্যতম কারণ
বিশ্বের মাঝে খোদা প্রদত্ত অপরিসীম প্রাকৃতিক সম্পদের বিপুল সমারোহে মুসলমানরা গর্বিত হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম উম্মাহ্ আজ শতধা বিভক্ত। মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ নানা শ্রেণি, মত এবং অনৈক্য দ্বন্দ্ব সংঘাত ও বিভেদে লিপ্ত। বিশ্বব্যাপী মার্কিনী ও ইহুদী আগ্রাসনের মুখে মুসলমানদের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য সভ্যতা, সংস্কৃতি শিক্ষা আদর্শ ও অস্তিত্ব ক্রমাগতভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে। মুসলমানদের অনৈক্য ও ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের সুযোগে আমেরিকা ও তার তাবেদার ইহুদী খৃস্টানচক্র আজ পৃথিবীর দেশে দেশে অবৈধ কর্তৃত্ব দখলদারিত্ব ও আধিপত্য বিস্তারে তৎপর। পৃথিবীর প্রায় দুইশত কোটি মুসলমানদের পারস্পরিক অনৈক্য বিকৃত মানসিকতা, বিলাসিতার কারণে মুসলমানদের পবিত্র স্থান ফিলিস্তিনের মসজিদুল আকাসা বায়তুল মুকাদ্দাস আজ ইহুদীদের দখলে। আরবদেশ ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক সর্বক্ষেত্রে খৃস্টান ও ইহুদীদের প্রভাব বিস্তৃত। ইসলামী স্থাপনা-ইতিহাস ঐতিহ্য পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করার মহা পরিকল্পনা নিয়ে ইহুদী ও পশ্চিমা বিশ্ব মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ ক্রুসেড শুরু করেছে। কেবলমাত্র ফিলিস্তিন নয় পৃথিবীর প্রতিটি মুসলিম অধ্যূষিত জনপদে প্রতিনিয়ত মুসলমানদের রক্ত ঝরছে। ফিলিস্তিনীদের ঘরবাড়ী ধ্বংশস্তুপে পরিণত করেছে। নিজেদের বসতবাড়ী থেকে তাদেরকে উচ্ছেদ করে ইসরাঈলীরা একে একে সবগুলো এলাকা তাদের দখলে নিয়ে যাচ্ছে অথচ বিশ্ব বিবেক আজ নিরব নির্বিকার। মানবতা আজ ধুকে ধুকে মরছে, ইহুদী পাষন্ডদের বর্বরতা নারকীয় বীভৎসতা ও তান্ডবলীলা শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো নীরবে তাকিয়ে আছে, পশ্চিমা বিশ্ব সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে অথচ মুসলিম রাষ্ট্র প্রধানরা আজ পর্যন্ত কার্যকর শক্তিশালী কোন পদক্ষেপ ও ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসছে না। ফিলিস্তিনের নির্যাতিত নিপীড়িত মুক্তিকামী জনগণের অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা সন্ত্রাসী কার্যক্রম বলে আখ্যা দিচ্ছে।
পক্ষান্তরে ইসরাঈলী বর্বরতা অমানবিক নৃশংসতাকে আত্মরক্ষার অধিকার বলে ইহুদীদেরকে উৎসাহিত করছে।

মুসলিম উম্মাহর ঐক্য আজ সময়ের দাবী
আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন
وَاعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللهِ جَمِيْعًا وَلاَ تَفَرَّقُوْا
তরজমা: তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে মজবুতভাবে ধারণ করো এবং পরস্পর বিভক্ত হয়োনা। [সূরা আল-ই ইমরান : আয়াত-১০৩]
ফিলিস্তিনী মুসলমানদের আন্দোলন জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের আন্দোলন। আল আকসা মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক। মুসলমানদের ঈমানী চেতনার বাতিঘর। মুসলিম উম্মাহকে দ্রুত উপলব্ধি করা দরকার ইসরাইল শুধুমাত্র ফিলিস্তিন ভূখ- নিয়ে সন্তুষ্ট নয় বরং গোটা মধ্য প্রাচ্য জুড়ে ইহুদী রাষ্ট্র গড়ে তোলার মহা পরিকল্পনা নিয়েই ইহুদীদের সন্ত্রাসী তা-ব ক্রমেই দীর্ঘ ও জোরদার হচ্ছে।
মুসলিম উম্মাহর এই ক্রান্তিকালে মুসলিম রাষ্ট্র প্রধান ও জনগণের ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি আজ সময়ের অপরিহার্য দাবী। ইসলাম ও মুসলমানদের চিরশত্রু মানবতার শত্রু অভিশপ্ত ইহুদীদের ঘৃণ্য কর্মকা-ের প্রতি ঐক্যবদ্ধ জনমত সৃষ্টি করা, ইহুদী চক্রান্ত থেকে দেশ জাতির সর্বোচ্চ সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বন ও তাদের সকল প্রকার চক্রান্ত ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মুসলিম উম্মাহকে রুখে দাঁড়াতে হবে। সত্য সমাগত মিথ্যা অপসৃত, মিথ্যা তো অপসৃত হবারই। আল্লাহ্ আমাদের সহায় হোন। আমীন।

লেখক: অধ্যক্ষ-মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া ফাযিল (ডিগ্রি), বন্দর, চট্টগ্রাম।